🖋️আল্লামা বোরহান উদ্দিন মুহাম্মদ শফিউল বশর (ম.জি.আ)
“ওয়ারিসে রাসূলে খোদা হূ তুম,
নায়িবে আসাদুল্লা-হ হী হূ তুম,
আয় গুলে গুলাবে বুস্তানে যাহারা!
আ-পকো হামারা সালাম হূ,
আ-পকো হামারা সালাম হূ।
বাহর হূ তুম উলূম কা,
মকবূল হূ তুম গাউসে আ’যম কা,
মখদূম হূ তুম খলা-য়িক্ব কা,
আ-পকো হামারা সালাম হূ,
আ-পকো হামারা সালাম হূ।”
আল্লামাহ মকবূল কাঞ্চনপুরী রাদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারী’র সত্তা পরিচয়দানের মুখাপেক্ষী নয়। তিনি আপন মুর্শিদ ইমামুত্ত্বরীক্বত গাউসুল আ’যম হযরত শাহসূফী সৈয়্যদ মাওলানা আহমদুল্লা-হ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কর্তৃক মকবূল বা গৃহীত, কবুলকৃত খেতাবে ধন্য। তিনি সমসাময়িক ওলামাদের মাঝে বাহরুল উলূম বা জ্ঞানের সাগর অভিধায় বিভূষিত। তাঁর সম্পর্কে অছিয়ে গাউসুল আ’যম হযরত শাহসূফী সৈয়্যদ দিলাওর হুসাইন মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র কলম নিঃসৃত, “তিনি একজন তত্ত্বজ্ঞানী আলেমে কামেল অলি উল্যাহ ছিলেন। তাঁহার সমসাময়িক লোকেরা তাঁহাকে ‘বাহরুল উলূম’ বা ‘জ্ঞান সাগর’ বলিয়া অভিহিত করিতেন। তিনি হযরত গাউছুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারী’র ফয়েজ প্রাপ্ত খলিফাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন” (বেলায়তে মোতলাকা ৪৩পৃষ্ঠা)।
আইনায়ে বারী থেকে ভাষান্তরিত “কারামাতে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী” নামে ২০০৬ সনে প্রকাশিত গ্রন্থে আমি তাঁর সম্পর্কে “আইনায়ে বারী প্রণেতার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি” শিরোনামের নাতিদীর্ঘ একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তথ্যাভাবে তাতে যে ঘাটতি ছিল, তথ্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে তা শোধরিয়ে নিতেই আজকের প্রয়াস। বিশেষত তাঁর পবিত্র বার্ষিক উরসে পাক উপলক্ষে ক্ষুদ্র হাদিয়াহ্-নযরানাহ্। তাঁর ভাই-পৌত্র মাওলানা সৈয়্যদ আবুল কাসিম মদ্দাজিল্লুহুল আলীকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণের দায়ও কিছুটা কার্যকারণ।
নাম: বাহরুল উলূম আল্লামাহ মাওলানা সৈয়্যদ আবুল বরাকাত মুহাম্মদ আব্দুল গনি আস্সাফী আল্ মক্ববূল কাঞ্চনপুরী রাদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারী।
জন্ম: তাঁর ভাই আল্লামাহ সৈয়্যদ আব্দুস সালাম ভূজপুরী রাদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারীর “আপ্ত দর্পণ” সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, “বুধবার, শ্রাবণ,১২২৯ মগি”। তদমোতাবেক ১২৭৪ বঙ্গাব্দ, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ।
কবিতার ভাষায় বলার মোহ আমার আশৈশবের। কাব্যিক হল কিনা, তা নয়, স্বাচ্ছন্দ্যে বলাটাই মুখ্য।
“বর্ষণ-মুখর শ্রাবণের শুভ বুধবার,
এসেছিলেন ধরণীতে;
বর্ষিয়ে জ্ঞান-বারি পুস্পখুশবোদার,
ফুটাইতে এ অবনীতে”।
বংশ: তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর, তাঁর নসবনামা নিম্নরূপ-
সৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুল গনি ইবনে হাফিয মাওলানা সৈয়্যদ আব্দুল ওয়াহ্যাব ইবনে সৈয়্যদ সূফী মাওলানা মুহাম্মদ বুরহানুদ্দীন ইবনে আল্লামাহ সৈয়্যদ মুহাম্মদ আশরাফুদ্দীন ইবনে সৈয়্যদ সূফী সাদেক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহিম।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা: সৈয়্যদ সূফী সাদেক্ব (রা.) ধর্ম প্রচারার্থে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে ফটিকছড়ির ধুরং এসে বসতি স্থাপন করেন।তাঁর বংশধর কাঞ্চনপূরী (রা.)’র পিতা হাফিয মাওলানা সৈয়্যদ আব্দুল ওয়াহহাব (রা.) বোচা উকিল প্রতিষ্ঠিত কাঞ্চনপূর জামে মসজিদের খেত্বাবত ও ইমামতের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে তথায় সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। অনুচ্চ পাহাড়ের কোলে, সবুজ বৃক্ষরাজির ছায়াঢাকা, মায়াময় প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরশেই কাঞ্চনপুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়। তিনি আপন পিতার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সুসম্পন্ন করেন।
সফর ও উচ্চ শিক্ষা: উচ্চ শিক্ষা অর্জনে তিনি কলিকাতা সফর করেন। কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন করে কুরআন হাদীস, তাফসীরসহ বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন পূর্বক সফলতার সাথে সমাপনী সনদ লাভ করেন।
ত্বরীক্বতের দীক্ষা ও অধ্যাত্মিক জ্ঞান: জনশ্রুতি আছে, তিনি প্রথম জীবনে মাইজভাণ্ডার দরবারের বিরােধী ছিলেন। তাঁর ভাই মওলানা আব্দুল হাদী রাদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারী ছিলেন গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারীর মুরিদ ও খলিফা। উভয়জনের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রায় সময় তর্ক-বিতর্ক হতাে। তাই তিনি ঘরের উঠানে ৮ হাত লম্বা বেড়া দেন, যাতে হাদী সাহেব কেবলার মুখ না দেখেন। ঘটনাক্রমে একদা রাত্রে আল্লামা হাদী সাহেব কেবলা (রাদ্বি.) বেহালা বাজিয়ে মাইজভাণ্ডারী গান গাইতেছিলেন। গানের সুর আল্লামা মকবুল (রাদ্বি)কে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করল। তিনি বেড়া ডিঙ্গিয়ে হাদী (রাদ্বি)’র ঘরের দরজায় উপস্থিত হয়ে দরজা খুলতে বললে হাদী (রাদ্বি.) প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে অত্যধিক মিনতির কারণে দরজা খুলে দেন। তিনি গুলিবিদ্ধ পাখির ন্যায় ছটফটাতে ছটফটাতে প্রবেশ করে বলেন, “আমার কোন গতি কর। তােমার গানের আকর্ষণে আমার হৃদয় তন্ত্রীতে প্রেমের বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলছে, এতে সর্বাঙ্গ জ্বলছে। এ জ্বালা কিসে নিবারণ করব উপায় বাতলিয়ে দাও।” আল্লামা হাদী (রাদ্বি.) বলেন, “আমিও আপনার মত একই রােগের রােগী, আমি আপনার চিকিৎসা করতে পারবাে না। আপনার সাথে আমার তফাৎ হচ্ছে আমার চিকিৎসক আছে আপনার নেই; সুতারাং আপনি ইস্তেখারা করুন।” আল্লাহর অপার মহিমায় তাঁর ভাগ্যের দুয়ার খুলে গেল। উক্ত রাতেই তিনি স্বপ্নে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারীর দর্শন লাভ করেন এবং দরবারে যেতে আকুল হয়ে পড়েন। পরদিন প্রাতে তাঁর ভাই হাদী রহমতুল্লাহি আলাইহির সাথে দরবারে পাকে গিয়ে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারী’র শিষ্যত্ব গ্রহণে ধন্য হন। অতঃপর নিয়মিত আপন মুর্শিদে কামেলে মুকাম্মেলের দরবারে আসা-যাওয়া করতে থাকেন।
গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারী তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন এবং স্নেহ করে মকবুল বলে ডাকতেন। ত্বরীক্বতে দাখিল হওয়ার পর সমস্ত জীবন মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বার খেদমতে উৎসর্গ করেন।
কর্মজীবন: তিনি কলিকাতা থেকে এসে মিরসরাই লতিফিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। অতঃপর বােচা উকিল প্রতিষ্ঠিত কাঞ্চনপুর জামে মসজিদে ইমামতি করেন। সেখানে মসজিদের মুতাওয়াল্লী আব্দুল গণি চৌধুরী তাঁকে বলল, “আপনি ইমামতি প্রত্যাশী হলে মাইজভাণ্ডার ছাড়ুন আর মাইজভাণ্ডারে গেলে ইমামতি ছাড়ুন; দুইটার একটা গ্রহণ করুন, উভয়টি এক সাথে করতে পারবেন না।” প্রত্যুত্তরে তিনি “আমি ইমামতির লালায়িত নই, তােমার এই গরু ঘরে পেশাব (প্রস্রাব) করে দিলাম।” বলে মাইজভান্ডার বিরােধী লােকের সমাগমে সােজা মসজিদ থেকে বের হয়ে খড়ম পায়ে পানির উপর দিয়ে হেঁটে পুকুরের পূর্ব পাড়ে চলে যান। অতঃপর উক্ত বােচা উকিল বাড়ীর কিছুদূর পূর্বে এসে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে অলির মার জামে মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হন এবং প্রায় ২৪/২৫বছর ইমামতি করেন।
চরিত্র ও মর্যাদা: তিনি নম্র-ভদ্র, উদার প্রকৃতির সাদা-সিদে জীবন যাপনে অভ্যস্ত, সুন্নতে মুস্তফার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তাঁর মত উদার ব্যক্তি বিরল। কথিত আছে যে, যেই আবদুল গণি চৌধুরী তাঁকে মসজিদ থেকে বের করেছে, সমাজ জীবনে আরাে বহু কষ্ট দিয়েছে সেই আবদুল গণি চৌধুরী মারা গেলে তিনি জানাযার ইমামতি করেন এবং একথা বলেন যে, ‘সে আমার বড়ই বন্ধু ছিল। যদি আমি
পুলসিরাত পার হতে পারি তাহলে তাকেও পার করাব।’ শত্রুকে এমন নিঃস্বার্থ ক্ষমা করতে পারে এমন লােক সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তিনি وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ আয়াতের বাস্তব নমুনা ছিলেন।
রচনাবলী: তিনি ইসলামী ধর্মদর্শন ও মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বা দর্শন সম্বন্ধে আরবী, ফার্সী, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় বহু অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। নিন্মে তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর নাম উল্লেখ করা হল।
১. আইনায়ে বারী ফি তরজুমাতে গাউসিল্লাহিল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রদ্বিয়ানহুল্লাহুল বারী। গ্রন্থটি আরবী, উর্দু, ফার্সী ও হিন্দি ভাষার সংমিশ্রণে রচিত। তাঁর সুযােগ্য সন্তান মওলানা ছৈয়্যদ মুহাম্মদ ফজলুল বারী (রাদ্বি.)’র অনুমতিক্রমে মওলানা সৈয়্যদ দিলাওর হােসাইন মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.) কর্তৃক বিংশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে ইসলামীয়া ইমপ্রিন্টিং প্রেস চন্দনপুরা চট্টগ্রাম থেকে গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়। অধমের নিকট সংরক্ষিত কপিটিতে মুদ্রণ সনের উল্লেখ নেই। তবে লেখক ১৪ জমাদিউসসানী ১৩৩০ হিজরী বুধবার আসরের নামাজের সময় লিখে শেষ করেন বলে কিতাবের শেষ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন।
২. প্রেম দর্পণ ৩. গুলশানে উশশাক প্রথম মুদ্রণ ১৩২৮ বাংলা, দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৪০২ বাংলা, ২ ও ৩নং পুস্তকদ্বয় অধ্যাত্ম চেতনায় স্বীয় মুর্শিদের নিবেদনে রচিত। ৪. আত্মপাঠ, ৫. আত্ম পরিচয়, ৪ ও ৫নং এ দু’টি পয়ার ছন্দে তত্বমূলক পুস্তক। ৬. মুশাহেদায়ে মকবুলিয়া মিন ফয়ূজাতে গাউসিয়াতিল অহমদীয়া, ৭. পন্দনামা ৮. মজাকে ইশক (দিওয়ানে ছফী), ৯. দিওয়ানে মকবূল ১০. জ্ঞান দর্পণ, ১১. শরহুল মুনাব্বেহাত ১২. তনকীহুল মফহুম ১৩. শরহে কুল্লিয়াতে খাকানী ও ১৪. জলওয়ায়ে নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইত্যাদি। (৬-১৪) নং পর্যন্ত ৯টি গ্রন্থ অপ্রকাশিত।
প্রভুমিলন: আপ্ত দর্পণ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, তিনি ২৫ রবিউস সানী, ৫ কার্তিক ১২৮৯ মগি,২২ অক্টোবর শনিবার দিবাগত রাত নয়টার সময় প্রভু-মিলনে পরলোকগত হন।উল্লেখ্য যে, চান্দ্র বর্ষীয় দিন সূর্য অস্তান্তে শুরু হয় বিধায় তা হবে ২৬ রবিউস সানী।
২৬ রবিউস সানী ১৩৪৫ হিজরী,
০৫ কার্তিক ১২৮৯ মগি, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ,
২২ অক্টোবর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ; শনিবার।
প্রতি বছর ০৬ কার্তিক কাঞ্চনপুর দরবার শরীফে তাঁর উরসে পাক উদযাপন হয়।
আল্লাহ এ মহামানবের ফুয়্যূদ্বাত সকলের জন্য অবারিত করুন। আমিন, বিহুরমতি সৈয়্যদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লামা।