আলীর যিকর ইবাদত
✍️বোরহান উদ্দিন মুহাম্মদ শফিউল বশর
স্বমত প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, কেবল পরমত খণ্ডনের জন্য বাগাড়ম্বরতাকে বিতণ্ডা বলে, বিতর্ক নয়। বিতর্কে সত্য প্রমাণের অপচেষ্টা আর বিতর্কের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন প্রচেষ্টা,দু’টোর মধ্যে ঢের তফাৎ রয়েছে; বর্তমানে প্রথমটি যত্রতত্র সুলভ হলেও দ্বিতীয়টি ঠিক যেন অমাবস্যার চাঁদ!
আজ বড়ই দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে লেখতে বসলাম। আমি সঠিক জানিনা যে, খারিজীয়্যাত- নাসিবীয়্যাত ও রাফিদ্বীয়্যাতের ঢল কূল ভেঙে আমাদের আবাদি ভেসে নিচ্ছে, নাকি আমাদের তরুণ প্রজন্ম জোশে হুঁশ হারিয়ে আত্মহুতির জন্য সেই খরস্রোতা স্রোতস্বিনীতে ঝাঁপ দিচ্ছে! নবপ্রজন্ম যাদের মডেল জ্ঞান করেন, তাঁদের সমুচিত পদক্ষেপ কামনা করছি।
যিকর (ذكر) শব্দটি বহু অর্থের ধারক একটি শব্দ। তদ্মধ্যে যে কোন একটি অর্থের জন্য শব্দটি নির্দিষ্ট করতে গেলে (قرينه اي أمر يشير إلى المطلوب) ক্বারীনাহ্ অর্থাৎ মর্মের প্রতি ঈঙ্গিতবহ বিষয়ের উপস্থিতি জরুরি। ক্বারীনাহ্’র অনুপস্থিতি সত্ত্বেও শব্দটি বহু অর্থের একটি অর্থে নির্দিষ্ট করে কারো বিরুদ্ধে শির্কের অভিযোগ আদল ও ইনসাফের বিপরীত; ইহ্সানতো দূরে থাক!
সম্প্রতি স্বনামধন্য জনৈক গবেষকের “আলীর যিকর ইবাদত’ হাদিসের অপব্যাখ্যার জবাব” শীর্ষক একটি পোস্ট আমার দৃষ্টি গোচর হয়। সেখানে তিনি ‘আলীর যিকর ইবাদত’ শীর্ষক হাদীসে যিকর আলোচনা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এমনটি প্রমাণ করতে গিয়ে লিখেছেন,
“ হাদিসটির সঠিক ব্যাখ্যা:
আমাদের কতিপয় নব্য শিয়াগণ এ হাদিসের অপব্যাখ্যা করে বুঝাতে চান যে, আল্লাহ আল্লাহ নাম জপা যেমনিভাবে ইবাদত তেমনিভাবে আলী আলী নাম জপাও ইবাদত। নাউযুবিল্লাহ! অথচ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় কোন সুফি, কোন হাদিসের ব্যাখ্যাকার এমনটি বলেননি।
মহান রব ইরশাদ করেন- وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
“আমি আপনার জন্য আপনার যিকরকে সম্মুন্নত করেছি।” (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত নম্বর-৪)
উপরের হাদিসে ‘যিকর’ যে অর্থে ব্যবহার হয়েছে এ আয়াতেও ‘যিকর’ শব্দটি সে অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
এ আয়াতের ‘যিকর’ শব্দের ব্যাখ্যায় একদল হাদিসের ইমাম হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রসুল (দ.) ইরশাদ করেন,
أَتَانِي جِبْرِيلُ، فَقَالَ: إِنَّ رَبِّي وَرَبَّكَ يَقُولُ لَكَ: كَيْفَ رَفَعْت ذِكْرَكَ؟ قَالَ: اللَّهُ أَعْلَمُ. قَالَ: إِذَا ذُكِرْتُ ذُكِرْتَ معي
-“আমার নিকট হযরত জিবরাঈল (আ.) আগমন করলেন আর বললেন, আমার রব ও আপনার রব আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, কীভাবে আপনার যিকরকে সম্মুন্নত করা হয়েছে ? তিঁনি (দ.) বললেন, মহান আল্লাহই ভালো জানেন। হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, মহান রব বলেছেন, যখনই আমার ‘যিকর’ (আলোচনা) হবে তখনই আমার সাথে আপনারও আলোচনা হবে।” (ইমাম ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ, হা/৩৩৮২, ইমাম আবু ই‘য়ালা, আল-মুসনাদ, হা/১৩৮০, ইমাম সুয়ূতি, তাফসিরে দুররুল মানসুর, ৮/৫৪৭ পৃ.) ইমাম হাইসামী (রহ.) বলেন, হাদিসটির সনদ ‘হাসান’। (মাযমাউয যাওয়াইদ, ৮/২৫৪ পৃ. হা/১৩৯২২)
উপরোক্ত আয়াত এবং হাদিসে কুদসী থেকে বুঝতে পারলাম ‘যিকর’ শব্দটি আলোচনা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।”
আরো পড়ুন- আলীর যিকর ইবাদত ( পর্ব -দুই )
তাঁর আনীত অভিযোগের ভিত্তি যাচাই সঙ্গত মনে করি।
তাঁর মন্তব্য অনুসারে ذكر علي عبادة ‘আলীর যিকর ইবাদত’ হাদীসে যিকর সেই অর্থেই ব্যবহৃত, যে অর্থে সূরা ইনশিরাহ’র ৪ নম্বর আয়াতে ব্যবহৃত। এখানে তাঁর সাথে আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু উক্ত আয়াত ও তার ব্যাখ্যায় উত্থাপিত আবূ সাঈদ খুদরীর হাদীসে যিকর শব্দের ব্যাপক অর্থের বিপরীতে কেবল আলোচনা অর্থে নির্দিষ্ট করা; আমি কেন, কোন সুন্নীই মেনে নিতে পারে না। কেন পারে না, সেই কারণ বর্ণনায় বড়সড় কিতাবাদির উদ্ধৃতির ঝামেলায় না গিয়ে প্রথমে তাঁর পোস্টের মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হুজুর আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান হাফিজাহুল্লাহ’র লেখনী থেকে একটি উদ্ধৃতি উদ্ধৃত হল।
”وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ“ اور بلند فرمایا ہمنے آپکے ذکر کو-جب جبرائیل علیہ السلام حاضر خدمت ہوئے عرض کیا یا رسول اللہ! اللہ تبارک وتعالیٰ فرماتا ہے کہ اللہ نے آپکی شان کو بلند فرمایا،کیسا بلند فرمایا؟ حضور کریم صلی اللہ علیہ وسلم نے ارشاد فرمایا کہ اللہ جانتا ہے کہ اللہ تعالیٰ نے میری شان کو کیسا بلند فرمایا- تو جبرائیل علیہ السلام نے عرض کیا کہ اللہ تبارک وتعالیٰ نے آپکی شان کو اسقدر بلند فرمایا کہ جہاں اللہ تبارک وتعالیٰ کا نام لیا جائیگا، جہاں اللہ تبارک وتعالیٰ کا ذکر ہوگا وہاں آپکا ذکر ہوگا- اور اللہ تعالیٰ نے فرشتوں سے مسلمانوں سے ارشاد فرمایا آپ پر دورود شریف بھیجو اور آپکی اطاعت کرو، فرمایا ” من یطع الرسول فقد اطاع اللہ “ یعنی جسنے رسول کی اطاعت کی اس نے اللہ کی اطاعت کی، جب اللہ تبارک وتعالیٰ نے حضور کریم صلی اللہ علیہ وسلم کی شان کو بلند فرمایا اب کس کی طاقت ہے کہ آپکی شان کو پست کرسکے؟ جو بدنصیب لوگ ہیں وہ قرآن پاک تلاوت کرتے ہیں، کتابیں دیکھتے ہیں، اسلئے دیکھتے ہیں کہ انکو ایسی کوئی آیت مل جائے، ایسی کوئی روایت مل جائے،ایسی کوئی حدیث مل جائے، جسکے ذریعے وہ لوگوں کے سامنے حضور کریم صلی اللہ علیہ وسلم کی شان کو گٹھا سکیں وہ ایسے بدنصیب لوگ ہیں- تو اللہ تبارک وتعالیٰ جسکی شان کو بلند فرمایا ہے کسکی طاقت ہے اسکی شان کو گٹھائے؟
“এবং সমুন্নত করেছি আমি আপনার স্মরণকে”। যখন হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাঁর পবিত্র দরবারে হাজির হলেন, তখন আরয করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা ফরমাচ্ছেন যে, আল্লাহ তা’আলা আপনার মর্যাদা, আপনার শানকে কেমন সমুন্নত করছেন?” হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ্ই জানেন যে, আমার সম্মান কত সমুন্নত”। তখন হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আরজ করলেন, “আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা’আলা আপনার শানকে এই পরিমাণ সমুন্নত করেছেন যে, যেখানে আল্লাহ তবারাক ওয়া তা’আলার নাম নেওয়া হবে সেখানে আপনার নামও নেওয়া হবে। যেখানে আল্লাহ তাবারকা ওয়া তাআলার স্মরণ করা হবে সেখানে আপনাকেও স্মরণ করা হবে। যেমন (আযানে, খোৎবায়, নামাযে) সর্বত্র যেখানেই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার নাম নেয়া হবে সেখানে আপনার নামও স্মরণ করা হবে”। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা ফেরেশতাগণ ও মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা আপনার উপর দরূদ শরীফ প্রেরণ করেন। আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা‘আলা রাসূলের আনুগত্যকে তাঁরই আনুগত্য হিসেবে গণ্য করেছেন। যেমন ক্বোরআন পাকে এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করেছে, সে আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা’আলার আনুগত্য করেছে”। সুতরাং যেখানে আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানকে বুলন্দ করেছেন, সেখানে কার শক্তি আছে যে, তাঁর শানকে ক্ষুণ্ন করতে পারে? কেউ এ কথা চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু যারা বদ- নসীব, এ অপকর্মে লেগে থাকে এবং ক্বোরআন পাক তেলাওয়াত করতে থাকে, কিতাব পর্যালোচনা করে থাকে, তাও এ জন্যই করে যে, এমন কোন আয়াত পাওয়া যায় কিনা, এমন কোন হাদিস পাওয়া যায় কিনা, যা দিয়ে তারা মানুষের সম্মুখে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানকে ক্ষুন্ন করতে পারে। এমন বদ-নসীব লোকও পৃথিবীর বুকে বিচরণ করছে! বস্তুতঃ আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা‘আলা যার শানমান সমুন্নত করেন, তাঁর শান মানের হানি ঘটাতে পারে এমন কার শক্তি আছে? (কারো নাই।)” [মুর্শিদে বরহক আল্লামা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাহমতুল্লাহি আলাহি’র জীবনী গ্রন্থ, সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান, পৃষ্ঠা: ১২৬- ১২৯।]
যে আয়াত আর হাদীস উদ্ধৃত করে গবেষক মহোদয় বন্ধনী যোগে এবং বন্ধনী বিহীন যিকর আলোচনা অর্থে ব্যবহৃত দাবি করেছেন, ঠিক একই আয়াত ও হাদীসের অনুবাদে তিনি কর্তৃক মডেল রূপে ব্যবহৃত হুজুর মহোদয় “স্মরণ, নাম নেওয়া (জপ করা)” অর্থ করেছেন।
গবেষক মহোদয় যদি “উপরের হাদিসে ‘যিকর’ যে অর্থে ব্যবহার হয়েছে এ আয়াতেও ‘যিকর’ শব্দটি সে অর্থে ব্যবহার হয়েছে” দাবিতে অনড়, নিজের মডেল হুজুরের অনুবাদকে সঠিক এবং হুজুরকে সুন্নী মনে করেন, তবে “আমাদের কতিপয় নব্য শিয়াগণ এ হাদিসের অপব্যাখ্যা করে বুঝাতে চান যে, আল্লাহ আল্লাহ নাম জপা যেমনিভাবে ইবাদত তেমনিভাবে আলী আলী নাম জপাও ইবাদত। নাউযুবিল্লাহ! অথচ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় কোন সুফি, কোন হাদিসের ব্যাখ্যাকার এমনটি বলেননি” অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে; অন্যথায় হুজুরকেও একই কাতারে গন্য করতে বাধ্য।
দ্বিতীয়ত: ”وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ“ “এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি”। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে,——————————
তিনি বললেন,(আল্লাহ এরশাদ করেন,) “আপনার স্মরণকে সমুন্নত করার অর্থ হচ্ছে- যখন আমাকে স্মরণ করা হবে, তখন আমার সাথে আপনাকেও স্মরণ করা হবে”। [তারজুমা ও তাফসীর কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান, বঙ্গানুবাদ: আলহাজ্ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, সূরা:৯৪ ইনশিরাহ্, পারা:৩০, পৃষ্ঠা:১০৮৬।]
ঠিক একই আয়াত ও একই হাদীসের অনুবাদে যিকরের মর্ম ‘স্মরণ’ গৃহীত হয়েছে।
জনাব! কলিমা,আযান,নামায ইত্যাদিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার নাম কি আলোচনার উদ্দেশ্যে নিতে হবে?
শির্কের সংশয় আপনাকে রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর “যদি কারো আক্বীদাহ-বিশ্বাস এটা হয় যে, হুযূর আলায়হিসসালাম নিজে সালামের সম্বোধন শুনেন, তা কুফর; চায় আসসালামু আলায়কা বলুক বা সালামুন আলান্নবীয়্যি বলুক। আর যার আক্বিদাহ এটা হবে যে, সালাম ও সালাত তাঁর (দ.) নিকট পৌঁছানো হয়, একদল ফিরিশতা এ কাজের জন্য নিয়োজিত, যেমন হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে, তবে উভয়ভাবে পড়া মুবাহ বা বৈধ। অতঃপর শুন যে, যদি ইবনে মাসউদ ওফাত শরীফের পর দ্বিতীয় পুরুষবাচক শব্দকে নামপুরুষে পরিবর্তন করেনও কোন অসুবিধা নেই, হয়তো কোন উপযোগীতার কারণে করেছেন আর মূল শিক্ষা মতো পড়া হলেও কোন অসুবিধা নেই; যেহেতু উদ্দেশ্য (সালাম নিবেদন নয়) বর্ণনা’ ফতওয়া-ই রশীদীয়্যাহ, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, ১০২-১০৩ পৃষ্ঠা, মকতবাহ-ই থানভী দেওবন্দ” এই আক্বীদাহ-বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যাবে নাতো?
আরো পড়ুন- আলীর যিকর ইবাদত ( পর্ব -দুই )
আপনি ক্রমশ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর “আয্ ওয়াসওয়াসাহ-ই যিনা খিয়ালে মুজামি‘আতে জাওযাহ-ই খোদ বিহতর আস্ত; ওয়া সরফে হিম্মত বসূয়ে শায়খ ওয়া আমসালে আঁ আয্ মু‘আযযমীন গো জনাবে রিসালতে মায়াব বাশন্দ বচন্দীঁ মরতবাহ বদতর আয ইস্তিগরাক্ব দর খিয়ালে গাও ও খরে খোদ আস্ত’। অর্থাৎ ‘নামাযে যেনার ধ্যান অপেক্ষা আপন স্ত্রীর সাথে সহবাসের ধ্যান উত্তম; আর শায়খ ও তদ্রুপ সম্মানী এমনকি রসূলুল্লাহ (দ.)’র প্রতিও মনযোগ নিবন্ধন আপন গরু ও গাধার ধ্যানে ডুবে থাকার চেয়েও বহুগুণ মন্দতর’ সিরাতে মুস্তাক্বীম ৮৬ পৃষ্ঠা, মকতবাহ সালাফিয়্যাহ লাহূর” দর্শন-ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠছেন নাতো?