✍প্রমিত মুন্তাসির পান্থ
আব্দুস সমাদ বিন হুমাম নামক বাগদাদের এক সর্বজনগ্রাহ্য ধনী লােক ছিল। স্বভাবত ধনীরা ধন-ঐশ্বর্যের দম্ভে কামিলীনদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়। পরন্তু আমাদের গল্পের চরিত্র ধন-দৌলতের গর্বে নয় বরং লােকমুখে প্রচারিত গাউসে পাক (রা.)’র অত্যাশ্চর্য-অদ্ভূত কারামাত বা অলৌকিকতার প্রসিদ্ধি হেতুই তাঁর প্রতি অনাসক্ত-বিরক্ত ছিল।
এসব কারামাত তার বিশ্বাস হতােনা বলেই সে শায়খ (রা.)’র প্রতি বিরাগী ছিল এবং সংস্রব থেকে দূরে থাকত।
পরবর্তীতে দেখা গেল সে শায়খ (রা.)’র পরম অনুরাগীতে পরিণত হয়েছেন। বড় উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে শায়খ (রা.)’র খিদমতে আসা-যাওয়া করছেন। তাঁর এমন পরিবর্তনে লােকেরা অত্যাশ্চর্য হলেন।
হযরত শায়খ আব্দুল কাদির জীলানী (রা.)’র বিসাল শরীফের পর আবূ ইয়াসির আব্দুর রহীম তাঁকে এ বিরাগ ও অনুরাগের রহস্য জিজ্ঞাসা করেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর প্রতি আমার বিরাগ শুধু আমার ভাগ্যবঞ্চনা হেতুই ছিল।
একদিনের ঘটনা, সেদিন ছিল জুমু‘আর দিন। শায়খ (রা.)’র মাদ্রাসার নিকট দিয়েই আমি যাচ্ছিলাম। একদিকে নামাযের সময় সমাগত, অপরদিকে আমার পায়খানা-প্রস্রাবের হাজত ছিল। (তখনকার দিনে-তাে মসজিদ সংলগ্ন শৌচাগার ছিলনা যে, হাজত সেরেই মসজিদে ঢুকবেন।) আমি তাড়াতাড়ি নামায সমাপনান্তে হাজত সারবাে মনে করে মসজিদে গেলাম। মিম্বরের নিকট খালি যায়গা দেখে ওখানে বসে পড়লাম। আমার জানা ছিলনা যে, নামায তিনি (রা.) পড়াবেন বিধায় বহু লােক সমাগম হবে। আমি আপন যায়গায় বসে রইলাম আর বহু লােক এসে গেল। আমার হাজাতের বেগ বৃদ্ধি পেলে আমি ওঠতে মনস্থ করি কিন্তু বিপুল লােকের আগমন হেতু ওঠতে পারিনা। একপর্যায়ে আমি তীব্র বেগ ধরে রাখতে পারছিলামনা, অমনি তিনি (রা.) এসে মিম্বরে ওঠলেন। এমতাবস্থায় আমার অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ আরো বেড়ে গেল।
আমি বড়ই চিন্তিত হলাম যে, আমার অবস্থা কী হবে? আমি কি করবাে? একদিকে পায়খানা-প্রস্রাবের তীব্র বেগে পেটের যন্ত্রণা, অপরদিকে শায়খ (রা.)’র প্রতি মনের প্রচন্ড ক্ষোভ, সর্বোপরি এসব বেরিয়ে গেলে কিংবা নির্গমনের প্রাক্কালে লােকেরা দুর্গন্ধ টের পেলে আমার লজ্জা-অপমানের অন্ত রইবেনা।
আমি দুঃখ-ক্ষোভ, লজ্জা-অপমানে মরতে বসছিলাম আর প্রস্রাব-পায়খানা বেরুতে যাচ্ছিল, অমনি শায়খ (রা.) মিম্বর থেকে কয়েক ধাপ নেমে আপন আস্তিন মােবারক আমার মাথার ওপর রাখলেন। আমার মনে হলাে আমি একটি বাগানে, যেখানে জলপ্রপাত রয়েছে। আমি শৌচকার্য সেরে ওযু করে দুরকাআত নামায পড়লাম। অতঃপর শায়খ (রা.) আপন আস্তিন ওঠিয়ে নিলে আমি নিজেকে মিম্বরের পাশে আপন যায়গায় বসা পেলাম; এতে আমি অত্যাশ্চর্য হলাম। আমার হাত-পা ও ওযুর স্থানসমূহের আর্দ্রতার চিহ্ন কাপড়ে দেখতে পেয়ে আমার আশ্চর্যান্বিতা আরাে বৃদ্ধি পেল।
নামায শেষে প্রত্যাবর্তনকালে আমার হাত-রুমাল, যাতে আমার চাবিসমূহ বাধা ছিল, পাচ্ছিলামনা। আমি যেখানে বসে ছিলাম সেখানে অনেক খুঁজেও পেলামনা। অবশেষে ঘরে ফিরে তালার কারিকর দ্বারা সিন্দুক খুলিয়ে নিলাম।
ওই সময় নিজের কোন এক কাজে আমি ইরাক যাওয়ার মনস্তু করলাম। অতএব ওইদিন সকালে যাত্রাও দিলাম। দ্বিতীয় মনযিল অতিক্রম করে তৃতীয় মনযিলের পথে এক যায়গায় দেখলাম, বাগানও আছে, জলপ্রপাতও রয়েছে। আমার সঙ্গী-সাথীরা বলল, সামনে পানি পাবাে মনে হয়না, সুতরাং এখানে অবতরণ করে নামায ও পানাহার সেরে নিই। আমি নেমে দেখলাম যে, ঠিক ওই যায়গাই, যা এ জুমু’আর দিনে দেখেছি। আমি ওযু সেরে নামায আদায়ের জন্য আগ বাড়াতেই দেখলাম চাবিসমেত আমার হাত-রুমাল পড়ে আছে। এতে আমার আশ্চর্যের সীমা রইলনা।
শায়খ (রা.)’র সংশ্রব লাভের প্রবল অনুরাগ নিয়ে শেষতক আমি সফর সম্পন্ন করি। ফেরার সময় আমার মূল উদ্দেশ্য এটিই ছিল যে, বাগদাদ পৌঁছা মাত্রই তাঁর খিদমত গ্রহণ করবাে।
আমি এ ঘটনা কারাে কাছে বর্ণনা করিনি যে, শ্রোতার তাতে সন্দেহ হবে এবং আমাকে মিথ্যুক মনে করবে। জিজ্ঞাসাকারী বললেন, আপনি যা দেখেছেন, সকলকে তা বলবেন, শায়খ (রা.)’র অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ কারাে হতেই পারেনা। তিনি বললেন, এখন আমার এর অধিক বর্ণনার আর প্রয়ােজনই নেই, যেহেতু অনেক নির্ভরযােগ্য বর্ণনাকারী এ ধরণের বহু ঘটনাবলী বর্ণনা করেছেন।
জিজ্ঞাসাকারী বললেন, আল্লাহ আপনাকে বড় দয়ানুগ্রহ করেছেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর পরম কৃতজ্ঞতা যে, তিনি আমাকে এই অবস্থায় (অর্থাৎ শায়খ (রা.)’র প্রতি বিরাগ) মৃত্যু দেননি।
আল্লাহ সকলকে কামিলীনদের মর্যাদা বুঝার তৌফিক দিন, আমীন।
(ক্বলায়িদুল জাওয়াহির অবলম্বনে)