মাওলা-ই কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু
(তৃতীয় পর্ব)
✒আল্লামাহ্ বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
মাওলা-ই কায়িনাত (রা.) ও কুরআনুল কারীমের সম্পর্ক সম্বন্ধ পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য অবিচ্ছিন্ন। হাদীসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে,
اخرج الطبراني في الاوسط عن امّ سلمة قالت سمعت رسول الله صلي الله عليه وسلم يقول عليّ مع القران والقران مع عليّ لا يفترقان حتى يردا علي الحوض –
আখরাজাত ত্বাবরা-নিয়্যু ফীল আওসাতি আন উম্মি সালামাতা ক্বা-লাত সামি’তু রাসূলাল্লা-হি সাল্লাল্লা-হু আলায়হি ওয়া সাল্লামা য়াকূলু আলিয়্যুম মা‘আল কুরআনি ওয়াল কুরআনু মা‘আ আলিয়্যিন লা-য়াফতারিক্বা-নি হাত্তা য়ারিদা-আলায়্যাল হাওদ্বা।
অর্থাৎ: ‘ত্বাবরানী আওসাতে উম্মে সালামাহ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (দ.)কে বলতে শুনেছি যে, আলী কুরআনের সাথে আর কুরআন আলীর সাথে; এ দু’টি বিচ্ছিন্ন হবেনা, যাবৎনা হাওযে আমার নিকট উপস্থাপন হবে’। [সূত্র: আসসাওয়ায়িকুল মুহরিক্বাহ ১২৩-১২৪ পৃ. উস্তাম্বুল – তুর্কী।]
১ম পর্বে হাদীসে পাকের বর্ণনার ভিত্তিতে আমরা প্রমাণ উপস্থাপন করেছি যে, হযরত আলী (রা.) আহলে বায়তের অন্যতম সদস্য। আহলে বায়ত ও কুরআনের পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিষয়ে ইরশাদ হচ্ছে,
عن زيد بن ارقم رضي الله عنه قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم انّي تاركٌ فيكم ما ان تمسّكتم به لن تضلّوا بعدي احدهما اعظم من الاخر: كتاب الله حبل ممدود من السماء الي الارض وعترتي اهل بيتي ولن يّتفرقا حتّى يردا عليًّ الحوض فانظروا كيف تخلفوني فيهما –
‘আন যায়দিবনি আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লা-হু আনহু ক্বা-লা ক্বা-লা রাসূলুল্লা-হি সাল্লাল্লা-হু আলায়হি ওয়া সাল্লামা ইন্নী তা-রিকুন ফীকুম মা-ইন তামাসসাকতুম বিহী লান তাদ্বিল্লূ বা’দী আহদুহুমা আ’যামু মিনাল আ-খিরি, কিতা-বুল্লা-হি হাবলুম মামদূদুম মিনাস্ সামা-য়ি ইলাল আরদ্বি ওয়া ইতরাতী আহলু বায়তী ওয়া লায়ঁ য়াতাফাররাক্বা- হাত্তা য়ারিদা- আলায়্যাল হাওদ্বা ফানযুরূ কায়ফা তাখলুফূনী ফীহিমা’
অর্থাৎ: ‘যায়দ ইবনে আরক্বাম (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মাঝে (দু’টো জিনিষ) রেখে গমনকারী; তোমরা তা আঁকড়ে ধরে রাখলে আমার পর কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা। এ দু’টির একটি অপরটি অপেক্ষা বড়। আল্লাহর কিতাব নভোমণ্ডল হতে ভূলোকের দিকে ঝুলন্ত রশি এবং আমার নিকটাত্মীয়-আহলে বায়ত। এবং এ দু’টি কখনো বিচ্ছিন্ন হবেনা; এমনকি হাওযে কাওসারে আমার নিকট এসে মিলবে। অতএব, তোমরা লক্ষ্য রেখো, এ দু’টোর সাথে আমার পর কেমন আচরণ করছো।
উক্ত হাদীসটি তিরমিযীর সুনানে, নাসাঈর আস সুনানুল কুবরায়, হাকিমের মুস্তাদরিকে, ত্ববরানীর আল মু’জামুল কবীর, আওসাত ও সাগীরে সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
সম্মানিত পাঠক! অল্প সময়ের জন্য আমরা উক্ত বর্ণনার নিরিখে অন্য একটি বিষয় বুঝার চেষ্টা করবো, ততক্ষণ মন-মগজে আলী (রা.) ও কুরআনে হাকীমের পারস্পরিক অবিচ্ছিন্নতার কথা পূর্ণদমে ধরে রাখুন। এ দৃশ্যপট চিত্রায়ণে হযরত আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) বলেন,
يه هي خاموش قران اور وه قران ناطق هين
‘ইয়ে হ্যায় খা-মূশ কুরআন আওর বহ কুরআনে নাত্বিক হ্যায়ঁ’
অর্থাৎ ‘এটি নীরব কুরআন আর ওটি সবাক কুরআন’।
হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.)’র ঘরের ভোজন সমাবেশের পূর্বেই পবিত্র কুরআনের সূরাহ বাক্বারাহর ২১৯ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। এ আয়াতে মদ সম্পর্কে কি বলা হয়েছে একটু দেখুন। ইরশাদ হচ্ছে,
يسئلونك عن الخمر والميسر قل فيهما اثم كبيروَّمنافع للناس واثمهما اكبر من نفعهما –
য়াসয়ালূনাকা আনিল খামরি ওয়াল মায়সিরি কুল ফীহিমা ইছমুন কবীরুওঁ ওয়া মানা-ফিউ লিন্নাছি ওয়া ইছমুহুমা- আকবারু মিন নাফ‘ইহিমা-’
অর্থাৎ: ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, এতদূভয়ের মধ্যে মহাপাপ ও মানুষের জন্য উপকারিতা রয়েছে। তবে এ দু’টোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়’। সূরাহ বাক্বারাহ ২১৯ নম্বর আয়াত সংক্ষেপিত।
উক্ত আয়াতে মদে মহাপাপ থাকার ঘোষণা স্পষ্টরূপে বিবৃত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.)’র ঘরের ভোজন সভায় কুরআনে মাজীদের এ আয়াত কি মাওলা আলীকে ছেড়ে গিয়েছিল, নাকি মাওলা আলী এ আয়াতকে? যদি কেউ কাউকে ছেড়ে না যান, তবে তিনি মদ খাবেন কী করে? তিনি (রা.) আয়াতের বাহ্যিক মর্মটাও কি উপলব্ধি করতে পারলেন না!!! দূর, এমনটা কি হতে পারে?
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
ان القران انزل علي سبعة احرف ما فيها حرف الاوله ظهر وبطن وانَّ عليًّا عنده من الظاهر والباطن –
‘ইন্নাল কুরআনা উনযিলা আলা সাব‘আতি আহরুফিন মা-ফীহা- হারফুন ইল্লা- ওয়া লাহু যাহরুন ওয়া বাত্বানুন ওয়া ইন্না আলিয়্যান ‘ইন্দাহু মিনায যা-হিরি ওয়াল বা-ত্বিনি’
অর্থাৎ: ‘নিশ্চয় কুরআন সপ্ত বর্ণে বা পাঠরীতিতে অবতীর্ণ হয়েছে। এমন কোন হারফ বা পাঠরীতি নেই, যার গুপ্ত-ব্যক্ত দু’টি দিক নেই। পরন্তু হযরত আলী (রা.)’র নিকট প্রতি পাঠরীতির গুপ্ত-ব্যক্ত উভয়ের অবগতি ছিল।’ [সূত্র: সফীনাহ-ই নূহ প্রথম খণ্ড ৮৪ পৃষ্ঠা। ]
এতেকরে প্রমাণিত যে, মাওলা-ই কায়িনাত কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করতে পারেননি, এমন ধারণাই অলৌক ধারণা বৈ কিছু নয়।
আল্লামাহ আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.)’র ভাষায় বলতে গেলে হযরত আলী (রা.)’র প্রতি মদ পানের সম্পর্ক জুড়ে দেওয়া নীরব কুরআনের সাথে সবাক কুরআনের দ্বন্ধ সম্ভব মর্মীয় আক্বিদাহ-বিশ্বাসকে আবশ্যক করে বৈকি! এমন বিশ্বাসে একজন ব্যক্তির কুরআনে কারীমের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়া ছাড়া অন্য কিছুই অর্জিত আর প্রমাণিত হয়না।
আল্লামাহ আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) বলেন,
نه هون جس دل مين يه اس مين نهين قران كا رشته
‘না হূঁ জিস দিল মেঁ ইয়ে উস মেঁ নেহীঁ কুরআন কা রিশতাহ’
অর্থাৎ ‘যে অন্তরে এটি (সবাক কুরআন আহলে বায়ত) হবেনা, তার সাথে নেই কুরআনের সংযোগ-সম্বন্ধ’।
আরো উল্লেখ্য যে, মাওলা-ই কায়িনাত (রা.) ও কুরআনের বিচ্ছিন্ন না হওয়াটা ইরশাদে মুস্তফা (দ.) মতে সার্বক্ষণিক। অতএব, মদ পানোত্তর নেশাগ্রস্ততার বিবৃতি সঠিক ধরে নিলেও ইমামতিতে সূরাতুল কাফিরূন পাঠে لا (লা) বাদ যাওয়া অকল্পনীয়।
সূরাতুল বাক্বারাহর উদ্ধৃত ২১৯ নম্বর আয়াত সূত্রে মদে اثم كبير ইছমুন কবীরুন বা বড় পাপ এবং উপকার অপেক্ষা বড় পাপ থাকা প্রমাণিত। বড় পাপ ‘রিজস’ বা অপবিত্র-ময়লা-আবর্জনা-পঙ্কিলতা- কলুষতা কিনা? রিজস আর আহলে বায়ত বিশেষতঃ মাওলা-ই কায়িনাত (রা.)’র সহাবস্থান সম্ভব কি না? এ বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা আগামী পর্বে উপস্থাপনের প্রয়াস রাখি; ইনশা-য়াল্লা-হ।
মা‘আসসালাম
-চলমান