স্বশরীরে মি’রাজ ও নূরীকায়া তত্ত্ব

ঈমানদার মুসলমানরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’কে যেমন বিশ্বাস করেন, তেমনি স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মি’রাজ সংঘটিত হওয়ার দাবী বিষয়েও অটল বিশ্বাসী। 
তাইতো শিফা শরীফে ইমাম ক্বাযী আয়ায (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বিবৃত তথ্যসূত্রে উল্লেখ আছে-“ইসরা (মি’রাজ) স্বশরীরে-জাগ্রতাবস্থায় সংঘটিত হওয়াই যে শাশ্বত সত্য তদ্বিষয়ে পূর্বসূরী মর্যাদাবান মুসলমানদের অটল বিশ্বাস রয়েছে। আর এটা সর্বহযরাত ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), হুযাইফাহ্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আবু হুরাইরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), মালিক ইবনু ছা’ছা’আহ্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আবু হিব্বা আলবদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ইবনু মাস’উদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আদ্বিহাক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), সা’ঈদ ইবনু জুবাইর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ক্বাতাদাহ্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু),ইবনুল মুসায়্যিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ইবনু শিহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ইবনু যায়দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আল্ হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ইব্রাহীম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), মসরূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), মুজাহিদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ইকরামাহ্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ইবনু জুরাইজ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ‘আয়িশাহ্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র দলিল ভিত্তিক, আত্ত্ববরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র মতভিত্তিক, ইবনু হাম্বল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সহ মুসলমানদের সুবৃহৎ একটি দল এবং পরবর্তী যুগের অধিকাংশ ফিকহবিদগণ, মুহাদ্দিসগণ, কালামশাস্ত্রবিদগণ ও তাফ্সিরকারগণের অভিমত”(শিফা শরীফ; ১ম খণ্ড; ১৮৮ পৃঃ)।”
স্বশরীরে মি’রাজ সংঘটিত হওয়ার সংবাদেই তো মক্কানগরীর অলিতে-গলিতে কাফির-মুশরিক্বদের অপতৎপরতার কোলাহল শুরু হয়ে গিয়ে ছিল। “আবু জহল, হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে দৌঁড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমিতো সে নবীর দাবী সত্য বলে বিশ্বাস কর! এখন বল তুমি কি বলবে? তোমার বন্ধুতো এমন এক দাবী করল, যা মানতে তুমি কখনো সম্মত হবে না!’ হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আবু জহলের মুখেই মি’রাজের দাবীর কথা শুনে মৃদু হেসে ইরশাদ করলেন-‘আমি তো হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র পবিত্র মুখে শুনেই সৃষ্টি জগতের স্রষ্টাকেও মানলাম এসব বিষয় তো তার চেয়ে বেশী কিছু নয়!’ হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হুযূরে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র দরবারে গিয়ে যাচাই করা পর্যন্ত আর অপেক্ষা না করে মি’রাজ পরিভ্রমণের দাবীকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়ে সেই সকালেই ছিদ্দীক্বে আকবর (অত্যাধিক সত্যবাদীর শ্রেষ্ঠজন) উপাধিতে ধন্য হন।” (তাফসিরে ইবনে কসীর)। 
এতদসত্ত্বেও কাফির-মুশরিকরা স্বদলবলে আবু জহলের নেতৃত্বে সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র নিকট উপস্থিত হয়ে স্বশরীরে মি’রাজ গমনের দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারে কি-না সে অপতৎপরতায় বাইতুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করতে লেগে যায়। “হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’কে ইরশাদ করতে শুনেছি, ‘কুরাইশরা যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা চালায়, তখন আমি হাজরে আস্ওয়াদ-এর নিকট দাঁড়ালাম, অথচ আল্লাহ তা‘আলা বাইতুল্ মুকাদ্দাসকে আমার নিকট উদ্ভাসিত করে দেন; অতএব আমি তা দেখে দেখে সমস্ত নিদর্শনাবলী তাদেরকে বলতে লাগলাম।”
তথ্যসূত্রেঃ 
১.বুখারী, ২য় খণ্ড, ৬৮৪পৃঃ।
২. মুসলিম ১ম খণ্ড, ৯৬ পৃঃ।
৩. তিরমিযী ২য় খণ্ড, ১৪১পৃঃ। 
৪.মুসনদে ইমাম আহমদ, ৩য় খণ্ড, ৩৭৭ পৃঃ। 
৫.শরহুল্ মওয়াহিব ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১২৭ পৃঃ। 
‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ সম্পর্কে যথাযথ জবাব পেয়ে কাফির-মুশরিকগণ, তাদের চেষ্টা বৃথা হতে যাচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করলঃ ‘আমাদের কয়েকটি কাফেলা সে পথে যাত্রারত রয়েছে, তাদের ব্যাপারে বলুন তো!’ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করলেন- ‘তোমাদের প্রথম কাফেলাটি ‘রওহা’ স্থানে দেখে ছিলাম। সে কাফেলার নের্তৃত্বে রয়েছে অমুক গোত্রের অমুক। অতঃপর ঘটনা হল, সে কাফেলার একটি উঠ হারিয়ে যায়। তারা সেখানে যাত্রা বিরতি দিয়ে উঠটির তালাশে গিয়েছিল আমি সেখানে পৌঁছলে আমার পিপাসা পায়। দেখতে পেলাম, তাদের একটি উটের ‘পালান’ (মালামাল বোঝাই করার গদি)-এর একপাত্রে পানি রয়েছে। তা ঢেলে পান করে নিয়ে যখন রওয়ানা হচ্ছিলাম, তখন উল্লেখিত ব্যক্তি উট তালাশ করে ফিরে আসে। আমি যেতে যেতে তাকে সালাম দিলে কাফেলার কেউ বলে উঠল, ‘এটা তো মুহাম্মদের কন্ঠঃস্বর!’ কাফেলা ফিরে আসলে তোমরা তাদের থেকে জেনে নাও!’
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা বলেন, আমি যী-ফজা নামক স্থানে পৌঁঁছলে দ্বিতীয় কাফেলাকে দেখি। সে কাফেলার একটি উঠে অমুক অমুক নামের দু’বন্ধু আরোহী ছিল। আমার ‘বুররাক্ব’ যখন তাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে, তখন উঠটি ভয়ে পালায় এবং তারা দু’জন উল্টে পড়ে। অমনিরূপে আকস্মিক দুর্ঘটনায় একজনের হাত ভেঙ্গে যায়। কাফেলাস্থরা আসলে, সমস্ত অবস্থার কথা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নিতে পার!
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা বলেন-‘তৃতীয় কাফেলা আমি ‘তুল্বী-ন’ স্থানে দেখেছি।’ কাফির-মুশরিক্বগণ সে কাফেলার কিছু আলামত-চিহ্ন জিজ্ঞেস করলে ইরশাদ করেনঃ ‘কাফেলাটির অগ্রভাগে ঈষৎ লালিমা মিশ্রিত কালরঙের উট, যার উপরে দু’টি খেজুর পাতার মাদুর বোঝাই রয়েছে; একটি কালো রেখা বিশিষ্ট, দ্বিতীয়টি সাদা রেখা বিশিষ্ট। সে কাফেলা যখন এসে পড়বে, তখন নিজেদের স্বচক্ষে দেখে নিও!’ 
মক্কাবাসী কাফিররা চিন্তা করল যে, এ তিনটি দলিল শক্তিশালী, অতএব প্রস্থানে উদ্যত হয়ে তারা বলল, আর এটুকু বলুন যে, কাফেলাগুলো আনুমানিক কবে নাগাদ মক্কায় পৌঁছে যাবে?
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ফরমালেন- প্রথম কাফেলা আগামীকাল সূর্য উঠার আগে মক্কায় পৌঁছে যাবে, দ্বিতীয়টি ঠিক মধ্যদিনে এবং তৃতীয় কাফেলা পৌঁছার সময় হল, সূর্য ডুবার অল্প আগে (আলমাওয়াহিবুল্ লাদুনিয়্যাহ্, ২য় খণ্ড, ৪০ পৃঃ)। 
কাফেলা গুলোর আগমনের সময়কাল শ্রুত হয়ে কাফিরদের একটি দল মক্কা মু‘আযযমার সর্বোচ্চ পাহাড়টির উপর গিয়ে বসে পড়ল এবং সূর্য উঠার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগল। অপর দিকে মুসলমানগণও নিজেদের আক্বার নির্দেশনাবলী অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে দেখানোর প্রত্যয়ে অবস্থান নিলেন। সূর্য উদয় হতে যাচ্ছিল এমন সময় এক কাফির চিৎকার দিয়ে বলতে যাচ্ছিল-আল্লাহর শপথ, সূর্য উদিত হয়ে…….। তার বাক্য পূর্ণ না হতেই সাহাবা-ই কেরাম আওয়ায দিয়ে উঠলেন দেখ কাফেলাও এসে পড়েছে দেখা যাচ্ছে! তা দেখে কাফিররা বলতে লাগল, ‘এটা তো যাদু, যা আমরা মানতে রাজি নই!’ ঘটনা প্রবাহে দ্বিতীয় কাফেলাটিও অমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ইরশাদ মোতাবেক ঠিক মধ্যদিনে এসে পৌঁছল। 
তৃতীয় কাফেলাটি পথে কোন প্রয়োজন বশতঃ দেরী করতে যাচ্ছিল। এদিকে সূর্য ডুবার কাছাকাছি হলেও কাফেলাটি আসার নাম-নিশানা দেখা যাচ্ছিলনা! কাফিররা কিছু বলাবলিও শুরু করে দিল! সত্যের সূক্ষ্মমর্যাদাবোধ তখন জোশে এসে গেল, সূর্যকে হুকুম হল ওখানে থেমে যাও; ওই কাফেলা এসে না পৌঁছা পর্যন্ত তোমার ডুবার অনুমতি নেই! এরূপে সূর্য দিগন্তে ধরণীর প্রান্তসীমায় থেমে রয়েছে আর সময় অতিবাহিত হচ্ছে! এমনিভাবে কাফেলার উদয় হয়ে যাওয়াতে যখন কাফিরদের কিছুই বলার ছিল না, তখন বলতে লাগল, ‘আমরা মানিনা, এটাতো প্রকাশ্য যাদু!’ (আশশিফা, ১ম খণ্ড, ২৮৪ পৃঃ)। 
উপরোক্ত ঘটনাবলী স্বশরীরে মি’রাজ সংঘটিত হওয়ার পক্ষে সুষ্পষ্ট দলিলতো বটেই, উপরন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা নূরীকায়ায় সর্বত্র হাযির-নাযির থাকার বৈশিষ্ট্যধারী হওয়ার পক্ষেও প্রমাণবহ। কেননা এত স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয় এমন দূরবর্তী স্থান ও স্তরসমূহ, বহুল ঘটনাসহ পরিভ্রমণ প্রশ্নে স্বীকার্য যে, শুধু দ্রুতগতি দ্বারা নয়, বরং একই মুহূর্তে সর্বত্র উপস্থিতির মতো বৈশিষ্ট্যের হওয়া দ্বারাই তা সম্ভব। অন্যথায় শুধু দ্রুতগতিতে সে ভ্রমণ সম্পন্ন করা সম্ভব হলেও ঘটনা বহুলতা সম্পন্ন করা কিভাবে সম্ভব! পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা শাহিদ (সাক্ষীদাতা তথা উপস্থিত-পর্যবেক্ষণকারী) রূপে প্রেরিত (২২ পারা, সূরা আহযাব, ৪৫ আয়াত) মর্মে সর্বত্র হাযির-নাযির বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়াতো পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিষয়। অতএব স্বশরীরে নূরী কায়ায় সর্বত্র হাযির-নাযির রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা এমনই হন, যেমন অন্তহীন পরিভ্রমণযুক্ত মি’রাজ কালে কোথাও একটি কাফেলার পানিও পান করলেন, কাফেলার লোকজন হারানো উট খোঁজায় ব্যস্ত থাকার খবরও রাখলেন, যেতে যেতে তাদেরকে সালামও দিলেন, তারা সে কণ্ঠঃস্বর শুনে চিনতেও পারল, কিন্তু তাঁকে দেখতে পাওয়া গেল না! নূরী কায়ায় সর্বত্র হাযির-নাযির রাসূলের অদৃশ্যজ্ঞান ও দর্শন এমনই, যেমন কোন্ কাফেলাটি কখন এসে পড়বে, তা বাস্তবে সংঘটিত হওয়ার আগেই সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে দেখতে পান। ইত্যাদি। 
এভাবে অন্তহীন ঘটনাবহুল মি’রাজ পরিভ্রমণকে বিশ্বাস করা ঈমানদারের জন্য আশ্চর্যের কিছু নয়; কেননা ঐ হেন মি’রাজ পরিভ্রমণ তো নূরী কায়ায় সর্বত্র হাযির-নাযির রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র একটি ঝলকই মাত্র; যা মু’যিযা রূপে পরিচিহ্নিত হয়ে সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার কুদরতেরই বহিঃপ্রকাশ।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *