ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.)’র বিচিত্র আনুষ্ঠানিকতা

✒ আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর

চান্দ্রবর্ষের বার মাসে রবি‘উল আওয়াল শরীফ বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদায় বিভূষিত। কেননা এ পবিত্র মাসে মা আমিনা (রা.)’র কোলে ওই মহান সত্তার আগমন ঘটেছে, যিনি বিশ্বজগত সৃষ্টির হেতু। এমনিতে সারা বছর নবী করীম (দ.)’র প্রশংসা-প্রশস্তি আলোচনায় সভা-সেমিনার আয়োজন-তো হয়ই, পরন্তু এ মাস আসতেই নগরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে আনন্দ-উৎফুল্লতার প্লাবন বয়ে যায়; দিকে-দিকে সভা-সমাবেশ, জুলূস বা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার ধুম পড়ে যায়; ঈমানদারগণ বিচিত্র আয়োজনে প্রেমাষ্পদ নবী (দ.)’র প্রতি নিজেদের প্রেম-ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়; এ উদ্যম সময়ের বহতায় স্তিমিত হয়না, বরং নান্দনিক উম্মত্ততার রূপ পরিগ্রহ করে।
মীলাদ মাহফিলে লিখনী, বক্তব্য, গান-গীতির মাধ্যমে লিখক-প্রাবন্ধিক, জ্ঞানী-গুণী আলিম-ওলামা, গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী নিজেদের ভক্তি বিশ্বাসের পুষ্পার্ঘ্য পেশ করেন মাহবূব নবী (দ.)’র সকাশে। সকলই আপন-আপন সাধ্যানুপাতে পদ্যে-গদ্যে নবী (দ.)’র সৃজন, শুভাগমন, শান-মান, মর্যাদা-মাহাত্ম্য বর্ণনায় মুখরিত হয়ে ওঠেন। মীলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে আয়োজিত সভা-সমাবেশে প্রেমগীতি গীত হয়। রাসূলে আকরম (দ.)’র অনুপম আকৃতি-প্রকৃতি, মর্যাদা-মাহাত্ম্যের আলোচনা বড়ই চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়। ওই সকল পবিত্র মাহফিলে তাঁর (দ.) শুভাগমনের অবস্থাদি, মা আমিনা ও হালীমাহ সা’দিয়া’র স্নেহের কোলে অতিবাহিত সময়কালের অবস্থা ও ঘটনাবলীর বর্ণনায় হৃদয়তন্ত্রী শিহরিত হয়। তিনি (দ.)’র মধ্যাহ্নরবিবৎ চেহারা ও অমারজনীরূপ চুল মুবারকের মনমোহনী বর্ণনায় শ্রোতাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তিনি (দ.)’র অলৌকিকতা ও পরিপূর্ণতা বর্ণিত হলে-তো উম্মত্ততা ও ভাবোদ্বেলতার এমন চিত্র পরিস্ফুটিত হয়, যা কেবল অনুভবই করা যায়, বর্ণনার সাধ্য কলম ও মুখের অতীত।
মীলাদুন্নবী (দ.)’র মুবারক মাহফিলে মুস্তফা (দ.)’র অতুল্য সূরত-সীরত বা রূপ-গুণের বর্ণনা-তো হয়ই, তাঁর (দ.) ব্যাপক শানের বিভিন্ন দিকের আলোচনায় ঈমানদারদের অন্তরে প্রেম-ভালবাসার এমন প্রদীপ প্রদীপ্ত হয়, যার আলোতে জীবনের অমারজনী আলোক-উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মীলাদুন্নবী (দ.) ঈমানকে জীবন্ত করার অব্যর্থ ও পরীক্ষিত মাধ্যম, যদ্ধারা ওই শক্তির উন্মেষ ঘটে যাকে দার্শনিক কবি ইকবাল ‘প্রেম’ নামে আখ্যায়িত করেছেন এবং যদ্ধারা ‘মুহাম্মদ’ নামের আলো-বিকিরণে যুগনিশী আলোক-উজ্জ্বল করা যায়। ইকবালের কথা মতো জশনে মীলাদ পালনের উদ্দেশ্যও তা-ই।
‘কূওয়াতে ইশক সে হার পস্ত কো বা-লা- করদে,
দহর মে ইসমে মুহাম্মদ সে উজালা কর দে’
‘প্রেম-বলে সকল নীচে উঁচু করে দে,
মুহাম্মদ নামে জগৎ উজ্জ্বল করে দে’।
মীলাদুন্নবী (দ.) ঘিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদির ঈমান-জ্যোতি-বিচ্ছুরক ও অন্তরাত্মা উদ্দীপ্তকারী নানা কর্মসূচীকে শিরক, বিদ্‘আত, নাজায়েয ও হারাম আখ্যায়িত করে উম্মতকে নবী থেকে দেহকে প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শবদেহ মাটিচাপা দেওয়ার অশুভ তৎপরতার প্রতিকার-প্রত্যুত্তরে কুরআন ও সুন্নাহ্’র আলোকে পর্যালোচনা উপস্থাপনের প্রয়াসেই কলম হাতে তুলে নেওয়া। জানি, স্বীকারও করি যে, আমি অতি নগণ্য ও হীন এক উম্মত, প্রেমের শক্তিতে যদি আমার হীনতা পূর্ণতার চূড়ায় পৌঁছে দেন মনিব, যদি অভিষ্ট-পথ মুহাম্মদ নামে দীপ্ত হয়, তবে কুরআন ও সুন্নাহ’র দীপ্তিতে প্রদীপ্ত হবে নিবন্ধ, বিদূরীত হবে আঁধার, আলোর পথ হবে নিষ্কন্টক আর গর্তে ঢুকিবে পেচক।
এক. সম্মেলন-সভা-সমাবেশের আয়োজন:
ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.)’র আনন্দপূর্ণ উপলক্ষে না’ত মাহফিল, যিকরে মুস্তফা (দ.) মজলিস ও সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হয়, যাতে মানুষ পরম প্রেম-ভালবাসা ও চরম ভক্তি-বিশ্বাস ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করে মাহবূবে খোদা (দ.)’র প্রশংসা-প্রশস্তির মাধ্যমে নিজের অন্তরাত্মা প্রশান্ত, বিবেক-বিবেচনা জাগ্রত আর মন-মগজ সুবাসিত করে তোলেন। নবী করীম (দ.)’র মীলাদ বর্ণনায় ওইরূপ সমাবেশের ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর হাবীব (দ.) করেছেন, কুরআনে করীম ও হাদীসে পাকে তার প্রমাণ বিদ্যমান।
ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং (হে মাহবূব স্মরণ করুন) যখন আল্লাহ তা‘আলা নবীগণের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, যখন আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দানে ধন্য করবো, অতঃপর তোমাদের সঙ্গস্থ (কিতাব) সত্যায়নকারী রসূল তোমাদের নিকট আসবেন, তখন অতি-অবশ্যই তোমরা তাঁর ওপর ঈমান আনবে এবং অবশ্য-অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবে। (আল্লাহ) বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে এবং তদপরে আমার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করলে? তাঁরা বললেন আমরা স্বীকার করে নিলাম। (আল্লাহ) বললেন, তোমরা একে  অন্যের ওপর সাক্ষী হও এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষীভুক্ত।’ (সূরা আলে ‘ইমরান ৮১ নং আয়াত)।
উক্ত আয়াতে মনোযোগ দিলে স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা নবীগণ আলাইহিমুসসালামকে সমাবেশিত করেছেন, তাঁদের থেকে মাহবূব (দ.)’র ওপর ঈমান আনার অঙ্গীকার নিয়েছেন, সে সাথে হাবীব (দ.)’র মীলাদ ও শান-মান বর্ণনা করেছেন।
এবার হাদীসে পাকের বর্ণনাও একটু দেখুন। ‘হযরত মুত্তালিব বিন আবী ওয়াদা-‘আহ হতে বর্ণিত, হযরত আব্বাস (রা.) রসূলুল্লাহ (দ.)’র  খিদমতে উপস্থিত হলেন, (ওই সময় তাঁর অবস্থা এমনই ছিল) তিনি যেন (নবী করীম (দ.) সম্পর্কে কাফিরদের থেকে) কিছু (অযথা উক্তি) শুনে (বলতে) এসেছেন। তখন নবী করীম (দ.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি কে? (প্রত্যুত্তরে সাহাবা-ই কিরাম) বললেন, আপনি রসূলুল্লাহ আলাইহিস্ সালাম। তিনি (দ.) বললেন, আমি মুহাম্মদুবনু আব্দিল্লাহ ইবনি আব্দিল মুত্তালিব। আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগত সৃজন করে আমাকে তাদের উত্তম শ্রেনীর (মানুষ) অন্তর্ভুক্ত অতঃপর সে উত্তম সৃষ্টিকে দু’ভাগ (আরব-আজম) করে আমাকে উত্তম অংশে (আরবে) অতঃপর ওই উত্তম অংশকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম গোত্রে (কুরাইশে) অতঃপর ওই গোত্রকে বিভিন্ন পরিবারে বিন্যাস করে উত্তম পরিবার ও বংশে (বনু হাশিমে) সৃজন করেছেন।’ মসনদে আহমদের বর্ণনায় বর্ণিত অংশের পর আরো রয়েছে, ‘অতএব আমি তোমাদের মাঝে ব্যক্তি ও পরিবার হিসেবে উত্তম হই’। (তিরমিযী শরীফ ৩৫৩২,৩৬০৮; মসনদে আহমদ ১৭৮৮ নং হাদীস)।
হযরত উকবাহ বিন আমির (রা.) হতে বর্ণিত, “একদা নবী করীম (দ.) বহির্গমন করে উহুদের শহীদগণের ওপর জানাযার নামাযের ন্যায় নামায পড়লেন। অতঃপর মিম্বরে আরোহণ পূর্বক ইরশাদ করলেন, ‘আমি তোমাদের অগ্রযাত্রী (আগে গিয়ে অবস্থাদি পর্যবেক্ষণোত্তর ব্যবস্থা গ্রহণকারী) ও তোমাদের ওপর সাক্ষী হই। আল্লাহর শপথ! আমি এ মুহূর্তে আমার হাউদ্ব (হাউদ্বে কাওসার) দেখছি এবং আমাকে পৃথিবীর ভাণ্ডারসমূহের চাবি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি এ আশঙ্কা করিনা যে, তোমরা আমার পর শিরক করবে পরন্তু এ আশঙ্কা করি যে, তোমরা পাল্লা দিয়ে দুনিয়ায় নিমগ্ন হয়ে পড়বে”। (সহী বুখারী ১২৭৯,১৪০১,৩৮৫৭,৬০৬২,৬২১৮ সহী মুসলিম ২২৯৬ নং হাদীস)।
উক্ত হাদীসে পাক দু’টির ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ (দ.) উপস্থিতিকে সম্বোধন করে নিজের মীলাদ, পারিবারিক, গোত্রীয় ও বংশীয় মর্যাদা এবং আপন সত্তাগত মর্যাদা-মাহাত্ম্য সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। এ জন্য সাধারণ রীতির বাইরে মজলিস আয়োজন করে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের দেশেও মীলাদুন্নবী (দ.)’র মাহফিল আয়োজন করে ওই সবই-তো হয়।
মাহফিল-মজলিসের জন্য দিনধার্য করণ:
মীলাদুন্নবী (দ.) মাহফিলের জন্য নির্দিষ্ট দিন ধার্য করার ওপরও কারো কারো আপত্তি অথচ ভাল আলোচনা ও কর্মের জন্য দিন ও স্থান নির্ধারণ করা সুন্নত। হাদীসে পাকের বর্ণনায় রয়েছে, “হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহিলাগণ নবী করীম (দ.)’র খিদমতে আরয করলেন, ‘আপনার দরবারে পুরুষগণ আমাদের ওপর বিজয়ী অর্থাৎ তাঁদের কারণে আমরা ঠাঁই পাই কম; অতএব আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করুন’। এতে রসূলুল্লাহ (দ.) একটি দিন ধার্য করে প্রতিশ্রুতি দিলেন, যাতে তিনি তাদের নিকট গমন করে ওয়ায-নসিহত ও নির্দেশ দিলেন” (বুখারী শরীফ ৭৫ নং হাদীস)।
দুই. প্রশংসাগীতি ও না’তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
মীলাদুন্নবী মাহফিলের অন্যতম অঙ্গ রসূলুল্লাহ (দ.)’র প্রশংসাগীতি ও না’ত পরিবেশন। মুসলিম বিশ্ব ওই দিন না’ত মাহফিলের আয়োজন করে আপন প্রিয় নবী (দ.)’র সাথে নিজেদের প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক ও ভক্তি-বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটায়। না’তে রসূল (দ.) কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত পুণ্যকাজ।
‘হামাহ কুরআন ব-তওসীফে মুহাম্মদ’ বা ‘সমুদয় কুরআন মুহাম্মদ (দ.) প্রশংসায়’ মর্মালোকে পুরো কুরআনে করীমের প্রতি পারা- প্রতি সূরা, প্রতি আয়াত- প্রতি বর্ণই-তো নবী (দ.)’র প্রশংসা আর না’ত। না’ত শব্দের শাব্দিক অর্থ প্রশংসা-প্রশস্তি-স্তুতি-গুণগান; পরিভাষায় কবিতা বা গীতি আকারে রসূলুল্লাহ (দ.)’র স্তুতিই না’ত। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আপন মাহবূব (দ.)’র প্রশংসা না’তের ঢঙে করেছেন। যখনই মাহবূব (দ.) কে সম্বোধন করেছেন, তখন নাম নেওয়ার পরিবর্তে কখনো মুযযাম্মিল কখনো মুদ্দাসসির আবার কখনো ইয়াসীন বলে সম্বোধন করেছেন। কালামে মজীদের কোথাও ওয়াদ্দ্বোহা বা মধ্যাহ্নরবি বলে তিনি (দ.)’র আলোময় চেহারার শপথ আবার কোথাও ওয়াল্লায়লি বা অমারজনী বলে তাঁর (দ.) ঘন-কালো চুল মুবারকের শপথ ব্যক্ত হয়েছে।
স্বয়ং নবী-ই আকরম (দ.) না’ত মাহফিল আয়োজন করে হাসসান বিন সাবিত (রা.) কে কসীদাহ শুনানোর ফরমায়েশ করতেন। “উম্মুল মু’মিনীন সৈয়্যদাহ আয়েশাহ সিদ্দীকাহ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রসূলুল্লাহ (দ.) হযরত হাসসান (রা.)’র জন্য মসজিদে নববী শরীফে মিম্বর রাখাতেন এবং তিনি (রা.) তাতে দাঁড়িয়ে রসূলুল্লাহ (দ.)’র পক্ষে গৌরবগাথা গাইতেন অথবা (বিপক্ষের আনীত অভিযোগ) প্রতিহত করতেন এবং রসূলুল্লাহ (দ.) বলতেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা রূহুল কুদস দ্বারা হাসসানকে সাহায্য করেন, যখন তিনি রসূলুল্লাহ (দ.)’র প্রশংসাগীতি গায় এবং কুৎসার উত্তর দেয়”। (তিরমিযী শরীফ ২৮৪৬, মুসতাদরিক লিল্ হাকিম ৬০৫৮, মসনদে আহমদ ২৪৪৮ নং হাদীস)।
রসূলুল্লাহ (দ.) বলতেন, ‘হে হাসসান! রসূলুল্লাহ (দ.)’র পক্ষ থেকে উত্তর দাও। হে আল্লাহ তাকে (হাসসানকে) রূহুল কুদস দ্বারা সাহায্য করুন’। (বুখারী শরীফ ৩১৪ নম্বর হাদীস)।
আল্লাহ! আল্লাহ! আজও যদি কোন হাসসানী না’তে মুস্তফা (দ.)’র মাধ্যমে নবী করীম (দ.)’র গৌরবগাথা গায়, বিরোধীদের কুৎসা রটনার উত্তর দেয়, তবে উম্মতে মুহাম্মদী (দ.) মাত্র-তো আনন্দিত-উৎফুল্লিত হওয়ার কথা; উম্মত পরিচয়ে উল্টো রুষ্ট হচ্ছে এরা কারা? এরা নবী করীম (দ.)’র কুৎসা রটনাকারী ওইসব কাফির, মুশরিক ও ইয়াহূদীদের দোসর নয় কি?
আলহামদুলিল্লাহ! আজও-তো না’ত মাহফিলে তা-ই করা হয়, যা হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) করতেন। নবী (দ.)’র ঘোষণা ও দু’আ মর্মে আজও যদি না’ত শরীফের গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী রূহুল কুদসের মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত হন, তাতে আশ্চর্যের কি?
তিন. বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা:
মীলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে পালিত কর্মসূচীর অন্যতম জুলূস বা বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা। ওইদিন দুরূদ-সালাম ও না’ত-ই মুস্তফা (দ.)’র কোরাস গেয়ে বেড়ায় আশেকানে মুস্তফা (দ.)। তাঁদের ইয়া রাসূলাল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চতুর্দিক। কোথাও কোথাও বাদ্যযন্ত্রযোগেও চলে সে আনন্দ মিছিল। তাঁদের এ কর্মও আল্লাহর মাহবূব (দ.)’র সাহাবা-ই কিরাম (রা.)’র অনুসরণ।
সীরাতে ইবনে হিশামে বিবৃত, কতেক আনসারী সাহাবী বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (দ.)’র মক্কা হতে নির্গমনের সংবাদ পেয়ে আমরা তাঁর আগমন প্রতীক্ষায় ছিলাম। ফজরের নামাযান্তে কুবায় গিয়ে দৃষ্টি আর হৃদয় তাঁর আগমন পথে বিছিয়ে রাখতাম। সূর্য ছায়া পরে বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত আমরা নড়াচড়া করতামনা। যখন ছায়া খুঁজে পেতামনা, তখন গৃহে ফিরে আসতাম। তখন ছিল প্রচণ্ড গরমের দিন। যে দিন (১২ রবিউল আওয়াল সোমবার) তিনি (দ.) এলেন, সেদিনও নিত্যকার মতো অপেক্ষা করে ঠিক দুপুরে গৃহে প্রত্যাবর্তন করি। আমরা যখন গৃহে প্রবেশ করি, তখনই রসূলুল্লাহ (দ.) এসে পৌঁছলেন। তাঁকে প্রথমে যে দেখেছে, সে ছিল একজন ইয়াহূদ। সে আমাদের নিত্য প্রতীক্ষা দেখেছিল। সুতরাং উচ্চরবে আগমনের সংবাদ দিল। পরবর্তী দৃশ্য সহীহ মুসলিম শরীফের কিতাবুল যুহদি বাবুন ফী হাদীসিল হিজরাতি’র বর্ণনালোকে প্রত্যক্ষ করুন।
‘অতএব, ইয়া মুহাম্মদু! ইয়া রাসূলাল্লাহ! (২বার) সমস্বরে ডাকতে-ডাকতে নারী-পুরুষ ঘরের ছাদে ওঠে পড়লেন এবং বালক ও খাদেমগণ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লেন।’ (বি.দ্র. এটি ইয়া মুহাম্মদু! আহ্বান নিষিদ্ধ হওয়ার আগের ঘটনা।)
রসূলুল্লাহ (দ.) যখন মক্কা হতে হিজরত করে মদীনায় পৌঁছলেন, তখন আনসারদের কচি বালক আর আউস ও খাযরাজের বালিকারা দফ বাজিয়ে কসিদা গেয়ে প্রাণাধিক প্রিয় অতিথিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ কসিদার নিম্নোক্ত পংক্তি চির প্রসিদ্ধি পেয়েছে।
“বিদার পথ হয়ে মোদের পরে ওঠেছে পূর্ণশশী, কৃতজ্ঞতা আবশ্যক মোদের পরে চির কৃতজ্ঞতা অবিনাশি।”
(ফতহুলবারী ৭ম খণ্ড ২৬১ পৃষ্ঠা)।
চার. রকমারি সাজ-সজ্জা ও পতাকা উত্তোলন:
লাইট, প্যান্ডেল, সুশোভিত বিছানা, পুষ্প-সজ্জা, আলোক-সজ্জা, পতাকা উত্তোলন ও বহন ইত্যাদি ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) মাহফিলের অন্যতম অংশে পরিণত হয়েছে। আশেকানে মুস্তফা (দ.)’র এসব কর্মকাণ্ড মূলতঃ আল্লাহ রব্বুল ‘ইযযতের সুন্নাত। আল্লাহর প্রিয় মাহবূব (দ.) একদা হযরত আলী (রা.) কে বলেন, আল্লাহ তা‘ আলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে পরম প্রশংসিত সত্তা মুহাম্মদ! আমার মর্যাদা-মাহত্ম্যের শপথ! যদি আপনি না হতেন, না আমি ভূমণ্ডল সৃজন করতাম, না নভোমণ্ডল, না নীলাভ ছাদ, না মর্তজ বিছানা’। (ইনসানুল‘উয়ূন, বুরহানুদ্দীন হালবী, প্রথম খণ্ড, ৩৬৭ পৃষ্ঠা) আল্লাহর হাবীব (দ.) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনি আব্বাস (রা.) কে বলেন, ‘আমার নিকট জিব্রাঈল (আ.) এসে বলল, হে পরম প্রশংসিত! যদি আপনি না হতেন, তবে জন্নাত সৃজন করতেন না, আপনি না হলে জাহান্নাম সৃষ্টি করতেন না’। (আবূ আব্দিল্লাহ হাকিম নিশাপূরীর আল্ মাস্তাদরিক ২য় খণ্ড ৬১৫ পৃষ্ঠা)। এ ধরণের বর্ণনার বিরাট একটি সংকলন উপস্থিত করা যায়, কুরআন-ই করীম’র আয়াত ও বিভিন্ন ঐশীগ্রন্থের বর্ণনালোকে সমর্থনপুষ্ট বিষয়টি আরো স্পষ্টরূপে প্রমাণ করা যায়; পরন্তু বিশ্বাসীদের জন্য এ দু’টোই যথেষ্ট। উক্ত বর্ণনালোকে প্রমাণিত যে, চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্র সজ্জিত নীলাভ আকাশ এবং ঝরণা ও উদ্যানে ভরা সবুজ গালিচা-বিস্তৃত ভূপৃষ্ট নবী (দ.)’র জন্য, নবী (দ.)’র মীলাদেরই জন্য। মহামহিম আল্লাহ আপন শান অনুযায়ী সাজিয়েছেন আর বান্দা আল্লাহ প্রদত্ত সাধ্যানুপাতে সাজাচ্ছেন।
নবী করীম (দ.)’র মীলাদ উপলক্ষে আল্লাহ রব্বুল ইযযতের পরিপূর্ণ কূদরতী ব্যবস্থাপনার ঝলক দেখুন। তিনি তাঁর মাহবূব (দ.)’র আগমনের জন্য যে মৌসুম নির্বাচন করেছেন, তা বসন্তের।
তিনি (দ.) যে রবিউল আওয়াল শরীফে তশরীফ এনেছেন, তা বসন্তের ভরা যৌবনা রূপ-শোভায় শোভিত ছিল; অথচ চান্দ্রবর্ষের অন্যান্য মাসের ন্যায় এ মাসও বছরের বিভিন্ন মৌসুমে বিবর্তিত হয়ে আসে। হযরত সা‘ঈদ ইবনি মুসায়্যিব (রা.)’র উক্তি ‘রসূলুল্লাহ (দ.)’র শুভাগমন বসন্তের মৌসুমে হয়েছে’। (আসসিরাতুল হালবিয়্যাহ ১ম খণ্ড ৫৭ পৃষ্ঠা)।
তিনি (দ.)’র আগমন উপলক্ষে আল্লাহর কূদরতে কামিলাহ সমস্ত পৃথিবীকে সতেজ-সবুজ করে দিয়েছেন। জরাজীর্ণ বৃক্ষাদিকে পত্র-পল্লব আর ফুলে-ফলে ভরিয়ে দিয়েছেন। দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলে ফসলের বিস্তারে ওই বছর সচ্ছলতা আর আনন্দের বছর রূপে আখ্যায়িত হয়েছে। ‘যে বছর নূরে মুহাম্মদী হযরত আমিনাহ (রা.)’র গর্ভে সঞ্চিত হয়েছে, ওই বছর বিজয় ও সচ্ছলতার বছর হিসেবে অভিহিত হয়; যেহেতু ইতোপূর্বে কুরাইশরা অভাব অনটন ও দুর্ভিক্ষে জর্জরিত ছিল। বিলাদতে মুস্তফা (দ.)’র বরকতে আল্লাহ তা‘আলা মরু অঞ্চলকে সবুজ-সতেজ করে দিয়েছেন, জরাগ্রস্থ বৃক্ষাদি ফুলে-ফলে ভরিয়ে দিয়েছেন; এভাবে সর্বদিক থেকে আগত মঙ্গলে তারা সচ্ছল হয়ে গেল’। (আসসিরাতুল হালবিয়্যাহ ১ম খণ্ড ৪৮ পৃষ্ঠা)।
মীলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে আমরা আলোকসজ্জা করি, নিজেদের সাধ্যানুপাতিক ঘর-বাড়ি, পাড়া-মহল্লা, মসজিদ-মাদরাসা, খানকাহ-মাযার, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর বাতি দিয়ে সজ্জিত ও আলোকিত করি। পরন্তু জগৎস্রষ্টা যার করায়ত্বে পূর্ব-পশ্চিম, তিনি মাহবূব (দ.)’র মীলাদে আলোকসজ্জা করতে চাইলেন-তো শুধু পূর্ব-পশ্চিম নয় বরং আসমানী জগতকেও ওই খুশিতে শামিল করে নক্ষত্ররাজিকে প্রদীপ বানিয়ে পৃথিবীর নিকটবর্তী করে দিলেন। হযরত ‘উসমান বিন আবীল ‘আস (রা.)’র মা ফাতিমাহ বিনতে আব্দিল্লাহ সক্বফিয়্যাহ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘যে রাত রসূলুল্লাহ (দ.)’র আবির্ভাব হয়েছে, সে রাত আমি রসূলুল্লাহ (দ.)’র আম্মাজান আমিনাহ বিনতে ওহাব (রা.)’র নিকট ছিলাম; আমি ঘরের যে বস্তুর দিকেই দৃষ্টি দিই, তা-ই নূরে ভরপুর দেখতে পাই। আমি নক্ষত্ররাজির দিকে দেখি যে, তা নিকটবর্তী হয়ে গেল; এমনকি আমাকে বলতে হল, তা আমার ওপর খসে পড়বেনা-তো!’ (ত্ববরীর তারিখুল উমামি ওয়াল মুলূকি ১ম খণ্ড ৪৫ পৃষ্ঠা)।
পতাকা উত্তোলনের বিষয়ে সৈয়্যদাহ আমিনাহ (রা.)’র বর্ণনা পর্যবেক্ষণ করুন। তিনি বলেন, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমার চক্ষু হতে পর্দা অপসারিত করলেন আর আমি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম সব দেখলাম। আমি উড়ন্ত তিনটি পতাকা দেখলাম; একটি পূর্বে, একটি পশ্চিমে এবং একটি কা’বাহ’র ছাদে পতপত উড়ছে’। (আল খাসায়িসুল কুবরা, জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী ১ম খণ্ড ৮১-৮৩ পৃষ্ঠা)।
পাঁচ. দুরূদ-সালাম ও ক্বিয়াম:
মীলাদুন্নবী (দ.) মাহফিলের অন্যতম একটি অংশ, রসূলে করীম (দ.)’র প্রতি দুরূদ-সালাম পেশ করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ দুরূদ প্রেরণ করেন নবী (দ.)’র ওপর, হে ঈমানদারগণ! তাঁর প্রতি দুরূদ ও উত্তম সালাম পেশ করো। নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের ওপর দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর অভিশাপ এবং (আল্লাহ) তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন’। (সূরা আহযাব ৫৬-৫৭ আয়াত)।
আল্লাহ-আল্লাহ! কতই গুরুত্বসহ দুরূদ ও সালাম আবশ্যক করেছেন; প্রেমাষ্পদত্বের শান ঝলমল করছে! সেই সাথে ওইসব হতভাগাদের অশনিসংকেত শুনাচ্ছেন, যারা না নিজে দুরূদ ও সালাম পড়ে, না অন্যকে পড়তে দেয়; এভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মাহবূবের গুণগাহীদেরও আশ্চর্য মর্যাদা; সত্যিই যারা মাহাত্ম্য নিয়ে চলে, তারাও মহৎ হয়ে যান। সুবহানাল্লাহ! ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই হন, যিনি তোমাদের উপর দুরূদ প্রেরণ করেন এবং তাঁর ফিরিশতাগণ; যেন তোমাদের আঁধারাদি হতে আলোর পানে নির্গত করে আনেন এবং তিনি মু’মিনদের ওপর দয়ালু। তাঁদের জন্য সাক্ষাতের সময়ের অভিবাদন হবে ‘সালাম’ এবং তাঁদের জন্য সম্মানজনক পুরষ্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন’। (সূরা আহযাব ৪৩-৪৪ নম্বর আয়াত)।]
আল্লাহ! আল্লাহ! যখন বিশ্বকুল সম্রাট মাহবূব (দ.) কে ধন্য করেছেন, তখন মাহবূবের গোলাম-গুণগাহী-আশেকদেরও ধন্য করে দিলেন। কোথায় আমরা আর আমাদের দুরূদ-সালাম আর কোথা তিনি ও তাঁর ফিরিশতাদের দুরূদ!
উক্ত আয়াতসমূহের আলোকে প্রতিভাত যে, দুরূদ ও সালাম এমন এক আমল, যা আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ করেন। এটি আল্লাহর সুন্নাত, যাতে পরিবর্তন নেই। আল্লাহ তা‘আলা স্থান ও কালের উর্ধ্বে-‘দয়াময় আর্শের ওপর দীপ্তিময়’ ‘প্রত্যহ তিনি নিত্য শানে আছেন’। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার দুরূদ-সালামের ধরন আমাদের অজানা। পরন্তু ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধ দাঁড়ানো, দুরূদ পড়ছেন আর আল্লাহ তাঁদের শপথ করছেন, ‘শপথ ওইসব সারিবদ্ধ দাঁড়ানো ফিরিশতার’ (সূরা আসসফ্ফাত ১নং আয়াত)।
আয়াতে ‘সাল্লূ’ ও ‘সাল্লিমূ’ সাধারণ নির্দেশ, তাতে স্থান-কাল-পাত্র-ধরন ইত্যাদির শর্ত নেই, দাঁড়িয়ে-শুয়ে-বসে, নামাযে-নামাযের বাইরে, মাহফিলে-মাহফিলের বাইরে সবখানে পড়া যায়। প্রত্যেক নামাযের বৈঠকে যেমন বসে দুরূদ পাঠ রয়েছে, তেমনি জানাযাহ’র নামাযে দাঁড়িয়ে পড়ার বিধানও আছে। সুতরাং নামাযের বাইরেও বসে-দাঁড়িয়ে পড়তে বাধা কোথায়? ‘ওয়া সাল্লিমূ তাসলীমা’ অর্থাৎ ‘সালাম পড়ার মতো সালাম পড়ো’ নির্দেশে সালাম পেশ করার শিষ্টাচারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের ওপর আপন মাহবূবের সম্মান-শ্রদ্ধা আবশ্যক করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে ‘যেন তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনো এবং তাঁর (তাঁর দ্বীনের) সাহায্য ও তাঁর (সর্বান্তকরণে) শ্রদ্ধা-সম্মান করো’। (সূরা ফাতাহ্ ৯নং আয়াত)।
দাঁড়িয়ে সালাতুসসালাম পেশ করা তা’যীম-তাওক্বীর তথা শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন বৈকি! নবী (দ.)’র সম্মানার্থে দাঁড়ানোর সবুত হাদীসে পাকে বিদ্যমান। হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) বলেন, ‘নবী (দ.) আমাদের সাথে বৈঠকে বসে কথা বলতেন, অতঃপর তিনি (দ.) যখন দাঁড়াতেন, আমরাও ওঠে দাঁড়িয়ে থাকতাম যাবৎনা তিনি (দ.) তাঁর কোন বিবির ঘরে প্রবেশ করতেন’। (সুনানে আবী দাউদ কিতাবুল আদব)।
মীলাদুন্নবী (দ.)’র সাথে সালাতুসসালামের বিশেষ এক সংযোগ রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল্ কুরআনে হযরত ইহইয়া (আ.)’র বিষয়ে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং তাঁর (ইহইয়া (আ.)’র) ওপর সালাম, যেদিন জন্মেছেন, যেদিন মৃত্যুবরণ করবেন এবং যেদিন জীবন্ত উত্তোলিত হবেন’। (সূরা মারয়াম ১৫ নং আয়াত)। হযরত ঈসা (আ.)’র বিষয়ে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং আমার ওপর সালাম, যেদিন জন্মেছি, যেদিন মৃত্যু বরণ করবো এবং যেদিন জীবন্ত উত্তোলিত হবো’। (সূরা মারয়াম ৩৩ নং আয়াত)। আয়াতদ্বয়ে দৃষ্টি দিলে কুরআনে করীমে মীলাদের আলোচনা বিদ্যমান যেমন প্রতিভাত হয়, তেমনি মীলাদ দিবসে সালামের গুরুত্ব-বিশেষত্বও প্রমাণিত।
ছয়. পানাহারের আয়োজন-পরিবেশন:
ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) মাহফিলে নানা রকমের পানাহারের আয়োজন করে অভিজাত ও সাধারণ নির্বিশেষে সকলের ভোজন ব্যবস্থা করা হয়। পানাহার করানো এমন এক কাজ, যা আল্লাহ তা‘আলা ও রসূলুল্লাহ (দ.)’র নিকট পছন্দনীয়। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে মজীদে মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় ইরশাদ করেন, ‘তাঁর (আল্লাহর) প্রেমে নিঃস্ব, অনাথ ও বন্দীদের আহার্য দান করেন। (বলেন) আমরা-তো কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমাদের আহার করিয়েছি, না আমরা তোমাদের নিকট বিনিময় চাই, না কৃতজ্ঞতা’ (সূরা দাহর ৮-৯ নং আয়াত)। হাদীসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, “ইসলামে খুব উত্তম কাজ কোনটি? ইরশাদ করলেন, আহার করানো”। (বুখারী শরীফ কিতাবুল ঈমান)। স্বয়ং বিশ্বকুল সরদার (দ.) আপন শুভাগমনের খুশিতে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে ছাগল যবেহ করে ভোজনানুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। “খাদেম-ই রসূল হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী-ই আকরাম (দ.) নবূয়ত ঘোষণার পর নিজের পক্ষ থেকে ‘আক্বীক্বাহ করেন” (বায়হাক্বীর সুনানে কুবরা, ত্ববরানীর আলমু’জামুল আওসাত)।
ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) বা রসূলুল্লাহ (দ.)’র শুভাগমনের ঈদ উপলক্ষে পালিত কর্মসূচীর ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা ইতোপূর্বে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে এমন কোন কর্ম নেই, যার ভিত্তি কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত নয়। ওইসব কর্ম আলাদা-আলাদা জায়েয হলে, তবে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) মাহফিল নামে একত্রিত ভাবে কেন নাজায়েয হবে? অ-হ্যাঁ! বিরোধীদের সর্বশেষ অস্ত্র অপচয়ের অভিযোগ। মাহবূব (দ.)’র প্রেম-বিভোর আশিকদের আনন্দ উদযাপনকে অপচয় কিংবা হৈ-হাল্লার পরিবর্তে নীরব ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার দোহাইতে রুদ্ধ করার সেই অস্ত্র স্বয়ং আল্লাহই বেকার করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘বলুন, (এ সবকিছু) আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া-হেতু (যা রসূলুল্লাহ (দ.)’র নবূয়ত প্রকাশের মাধ্যমে তাঁদের প্রাপ্তি ঘটেছে) সুতরাং তাঁরা (মু’মিনরা) তদপরে যেন খুশি উদযাপন করেন; তা (খুশি উদযাপন) তারা যা সঞ্চয় (পুণ্য ও মাল-সম্পদ) করে, তার চেয়ে উত্তম’। (সূরা ইউনুস ৫৮ নং আয়াত)। আয়াতে আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া দ্বারা রসূলুল্লাহ (দ.)’র সত্তা বুঝানো হয়েছে; এ ক্ষেত্রে শুধু ওলামা-ই আহলে সুন্নতের নয়, বরং অন্যান্য ঘরণার আলিমদের অভিমতও বিদ্যমান। উক্ত আয়াত মর্মে প্রতিভাত যে, মীলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে ব্যয় অপচয়তো নয়ই বরং সঞ্চয় অপেক্ষা উত্তম।
আশা করি উক্ত আলোচনায় অনেকের ভ্রম ভাঙ্গবে, পরন্তু যারা শুধু বিদ্বেষের বশে বিরোধিতা করে, তাদের জন্য আল্ কুরআনের সাবধানবাণী, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো, তবে অবশ্য আমি তোমাদের বাড়িয়ে দেব আর যদি অকৃতজ্ঞতা করো, তবে আমার শাস্তি অতিকঠোর’ (সূরা ইব্রাহীম ৭নং আয়াত)।
পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ফরিয়াদ, তিনি যেন আপন মাহবূব (দ.)’র প্রেমে আমাদের দৃঢ় রাখেন। আমীন বিহুরমতি সৈয়্যদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *