মুরশিদে করীমের তাকরীর

চলিত ভাষায় রূপান্তরঃ মঈনুদ্দীন মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ

 নুরে মুহাম্মাদী (صلى الله عليه وسلم)

খুৎবা, দুরূদ-সালাম ও সম্ভাষণোত্তর ইরশাদ করলেন, ‘মারহাবা আয় ক্বাসিদে ত্বয়্যারি মা, মীদেহী হার দম খবর আয্ ইয়ারি মা’। (মারহাবা! হে আমার বার্তাবাহক পাখি (রূহ)! দাও সর্বদা আমার প্রেমাস্পদের (আল্লাহর) সংবাদ।)আমি দীর্ঘ আলোচনা করবোনা। আমি একটি আয়াত তিলাওয়াত করেছি। ‘ওয়ামা খালাক্বতুল জ্বিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিইয়া’বুদূন’। আল্লাহ রাব্বুল ইয্যত ইরশাদ করছেন ‘আমি জ্বিন ও ইনসান জাতিকে বানাতামনা, বানিয়েছি কেবল মাত্র আমার ইবাদত করার জন্য- আমাকে চেনার জন্য’। (সূরা যা-রিয়াত ৫৬ নং আয়াত) আবার ‘লাক্বাদ কাররামনা বনী আদমা’ অবশ্য আমি আদমের ফরযন্দকে সম্মান-মর্যাদা দান করেছি বলে ইনসান জাতিকে আলাদা করে দিয়েছেন। তাহলে বুঝা যায় মানব-শ্রেষ্ঠত্বের কারণ ইবাদত নয়। অতএব মানব শ্রেষ্ঠত্বের হেতু ও আল্লাহকে চিনতে গেলে কিছু কথা আমাদের বুঝতে হবে, না বুঝলে আমরা আল্লাহ চিনব কেমনে, আল্লাহ চেনার পন্থা ধরব কিভাবে?আল্লাহ তা’আলা হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ ফরমান, ‘কুনতু কনযান মখফিয়ান’। হাদীসে কুদসী হল আল্লহর কালাম, রাসূল (দ.)’র জবানে পাকে। এটা বুঝতে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। কারণ আল্লাহর কথা রাসূলে পাকের জবানে বের হল কিভাবে। আমি বুঝালেও এগুলি আপনারা বুঝবেন না। কাজেই এটুকু বুঝুন যে, কুরআন হচ্ছে যেটা ‘বিওয়াসিতায়ে জিব্রাঈল’ জিব্রাঈল (আ.)’র মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ (দ.)‘র ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। হাদীসে কুদসীতে জিব্রাঈল, মিকাঈল, ইস্রাফীল কেউ নেই। এটা ‘বিলাওয়াসিতাহ’ সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর হাবীবের মধ্যকার কথোপকথন। সরকারে দু’আলম (দ.)’র নিজস্ব বাণী হল হাদীস।উক্ত হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘কুনতু কনযান মখফিয়ান ফাআহবাবতু আন উযহিরা আও উ’রিফা বিযাতি ওয়া সিফাতি ফাখালাকতুল খলকা’ আমি (আল্লাহ) পুশিদা (গুপ্ত) খনি ছিলাম, যখন যাত (সত্তা) ও সিফাত (গুণাবলী) সহ প্রকাশ অথবা পরিচয় হতে ভালবাসলাম; তখন সৃজন করলাম, এক বিশেষ সৃষ্টি।
আল্ কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘ইন্নামা-আমরুহূ-ইযা-আরাদা শাইয়ান আঁয়য়াক্বূলা লাহূ কুন ফায়াকুনা’ আল্লাহর শানতো এ যে, তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন সেটা লক্ষ্যে বলেন হও, অতএব তখনি তা হয়ে যায়। (সূরা ইয়াসীন ৮২ নং আয়াত)যখন আল্লাহ আল্লাহই ছিলেন, তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা, তখন আত্মপ্রকাশের প্রেম জেগে ওঠল। ওই প্রেমের হিল্লোলে তরঙ্গিত সাগরের প্রেমের মৌজে প্রেমের উচ্ছ্বাসে আপন জ্যোতি লক্ষ্যে বল্লেন ‘কুন মুহাম্মদা’ মুহাম্মদ বা পরম প্রশংসিত সত্তা হও। হাদীসের বর্ণনায় রয়েছে, ইয়া জাবির! ইন্নাল্লাহা তা‘আলা ক্বাদ খালক্বা ক্বাবলাল আশিয়ায়ি নূরা নবীয়্যিকা মিন নূরিহী’ হে জাবির! নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সকল সৃষ্টির পূর্বে তোমার নবীর নূর তাঁর (আল্লাহর) নূর হতে সৃজন করেছেন’। (কুস্তলানীর আল্ মাওয়াহিবুল লাদুনীয়া ১ম খ- ৫১ পৃষ্ঠা; হালবীর আস্সীরাতুল হালবীয়্যা ১ম খ- ৫০ পৃষ্ঠা) আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘ক্বাদ জা-আকুম মিনাল্লাহি নূরুওঁ ওয়া কিতাবুম মুবীন’ নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে নূর আর্থাৎ মুহাম্মদ মুস্তফা (দ.) ও সুস্পষ্ট কিতাব বা কুরআন মজীদ এসেছে। (সূরা আলমায়িদাহ ১৫ নং আয়াত)অতঃপর হাদীসে জাবির আলোক সকল সৃষ্টি নবী (দ.)’র নূরের কিরণ হতে হওয়ার আলোচনা করে মুস্তফা (দ.)’র আবুল আরওয়াহ বা রূহসমূহের পিতা হওয়া, আদম (আ.)’র আবুল বশর বা মানবজাতির পিতা হওয়া, নবী (দ.) আদমযাদা আবার আদমের মূল হওয়া, দুয়ের তফাৎ, আয়াতে মীসাকের আলোকে নবীগণের অঙ্গিকার, মুস্তফা (দ.)’র ওপর ঈমান আনয়ন ও সকল নবীর কলিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ হওয়া এবং নবীগণ কর্তৃক রাসূলে পাকের আগমন সুসংবাদ দেওয়া ও সকল আসমানী কিতাবে নবীর প্রশংসা উচ্চারিত হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।সাজরাতুল ইয়াকীনে ময়ুর রূপে অবস্থানের সময় আল্লাহ নূরে মুহাম্মদীর প্রতি তাওয়াজ্জুহ করলে মুহাম্মদ (দ.) আত্মরূপ দর্শনে পরিতুষ্ট হয়ে আল্লাহর শোকরিয়ার্থে পাঁচটি সিজদা দেন। ওই পাঁচ সজিদার ভিত্তিতে উম্মতে মুস্তফার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয়। নামাযে আহমদ শব্দের শেকল বা আকৃতি পরিস্ফুটিত। দাঁড়ানো অবস্থা ‘আলিফ’ রুকূ ‘হা’ সিজদা ‘মীম’ এবং বৈঠক ‘দাল’ অক্ষরের ন্যায়; শেকলে আহমদের ওপর নামাযের সংঘটন। শেকলে মুহাম্মদীর ওপর ইনসান বা মানুষের সৃজন। মাথা ‘মীম’ কাঁধ ও দুই হাত ‘হা’ কোমর ‘মীম’ পা ‘দাল’। হাদীস শরীফের বর্ণনা, ‘খালাক্বাল্লাহু আদমা আলা সূরতিহী’ আল্লাহ মানুষকে তাঁরই আকৃতিতে সৃজন করেছেন; ওই দিকে ইঙ্গিত করে। আল্লাহর তজল্লী হল মুহাম্মদ (দ.) আর মুহাম্মদ নামের সুরতে মানুষ তথা বান্দা সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এ সুরতে আল্লাহ কাউকে জাহান্নামে দিবেননা। জাহান্নামের আগুন মুস্তফা (দ.)’র সুরতকে বরদাশত করতে পারবেনা। আল্লাহ তাঁর হাবীবের সম্মানার্থে ওই আকৃতিতে কোন বেদ্বীন, কাফির, ইহুদী ও খৃষ্টান কাউকে নরকে দিবেননা। প্রশ্ন জাগে কোন সুরতে দেবেন? পার্থিব জীবনের আমল অনুযায়ী শূকর-কুকুর-বিড়াল ইত্যাদির আকৃতিতে জাহান্নামে দেবে। আজ যারা শেকলে মুহাম্মদের মর্যাদা নিয়ে মুস্তফা (দ.)’র ইত্তিবা-অনুসরণ করছে, তাওয়াল্লুদ শরীফ বয়ান করছে, সিদ্কে নিয়্যতের সাথে জাঁকজমক অনুষ্ঠান করছে, আল্লাহ তাদেরকে কি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন? কখনো না। যদি তাদের কেউ জাহান্নামে পড়ে যায়, তবে জাহান্নামের আগুন নিভে যাবে।পিয়ারে মুসলমানো! আপনারা আলেমদের মুখে শুনেছেন, নবী (দ.)’র ছায়া ছিলনা। কেন ছিলনা? যত নবী-রাসূল ছিলেন, সকলের ছায়া ছিল, নবী (দ.)’র ছায়া ছিলনা কেন? কারণ রাসূলুল্লাহ (দ.) আল্লাহর ছায়া, আল্লাহর জলওয়া, আল্লাহর নূর। ছায়ার ছায়া থাকেনা। এখন আল্লাহ কি তা রাসূল জানে আর রাসূল কি তা আল্লাহ জানে; আমি ওই দিকে যাচ্ছিনা। আমি মুস্তফা (দ.)’র কি তা’রীফ কি প্রশংসা করবো? আমার ওই শক্তি কোথায়? লা ইউমকিনুুস্ সানাউ কামা কানা হক্কাহু, বা’দে আয্ খোদা বুযুর্গ তুঈ কিস্সা মুখতাসর’। মুস্তফা (দ.)’র প্রশংসার মত প্রশংসা করা কোন মানবের পক্ষে সম্ভব নয়-মুমকিন নয়; আল্লাহ রব্বুল ইয্যতের পর তিনি মহান-বুযুর্গ, এখানেই কিচ্ছা শেষ। সমস্ত সাগরের পানি যদি কালি হয়, গাছ-বাঁশ যদি কলম হয়, মানব জাতির প্রতিজন যদি লিখক হয়, সবাই মিলে লিখে শানে মুস্তফা শেষ করতে পারবেনা।লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ কলিমা পড়ে, কুরআন, হাদীস, ইজমা পড়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূল মরে মাঠির সাথে মিশে গিয়েছে, নবী (দ.) নাকি গায়েব জানেন না, নবী (দ.) বড় ভাইয়ের মত; নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।বড় ভাই সবার আছে আবার তাদের ছায়াও আছে। রাসূল ভাই হলে ছায়া ছিলনা কেন? নবী (দ.)’র সাথে আমাদের আরো বহু তফাৎ আছে; এ সামান্য টুকু বুঝলেও নবীকে ভাই বলতে পারতনা। রাসূল মরিল কেমনে? রাসূল গেল কিভাবে, রইল কিভাবে; আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। পূর্বোক্ত হাদীসে জাবির মর্মে সকল নবী-রাসূল যদি রাসূল (দ.)’র নূর হতে সৃজিত হয়, তবে সকল নবীর মাঝে রাসূল (দ.) গিয়েছেন, মুস্তফা (দ.)’র নূরের তজল্লিয়াত গিয়েছে। আর্শ, কুরসি, লওহ, কলম, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ-তারা এককথায় সবকিছু যদি মুস্তফা (দ.)’র নূরের তজল্লিয়াত হতে সৃষ্টি করা হয়, তবে সমগ্র জগতে খোদার খোদায়ী জুড়ে রাসূল কি নেই? অবশ্য আছেন। চোখে দেখতে পাচ্ছনা। কেননা ওই চোখ ফুটেনি ওই চোখ খুললে তবে সব দৃষ্টির সামনে দেখতে পেতে।রাসূল মারা গেল কোথায়? রাসূল ছিলেন, আছে এবং থাকবে। ক্বিয়ামত-ইস্রাফীলের সিঙ্গায় মুস্তফা (দ.)’র ক্ষয় হবেনা। কারণ সূর্য থাকলে তার কিরণ যেমন থাকে, আল্লাহ থাকলে তাঁর তজল্লীও থাকবে। রাসূল (দ.)’র বিনাশ হয়েছে বল্লে আল্লাহ বাকী থাকে কি? মাওলানা সাহেবরা! প্যাঁচ লাগছে? (উপস্থিত আলেমদের কেউ একজন বলে ওঠলেন, ‘কুল্লু মান আলায়হা ফান, ওয়া ইয়াব্কা ওয়াজহু রাব্বিকা যূল্ জালালি ওয়াল ইক্রাম’ অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে যা আছে, সবকিছুই নশ্বর। এবং চিরস্থায়ী হচ্ছে, আপনার প্রভুর চেহরা, যিনি মহান মর্যাদা ও মহিমার অধিকারী।) (সূরা র্আরাহমান ২৬-২৭ নং আয়াত) মাওলানা সাহেব! আপনি আমার আলোচনার গতি-প্রকৃতি বুঝেননি। আপনি জমিনের ওপরের বিষয় নিয়ে আছেন, আর আমি আলমে আরওয়াহ ও তার উর্ধ্বের লা মক্বানের আলোচনা করছি। নূরে মুহাম্মদী ও হাক্বীক্বতে মুহাম্মদীর কথা বলছি, যা পূর্বোক্ত হাদীসে কুদসী ও কুরআনের আয়াত মর্মে আল্লাহর তজল্লী, মুহাব্বত, ইরাদাহ, আমর; এটার ফানা নেই, ধ্বংস নেই। ওটার জন্য ধ্বংস স্থির করা হলে, আল্লাহর জন্যও বিনাশ মানা আবশ্যক হবে; যেহেতু হাক্বীক্বতে মুহাম্মদী আল্লাহর তজল্লী; আল্লাহ থাকবেনতো তজল্লীও থাকবে। মানুষের রূহ আমরে রব, তারও ধ্বংস নেই, কুরআনে মাজীদ ফুরকানে হামীদেরও ধ্বংস নেই। আমরা-আপনারা যা পড়ছি, তা আকসে কুরআন বা কুরআনের প্রতিফলিত রূপ। হাক্বীক্বতে কুরআন মাখলুক নয়, ওটার ধ্বংস নেই।

অতঃপর আহমদ ইবনে হাম্বল (রা.)’র ঘটনার বর্ণনা উপস্থাপন করলেন এবং তাঁর বীরত্বের প্রশংসা করলেন। সত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাণ বিসর্জনের তথা আত্মোৎসর্গের প্রয়োজনীয়তার প্রতি ইঙ্গিত দিলেন।
পিয়ারে মুসলমানো! আমার আলোচনা ওই দিকে নয়, আমি এ কথা বলতে চেয়েছিলাম, আল্লাহ আমাদের বানিয়েছে, তাঁকে চেনার জন্য-পাওয়ার জন্য। আল্লাহকে কীরূপে চেনা যাবে? হাদীসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, ‘মান আরাফা নফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রব্বাহু’ যে নিজেকে চিনেছে, সে তাঁর রবকে চিনেছে। আত্মপরিচয় লাভ হলে খোদার পরিচয় লাভ হবে। খোদাকে পাওয়ার আলোচনা পরে আসছে।

আল্লাহ আমাদেরকে ইসমে মুহাম্মদরে আকৃতিতে গঠন করে জন্নাত হতে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘লাক্বাদ খালাকনাল ইনসানা ফী-আহসানি তাক্বভীম, ছুম্মা রাদাদনাহু আসফালা সাফিলীন অর্থাৎ আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতিতে সৃজন করেছি। অতঃপর সর্বনিম্নস্তরে অবনমিত করে দিয়েছি’।(সূরা ত্বীন ৪-৫ নং আয়াত) এ জগতে প্রেরণের পূর্বে এখানে-ওখানে ও বেহেশতে রেখেছেন। এগুলো আল্লাহর হিকমত-কুদরত-বাহানা; আমরা বুঝবনা। রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, হযরত আদম ও মূসা আলায়হিমাস্সালাম বিতর্কে লিপ্ত হলেন। অতএব মূসা (আ.) আদম (্আ.) কে বললেন, আপনি ওই আদম, যাকে আপনার ভুল জান্নাত হতে বের করে দিয়েছে! আদম (আ.) তাঁকে বল্লেন, আপনি ওই মূসা, যাকে আল্লাহ আপন রিসালত ও কালাম দ্বারা মনোনীত করেছেন; অতঃপর আপনি আমাকে এমন বিষয়ে ভর্ৎসনা করছেন, যা আমার সৃষ্টির পূর্বে নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। এ ঘটনার বর্ণনাত্তোর রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেন, আদম (আ.) বিতর্কে মূসার ওপর দু’বার বিজয়ী হন। (বুখারী শরীফ, ১ম খ- ৪৮৪ পৃষ্ঠা)

মুর্দা দিল জিন্দা করার উপায়

পিয়ারে মুসলমানো! ‘আদ্দুনিয়াউ মায্রা‘আতুল আখিরাতি’ দুনিয়া আখিরাতের কৃষিক্ষেত-খামার। এ জমিনে এসেছি বা আমাদের পাঠিয়েছে চাষাবাদ-ব্যবসা-বাণিজ্য-তিজারত করার জন্য। কোন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে? ব্যবসা লাভজনক হতে হবে। আমরা এখানে প্রবাসী, এখানে আমাদের ঘর-বাড়ি নয়। আমরা আর্শের পাক পাখি ছিলাম।

‘আর্শের পাক পাখি ছিলি ভবে আসি পেঁচা হলি
নিজ মান হারাইলি করি ধূলে গড়াগড়ি।
পাকা ছাড় ধূলা ঝাড় পরিষ্কার হও একবার
আর্শের কাঙ্গুরা পরে চল এবে মাটি ছাড়ি’।
আমাদের দেশের মানুষ টাকা-পয়সা রোজগারের মাধ্যমে নিজের অভাব মোচনের জন্য দুবাই, আবুধাবী, মস্কট, সৌদিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে যায় এবং আয়-রোজগার করে মানিঅর্ডার, ড্রাফট, হু-ি, ছালানি নানাভাবে স্বদেশে পাঠায়। ওই টাকায় গাড়ি-বাড়ি করে, জায়গা-জমি কিনে; অতঃপর স্বদেশে ফিরে আরাম-আয়েশে জীবন কাটায়। যারা টাকা পৌঁছাতে পারেনা, ইনকাম করতে পারেনা, তারা প্রবাসেও সুখ-শান্তিতে থাকতে পারেনা, স্বদেশে এসেও সুখ পায়না।
আমাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য-ক্ষেতকৃষি করার জন্য পাঠিয়েছে, যে দেশ হতে বিচ্ছেদ হয়ে এ দেশে এসেছি, সেখানে মানিঅর্ডার পাঠানোর জন্য, স্বদেশে সুখ-শান্তির আয়োজন করার জন্য, ফুল শয্যায় মারহাবা ধ্বনিতে বরিত হওয়ার জন্য।
পরকালে ক্ষেতকৃষি-ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য ওই কৃষিক্ষেত্র-ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র চিনতে হবে। ওই কৃষিক্ষেত্র-ব্যবসাকেন্দ্র হল আমাদের এ দেহ। ওই শষ্যের বীজ, ব্যবসার মুলধন তৌহীদÑলা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ; যা মুস্তাফা (দ.)’র নূরের তজল্লিয়াত হতে আল্লাহ মু’মিন বান্দার ক্বলবে বপন-স্থাপন করেছেন। মানুষের শরীরে ছয়টি লতীফ, যথা- নফস, ক্বলব, রূহ, সির, খফী ও আখফা রয়েছে। ক্বলবে বপিত বীজ যথার্থ পরিচর্যার মাধ্যমে অঙ্কুরিত করে শিকড় নফস পর্যন্ত প্রলম্বিত এবং শাখা-প্রশাখা রূহ, সির, খফী ও আখফা পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে। কুরআনে পাকে ইরশাদ হচ্ছে,‘আলাম তারা কায়ফা দ্বারাবাল্লাহু মাছালান কালিমাতান ত্বায়্যিবাতান কাশাজারাতিন ত্বায়্যিবাতিন আছলুহা ছাবিতুঁও ওয়া ফার‘উহা ফীস্সামা-য়ি; তূ’তী-উকুলাহা কুল্লা হী-নিম্ বিইয্নি রাব্বিহা ওয়া ইয়াদ্বরিবুল্লাহুল আমছালা লিন্নাসি লা‘আল্লাহুম ইয়াতাযাক্কারূন’। অর্থাৎ ‘তুমি কি লক্ষ্য করনি, দেখনি আল্লাহ কিভাবে উপমা দিলেন কলিমায়ে তায়্যবাহ তথা কলিমা-ই তৌহীদের? যেমন-পবিত্র এক মহান বৃক্ষ, যার মূল (মু’মিনের অন্তরে) সুদৃঢ় এবং শাখা-প্রশাখা আসমানে সুবিস্তৃত। তা সর্বদা ফল দান করে আপন প্রভুর মর্জিমত; আর আল্লাহ মানব জাতির জন্য উপমাসমূহ পেশ করেন, যাতে তারা অনুধাবন-উপলব্ধি করে’। (সূরা ইব্রাহীম ২৪-২৫ নং আয়াত)

উক্ত কলিমা পড়েছেন কি? না, মোটেও না। আমরা সে তালে নেই। আমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ পড়লে হয়তো পড়েছে। আমরা ওই কলিমায় নেই, আমরা গোশত খাওয়া, টুপী দিয়ে কতক্ষণ মুসলমান হওয়ার মধ্যে আছি। বাপ-দাদার দেখাদেখি মুসলমান। এটাকে ঈমানে তাক্বলীদি বা প্রথাগত-গতানুগতিক বিশ্বাস বলা হয়। আমাদের বাপ যেদিকে গিয়েছে আমরাও যাচ্ছি। মুসলমানী আর ঈমান কি বুঝতে চেষ্টা করছিনা।

পিয়ারে মুসলমানো! যদি অনাবৃষ্টিতে দেশ বিরান ভূমিতে রূপান্তরিত হয়, গাছপালা-বৃক্ষলতা মরে শুকিয়ে যায়, গরু-ছাগল খাদ্য না পায়, ফসল বিনষ্ঠ হয়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, প্রখর রোদে যদি দেশ পুড়ে যায়, তখন আল্লাহর বান্দাগণ আল্লাহর দরবারে সকাতরে ফরিয়াদ জানায়, কান্নাকাটি করে, রোদন করে; এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা সদয় হন, রহম-করমের দৃষ্টি করেন এবং বৃষ্টি দিয়ে জমিনকে জীবন্ত ও উর্বর করে দেয়। ইরশাদ হচ্ছে, “ই’লামূ-আন্নাল্লাহ ইউহ্য়িল আরদ্বা বা’দা মওতিহা” অর্থাৎ জেনে রাখ, আল্লাহ জমিনকে সেটার মৃত্যুর পর জীবন্ত করেন। (সূরা হাদীদ ১৭ নং আয়াত)

পিয়ারে মুসলমানো! আমাদের সাড়ে তিন হাতের জমিন, যাতে আল্লাহ আহকামুল হাকিমীন পাক পরওয়ার দিগার, আঠার হাজার আলমের স্রষ্টা, নূরে যাতে আহদিয়াত মুস্তফা (দ.)’র তজল্লিয়াত হতে তৌহীদের বীজ বপন করে এ জগতে ক্ষেতকৃষি-ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পাঠিয়েছেন, আমাদের ওই জমিতো প্রখর রোদে শুকিয়ে গিয়েছে, ওই বীজতো নষ্ঠ হয়ে গিয়েছে, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফা আসবে কোত্থেকে।

‘যমীনে শোর সুম্বুল বরনাহ আওয়ারদ, দর ইঁ সুকম মগীরদাহ আমলরা’ অর্থাৎ লোনাভূমি সুগন্ধি ঘাস উৎপাদন করেনা, ওই লোকসানে নিজের কর্ম বিনষ্ঠ করোনা। আমাদের জমিতো লবণে বরবাদ হয়ে গিয়েছে, ওই জমি আবু জাহেলী, আবু লাহাবী, মরদুদী, মুরতাদী, কবিরাহ, সগীরাহ, র্শিক, যুলুমাত-এ গ্রাস করে নিয়েছে। জমি অনাবাদী, পরিত্যক্ত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। তৌহীদের বীজ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ তথা নূরে পাকে মুস্তফা (দ.)’র তজল্লীয়তের যে নূর আল্লাহ আমার-আপনার ক্বলবে আমানত রেখেছেন, আমরা সে আমানত-তো ধ্বংস করে দিয়েছি। ওই পরিত্যক্ত জমিতে আমল তথা নামায, রোযার সেচ দিয়ে কি লাভ-মুনাফা-তিজারত হবে? আমানতের এ মস্তবড় খিয়ানত করে কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহ পাকের দরবারে কি উত্তর দিব? চেহরা মুস্তফা (দ.) কে কিভাবে দেখাব?
আয় পিয়ারে মুসলমানো! আমাদের জমিন আজ বরবাদ হয়ে গিয়েছে, ফসল দিচ্ছেনা; অথচ আমাদের উহ, আহা আর কান্না নেই। সাধারণ জমির ফসল পোকা-মাকড় নষ্ট করলে, পেটের খানা না জুটলে, পেট আল্জুউ-আল্জুউ ক্ষুধা-ক্ষুধা রব করে আর তাতে আমরা হাজার হাজার মানুষ কাঁদতে শুরু করি। কিন্তু আল্লাহর যে আমানত আমদের ক্বলবে গচ্ছিত ছিল, সে আমানত বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে, রূহ রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা ক্ষুধা-ক্ষুধা শোর করছে; আমাদের কর্ণে কিন্তু সে শব্দ যাচ্ছেনা, আমরা বধির হয়ে গিয়েছি।

পিয়ারে মু’মিনো-মুসলমানো! আল্লাহর দরবারে আমাদের কাঁদতে হবে। আমাদের মুর্দা দিল জিন্দা করে দেওয়ার জন্য সক্রন্দন-সকাতর ফরিয়াদ-প্রার্থনা করতে হবে।
এখন কথা হল, মুর্দা দিলকে, মুর্দা জমিনকে কোন পানি দিয়ে সতেজ-সজীব করবো? বৃষ্টির পানি, ঝরণার পানি, সাগরের পানি, কূপের পানি দিলে হবে? আটলান্টিক মহাসাগরের পানি, সাত সমুদ্রের পানি দিলে কি হবে? ওয়াহদানিয়তের-তৌহীদের-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ পবিত্র কলিমার পানি দিতে হবে। ওটা কোন পানি তা কি বলতে পারেন? ওটা কনতু কনযান মখফিয়ান ফাআহব্বতু তথা আল্লাহর মুহব্বতের জলওয়া যে ইশক আর মুহব্বত; ইশকে মুহাম্মদ-ইশকে মুস্তফা-ইশকে হাবীবে খোদার সেচ দ্বারা মুর্দা দিলকে জিন্দা ও তদস্থ বীজ অঙ্কুরিত-প্রস্ফুটিত করতে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ দমে-দমে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর লাঙল, কোদাল দিয়ে ক্বলবে জমিন আবাদ করে প্রেম-ভালবাসার সেচ দিলে মুর্দা জমিন-মুর্দা দিল জিন্দা হয়ে যাবে। তখন তুমি আল্লাহর সত্তা, সকল সৃষ্টি, সপ্ত আসমান, সপ্ত জমিন নজরের সামনে দেখবে।
আমি সংক্ষিপ্ত ভাবে ব্যবসার কেন্দ্র, মূলধন, নিয়মাবলী বলে গেলাম, এ ভাবে তিজারত-ব্যবসা করলে লাভ-মুনাফা অর্জিত হবে।

আল্লাহ নূরে মুস্তফা (দ.)’র যে জ্যোতি দ্বারা ক্বলবে তৌহীদের আমানত রোপণ করেছেন, ওই নূরের জ্যোতিতে চোখের আলোও দিয়েছেন, যা দ্বারা আমরা দেখছি অনুরূপ দু’টি চোখ ক্বলবেরও আছে দেখেছেন কোন দিন? হারাম না, এগুলো দেখার মধ্যে আমরা নেই। হালাল-হারামের তারতম্যতে নেই, এমনি নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত যে যতটুকু পারছি, করছি। কিন্তু হৃদয়ের চক্ষু ফুটাইনি।

পিয়ারে মুসলমানো! আজ যদি আমাদের ওই আমানতের ক্বলব জিন্দা করতে পারি, অন্তরের সে চোখ ফুটাইতে পারি, তবে মুস্তফা (দ.) নয়, নবী-রাসূল নয়, ওলীয়ে কামিল পর্যন্ত যে মরেনা তা হৃদয়ের নযরে দেখতে পাবো। আল্লাহর কুরআন স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, ওয়া লা-তাকূলূ লিমায়ঁয়ুক্বতালু ফী সবীলিল্লাহি আমওয়াতুন; বল আহয়া-উওঁ ওয়ালাকিঁল লা তাশ‘উরূন’। অর্থাৎ ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদ করে) খুন-ক্বতল (শহীদ) হয়েছে, তাঁদের মৃত বলোনা। বরং তাঁরা জীবিত; অধিকন্তু তেমাদের খবর-অনুভূতি-উপলব্ধি-বোধ নেই’। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৪ নং আয়াত) আরো ইরশাদ হচ্ছে, ‘ওয়া লাতাহ্সাবান্নাল্লাযীনা কুতিলূ ফী সবীলিল্লাহি আমওয়াতান বাল আহয়া-উন ‘ইন্দা রাব্বিহিম য়ুরযাকূন; ফারিহীনা বিমা-আতাহুমুল্লাহু মিন ফদ্বলিহী, ওয়া য়াস্তাব্শিরূনা বিল্লাযীনা লাম য়ালহাক্বূ বিহিম মিন্ খালফিহিম, আল্লা খাওফুন আলায়হিম ওয়া লাহুম য়াহযানূন’। অর্থাৎ ‘যারা আল্লাহর পথে (ধর্মযুদ্ধে) নিহত (শহীদ) হয়েছেন, কখনো তাদের মৃত ধারণা করোনা; বরং তারা আপন প্রতিপালকের কাছে জীবিত, জীবিকা পান। আল্লাহ আপন অনুগ্রহে তাঁদের যা দান করেছেন, তাতে তাঁরা উৎফুল্ল-আনন্দিত; এবং আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করছেন, তাঁদের পরবর্তীদের জন্য যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। এ কারণে যে, তাঁদের না কোন আশঙ্কা আছে এবং না কোন দুঃখ-বিষণœতা। (সূরা আল্-ই-ইমরান ১৬৯-১৭০ নং আয়াত)

ধর্ম যুদ্ধে ইসলামের শত্রুর সাথে লড়ে যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা জিন্দা। অনুরূপ যারা আল্লাহর পথে গমনে মানুষের বড় শত্রু নফসে আম্মারাহ ও তার খাহেশাতের বিরুদ্ধে জিহাদ করে আল্লাহর মহানত্বের তরবারীতে আল্লাহর মাঝে ফানা বা বিলীন হয়েছেন, তাঁরাও শহীদ ফী সবিলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ-নিহত। তাঁরাও জীবিত-জিন্দা। কেননা হাদীসে রাসূল মর্মে সাব্যস্ত, ইরশাদ হচ্ছে, “রাজি’না মিনাল জিহাদিল আসগরি ইলাল জিহাদি আকবরি, ক্বালূ ইয়া রাসূলাল্লাহ মাল জিহাদুল আকবরি, ক্বালা জিহাদুল হাওয়ায়ি” আমরা ছোট্ট যুদ্ধ হতে বড় যুদ্ধের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি। সাহবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বড় যুদ্ধ কি? রাসূলুল্লাহ (দ.) বললেন, নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। এ যুদ্ধের মর্দে মুজাহিদ গাযীরাও মুর্দা নন, তাঁরা অমর, জিন্দা।

 

হারুয়াল ছড়ি গাউছিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার আসল হাকিকত

হে পিয়ারে মুসলমানো! আমি এ মাদ্রাসা করলাম, আন্জুমান করলাম। দুইটি জিনিস আপনাদেরকে আমি নগন্য দিয়ে যাচ্ছি। আমি দিয়ে যাচ্ছি না, আল্লাহ দিচ্ছেন, আল্লাহর হাবীবে দিচ্ছেন, গাউসুল্লাহ দিচ্ছেন, মুরশিদ মাওলা আপনাদেরকে দিচ্ছেন। আমাকে কুশপুত্তলিকা স্বরূপ বানিয়ে এ গুলো করেছেন। তোমাদের আমি দুটি জিনিস সৃষ্টি করে দিলাম; আমি দিইনি, আমার বাপ দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী কেউ দেয়নি, খোদ খোদ মাওলা আহকামুল হাকেমীন পাক পরওয়ার দিগারে আলম দিয়েছেন। মগর (কিন্তু) ওছিলা খুঁটি একটি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। একটি মাদ্রাসায়ে গাউসিয়া রহমানিয়া ছুন্নিয়া অপরটি আন্জুমানে তৌহীদ। যে তৌহীদের বর্ণনা এতক্ষণ পর্যন্ত দিয়ে আসলাম। ইলম বহু রকমের আছে, ইলম মোটামুটি দু’ কিছিম আছে, ইলম ১২ কিছিম আছে, মূসা কলিমুল্লাহ যে সময় পাথরে লাটি মেরেছেন ১২ টি ঝরণা বের হয়েছে, ১২ ঝরণার সাথে ১২ টি ইলমের কানেকশন আছে, এমনি ২২ ইলম ২৩ ইলম ২৪ ইলম হাজার ইলম আছে, মগর (কিন্তু) ইলম ১২, ২২ সব বাদ দিয়ে মোটামুটি দু’টি ইলম সব ইলমকে পরিবেষ্টনকারী। একটি ইলমে যাহির অপরটি ইলমে বাতিন। একটি পাখির দুটি পাখা ধরুন, একটি যাহির অন্যটি বাতিন। দুই পাখার দ্বারা ওড়ে যদি দেখ, পাখি রূপে আরশে মুয়াজ্জম, আরশে মুয়াল্লার মধ্যে ওঠতে পারবে। মগর (কিন্তু) একপাখা যদি ভেঙে যায় আর এক পাখা দিয়ে ওড়লে, সারা জীবন ওড়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যাবেÑ কখনো উপরের দিকে যেতে পারবেনা। এই দুই পাখার মধ্যে একটি ইলমে যাহির, অন্যটি ইলমে বাতিন। ইলমে যাহির দরস-তদরিসের মাধ্যমে হাসিল হবে। মাওলানা সাহেবরা বালাগত, হিকমত, উসুল, ফিক্হ, হাদীস, তফসীর, কুরআন যে গুলো পড়াচ্ছেন এ জিনিস দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার আমর এবং নেহী যা করতে বলা হয়েছে সে মতে চলা, যা নিষেধ করছেন ঐ দিকে না যাওয়ার জ্ঞান লাভ হবে। এগুলো এক ডানা, এ ডানা দিয়ে সারা জীবনও যদি ওড়ে যাও মুস্তফা (দ.)’র যে জ্যোতি নূরের তজল্লিয়াতের জলওয়া, যা তোমার ক্বলবে আমানত রেখেছে তার নাগাল তথা আল্লাহর জাতে পাকের দীদার-দর্শন পাবে না। তোমাদের ত্বরিকতের ডানা-পাখা নিতে হবে। এ ত্বরিকতের পাখা যা অদেখা, তা আরিফ বিল্লাহদের নিকট রয়েছে; ভিতর-বাহির (ইলমে যাহির ও ইলমে বাতিন) উভয়টি দিয়ে ওড়তে হবে। কারণ উপরেরটি তোমাকে দলীল রূপে সাহায্য করবে, ভিতরেরটি তোমাকে শক্তি দান করবে। এই শক্তি তথা ভিতরের ইলম যদি না হয়, ইশকে মাওলা, ইশকে মুস্তফা (দ.) লাভ হবে না। এ কারণে তুমি পন্থা পাবে না। খারেজী, রাফেজী, শিয়া, মু’তাযিলা প্রত্যেকে মাদ্রাসা করছে, প্রত্যেকের মাদ্রাসায় হাদীস, কুরআন বয়ান হচ্ছে। আমরাও আজ হারুয়ালছড়ির বুকে মুষ্টিমেয় সাধারণ টুটা-ফাটা মানুষ মাদ্রাসা করলাম, যার নাম গাউসিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া রাখা হয়েছে, গাউসুল আ’যম (জিলানী ও মাইজভা-ারী) এর নামও আছে, সুলতানে আ’যম বাবাভা-ারীর নামও আছে, ছরকারে দো’আলম (দ.)’র নামও আছে; সমস্ত শক্তির নাম এখানে দিয়েছি। কেননা নামে পাকের তাওয়াজ্জু, ফয়য-বরকত হাসিলের মাধ্যমে মাদ্রাসা যেন সু-প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঝঃধনষব হয় জন্য। আমার মনো-আকাক্সক্ষা তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি, এ মাদ্রাসা খারেজী, তাবলিগী, রাফেজী, মওদুদীর মাদ্রাসার মত মাদ্রাসা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এ মাদ্রাসার ভিতর দিয়ে ঐ জিনিস দিতে চাই, ‘ওয়া’তাসিমু বিহাবলিল্লাহি জমিয়া’ তোমরা প্রত্যেকে আল্লাহর রশিকে মজবুত করে আঁকড়ে ধর। (সূরা আল-ই-ইমরান ১০৩ নং আয়াত) আল্লাহর রশির এতক্ষণ পর্যন্ত বয়ান হল, রশি কোনদিক হয়ে কোন দিক দিয়ে ঘুরে এসেছে তোমাদেরকে প্রকাশ্য বলার আর প্রয়োজন নেই। ঐ রশি তৌহীদের রশি, তৌহীদের রশি ধরে তোমার ক্বলবের যে আমানত মরে গিয়েছে, তা যদি জিন্দা কর তবে দীদারে ইলাহীর আশা রাখতে পার।
কেননা শরীয়তে মুস্তফা (দ.), ত্বরীক্বতে মুস্তফা (দ.), মা’রিফতে মুস্তফা (দ.), হাকী¡ক্বতে মুস্তফা (দ.)’র সমষ্টিতে দ্বীন-এ ইসলাম। দেখুন, এ চেয়ার এ টেবিলটির চারটি খুঁটি আছে; তিন খুঁটি বাদ দিলে এক খুঁটিতে চেয়ার-টেবিল কখনো থাকবে না।
মুস্তফা (দ.) ধর্ম চার খুঁটির উপর স্থিত। এ কারণে শরীয়ত, ত্বরীক্বত, হাক্বীক্বত ও মা’রিফত সব লাগবে। আমি আশা করি এ মাদ্রাসার ভিতর দিয়ে, এ আঞ্জুমানে তৌহীদের ভিতর দিয়ে, আঞ্জুমানে তৌহীদের বীর পুরুষদের ভিতর দিয়ে, গাউসিয়া রহ্মানিয়া মাদ্রাসার মুদাররিস এবং তালিবে ইলমের ভিতর দিয়ে ওই তৌহীদের ডঙ্কা বিশ্বের নগরে নগরে বাজতে থাকবে। আহ্কামুল হাকেমীন পাক পরওয়ারদিগার আমার এই ফরিয়াদ কবুল করুন। যদিও আমার মত নালায়েক আপনার সৃষ্টির মধ্যে আর কেউ নেই। মগর (কিন্তু) আমার আকাক্সক্ষা, আমার আশা, এই যে, আঞ্জুমানে তৌহীদ এবং মাদ্রাসায়ে গাউসিয়া রহমানিয়ার ভিতর দিয়ে আপনি খোদার খোদায়ীত্বকে এবং আপনার হাবীবের নূরের তজল্লিয়াতকে মানুষের মাঝে প্রস্ফুটিত করে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়া। গাউসিয়া রহমানিয়ায় পড়ে এক পাখা ওয়ালা পাখি হবে,তা আমার চাওয়া নয়। দুই পাখায় ওড়ে আল্লাহর দরবারে দিদার পর্যন্ত পৌঁছিবার তৌফিক কেফাসিটি তোমরা (ছাত্ররা) জোগাড় কর। ‘আঞ্জুমানে তৌহীদ’ সংগঠনকে মজবুত কর। আমার তাক্বরীর আর দীর্ঘায়িত করতে যাচ্ছিনা। রাত কিছুক্ষণ হয়েছে, আপনাদেরও কষ্ট হচ্ছে। আমার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সংক্ষেপে বলে দিলাম, এখন আমি সংক্ষিপ্তভাবে শেষ করে দিচ্ছি। আমার ওই ফরিয়াদ আল্লাহর দরবারে আপনাদেরও জানিয়ে দিচ্ছি, কারণ কখন মৃত্যুর পরওয়ানা এসে পড়ে তার ঠিক নেই। মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে এ কথা বলছি এটা ঐ রকম অকেজো মাদ্রাসা হবে, তা আমার কাম্য নয়। মুস্তফা (দ.)‘র নূরের তজল্লিয়াতের নূর দ্বারা জ্যোতিষ্মান চর্ম চোখে জগতে যা দেখা যাচ্ছে কিংবা দেখছ কিন্তু অন্তর চক্ষুর অভাবে ভিতরগত চক্ষু দ্বারা যা দেখতে হয় কিংবা দেখা যায়,ওইগুলো আজও অদেখা হয়ে রয়েছে। অতএব অন্তরের চক্ষু খোলার (ফুটাবার) চেষ্টা কর।
হে আঞ্জুমানে তৌহীদের সদস্যরা তোমরা নিজের চক্ষু খুলিয়ে মানুষকে খোলানোর পন্থা দেখাও। তোমরা যারা গাউসিয়া রহমানিয়ার তালিবে ইলম আছ, তোমরা নিজেকে প্রস্ফুটিত করে অপরকে করার চেষ্টা কর; তবে তোমাদের তৌহীদের খুশবো আরশ হতে পরশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।
একটি উদাহরণ দিয়ে কথা শেষ করছি, সামান্য কষ্ট করুন, দুই-চার মিনিট। দিল্লীতে একজন মুহাদ্দিস ছিলেন, তাঁর নাম ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহ্লভী (র.)। তিনি একদিন স্বপ্নে মুস্তফা (দ.)’র দর্শন লাভ করেছেন, এবং মুস্তফা (দ.) নিজের দু’টি চুল মোবারক তাঁকে দিয়েছেন। সকালে ঘুম হতে জাগ্রত হয়ে তাঁর বালিশের নিচে মুস্তফা (দ.)‘র চুল মোবারক দু’টি পেলেন। স্বপ্ন সঠিক কিনা, সারা দিন পরীক্ষা করলেন। তিনি এটাকে নিয়ে চোখে-মুখে লাগিয়ে-চুমো খেয়ে দুপুরে রোদে বের হয়ে দেখলেন, বের হওয়ার সাথে সাথে দুটি আবর (মেঘ) এসে তাঁকে ছায়া দিল। তিনি একবার ঘরে ঢুকেন আবার বের হন। তিনি ঢুকে গেলে আবর (মেঘ) চলে যায়, আবার বের হলে এসে পড়ে। এভাবে সারা দিন সূর্য থাকা পর্যন্ত তাঁর এ ডিউটি চলল। অতএব তা যে মুস্তফা (দ.)’র চুল মোবারক, সত্যিকার তার্বারুক, হাক্বীক্বতান তার্বারুক ওই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হলেন। এটা আমার আগাগোড়া তাক্বরীরের সারকথা। মুস্তফা (দ.)’র চুল মোবারক-কেশ মোবারকের বদৌলতে-বরকতে সূর্যের তাপ হতে রক্ষা করতে যদি মেঘ এসে ছায়া দেয়; তবে মুস্তফা (দ.)’র ওই নূরে পাকের তজল্লিয়াতের যে আমানত আমাদের ক্বলবে আছে ওই আমানত আমরা-আপনারা প্রস্ফুটিত করতে পারলে ১২ সূর্যের তাপ কি আমাদের পোড়াবে? কখনো পোড়াবে না। আমরা ছায়া কোথায় পাব? আরশে আ’লার নীচে। কেননা মুস্তফা (দ.)’র নূরের তজল্লিয়াত, আল্লাহর সত্তার নূর বা জ্যোতি; এ নূরের তজল্লিয়াতকে যদি আমরা আপন জমিনে তথা ক্বলবে প্রস্ফুটিত করি, আমাদের জমিনে যদি তা জিন্দা করি, তবে ক্বিয়ামত নয়, আবদান-আবাদ, হাশর-নশর নয়, জাহান্নাম-দোযখ নয়, তার চেয়ে বড় কিছুও আমাদের কিছু করতে পারবে কি? কখনো কিছু করতে পারবেনা। আমাদের জন্য কোন ভয়-ডর, দুশ্চিন্তা থাকবে না। আল্লাহ তা’আলা কুরআনে মজীদে ইরশাদ করেছেন, “আলা-ইন্না আওলিয়া-আল্লাহি লা খাওফুন আলায়হিম ওয়ালাহুম ইয়াহ্যানূন” খবরদার! জেনে রাখ নিশ্চয় আল্লাহর ওলি-বন্ধু-দোস্তদের জন্য না কোন ভয় আছে, না কোন দুঃখ-দুশ্চিন্তা। আমরা যদি আল্লাহকে চিনতে পারি, আল্লাহর দর্শন লাভ করতে পারি, তা হলে আমাদের নামও ডর-ভয়হীনদের ঐ দপ্তরে যাবে। থাকবে না কোন ডর আর ভয়। জাহান্নামের আগুন, ১২ সূর্যের তাপ, পুলসিরাতের কঠিন পুল; কোথাও ঠেকব না। প্রত্যেকে ওই নূরের তজল্লিয়াতকে প্রস্ফুটিত করুন। আমার কথা এই পর্যন্ত শেষ, আর বেশী বলবনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *