পূর্ব আকাশে রবির উদয় আঁধার হল বিলয়: গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী প্রসঙ্গ

হযরতুলহাজ্ব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ সােলাইমান আনসারী

প্রাককথা: আল্লাহ পৃথিবী ও মহাকাশের সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রিয় মানবসমাজের সার্বিক সুবিধার জন্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষ নিয়ে যে সমাজ সেটাই হল বিশ্ব সমাজ। বিশ্ব সমাজের অন্তর্ভুক্ত যে সকল মানুষ আল্লাহর প্রভুত্বকে স্বীকার করে তারা যেমন আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামত আলাে, বাতাস, খাদ্য প্রভৃতি ভােগ করে থাকে, তেমনি যারা আল্লাহর প্রভুত্বকে অস্বীকার করে তারাও নেয়ামত ভােগ করে। কারণ বেঁচে থাকার জন্যই মানুষ জন্মগতভাবে মহান আল্লাহর সৃষ্টি জগতের যাবতীয় প্রয়ােজনীয় উপায়-উপকরণ গ্রহণের এবং সুযােগ-সুবিধা ভােগের সমান অধিকারী। বিশ্বমানবের এ সকল দৈহিক প্রয়ােজন মেটানাের পাশাপাশি মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের নৈতিক ও রূহানী প্রয়ােজন মেটানাের যথারীতি ব্যবস্থা নিয়েছেন। মানুষের সকল প্রকার দৈহিক, নৈতিক ও রূহানী কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। এ সকল নবী-রাসূলগণ মানবসমাজকে বৈষয়িক উপায়-উপকরণ ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাদের নৈতিক ও রূহানী উন্নয়নের জন্য মহান আল্লাহর আদেশে পন্থা নির্দেশ করেছেন। এভাবে নবী ও রাসূলগণের নির্দেশিত জীবনযাপন প্রণালী প্রচলনের মাধ্যমে মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে থাকে। এবং বিশ্বের সকল মানুষের জন্য প্রেরিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মােস্তফা আহমদ মােজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির জন্য প্রেরিত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান চূড়ান্তরূপে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে বিশ্বসমাজের পূর্ণাঙ্গ কাঠামাে বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে। সেই পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা অবলম্বন করে সােনালি যুগের (খােলাফায়ে রাশেদার যুগ) মানবসমাজ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সুখ শান্তি সমৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে, দর্শনের বিকৃতির কারণে সেই পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপন প্রক্রিয়া আল ইসলাম বাহ্যিক রূপসর্বস্ব আত্মাহীন পুতুলে পরিণত হতে থাকে। সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য মহান প্রভু ইসলামের প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচশত বছর পর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রা.) মহিউদ্দীন তথা ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবনকারী নবুয়তের ছায়াধারী বেলায়ত শক্তির সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গাউসুল আ’যম হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁর কর্ম সাধনায় আবার ইসলামী জীবনযাপনে মানুষ সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধির ছােয়া পেতে থাকে। সময় আপন গতিতে গড়াতে থাকে। দিন-মাস-বছর-যুগ-শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে আবারও ইসলাম নামক জীবনযাপন প্রণালীটি সংকুচিত, কাদাযুক্ত, প্রশ্নবিদ্ধ, প্রাণহীন হতে থাকে। তাই গাউসুল আ’যম বড়পীর জিলানীর ছয়শতাধিক বছর পর ইসলামের প্রাণসঞ্চালনকারী হিসেবে পূর্বাঞ্চলের মাইজভাণ্ডার নামক স্থানে ১২৪৪ হিজরী মােতাবেক ১১৮৮ মঘী, ১৮২৬ ঈসায়ী, ১২৩৩ বঙ্গাব্দ ১ মাঘ বুধবার অপরাহ্নে জন্মলাভ করেন আহমদী বেলায়ত ক্ষমতার ঝাণ্ডাবর্দার উদার যুগনায়ক, কুতুবে রব্বানী, মাহবুবে ইয়াযদানী গাউসুল আ’যম হযরত মাওলানা শাহসূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)। তাঁর মহামতি পিতার নাম সৈয়দ মতিউল্লাহ (রা.)। মাতার নাম সৈয়দা খায়রুন্নিছা (রা.)। তাঁরা উভয়েই পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত ফটিকছড়ি উপজেলার ইছাপুর মহকুমার আজিমনগর মৌজার (গ্রামের) অধিবাসী ছিলেন। তারা উভয়েই রাসূল (দ.) বংশােদ্ভূত সৈয়দ ছিলেন। রাসূল (দ.) আনীত পালিত ধর্ম ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রচার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তাঁরই বংশধর সৈয়দগণ। তাঁদের স্বভাবজাত দায়িত্ব পালনে সুদূর জাজিরাতুল আরব থেকে গৌড় নগর হয়ে তাঁরা উক্ত স্থানে বসতি স্থাপন করেন।

শিক্ষা অর্জনে মাইজভাণ্ডারী হযরত: শিশুকাল থেকে মাতা পিতার তত্ত্বাবধানে থেকে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি লাভ করেন। নিজ গ্রামেই আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করার পর উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে ১২৬০ সনে সুদূর পশ্চিমবঙ্গে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন। হিজরী ১২৬৮ সনে কুরআন, হাদিস, ফিকাহ্, তাফসীরসহ ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণকল্পে সর্বপ্রকার কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেন এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেন।

অর্জিত জ্ঞান বিতরণে হযরত গাউসুল আ’যম: “তায়াল্লামুল্ ইলমা ওয়াল্লিমুহুন্নাছা”। বিশ্বের মহান শিক্ষক বিশ্বনবী (দ.) এর উক্ত ঘােষণা ‘তােমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং তা মানুষকে শিক্ষা দাও’ অনুসরণের তাগাদায় ১২৭০ হিজরী কলিকাতার মাটিয়া বুরুজে মুন্সি বু আলী মাদরাসায় প্রধান মােদাররিছ হিসেবে শিক্ষকতার পেশায় যােগদান করেন। এবং কুরআন, সুন্নাহ্সহ সামগ্রিক শিক্ষাদানে নিজেকে নিয়ােজিত রাখেন। অবশ্য এর পূর্বে মাদরাসা শিক্ষা শেষে যশাের কাজীর পদে কিছুকাল সফল দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।

দীক্ষা গ্রহণে হযরত কেবলা: মাদরাসায় শিক্ষকতাকালীন তিনি পীরানে পীর দস্তগীর মাহবুবে সােবহানী গাউসুল আ’যম মহিউদ্দিন শেখ সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী (রা.) এর বংশধর সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ সালেহ আল্ কাদেরী লাহােরীর দস্তে বায়াত গ্রহণপূর্বক আধ্যাত্ম সাধনায় নিয়ােজিত হন। পীরের নির্দেশে হযরত আবু শাহমা (ক.) এর অগ্রজ চিরকুমার শাহসূফী সৈয়দ দেলােয়ার আলী পাকবাজ মুহাজিরে মাদানী এর সােহবতে তিনি এত্তেহাদী কুতবিয়ত এর ফয়েজও হাসিল করেন। এই দুইজন মহান ওলীর সংস্পর্শে থেকে ফয়জ বরকত আহরণের লক্ষ্যে বায়াত গ্রহণের সময় হতে প্রায় পাঁচ বছর যাবতকাল কলিকাতায় তিনি অতিবাহিত করেন। ১২৭৫ হিজরী সনে স্বগ্রাম মাইজভাণ্ডারে ফিরে এসে কিছুকাল পর্যন্ত বিভিন্ন মাহফিলে ও মজলিসের মাধ্যমে হিদায়ত কার্য পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্বীয় আস্তানা শরীফে নিরবচ্ছিন্ন ঐকান্তিকতায় আধ্যাত্ম সাধনায় নিজেকে নিয়ােজিত রাখেন। ক্রমান্বয়ে অর্জিত বেলায়তী ক্ষমতার অনন্য দীপ্তি সন্নিহিত এলাকা ছাড়িয়ে বিকশিত হয়েছিল সর্বত্র।

দর্শন প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট: হযরত গাউসুল আ’যম শায়খ সৈয়দ মহিউদ্দিন আবদুল কাদির জিলানী (রা.)’র বিসালের ছয়শতাধিক বছর পর সময়ের বিবর্তন ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তির ফলে শরীয়তী ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ আচারধর্ম পালনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপােষকতা না থাকায় মুসলিম সমাজব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে অচল ও দুর্যোগের সম্মুখীন হতে থাকে। ইসলামী হুকুমতের অনুপস্থিতিতে শরীয়ত বা বিধান ধর্মের আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিবিধ শ্রেণীর আলেম-ওলামাদের মধ্যে মতানৈক্য ও বাদানুবাদ শুরু হয়। ফলে মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ফিৎনা ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়ে যায়। এমন সন্ধিক্ষণে মুসলিম সমাজের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক না করে ধর্মের মূলকথা নৈতিকতার বিকাশ সাধনার মানসে নৈতিক ধর্মের উপর গুরুত্বারােপকারী বেলায়তে মােতলাকায়ে আহমদী (অর্গলমুক্ত ও সর্ববেষ্টনকারী ভাবধারার বেলায়ত শক্তি) প্রবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বেলায়তে মােতলাকা, বিধান ধর্ম ও আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি খােদার ইচ্ছাশক্তি এবং মানুষের আত্মিক উন্নতির উপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করে। সুতরাং সময়ের প্রয়ােজনে হযরত গাউসুল আ’যম মাওলানা শাহসূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রা.) পবিত্র ইসলাম ধর্মের বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের উপর হস্তক্ষেপ না করে নৈতিক ধর্মের মাধ্যমে খােদার দিকে আহ্বান জানান এবং আল্লাহর বাতেনী শাসন পদ্ধতির প্রথানুযায়ী সমুচিত হিদায়ত ও শক্তিশালী ত্বরিকতের প্রভাবে প্রভাবিত করে জগদ্বাসীকে অন্ধকার থেকে সহজতম উপায়ে আলাের পথে আনার জন্য মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা-দর্শনের প্রবর্তন করেন। এর অনুসারী নবী করিম (দ.) এর যােগ্যতম প্রতিনিধি হিসেবে বিকাশ লাভ করতে সক্ষম।

অনন্য স্বতন্ত্র মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা: হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রা.) বেলায়তের সর্বোচ্চ শক্তিসম্পন্ন আকলে কুল্লির অধিকারী ছিলেন। এ স্তরের বেলায়ত বাধাহীন, সর্ববেষ্টনকারী বেলায়তী শক্তিসম্পন্ন। এ স্তরে উপনীত হলে বান্দা স্রষ্টাপ্রদত্ত সকল জ্ঞানের অধিকারী হয়। এ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তাঁর পীর মুর্শিদের ধারায় কাদেরীয়া ত্বরিকা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বেলায়তে মােতলাকায়ে আহমদি যুগের চাহিদা অনুযায়ী তিনি কুরআন হাদিস ও হিকমত বা কৌশল অবলম্বন করে যুগােপযােগী একটি মহাসাগররূপী স্বতন্ত্র ত্বরিকা-দর্শন প্রবর্তন করেন, যা মাইজভাণ্ডারী তরিকা-দর্শন নামে সুপরিচিত। এ ত্বরিকা একটি যুগােপযােগী দর্শন হিসেবে বিশ্বের সকল ধর্মের মানুষের কাছে বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা শরীয়ত বিরােধী নয়। হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (ক.) এর ফয়েজ ও প্রভাবে পরিচালিত অজস্র খলিফা বাংলাদেশের সর্বত্র বিদ্যমান, যাঁরা প্রত্যেকেই উচ্চ মর্তবার ওলী হন। তাঁরা বেলায়তে মােতলাকা অনুযায়ী মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা অবলম্বনে হিদায়তের কাজ আঞ্জাম দেন। হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (ক.) বিভিন্ন ত্বরিকা অবলম্বনকারীদের নিজ নিজ ত্বরিকায় বহাল রেখেও নিজ বেলায়তী ধারা বা পদ্ধতি অনুযায়ী ফয়েজ বিতরণ করতে সমর্থ। এ উম্মুক্ত বেলায়তি ধারাই মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা হিসেবে অভিহিত। এ দেশের সমগ্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গােত্রীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবিত এ ত্বরিকা, যা সর্বাধুনিক ও সর্বশেষ। এজন্য এ দেশবাসী অবশ্যই সৌভাগ্যের দাবীদার। মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকায় শরীয়ত, ত্বরীকত, হাকীকত, মারিফত এক কথায় দ্বীনে ইসলামের প্রতিটি দিক অতি সুন্দরভাবে সমন্বিত করা হয়েছে।

বন্দেগীতে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী: হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী হায়াতে কোনদিন এক ওয়াক্ত নামাজও ক্বাজা করেননি। যথাসময়ে নামাজে পাঞ্জেগানা আদায় করতেন। বেশী বেশী নফল নামাজ ও নফল রােজা রাখতেন। বাকী সময় কুরআন তিলাওয়াত, শিক্ষা ও দ্বীন চর্চায় কাটাতেন।

অলৌকিক ঘটনাবলীর কিঞ্চিৎ পরিচয়: হযরত কেবলা (ক.) নিজেকে গােপন রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। তবুও আল্লাহর মুখ্য উদ্দেশ্য ও বেলায়তী শানকে বিকশিত করার জন্য এবং খােদার প্রতি মানবজাতির বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেম জাগিয়ে তুলে তাদের সুপথে ও গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য তাঁর অনেক কারামাত বা অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ হয়ে পড়ে। এ সকল কারামাত খােদার ইচ্ছাতেই সংঘটিত হতাে। তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাবে এদেশের অলিতে গলিতে, মাঠে ঘাটে, সর্বত্র অলৌকিক ঘটনা ও কারামাত বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেশবাসীর মুখে ও অন্তরে তাঁর আত্মার প্রভাবজনিত যে সমস্ত কারামাত বিঘােষিত ও বিজড়িত হয়েছে তা এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব। তাঁর ব্যাপ্তি ও শক্তি সম্পর্কে কিঞ্চিৎ উপলব্ধি করার মানসে কয়েকটি কারামাতের শিরােনাম বর্ণিত হলাে। যেমন- হযরত আদম (আ.) এর সাথে হযরতের আধ্যাত্মিক যােগসূত্র, আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে বাড়িতে থেকে মক্কা-মদিনা ভ্রমন, লাঠির প্রহারে মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার, বিনা ঔষধে হস্তপঁচা ও ক্ষতনালী রােগ থেকে মুক্তি, খান বাহাদুর ফজলুল কাদেরের প্রতি রহমত বর্ষণ, সূর্যের উপর আধ্যাত্মিক প্রভাব, সাগর গর্ভে হযরতের প্রভাব, চট্টগ্রাম মােহছেনীয়া মাদরাসা (মহসিন কলেজ) ও নাজিরহাট আহমদিয়া মাদরাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠায় হযরতের প্রভাব, কবরে মুনকার-নকির সম্পর্কে হযরতের তছাররােফাত, ওফাতের পরে হযরতের প্রত্যক্ষ দর্শন দান, হযরত খিজির (আ.) এর সঙ্গে হযরত কেবলার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের নিদর্শন, নিষ্ফলা বৃক্ষে ফল দান, বন্য জন্তু এবং কীট প্রতঙ্গ থেকে ফসল রক্ষা, বেলায়তি ক্ষমতায় সন্তানদান, অল্প খাদ্যে অনেক লােকের আপ্যায়ন, অল্প দ্রব্য অসংখ্য লােকের মধ্যে বন্টন, সাগর ডুবিতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার, ডুবন্ত স্টীমারকে নিরাপদে উদ্ধার, অলৌকিকভাবে বাঘের মুখে লােটা নিক্ষেপে ভক্ত উদ্ধার, বাঘের হঠাৎ আক্রমণ থেকে ভক্ত উদ্ধারে অলৌকিক উপস্থিতি, মৃত্যুকালে আজরাঈল ফেরত এবং আয়ু বৃদ্ধি, লাঠির আঘাতে খালের গতি পরিবর্তন, নানা বিপদে আপদে উদ্ধার ও দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্তি প্রভৃতি অসংখ্য কারামাতাবলী সর্বজন বিদিত।

হযরত গাউসুল আ’যম’র মুখনিসৃত মণিমুক্তার ক’টি: 
(ক) “নবী করিম (দ.) এর নিকট দুটি টুপি ছিল, তিনি একটি আমার মাথায় এবং অপরটি হযরত পীরানে পীর ছাহেবের মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন।”এ অমূল্য ঘােষণার মাধ্যমে গাউসুল আ’যম একজন কিংবা দু’য়ের অধিক বিতর্কের দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছে।
(খ) “হাশরের দিন আমি প্রথম বলিব লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” যারা মাইজভাণ্ডারীদের শিরিক-কুফরের অপবাদ দেয় তাদের উত্তর প্রদত্ত হয়েছে।
(গ) “কবুতরের মত বাছিয়া খাও।” কবুতর শান্তির প্রতীক আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি পেতে চাইলে শরীয়ত নির্ধারিত হালাল হারাম বেছে চলা উচিত; এমন শিক্ষাই এখানে প্রদত্ত হয়েছে।
(ঘ) “কুরআন শরীফ তিলাওয়াত কর”। কুরআন সমুদয় বিষয়ের বিশদ বর্ণনা সমৃদ্ধ অর্থাৎ সকল সমস্যা কুরআনিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।
(ঙ) “ছালাতুত্ তাছবীহ্ ও তাহাজ্জুদের নামায পড়।” যা নফল নামাজ।
(চ) “আইয়ামে বীজের রােজা রাখ, আমার ছেলেরা সব সময় রােজা রাখে।” উক্ত বাণী দ্বারা অপপ্রচারের প্রতিরােধ করা হয়েছে। যেখানে মুস্তাহাব রােজা রাখার তাগাদা আছে সেক্ষেত্রে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত রােজাকে অস্বীকারের প্রশ্নই অবান্তর। আর শেষােক্ত বাণীর জীবন্ত পরিচায়ক হযরত বাবা ভাণ্ডারী। তিনি সাধনা অবস্থায় সারা বছরই রােজা রেখেছেন। তাহাজ্জুদ নামাজসহ বিবিধ নফল নামাজে রত থাকতেন।
(ছ) “নিজের হাতে পাকাইয়া খাও, পরের হাতে পাকানাে খাইওনা।” উক্ত রূপক বাণী দ্বারা পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে কর্মতৎপর হতে নির্দেশ দিয়েছেন।

পরমাত্মার সাথে মহামিলন: সৃষ্টির মহানীতি অনুসারে হযরত গাউসুল আ’যম শাহসূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) ৭৯ বছর বয়সে সকলকে দৃশ্যত অনুপস্থিতির শােকে জর্জরিত করে ১৩১৩ বিশুদ্ধ মতানুসারে ১৩১২ বঙ্গাব্দের ১০ মাঘ (হিজরী ১৩২৩ সনের ২৭ জিলকদ, ১৯০৬ ইংরেজী, ১২৬৮ মঘী) সােমবার দিবাগত রাত একটার সময় তাঁর পরম প্রিয়তম একমাত্র মাহবুব মহান আল্লাহর সাথে শুভমিলনের জন্য বিশ্ববাসীকে ছেড়ে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে আত্মগােপন করে পরমাত্মার সান্নিধ্যে পবিত্র অমরধামে গমন করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন)। তবে বিশ্বমানবকে এ কথা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, তিনি এরপরও সর্বকালে সর্বস্থানে আলােকিত এবং তার ঐশী প্রেমের আকর্ষণে খােদা প্রেমের সাগর সদা জোয়ার-মহিমান্বিত, প্রেমের বাগিচা চির বসন্তে উজ্জীবিত।

[“শানে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.) প্রবন্ধ সম্ভার-১”  উরসে হাদীয়ে যমান (রাদ্বি.) স্মারক গ্রন্থমালা -২ হতে]

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *