বিরহী খুঁটি

প্রমিত মুন্তাসির পান্থ
ছোট্টমণিরা! গাছের কি বিবেক-বুদ্ধি আছে? নেই। গাছ কি পাওয়ার আনন্দ আর হারানোর বেদনা প্রকাশ করতে পারে? হয়তো পারে, কিন্তু আমরা বুঝিনা। আজ আমরা জীবিত নয়, বরং মৃত একটি বৃক্ষের ঘটনা আলোচনা করবো; যার বিবেক-বিবেচনা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকেও হার মানায়।
আমাদের প্রিয় নবী (দ.)’র মসজিদটি তখনকার দিনে খেজুর গাছের খুঁটির ওপর খেজুর পাতার ছাউনি বিশিষ্ট ছিল। অবশ্য চার দেওয়াল ছিল পাথরের।
তোমরা কি সে মসজিদের নাম জানো? মসজিদ-ই নববী। সেটি কোথায় অবস্থিত? মদীনাহ্-ই ত্বায়্যে-বাহ্’য়। মদীনাহ্ শরীফ মক্কাহ্ শরীফের কোন দিকে? উত্তরে। বেশ! তোমরা-তো দেখি পারো!
মসজিদ-ই নববীর খুঁটিগুলোর একটির সাথে হেলান দিয়ে রসূলুল্লাহ (দ.) খুত্ববাহ্ বা ভাষণ দিতেন। একদা আনসার এক মহিলা নবী করীম (দ.)’র খিদমতে এসে আবেদন জানালেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার এক কাঠমিস্ত্রি গোলাম রয়েছে। আমি কি আপনার জন্য এমন কিছু বানিয়ে দেব, যাতে আপনি বসতে পারেন?’ রসূলুল্লাহ (দ.) বললেন, ‘তুমি যদি চাও, করো।’ ওই রমণী তিন স্তর বিশিষ্ট মিম্বর বানিয়ে পাঠালে মসজিদে তা স্থাপন করা হয়। জুমু‘আহ্’র দিন এলে নবী করীম (দ.) খুত্ববাহ্ দানের জন্য তাতে বসলেন।
এতদিন ধরে প্রিয় নবী (দ.)’র স্পর্শধন্য খুঁটিটি আজ পরশ বঞ্চিত হয়ে বিরহ-বিলাপ করছে। বাছুরের জন্য মা উটনি যেরূপ ডাকে, সেটিও ওইরূপ কাঁদছে। তার কান্নায় মসজিদ কেঁপে ওঠল। উপস্থিত মুসল্লীদের নয়ন যুগল জলে সিক্ত হল। বিচ্ছেদ-বেদনায় খুঁটিটি যখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম, তখন দয়াল নবী (দ.)’র দয়ার সাগর তরঙ্গে এল। তিনি (দ.) মিম্বর থেকে অবতরণ করলেন। আপন মুবারক দু’হাত বাড়িয়ে সেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ার নবী (দ.)’র মমতাময় পরশে সেটি ফুঁপাতে লাগল; ঠিক সান্তনায় ক্রন্দনরত শিশুর কান্না নিবারণ করতে গেলে সে যেমনটি করে। অতঃপর আস্তে-আস্তে সেটি শান্ত হল।
রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, ‘ওই সত্তার শপথ! যার কূদরতের হাতে আমার প্রাণ! আমি যদি তাকে জড়িয়ে না ধরতাম, তবে আল্লাহর রাসূল (দ.)’র বিরহ-বেদনায় সে ক্বিয়ামত পর্যন্ত এরূপ কাঁদতে থাকত’।
প্রেমাষ্পদের বিরহের আগুন এমন প্রখর যে, সৃষ্টির কোন আগুনের তুলনা তার সাথে চলেনা। আল্লামাহ্ রূমী (রা.) বলেন, ‘আমি বন্ধুর বিরহের অনলকে নরকের সাথে তুলনা দিয়েছি, আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই, আমি ভুল বলেছিলাম; বরং বিরহানলের ওপর নরকানল প্রাণোৎসর্গী।’
আল্লাহু আকবর! শুকনো একটি কাঠখণ্ড নবী করীম (দ.)’র বিচ্ছেদে চুরচুর হওয়ার যোগাড়! আর আমরাতো শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত! আমরা নবী-প্রেমিক বলে পরিচয় দেই! নবী-প্রেম নবী-প্রেম রব তুলি! আসলে প্রেমের অনুভূতিও কি আমাদের অন্তরে আছে?
‘ক্রন্দনকারী আঁখি চাও, কাঁদিতে সবাই নাহি পারে;
সবাই প্রেমালাপ পাড়ে, প্রেমানুভূতি দুর্লভ ভব-বাজারে।’
খুঁটিটি সুস্থির হলে রাসূলুল্লাহ (দ.) তাকে বললেন, ‘তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে সে বাগানে ফিরিয়ে দেব, যেখানে তুমি ছিলে। তোমার শিকড় গজাবে, তুমি সৌষ্ঠব পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হবে, নূতন করে ফুল-ফল ধরবে। আর যদি চাও জান্নাতে বপন করে দেব, তোমার ফল আওলীয়ায়ুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধুগন খাবে।’
খুঁটির উত্তর শুনার জন্য রাসূলুল্লাহ (দ.) ঝুঁকলেন। সে বলল, ‘আমাকে জান্নাতে বপন করে দিন, যাতে আমার ফল আল্লাহর বন্ধুগণ খান এবং আমিও এমন স্থানে হই, যেখানে বিরহ-বেদনায় বিলীন না হতে হয় অর্থাৎ আপনার সাঙ্গ পাই।’
খুঁটির উত্তর শুনে রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করলেন, ‘এটি নশ্বর জগতের বিপরীত অবিনশ্বর জগতকে বেছে নিয়েছে।’ অতঃপর নবী করীম (দ.) সেটিকে মিম্বর শরীফের নীচে দাফনের নির্দেশ দিলে সেখানে দাফন করা হয়।
সোনামণিরা! বলতো দেখি, শুকনো একটি খুঁটি এ সমঝ কীভাবে লাভ করল? আল্লাহর হাবীব (দ.)’র ছোঁয়ায়। মা-শা-য়াল্লা-হ! তোমরা ঠিকই বুঝেছ। একটি খুঁটি যদি নবী করীম (দ.)’র মর্যাদা-মাহাত্ম্য, সৌন্দর্য-মাধুর্য অনুধাবন করে তাঁর প্রেম-ভালবাসায় আকুল হয়ে বিরহ-বেদনায়, মিলন-আকাংখায় বিলাপিয়ে কাঁদে, তবে আমরা উম্মত হয়ে তাঁর প্রেমে কত ব্যাকুল হওয়া উচিৎ? একটি খুঁটির ব্যগ্রতায় সান্তনা দেওয়ার জন্য যদি নবী (দ.) মিম্বর থেকে অবতরণ করে বুকে জড়িয়ে নেন, তবে ব্যগ্র উম্মতকে মিলন দানে কেন ধন্য করবেন না? যে উম্মতের মায়ায় নবী (দ.) কান্না করেন, সে উম্মতের অশ্রু-তো আপন আঁচলে অবশ্যই মুছে নেবেন।
উম্মতের প্রতি প্রিয় নবী (দ.)’র দরদ কতটুকু, তা পরিমাপের সাধ্য কারো নেই। “একদা নবী করীম (দ.) কুরআনে মজীদের সূরা ইব্রাহীমস্থ হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামের উক্তি ‘হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয় এসব প্রতিমা বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে, অতএব যে আমার অনুসরণ করেছে, সে-তো আমারই; আর যে আমার অবাধ্য হয়েছে, (তার বিষয়টি আপনার প্রতি সোপর্দিত) নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল-দয়ালু’ এবং সূরা মায়িদাহস্থ ঈসা আলায়হিস্ সালামের উক্তি ‘যদি আপনি তাদের শাস্তি দেন, তবে তারা আপনারই বান্দা, আর যদি ক্ষমা করে দেন, তবে আপনি পরাক্রমশীল-প্রজ্ঞাময়’ তিলাওয়াত করলেন। অতঃপর আপন মুবারক দু’হাত দু‘আর জন্য উত্তোলন করে ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত’ বলে জার-জার কাঁদলেন। অতএব আল্লাহ বললেন, ‘হে জিব্রাঈল! মুহাম্মদ (দ.)’র নিকট যাও এবং জিজ্ঞাসা কর, তাঁকে কিসে কাঁদাচ্ছে? অথচ তোমার প্রভু ভালই জানেন’। জিব্রাঈল (আ.) নবী করীম (দ.)’র খিদমতে এসে জিজ্ঞাসা করে তিনি (দ.) যা বললেন, তা আল্লাহকে জানালেন; অথচ আল্লাহ তা‘আলা অধিক জানেন। আল্লাহ বললেন, “হে জিব্রাঈল! মুহাম্মদ (দ.)’র নিকট গিয়ে বল, ‘নিশ্চয় তাঁর উম্মতের ক্ষমার ব্যাপারে আমি তাঁকে সন্তুষ্ট করবো, অসন্তুষ্ট করবোনা।”
“আপন আমলের ভিত্তি কিরে?
লজ্জা বিহীন নেইতো কিছুইরে!
রইব নিরাপদ তব সম্পর্ক-বরে;
আমারতো কেবল ভরসা এই রে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *