হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র প্রশংসায় তাঁর খুলাফায়ে ইযাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম

হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র প্রশংসায় তাঁর খুলাফায়ে ইযাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম

✍️ মাওলানা তৌহিদুল আনােয়ার মুহাম্মদ আব্দুল হাই আল্ হারূনী
সমস্ত প্রশংসার একমাত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলীর বিকাশ এবং পরম প্রশংসিত নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র পরিপূর্ণ অনুগামী উত্তরসূরী গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র পূর্ণাঙ্গ প্রশংসা বর্ণনা সাধ্যাতীত। বাহরুল উলুম বা জ্ঞানের সমুদ্র খ্যাত ব্যক্তিত্ব অকপটে বলেন,
“গাউসে ধনের মর্ম ভবে সত্য মতে কেবা জানে?
শরীয়তে বান্দা দেখি হাকীকতে খােদা জানে।
প্রভু আর তান মর্ম ভবে কে জানিবে বল,
প্রভুর মর্ম তিনি জানে তানে ভবকর্তা জানে।”
                          -মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ আব্দুল গনি কাঞ্চনপুরী (রা.)

মহান আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর হাবীব মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামার প্রশংসা যেমন প্রত্যেকে আপন আপন শক্তি-সামর্থ্য অনুপাতে করে থাকেন, তেমনি আল্লাহর প্রতিনিধি ও নবীকুল সম্রাট (দ.)’র উত্তরসূরী গাউসুল আ’যম হযরত শাহসূফী সৈয়দ আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র প্রশংসা-কীর্তনও নানা কণ্ঠে নানা ভাষায় ধ্বনিত হয়েছে। আলােচ্য নিবন্ধে আমরা তাঁর খলিফাগণের ভাষায় তাঁর প্রশংসার কিছু অংশ তুলে ধরার প্রয়াস পাবাে।
এক. মুজাদ্দিদে দ্বীন শায়খুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন হযরত আল্লামা সৈয়্যদ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (ক.), যার ব্যাপারে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.) নিজ যবানে বলেন, ‘আমার আমিন মিঞাকে আমার ছয়টি কিতাবের একটি দিয়েছি। যার লিখনীকে কেন্দ্র করে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.)’র পীর-মুর্শিদ মাওলানা সৈয়্যদ আব্দুল হামীদ বাগদাদী (রহ.) বলেন, ‘তাঁর লিখনীতে হীরার ধার আছে।’ যার বিষয়ে শেরে বাংলা (রহ.) বলেন, “মিসলে ঊ হারগিয্ মুহাক্কিক্ব মন নবীনম দর জাহাঁ বা তাঁর মত তত্ত্বজ্ঞানী আমি জগতে কখনাে দেখিনি।” তাঁর লেখিত তুহফাতুল আখইয়ার গ্রন্থখানায় স্বয়ং গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.) স্বাক্ষর করেছেন। ওই তুহফাতুল আখইয়ার গ্রন্থেই তিনি গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র শানে লিখেছেন,
‘সৈয়্যিদুল কাওনাইনি তাজুল আসফিয়া, মুর্শিদুল আফাক্বি ফখরুল আউলিয়া ।
আশরাফুল মাখলুক্বি ফী হাযায্ যমান, রহমতুল্লিল আলামীনা যিল্লুল আমান ।
মুসদরু আনওয়ারি রাব্বিল ‘আলামীন, ক্বিবলাতুত্ তৌহীদি লি-আহলিল ইয়াক্বীন।
ওয়জহুহু মিসলুল মিরাতি লিল্ ওয়ারা, ফীহি ওয়জহুল্লাহি তা‘আলা ইয়ারা।
ক্বাদ বাদা ফীল্ ‘আলামি বদরুল্ কামাল, যালা বিহী মিনহু যল্লামুদ্ দ্বালাল।
সৈয়্যিদুল আবরারি যূল মজদিল ফখীম, গাউসুল মাইজভাণ্ডারী যূল ফদ্বলিল ‘আমীম।’
অর্থাৎ উভয় জগতের সর্দার, আসফিয়াদের মুকুট; বিশ্বজগতের পথপ্রদর্শক, ওলীদের গৌরব। এ যুগে সৃষ্টির সেরা, সমগ্র জগতের রহমত, নিরাপত্তার ছায়া। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নূরসমূহের উৎস, আহলে ইয়াক্বীনদের জন্য তৌহীদের ক্বিবলা । তাঁর চেহরা জগতের জন্য দর্পণ সদৃশ, যাতে আল্লাহর চেহরা দেখা যায়। জগতে পূর্ণচন্দ্রের অভ্যুদয় ঘটেছে, যদ্ধারা সেখান হতে ভ্রষ্টতার আঁধার বিদূরীত হয়েছে। পুণ্যবানদের সর্দার, বিশাল মহত্বের অধিকারী, গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী ব্যাপক অনুগ্রহের মালিক।
দুই. হযরত আকদসের অনুগ্রহ প্রাপ্ত মকবুলে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী;  মাওলানা আব্দুল গনি কাঞ্চনপুরী (ক.), সমসাময়িক আলেমগণ যাকে ‘বাহরুল উলুম’ বা জ্ঞান সাগর অভিহিত করতেন। তিনি হযরতের ফয়েজ প্রাপ্ত খলিফাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, তিনি হযরত আকদস (ক.)’র শান ও ত্বরীক্বা সম্বন্ধে আরবী, ফার্সী, উর্দু ও বাংলায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি তাঁর অমর রচনা আঈনায়ে বারীতে হযরত আকদসের শানে লিখেন-
‘মহাপ্রভুর আসন রবি উদিত হয়েছে, মানবাকারে খােদার গােপন রহস্য প্রকাশ পেয়েছে । ত্রিভুবন যার আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল, আজ সে আশার পুষ্পরাজ প্রস্ফুটিত হয়েছে। যাকে নিয়ে নবীবর আহমদ মুস্তাফা (দ.) গৌরব করতেন, আজ সে গৌরব সূফীদের সার তত্ত্ব খনি জগতে আবির্ভূত হয়েছেন।’ (আঈনায়ে বারী-১৪০ পৃ:)।
‘ওলীদের শিরােমনি, খােদার গাউছ ভবে পদার্পণ করেছেন। জগদবাসীর প্রাণপ্রিয়, সূফীদের লক্ষস্থল ইমাম ভবে তাশরীফ এনেছেন। দু’জগত তাঁর কদম মােবারকের পাদুকা বিশেষ, জগতে শ্রেষ্ঠত্বের বাদশাহের আগমন হয়েছে। (প্রাগুক্ত-১৩৮ পৃষ্ঠা)।
‘হে আমাদের পরিত্রাণকর্তা! বরকত আপনার নিকট, আমরা আপনার দিকে অগ্রগামী এবং আগুয়ান হয়েছি; সদা সর্বদা আপনার প্রতি আল্লাহর পরিপূর্ণ শান্তি আসতে থাকুক। তুমি আল্লাহর মনােনীত গাউসুল আ’যম এবং সম্মানিত কুত্বব। তুমি সর্ব মর্যাদায় একচ্ছত্র ও অদ্বিতীয় ।
আল্লামা কাঞ্চনপুরী (ক.) “গােলশানে ওশশাক” ৪৩ নং গজলে লিখেন,
‘মারহাবা মারহাবা খােদাকা পেয়ারে গাউছুল আ’যম ভাণ্ডারী,
সংসার প্রাণ পাওঁকা ছদকা কেইছি ছুরত তােমহারী ।
কপাল চমক, বিজলী ঝলক নুরে ঝিলী মিলি ইন্দু মুখ,
মােবারক নয়ন, সাফল্য জীবন, যু দেখা পেয়ারে ভাণ্ডারী ।
আর্শকা ছুরজ জমিতে বিরাজ, খােদাকা আজব রহমত হায়,
আল্লাহ নাম জপাইয়ে খােদা পহচানাইয়ে নিতে কলির পাপী নিস্তারী।
খােদাকা কৃপাগুণে ভাণ্ডারী এ ভুবনে বড়ী ইয়ে আযব নেয়ামত হায়,
কলিকা জমানে গােমরাহী তুফানে আয়া হায় কেইছা কাণ্ডারী।’
২০ নং গানে লিখেন,
‘আহমদ মুহাম্মদ নামে মন প্রাণ মধুময়
গাউসে আ’যম মাইজভাণ্ডারী সেই মধু ভাণ্ড হয়।’
তিন. হযরত আকদসের ফয়েজ প্রাপ্ত খলিফা বুল বুল’ খেতাবে ভূষিত আরিফে কামিল হযরত আব্দুল হাদী (ক.) রচিত রত্নসাগর ২নং গজলে হযরত আকদসের কাছে মিনতি করেন,
‘আয় গাউছে মাইজভাণ্ডার মুঝে শরবত পিলা দাও,
তৃষ্ণেগীয়ে দিলকো মেরি আজ বুঝা দো।
তাছকিন কর দিলকো মেরি গাউছে দো’আলম,
শায়দাকো তেরে পায়ে মােবারক পর লুঠা দো’।
৩নং গজলে হযরত আকদসের শানে লিখেন,
‘আয় দেলবরে দেলদারে পেয়ারে গাউছে মাইজভাণ্ডার
মালেকে মলকুত পেয়ারে গাউছে মাইজভাণ্ডার
নূরে রূহী ছিররে ওয়াহদাত গাউছে মাইজভাণ্ডার
আফছরে লাহূত পেয়ারে গাউছে মাইজভাণ্ডার
আফতাবে আর্শে আ’যম গাউছে মাইজভাণ্ডার
আহমদে বে মীম পেয়ারে গাউছে মাইজভাণ্ডার’।
চার. হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র ফয়েজ প্রাপ্ত খলিফা হযরত আব্দুস সালাম ভূজপুরী (ক.); উল্লেখ্য হযরত ভূজপুরী (ক.)কে দাফন করার প্রায় দেড় বছর পর তাঁর পুত্র সৈয়দ মঞ্জুরুল হক ও হাবিবুল হককে স্বপ্নে অন্যত্র দাফন করার আদেশ করেন। গণ্যমান্য ব্যক্তি ও হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে কাফন খুলে দেখেন নুরানী চেহারা হতে বিন্দু বিন্দু ঘাম নির্গত হচ্ছে ও ওষ্ঠদ্বয় নড়ছে। এ মহান ওলী হযরত আকদসের নিকট বেছাল তথা মিলনের আবেদন করে রত্নবিন্দু বইতে লিখেন,
‘আয় গাউছে আ’যম করকে করম মুঝকো দেখা দাও,
আতশে হিজরাকো বেছালতছে বুঝা দাও
কিশতি মেরি ইশক কা দরিয়া মে ডুবা হায়
নজরে মুহাব্বত হে মেরে কিশতি লাগা দাও’।
পাঁচ. সূফী কবি বজলুল করীম মন্দাকিনী (রহ.) “প্রেমের হেম” নামক গ্রন্থে লিখেছেন,
‘মাইজভাণ্ডারীর চরণ তরী, প্রেম সাগরে ভেসে যায়,
ভক্তি মুদ্রা নিয়ে তারা, রসিক জনে পার করায়’।
– (৩নং গান)।
‘ওহে কান্ত মাইজভাণ্ডারী, তুমি পাপ তাপ হারি।
তুমি কেবলা তুমি কাবা, তুমি বাবা তুমি
 মাওলা’।
– ৪নং গান)
‘অবশেষে ভাগ্য বলে, বিভুর করুণা ফলে,
সত্য প্রেমের দীক্ষা নিয়ে, মাইজভাণ্ডারীর আগমন।’
– (৬নং গান)।
‘আসিয়ে তােমার কাছে, শূণ্য করে কে গিয়েছে?
খুলে দাওনা করিমের বন্ধন রে ।’
– (১৫নং গান)
‘করিমের কেবলা কাবা, মাইজভাণ্ডারী মাওলা বাবা।
চিরশান্তি পেয়ে গেছে, যে নিয়েছে তার দাসত্ব।’
– (২৮নং গান)
উল্লেখ্য যে, উদ্ধৃত অংশে খুলাফায়ে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’র এমন কতেক সত্তার বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে, যাদের জাহেরী-বাত্বেনী ইলম ও বেলায়ত শক্তি সর্বজন স্বীকৃত। তাঁদের লিখনীতে হযরতে আকদসের ‘গাউসুল আ’যম’ অভিধা সরাসরি ও নানা ব্যঞ্জনায় ব্যঞ্জিত বিধায় তা-ও সর্বজন স্বীকৃত মতের পর্যায়ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে নানাবিদ কুট-কৌশলে বিতর্কের অবতারণা বাড়াবাড়িরই নামান্তর হেতু পরিতাজ্য।
উক্তরূপ আরাে বহু উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় পরবর্তীতে অন্যান্য খলিফাগণের লিখনী উদ্ধৃত করে লেখার আশা ব্যক্ত করে ইতি টানছি। আল্লাহ সকলের সহায় হােন ।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *