মাওলা-ই কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু
(ষষ্ঠ পর্ব)
🖊আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
মিনতি: প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবার আগেই আয়াতে তাত্বহীরালোকে সংশোধনী আনুুন।
সংকেত: উত্থাপ্য প্রশ্নাবলীর অনিঃশেষ ধারা অনুধাবনে প্রশ্নবোধন দেখুন।
পূর্বধারাবাহিকতায় আজকের আলোচ্য পাঠক মাত্রই অবগত আছেন। মূল আলোচ্যে আসার পূর্বে মাওলা আলী মুশকিল কোশা (রা.)’র শান সংশ্লিষ্ট একটি আয়াতের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। হযরত সৈয়্যদ আলী বিন উসমান জালাবী আরমা’রূফ দাতা গঞ্জে বখ্শ লাহূরী (রা.) বিরচিত ‘কাশফুল মাহজূব’র এর উর্দু অনুবাদ ‘তারজুমাঃ ই কাশফুল মাহজূব’ এর নিন্মোক্ত উদ্ধৃতি সমনোযোগ পাঠ করুন।
جب حضرت علی کرم اللہ وجھہ حضور علیہ الصلوۃ والسلام کے بسترپر سوئے اورحضور علیہ الصلوۃ والسلام حضرت ابو بکر صدیق رضی اللہ تعالیٰ عنہ کے ساتھ مکہ مکرمہ سے باہر غار میں تشریف لائے ۔ اور اسی رات کفار نے حضور علیہ الصلوۃ والسلام کو قتل کرنے کا پروگرام بنایا ہوا تھا ادہر اللہ تعالیٰ نے حضرت جبرائیل اور حضرت میکائیل علیھما السلام کو کہا کہ میں نے تم دونوں کے درمیان برادری والا تعلق رکھا ہوا ہے اور ایک کی زندگی دوسرے کی زندگی سے زیادہ کی ہوئی ہے ۔ تم دونوں میں سے کون ہے جو اپنے بھائی پر اپنی زندگی کا ایثار کرے اور اپنی موت کو اختیار وپسند کرے ۔ دونوں فرشتوں نے اپنے لئے زندگی کو اختیار کیا ۔ اللہ تعالیٰ نے حضرت جبرائیل اور حضرت میکائیل علیھما السلام کو کہا کہ حضرت علی رضی اللہ تعالیٰ عنہ کی عزت ومرتبہ و شرف کو دیکھو کہ انہوں نے حضور علیہ الصلوۃ والسلام کو فضیلت دی ہے۔ حالانکہ ان کے درمیان بھی میں نے برادری والا تعلق رکھا ہوا ہے۔ اور حضرت علی نے قتل اور موت کو اپنے لئے قبول کرلیا اور حضور علیہ الصلوۃ والسلام کے بستر مبارک پر جاکر سوگئے ۔ اپنی جان کو انپر فدا اور اپنی زندگی کا ان پر ایثار کردیا)اور(ذات کی ھلاک ہونے کو قبول کرلیا۔ اللہ تعالیٰ نے دونوں فرشتوں کو کہا کہ تم دونوں زمین پر جاو اور حضرت علی کو دشمن سے محفوظ رکھو۔ دونوں فرشتے آئے ۔ اور ایک فرشتہ سرکے طرف بیٹھا اور دوسرا پاوں کی طرف بیٹھا۔ حضرت جبرائیل علیہ السلام نے کہا =
بخ بخ من مثلک یا ابن ابی طالب ان اللہ تعالیٰ یباہی بک علی ملائکتہ ترجمہ = تیری طرح کون ہے اے ابو طالب کے بیٹے کہ اللہ تعالیٰ تمام فرشتوں سے زیادہ تم پر فخر کرتا ہے۔ اور تو اے علی بہترین و عمدہ نیند میں سویا ہوا ہے ۔
اس وقت اللہ تعالیٰ نے آپکی شان میں یہ آیت نازل کی =
ومن الناس من یشری نفسہ ابتغاء مرضات اللہ واللہ رؤف بالعبادہ =
অর্থাৎ ‘যখন হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহাল করীম হুযূর আলায়হিস সালাতু ওয়াসসালাম’র বিছানায় শূয়ে, হুযূর আলায়হিস সালাতু ওয়াসসালাম হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) কে নিয়ে মক্কার বাইরে গুহায়; আর ওই রাতই কাফিররা হুযূর আলায়হিস সালাতু ওয়াসসালামকে শহীদ করার ষড়যন্ত্র করেছিল। ওইদিকে আল্লাহ তা‘আলা হযরত জিব্রাঈল ও মিকাঈল আলায়হিমাস সালামকে বললেন, আমি তোমরা উভয়ের মধ্যখানে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রেখেছি এবং একজনের হায়াত অন্যজনের অপেক্ষা দীর্ঘতর করেছি। তোমাদের মাঝে কে নিজের জীবনকে আপন ভাইয়ের ওপর উৎসর্গ করবে এবং নিজের মৃত্যু গ্রহণ করবে? উভয় ফিরিশতা আপন আপন জীবনকেই পছন্দ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের বললেন, হযরত আলী (রা.)’র মর্যাদা-মাহত্ম্য দেখো, তিনি হুযূর আলায়হিস সালাতু ওয়াস সালামকে নিজের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন; অথচ তাঁরা উভয়ের মাঝেও আমি ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রেখেছি। হযরত আলী (রা.) ক্বতল বা হত্যা ও মৃত্যুকে নিজের জন্য গ্রহণ করে হুযূর (দ.)’র বিছানায় গিয়ে শূয়ে আছেন। নিজের জীবনকে হুযূর (দ.)’র ওপর উৎসর্গ করে নিজের জন্য মরণ কবুল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা দুই ফিরিশতাকে নির্দেশ দিলেন, পৃথিবীতে যাও, হযরত আলী (রা.)কে শত্রু হতে সংরক্ষিত রাখো। উভয় ফিরিশতা এসে একজন শিহরে অন্যজন পদপ্রান্তে বসলেন। জিব্রাঈল (আ.) বললেন, ‘সাবাশ! সাবাশ! হে আবু তালিবের বেটা! তোমার মতো কে? আল্লাহ তা‘আলা আপন ফিরিশতাদের নিকট তোমাকে নিয়ে গর্ব করেন।’ হে আলী! তুমি উত্তম নিদ্রায় ঘুমন্ত!
ওই সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শানে ‘লোকদের মাঝে তিনিও রয়েছেন, যিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রাণ বিক্রয় করে দেন; এবং আল্লাহ আপন বান্দার প্রতি অতি মেহেরবান’ [সূরাহ বাক্বারাহ ২০৭ নম্বর আয়াত] অবতীর্ণ করেন। (তারজুমাঃ-ই কাশফুল মাহজূব ২৭৬-২৭৭ পৃষ্ঠা)।
সুবহানাল্লাহ! উক্ত আয়াতালোকে মাওলা-ই কায়িনাত (রা.)’র শান-মান-মর্যাদা একবার ভাবুন। এতে সুস্পষ্ট যে, তিনি (রা.)’র প্রাণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিক্রিত, সুতরাং ওই সত্তার সমুদয় কার্যবলী আল্লাহর মর্জি মুত্বাবিক; সেখানে মুখালাফাত অকল্পনীয়।
মিনতি: প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবার আগেই আয়াতে তাত্বহীরালোকে সংশোধনী আনুুন।
আহলে বায়তে আত্হারের পবিত্রতা: সূরাতুল আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াত তথা আয়াতে তাত্বহীর আলোকে আহলে বায়তে পাক শুধু হারাম থেকে পবিত্র নন বরং প্রত্যেক নিন্দনীয় অবস্থা ও চরিত্র থেকেও পবিত্র। এক কথায় পবিত্রতার চূড়ান্ত সীমায় তাঁরা উপণীত, ওখান থেকে অবনমন হতে পারে এমন সাধারণ ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকেও তাঁরা মুক্ত।
হারাম রিজসের একমাত্র প্রকার নয় বরং বহু প্রকারের একটি। মদ হারাম হওয়ার পূর্বেও রিজস ছিল। সুতরাং হারামমুক্ত মর্মীয় ব্যাখ্যায় তাঁদের পবিত্রতার পূর্ণস্বীকৃতি হয়না।প্রকারান্তরে এটি কুরআনে পাকের আয়াতের বিপরীত অবস্থান গ্রহণের নামান্তর।
এ বিষয়টির ইঙ্গিত ‘মাওলা-ই কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ’ (চতুর্থ পর্বে) উদ্ধৃত মুহাদ্দিস আহমদ বিন হাজার হায়তমী মক্কীর আসসাওয়া-‘ইকুল মুহরিক্বাহ’র উদ্ধৃতিতে বিদ্যমান রয়েছে। সকলের জ্ঞাতার্থে তা পুনরুল্লেখ করা হল।
هذه الاية منبع فضائل أهل البيت النبوي لاشتمالها علي غررمّن ماثرهم والاعتناء بشأنهم حيث ابتدئت ب “انّما” المفيدة لحصر ارادته تعالي في امرهم علي اذهاب الرجس الذي هو الاثم … وتطهير هم من سائر الاخلاق والاحوال المذمومة –
অর্থাৎ ‘এ আয়াত নবী পরিবারের কৃতিত্বাদির শুভ্রতা ও তাঁদের বিষয়ে তত্ত্বাবধান ব্যাপকতা হেতু তাঁদের মর্যাদার উৎস। যেহেতু সমুদয় নিন্দনীয় অবস্থাদি ও আচরণাদি হতে পবিত্রকরণ এবং অপবিত্রতা, যা পাপ, … তা বিদূরণে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাকে সীমাবদ্ধকরণের উপকার প্রদায়িনী ‘ইন্নামা-’ যোগে শুরুকৃত’।
সূত্র: আস সাওয়া-য়িকুল মুহরিক্বাহ ১৪৪-১৪৫ পৃষ্ঠা।
وحكمة ختم الاية بتطهير المبالغة في وصولهم لاعلاه وفي رفع التجوز عنه‘ ثم تنوينه تنوين التعظيم والتكثير ولااعجاب المفيد الي انه ليس من جنس ما يتعارف ويؤلف –
‘আয়াতের সমাপ্তি তাত্বহীর বা পবিত্রকরণ শব্দে করার মাঝে হেকমত হল, পবিত্রতার চূড়ান্ত শিখরে তাঁদের উপনয়নে অধিকতর নিশ্চয়তা ঘোষণা এবং তা থেকে অবনমন বারণ। অতঃপর তার তানভীন সম্মান, আধিক্য ও বিস্ময় বোধক তানভীন; যার মর্মার্থ হচ্ছে ওই সবকিছু এক জাতীয় নয় যে, পর্যায়ক্রমিক পরিচয় করে দেওয়া হবে অথবা ধারাবাহিক সংকলন করা যাবে’। প্রাগুক্ত ১৪৫ পৃ.।
উক্ত বর্ণনালোকে সুস্পষ্ট যে, শুধু অপবিত্র বস্তু হতে তাঁদের পবিত্র করা হয়নি, বরং উত্তম আদর্শের বিপরীত সমুদয় কিছু থেকেও তাঁদের পূত করা হয়েছে; যার পরিসংখ্যান-পরিগণন অসম্ভব।
সংকেত: উত্থাপ্য প্রশ্নাবলীর অনিঃশেষ ধারা অনুধাবনে প্রশ্নবোধন দেখুন।
এখানে আমি আমার বোধের অগম্য কিছু বিষয় জ্ঞানীদের কাছে জানতে চাই। প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ-জ্ঞানী-গুণীদের বচন ‘প্রাক-ইসলামী যুগে সমগ্র আরব সমাজে মদ ও জুয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। শুধু তা নয়, মদ তথাকথিক আভিজাত্যের প্রতীক ছিলো’। কেউ কি বলবেন, তথাকথিত আভিজাত্য জিনিসটা কি? এটা কি দোষ বিবেচিত, নাকি গুণ?
আমি কিন্তু ইংরেজী অজানা লোকটির মতোই উত্তর দিবো, এ ‘তথাকথিত আভিজাত্য’ ওই অভিজাত জ্ঞানী-গুণীদের চৌদ্দ গোষ্ঠিকে মোবারক হোক, আমার নবী (দ.)’র পরিবারে নয়।
আরো জানতে ইচ্ছা করে, মদের বিধান সংশ্লিষ্ট চারটি আয়াত উদ্ধৃত করে কেবল একটি আয়াতের বিতর্কিত ও বিকৃত সববে নুযূলের অবতারণা কেন? ওখানে হযরত আলী (রা.)’র নাম যুক্ত করা কোন নিয়্যাতে? ‘পরবর্তীতে আরো এক ঘটনায় মদ্যপান করে সাবাহা-ই কেরামের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটলে মদ্যপান হারাম মর্মে চূড়ান্ত আয়াত নাযিল হয়’ উল্লেখে কারো নাম- পরিচয় গোপনের চেষ্টা করা হয়েছে, নাকি সকল সাহাবা-ই কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে নির্বিশেষে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা? এখানে ‘কতেক’ জুড়ে দেওয়া কি সমীচীন ছিলনা? সত্য তুলে ধরার মহান ব্রতে নিয়োজিত হযরাতে কিরাম পরবর্তী ঘটনাটার সবিস্তার বর্ণনা কেন লিপিবদ্ধ করলেননা? সত্য-সঠিক ঘটনা জানিয়ে দিতে কোন পিছপা হলেন?
অ- হ্যাঁ! যারা ক্বা-লা আর ক্বা-লূ এর মারপ্যাচে অন্যকে ঘায়েলে ব্যস্ত, আয়াতে তাত্বহীর আর তাহরীমে খামর এর অবতরণ কাল নিয়ে অথৈ জল ঘোলার চেষ্টায় হাত-পা ছুড়ন্ত, তাদের খিদমতে আবেদন لاتقربوا الصلواة وانتم سکٰرٰی আয়াতটি মদ সম্পর্কে অবতীর্ণ দ্বিতীয় আয়াত নাকি তৃতীয়? এটি কোথায়, কখন নাযিল হয়েছিল? হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.)’র ঘরের ভোজন সভা ও মাগরিবের নামাযে কি নবী করীম (দ.)ও ছিলেন?
কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, এ অবান্তর-অনর্থক প্রশ্নমালার মানেটা কি? আসলে পরিপূর্ণ সাবধানতায়! লিখিত গ্রন্থের একটি বাক্যই আমার মতো বোকা পাঠককে এত্তো প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিল। লকডাউনের দিনে বড় কষ্টে সংগৃহীত সপ্তম সংস্করণের ৪৯৩ নম্বর পৃষ্ঠা হতে ওই বাক্যটি হুবহু সংকলন করছি।
‘মদ্যপান সম্পর্কে দ্বিতীয় আয়াত নাযিল হয় হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ঘরে’।
এ তো গেল প্রশ্নবোধন, প্রশ্নের অনিঃশেষ ধারা এখনো তোলা রইল। আশা করি নামাতে হবেনা; তদপূর্বে সংশোধনী আসবে।
এবার ওই আয়াতটির প্রতি একটু মনোযোগ আকর্ষণ করছি, যেটির সববে নুযূল নিয়ে এত্তো এত্তো কথা হচ্ছে। ইরশাদ হচ্ছে, ياايها الذين امنوا لا تقربوا الصلواة وانتم سکٰرٰی حتي تعلموا ماتقولون ‘অহে যারা ঈমান এনেছো মুহাম্মদ (দ.) ও কুরআনের ওপর, তোমরা নেশাগ্রস্তাবস্থায় নামাযের নিকটবর্তী হয়োনা; যাবৎ যে, জানবে-বুঝবে, যা (মুখে) বলছো’ (সূরা নিসা ৪৩ নং আয়াতাংশ)।
আয়াতাংশের আলোচ্যে কোন প্রকার অস্পষ্টতা নেই। এতে স্পষ্ট যে, আয়াতটি তাঁদের ক্ষেত্রে প্রজোয্য, যারা নেশাগ্রস্ততা হেতু কি বলছেন বলতে পারেন না। এখন হযরত আলী (রা.)’র বেলায় আয়াতটি প্রয়োগের যৌক্তিকতা বিবেচনা করুন। তিনি (রা.)ই-তো ওইদিন মাগরিবের নামাযে কি ঘটেছিল, তার বর্ণনাকারী! কি বলা হচ্ছে না জানলে বর্ণনা অসম্ভব, আর বর্ণনা করলেন-তো না জানা অসম্ভব। সুতরাং আয়াতটি মাওলা আলী (রা.)’র ক্ষেত্রে প্রয়োগ যুক্তির নিরিখে তথা ‘আক্বলান’ বিবেকগ্রাহ্য ভাবে পরিত্যক্ত।
আলোচিত আয়াতের শানে নুযূলে বর্ণিত বর্ণনাদির তাত্ববীক বা সামঞ্জস্য সাধন সময় সাপেক্ষ। ইনশা-আল্লাহ সময়-সুযোগ মতো আলোচনা করা হবে।
মা‘আস সালাম।
চলমান…