মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “সিদ্দীকের সত্যায়ন ও কুফ্ফারের মিথ্যা প্রতিপাদন”

🖊মুক্তিধারা ডেস্ক
হুযূর-ই আকরম (দ.) মক্কার কুরাইশদের সম্মুখে মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করলে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ শুরু করল। আবূ জাহল লোক একত্রিত করে হাসি-তামাসায় মেতে ওঠল। চতুর্দিকে মানুষ পাঠিয়ে লোকজনের সমাবেশ ঘটিয়ে মিথ্যাবাদী প্রতিপাদন ও বিদ্রুপার্থে মি’রাজের ঘটনা শুনাতে লাগল। সৈয়্যদুনা আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)কে ডেকে আনতে লোক পাঠাল এবং তাঁকে বলল, “তোমাদের রাসূল (দ.) বলছেন যে, ‘রাতের মধ্যে মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দস এবং সেখান থেকে আসমানে পৌঁছে সমস্ত নভোমন্ডল পরিভ্রমণ করে ফিরে এসে গেলেন।’ তাঁর এমন কথাও কি আপনি সত্যায়ন করবেন?” প্রত্যুত্তরে সিদ্দীকে আকবর (রা.) বললেন, ‘আমি-তো তাঁর চেয়েও অধিক দূরের বিষয়ে তাঁকে সত্যায়ন করি। যদি তিনি (দ.) বলে থাকেন তবে তার বাস্তবতায় কোন সন্দেহ সংশয় নেই’।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) হুযূর সৈয়্যদে আলম (দ.)’র খিদমতে আবেদন জানালেন, ‘হুযূর! আমি বায়তুল মুকাদ্দস দেখেছি, আপনি আমার নিকট তার বর্ণনা দিন’। বায়তুল মুকাদ্দস প্রকাশিত হল আর হুযূর (দ.) মসজিদে আক্বসার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন। (মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, ২য় খণ্ড)
মিথ্যা প্রতিপাদন ও বিদ্রুপে মেতে থাকা কুরাইশ কাফিররা বলতে লাগল, আমরা-তো আসমান দেখিনি কিন্তু মসজিদে আক্বসা দেখেছি। আপনি আমাদের সম্মুখে তার আকৃতি, রকম-সকম ও অবস্থাদির পূর্ণ বর্ণনা দিন। রাসূলুল্লাহ (দ.) বর্ণনা করতে লাগলেন-তো ঈষৎ সংকোচভাবের উদ্রেক ঘটল। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বায়তুল মুকাদ্দসকে হুযূর (দ.)’র সামনে হযরত উকাইল ইবনে আবী ত্বালিব (রা.)’র ঘরের নিকট রেখে দিলেন। হুযূর (দ.) তা দেখতে আর বর্ণনা দিয়ে যেতে থাকলেন।
নবী-ই আকরম (দ.) যখন মসজিদ-ই আক্বসা সংক্রান্ত প্রতিটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলেন, তখন কাফিররা অত্যাশ্চর্য হয়ে গেল। কেননা তারা জানতো যে, তিনি (দ.) কখনো মসজিদে আকসা দেখেননি। অগত্যা তাদের স্বীকার করতেই হল যে, মসজিদে আক্বসা বিষয়ে হুযূর (দ.) যা বললেন, তা পুরোপুরি সঠিক। পরন্তু কারো কাছে শুনেও বর্ণনা করতে পারেন ধারণায় বলল যে, মসজিদ-ই আক্বসার নক্সা-তো আপনি যথার্থই বর্ণনা করেছেন, এবার বলুন দেখি সেখানে যেতে বা আসতে আমাদের কোন কাফেলার সাক্ষাতও আপনি পেয়েছেন কিনা?
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ তোমাদের প্রথম কাফেলাটি ‘রওহা’ স্থানে দেখে ছিলাম। সে কাফেলার নেতৃত্বে রয়েছে অমুক গোত্রের অমুক। অতঃপর ঘটনা হল, সে কাফেলার একটি উট হারিয়ে যায়। তারা সেখানে যাত্রা বিরতি দিয়ে উটটির তালাশে গিয়েছিল। আমি সেখানে পৌঁছলে আমার পিপাসা পায়। দেখতে পেলাম, তাদের একটি উটের ‘পালান’ (মালামাল বোঝাই করার গদি)-এর একপাত্রে পানি রয়েছে। তা ঢেলে পান করে নিয়ে যখন রওয়ানা হচ্ছিলাম, তখন উল্লেখিত ব্যক্তি উট তালাশ করে ফিরে আসে। আমি যেতে যেতে তাকে সালাম দিলে কাফেলার কেউ বলে উঠল, ‘এটা তো মুহাম্মদের কন্ঠঃস্বর!’ কাফেলা ফিরে আসলে তোমরা তাদের থেকে জেনে নিও!’ 
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা বলেন, আমি যী-ত্বাওয়া নামক স্থানে পৌঁঁছলে দ্বিতীয় কাফেলাকে দেখি। সে কাফেলার একটি উটে অমুক অমুক নামের দু’বন্ধু আরোহী ছিল। আমার ‘বুররাক্ব’ যখন তাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে, তখন উটটি ভয়ে পালায় এবং তারা দু’জন উল্টে পড়ে। অমনিরূপে আকস্মিক দুর্ঘটনায় একজনের হাত ভেঙ্গে যায়। কাফেলাস্থরা আসলে, সমস্ত অবস্থার কথা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নিতে পার! 
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা বলেন-‘তৃতীয় কাফেলা আমি ‘তানঈম’ স্থানে দেখেছি।’ কাফির-মুশরিক্বগণ সে কাফেলার কিছু আলামত-চিহ্ন জিজ্ঞেস করলে ইরশাদ করেনঃ ‘কাফেলাটির অগ্রভাগে ঈষৎ লালিমা মিশ্রিত কালরঙের উট, যার উপরে দু’টি খেজুর পাতার মাদুর বোঝাই রয়েছে; একটি কালো রেখা বিশিষ্ট, দ্বিতীয়টি সাদা রেখা বিশিষ্ট। সে কাফেলা যখন এসে পড়বে, তখন নিজেদের স্বচক্ষে দেখে নিও!’ 
মক্কাবাসী কাফিররা চিন্তা করল যে, এ তিনটি দলিল শক্তিশালী, অতএব প্রস্থানে উদ্যত হয়ে তারা বলল, আর এটুকু বলুন যে, কাফেলাগুলো আনুমানিক কবে নাগাদ মক্কায় পৌঁছে যাবে?
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ফরমালেন- প্রথম কাফেলা আগামীকাল সূর্য উঠার আগে মক্কায় পৌঁছে যাবে, দ্বিতীয়টি ঠিক মধ্যদিনে এবং তৃতীয় কাফেলা পৌঁছার সময় হল, সূর্য ডুবার অল্প আগে (আল্ মাওয়াহিবুল্ লাদুনিয়্যাহ্, ২য় খণ্ড, ৪০ পৃঃ)। 
কাফেলা গুলোর আগমনের সময়কাল শ্রুত হয়ে কাফিরদের একটি দল মক্কা মু‘আযযমার সর্বোচ্চ পাহাড়টির উপর গিয়ে বসে পড়ল এবং সূর্য উঠার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগল। অপর দিকে মুসলমানগণও নিজেদের আক্বার নির্দেশনাবলী অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে দেখানোর প্রত্যয়ে অবস্থান নিলেন। সূর্য উদয় হতে যাচ্ছিল এমন সময় এক কাফির চিৎকার দিয়ে বলতে যাচ্ছিল-আল্লাহর শপথ, সূর্য উদিত হয়ে…….। তার বাক্য পূর্ণ না হতেই সাহাবা-ই কেরাম আওয়াজ দিয়ে উঠলেন দেখ কাফেলাও এসে পড়েছে দেখা যাচ্ছে! তা দেখে কাফিররা বলতে লাগল, ‘এটা তো যাদু, যা আমরা মানতে রাজি নই!’ ঘটনা প্রবাহে দ্বিতীয় কাফেলাটিও অমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ইরশাদ মোতাবেক ঠিক মধ্যদিনে এসে পৌঁছল। 
তৃতীয় কাফেলাটি পথে কোন প্রয়োজন বশতঃ দেরী করতে যাচ্ছিল। এদিকে সূর্য ডুবার কাছাকাছি হলেও কাফেলাটি আসার নাম-নিশানা দেখা যাচ্ছিলনা! কাফিররা কিছু বলাবলিও শুরু করে দিল! সত্যের সূক্ষ্মমর্যাদাবোধ তখন জোশে এসে গেল, সূর্যকে হুকুম হল ওখানে থেমে যাও; ওই কাফেলা এসে না পৌঁছা পর্যন্ত তোমার ডুবার অনুমতি নেই! এরূপে সূর্য দিগন্তে ধরণীর প্রান্তসীমায় থেমে রয়েছে আর সময় অতিবাহিত হচ্ছে! এমনিভাবে কাফেলার উদয় হয়ে যাওয়াতে যখন কাফিরদের কিছুই বলার ছিল না, তখন বলতে লাগল, ‘আমরা মানিনা, এটাতো প্রকাশ্য যাদু!’ (আশশিফা, ১ম খণ্ড, ২৮৪ পৃঃ)।
উল্লেখ্য যে, বায়তুল মুকাদ্দসের বর্ণনায় ঈষৎ সংকোচভাবের উদ্রেক প্রশ্নে রসূলুল্লাহ (দ.)’র অদৃশ্যজ্ঞান অস্বীকারের জো নেই। যেহেতু জ্ঞান না থাকলে-তো তিনি (দ.) বলে দিতেন যে, আমার নিকট সবকিছুর অবগতি নেই। তাছাড়াও ইতোপূর্বে সিদ্দীকে আকবর (রা.)’র সমীপে সবকিছুই বর্ণনা দিয়েছেন; ফের জ্ঞানহীনতার কিবা অর্থ? জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও কতেক জিনিসের প্রতি হুযূর (দ.)’র মনোনিবেশ ছিলনা; যদর্থে ওই অবস্থার উদ্রেক ঘটে। আল্লাহ তা‘আলা আপনা মাহবূব (দ.)’র ওই অবস্থা বিদূরণে মসজিদে আক্বসাকে এনে সামনে রেখে দিলেন। এতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী করীম (দ.)কে পরিপূর্ণ মর্যাদান্বিত করার বিষয়ই সাব্যস্ত হয় যে, অমনোযোগ হেতু সামান্য সংকোচভাবের উদ্রেক ঘটলো-তো তা দূরীকরণে আল্লাহ অলৌকিকতা রূপে স্বীয় কুদরতে কামিলাহ’র বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। মি’রাজের ঘটনা যেরূপ মু’জিযাহ, ঠিক তেমনি তার প্রমাণেও মু’জিযাহ জাহির করেছেন। যাতে অলৌকিকতাপূর্ণ শানে দাবী ও প্রমাণ পরষ্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায় এবং ঈমানদারদের কাছে এ হাকীকতও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, যে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হযরত সুলায়মান (আ.)’র জন্য পলক পড়ার আগে সাবা সম্রাজ্ঞী বিলকিসের বিরাটাকার সিংহাসন হাজির করতে পারেন, তিনি স্বীয় পরিপূর্ণ কুদরতে আপন মাহবূব (দ.)’র জন্য বায়তুল মুকাদ্দসও উপস্থিত করতে পারেন। প্রশ্ন হতে পারে যে, এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা মসজিদে আক্বসাকে অনুপস্থিত কেন পায়নি? উত্তর হল যে, সর্বক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর জন্য অসম্ভব নয় যে, শামদেশে মসজিদে আক্বসার দর্শনার্থীদের সামনে তার এমন প্রতিবিম্ব স্থাপন করবেন, যা দেখা মসজিদে আক্বসাই দেখা।
আল্লাহ আমাদেরকে সিদ্দীকে আকবর (রা.)’র অনুগামী করুন। অভিশপ্ত পথভ্রষ্ট কাফির মুশরিক মুনাফিকদের সহযাত্রী হওয়া থেকে রক্ষা করুন। আমীন বিজাহি সৈয়্যদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলায়হি ওয়া ‘আলা আলিহী ওয়া সাল্লাম।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *