প্রথম সাক্ষাত

আবূ বকর সিদ্দিক (রাদ্বি.)
প্রমিত মুন্তাসির পান্থ 
বিশ্বকুল সম্রাট (দ.)’র ভূলোকে আগমনের চত্বারিংশৎ বছর। ধরিত্রির বুকে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (দ.)’র রিসালত ঘোষণার সময় অত্যাসন্ন। জগতের অণু-পরমাণু আরশ হতে অবতীর্ণ বাণী শুনার জন্য অধীর অপেক্ষমান।
তখনকার দিনে আবূ বকর (রাদ্বি.) ছিলেন এক সৎ ও উদার ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক কাজে শামদেশে গমনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে তিনি প্রস্তুত হয়ে যাত্রা দেন।
সফর সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত গোলামকেও সঙ্গে নিলেন। আরব্য বণিকের এ ছোট্ট কাফেলা পথ চলতে চলতে শামদেশে প্রবেশ করলেন। একদিন ঘন অরণ্য অতিক্রম করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এল। কালো মেঘের বিক্ষিপ্ত টুকরো আকাশে দ্রুত একত্রিত হচ্ছিল। দেখতে না দেখতে মেঘের আঢ়ালে সূর্যের কম্পান কিরণ মিলে গেল। ঝড়-তুফানের মৌসুম, বৃক্ষ ঘেরা পাহাড়, উৎকণ্ঠিত দুই মুসাফির আর চতুর্দিকে নৈরাশ্যের ভিড়!
রাতের আঁধার নামার আগে জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকা অতিক্রম করতে হবে। উটের লাগাম ধরে দ্রুতপদে হাঁটলেন। আল্লাহর দয়া সাঙ্গ হল, কিছুদূর যেতেই উন্মুক্ত প্রান্তর দেখা দিল। বলা বাহুল্য যে, মুসাফিরের সন্ধ্যা কতই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার! আঁধারের রাজ্য পার হতেই রাত্রি যাপনের চিন্তা পেয়ে বসল।
মহামহিম প্রভুর অনন্ত মহিমা, অনতিদূরে খ্রিস্টানদের একটি গির্জা দেখা যাচ্ছে! জনবসতির চিহ্ন দেখে দেহ পিঞ্জরে প্রাণ ফিরে এল। যা হোক অন্তত আশ্রয়-তো মিলবে।
কাফেলার উট গির্জার সামনে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিজন প্রান্তরে মানুষের পদধ্বনি শুনে এক ব্যক্তি বেরিয়ে এলেন। হতবিহ্বলতা ও অনুসন্ধানের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কারা? কোত্থেকে আসছেন?
হযরত আবূ বকর উত্তর দিলেন, আমরা আরব্য ব্যবসায়ী। মক্কায় যেথা আল্লাহর ঘর, সেথা আমাদের বসতি। শাম যাত্রায় পথ ভুলে হয়তো এখানে এসে পড়েছি। গির্জায় নিশীযাপনের অনুমতি প্রার্থী।
ওই ব্যক্তি বলল, এ গির্জা ঈসায়ী ধর্মের এক বড় সাধকের উপাসনালয়। রাহিব জগতের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে শত বছর ধরে এখানে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন। শুধু আমিই ওই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যে তাঁর নিকট যেতে পারে। আমি ছাড়া আর কারো জন্য তাঁর নির্জনাবাসে পা রাখার অনুমতি নেই। আমি সিকি শতাব্দি ধরে তাঁর খিদমতে আছি। ঠিক একজন আধ্যাত্মিক গুরুর ন্যায় তিনি আমার রূহানী পরিচর্যা করছেন।
কথার ধারাবাহিকতা সচল রেখেই সে বলল, যেখানে রাত্রি যাপনের প্রশ্ন, সেখানে এ গির্জার কঠিন এক শর্ত আছে। এ গির্জায় তাঁরাই নিশীযাপন করতে পারেন, যাদের আঁচলে পাপের কালিমাচিহ্ন লাগেনি। কেননা আজ থেকে কয়েক বছর আগে ঠিক সন্ধ্যা বেলায় এক পাপিষ্ঠ মদ্যপ পথ হারিয়ে এখানে এসে পৌঁছে। মুসাফির মনে করে তাকে রাত যাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। …
তার কথা শেষ হলে আবূ বকর (রা.) বললেন, তোমার গুরুর কাছে পাপ-পুণ্যের পরিমাপক আছে কি? নাকি সকলের আমল নামা তার হাতে? কোন পাপীর কপালে তার পঙ্কিল জীবনের কুকর্মের তালিকা খুদাই করা থাকে কি? গির্জার ওইরূপ শর্তে পুণ্যবান মুসাফিরদের অধিকার হরণের সম্ভাবনা মোটেও ওড়িয়ে দেওয়া যায়না। সুতরাং এ শর্তের রহিত করণ জরুরি। এবার ওই যন্ত্রের কথা বলো, যা দিয়ে পাপী ও পুণ্যবানের পরিচয় নির্ণীত হয়।
আপন গুরুর প্রতি অগাধ আস্থা-বিশ্বাস সত্ত্বেও এক যৌক্তিক প্রশ্নে সেবক ক্ষণিকের জন্য দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়ে গেল। তার বুদ্ধির ভিত্তি নড়ে ওঠল। বড় সংশয়ে উত্তর দিল, আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি যে, যখন এক পাপিষ্ঠের পাপের অলক্ষণ শায়খ অনুভব করতে পারেন, তবে কোন পুণ্যবানের পুণ্যের সুলক্ষণও উপলব্ধির সক্ষমতা তাঁর অবশ্য থাকবে।
উত্তর শুনে আবূ বকর (রাদ্বি.) বললেন, তবে তুমি গিয়ে আমার বিষয়ে তোমার শায়খকে জিজ্ঞাসা করো। তার আপত্তি না থাকলে এক কোণায় রাত কাটিয়ে সকাল হতেই বেরিয়ে যাবো। অন্যথায় মুসাফিরের জন্য বিধাতার বিনা খুঁটির তাঁবু খোলা আকাশের ছায়াই যথেষ্ট।
সেবক কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রাহিবের নির্জন কক্ষে প্রবেশ করল। আপাদমস্তক বিনয়-বিনম্র হয়ে আরয করল, আরবের মক্কা নগরের দুই মুসাফির পথ ভুলে এখানে এসে পৌঁছেছে। তারা গির্জায় রাত যাপনের অনুমতি চায়। চেহারা দেখে একজন মনিব অন্যজন গোলাম বলে মনে হয়।
রাহিব কিছুক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞাসা করল, ওই মক্কা! যা পাহাড়ের জটলায় অবস্থিত? যার যত্রতত্র খেজুর গাছ মাথা উঁচু করে আছে?
খাদিম উত্তর দিল, আমি এত বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করিনি। যদি অনুমতি হয় জেনে আসতে পারি।
রাহিব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, অবশ্য জেনে এসো। তুমি যাকে মনিব ধারণা করেছো, তার নামও জেনে আসবে।
শায়খের আগ্রহ দেখে সেবকের মনে আগন্তুকের প্রতি শ্রদ্ধানুভূতি জন্মাল। সে গিয়ে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাসস্থান কি ওই মক্কা, যা পাহাড়ের জটলায় অবস্থিত এবং খেজুর বাগানে সুশোভিত?
হযরত আবূ বকর (রাদ্বি.) বললেন, হ্যাঁ! কথা দু’টো যথার্থ বাস্তব। সেবক পুনর্বার আরয করলেন, দয়া করে আপনার নামটি বলুন। ‘আমাকে আবূ বকর নামে ডাকা হয়’।
খাদিম দ্রুত ফিরে গেলেন রাহিবের কাছে। জানালেন, মক্কার ব্যাপারে আপনি যা বলেছেন, তা সঠিক এবং তিনি তাঁর নাম আবূ বকর বলে জানিয়েছেন।
নাম শুনতেই রাহিবের কপালে চিন্তা রেখা, তিনি যেন স্মৃতির পাতায় কি হাতড়িয়ে ফিরছেন! মগ্নতায় কেটে গেল কিছু সময়। অতঃপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে তালাবদ্ধ সিন্দুক খোলে পুরানো কাগজের দপ্তর বের করে অস্থিরতার সাথে পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করলেন! একটি পৃষ্ঠায় তার চক্ষু স্থির হল, চেহারায় ফুটে ওঠল আনন্দাভা। দেখে মনে হচ্ছে, তিনি যেন তাঁর উদ্দেশিতের সন্ধান পেয়ে গেলেন!
বড় অস্থিরতায় বিশ্বস্ত খাদিমকে ডাক দিয়ে বললেন, ওই বণিকের পিতার নামটিও জেনে এসো।
খাদিম আবার এসে বলল, পুনরায় কষ্ট দিতে হচ্ছে বলে আমি বড়ই লজ্জিত। আপনার সম্মানিত পিতার নাম যদি বলেন, তবে বড় উপকার হয়।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক বিস্ময় বিস্ফুরিত আঁখিতে দেখে এক শব্দে উত্তর দিলেন, আবূ কুহা-ফাঃ।
খাদিম ফিরে গিয়ে রাহিবকে ওই সংবাদ দিতেই তার চেহারা বিষ্ময় ও আনন্দের মিশ্রণে খেলে ওঠল। আবেগ-আকর্ষণের তরঙ্গে দাঁড়িয়ে খাদিমকে নির্দেশ দিল, যাও, কোনরূপ বিলম্ব না করেই তাকে আমার নিকট নিয়ে এসো।
রাহিবের এ নির্দেশে খাদিম অত্যাশ্চর্য হল। বিষ্ময়াবিভূত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ভাবতে লাগল শত বছরের রীতির বিপরীত সম্পূর্ণ অচেনা এ নির্দেশ বাস্তবিকই পালনের জন্য, নাকি মুখ থেকে অমনি বেরিয়ে পড়েছে!
তার অবস্থা দেখে রাহিব জোর দিয়ে বললেন, তুমি কেন ইতস্তত করছো? আমি জেনে বুঝেই আপন নিয়মের ব্যত্যয় করছি। ত্বরিৎ হুকুমের তামিল করো। বিষ্ময় প্রকাশের সময় এটি নয়।
হযরত আবূ বকর মনে মনে এ আশায় অপেক্ষা করছিলেন যে, যাছাই বাছাইয়ের পর এখানে রাত যাপনের অনুমতি মিলবে। সুতরাং পদধ্বনি কর্ণগোচর হতেই রাহিবের সিদ্ধান্ত শুনার জন্য উৎকর্ণ হলেন।
খাদিমের চেহারায় বিষ্ময়ভরা রহস্যময়তা! আসা মাত্রই সংবাদ দিল, ‘আমার জন্য আপনার ব্যক্তিত্ব আপাদমস্তক আশ্চর্যময়! গির্জার শত বছরের ইতিহাসে আপনিই প্রথম ব্যক্তি, আমাদের সংসারত্যাগী শায়খের নির্জন কক্ষে যার ডাক পড়েছে। বরং আপনার যাদুকরি ব্যক্তিত্ব তাঁকে আপাদমস্তক আশা-আকাঙ্খা বানিয়ে দিয়েছে। তিনি অতি অস্থিরতায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। শিগগির চলুন, অন্যথায় মুহূর্তের অপেক্ষাও পরিপূর্ণ অনুরাগীর কাছে কালান্তরের প্রহর গুণার মতো ঠেকবে।
হযরত আবূ বকর বিষ্ময়ের মূর্ত প্রতীক হয়ে তার পিছু পিছু রাহিবের কক্ষে প্রবেশ করলেন। ঝুলন্ত সাদা ভ্রু, কঙ্কালসার দেহ, কয়েকশ বছর বয়সি বৃদ্ধ স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
কক্ষে প্রবেশ করতেই ক্ষীণ এক আওয়াজ কানে এল, ‘যদি আপনি ওই ব্যক্তি হোন, যার কিছু নিদর্শন আমার কাছে সংরক্ষিত আছে; তবে আপনার সাক্ষাৎ আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের’।
এ কথা বলে ঝুলন্ত ভ্রু চোখ হতে সরিয়ে প্রদীপের প্রখর আলোতে মাথা হতে পা পুরো শরীর একবার পর্যবেক্ষণ করলেন। কখনো কিতাবের পুরোনো পৃষ্ঠায় আঙুল রাখেন-তো কখনও চেহারার আকার-আকৃতি দেখছেন। পুস্তকের লিখা আর অবয়ব গ্রন্থের রেখা মিলানোর অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ শেষে আত্মহারা অবস্থায় আওয়াজ দিলেন, ‘কষ্ট না হলে আপনার ডান হাতের কব্জি ও কনুইয়ের মধ্যবর্তী স্থল আমার চোখের সামনে মেলে ধরুন।’
হাতের এ অংশটির ওপর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিতেই তাঁর অনুরাগ-আকর্ষণ আয়ত্বের বাইরে চলে গেল। স্পন্দিত অধরে আঙুলে চুমো দিয়ে বললেন, ‘অনুমতি দিন যে, আমি আপনাকে আমীরুল মু’মিনীন আবূ বকর সিদ্দীক বলে ডাকি’।
আশ্চর্যের সুরে হযরত আবূ বকর বললেন, বুঝেই আসছেনা যে, একটি মাত্র রাত যাপনের প্রশ্নে আপনি কত ঝামেলা পাকিয়ে দিলেন! কখনো মক্কার ভৌগলিক অবস্থান জিজ্ঞাসা-তো, কখনো আমার আবার কখনো বাবার নাম। কখনো শত বছরের কাগজ নিয়ে আমার চেহারা ও শরীরের চিহ্নাদির পর্যবেক্ষণ-তো, কখনো এমন নামে ডাকার অনুমতি প্রার্থনা, যে নামে আমার বাবা নামকরণই করেননি। শেষতক আপনিই বিবেচনা করুন, এ কেমন রসিকতা? সমস্যাগ্রস্ত মানুষের সাথে এরূপ কৌতুক সংসার ত্যাগী রাহিবের জন্য মোটেও শোভন নয়।
একটি রাত কাটানোর অনুমতি দেওয়ার হলে দিন, অন্যথায় আকাশের শামিয়ানা মুসাফিরের জন্য বেশ যথেষ্ট।
এ কথা বলে আবূ বকর প্রস্থান করতে চাইলে রাহিব তাঁর হাত ধরে ফেললেন। দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, হায় আফসোস! আসমানি সুসংবাদ শুনে দুঃখিত হলেন! আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি যে, ধরাপৃষ্ঠের এক পরম সম্মানী ব্যক্তির সাথে আমি কখনো ঠাট্টা করতে পারিনা। আপনার ভাগ্যের যে লিখন আমার নিকট সংরক্ষিত ছিল, আমি তা পড়ে শুনিয়েছি মাত্র, কোনরূপ মজা করিনি।
আজ আমার কথায় হয়তো আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা। পরন্তু শুনে রাখুন যে, মক্কার আকাশে রিসালতের আলোক-উজ্জ্বলকারী রবি অতি সত্ত্বর উদয় হতে যাচ্ছে, যার পাশে এক আলোকময় তারাকা রূপে মহাপ্রলয় পর্যন্ত আপনি দীপ্ত থাকবেন।
আসমানি কিতাবসমূহে ধরিত্রীর শেষ নবীর আত্মপ্রকাশ ও তাঁর প্রথম খলীফাহর যে সকল নিদর্শনাদি চিহ্নিত রয়েছে, আপনার ব্যক্তিত্বের দর্পণে তা আমি সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আপনার তেজদীপ্ত চেহারার শুধু নয়, ডান হাতের এ তিলের কথাও আমাদের কিতাবে রয়েছে। ইব্রানী ভাষা জানা থাকলে নিজেই আপন আপাদমস্তক এ আসমানি লিখনীতে পড়ে নিন।
যা হোক, এখন আপনি এক ভিনদেশী মুসাফির নন, পবিত্র জ্যোতি বিচ্ছুরণালয়ের উত্তরাধিকারী ও রক্ষক। এ খানকাহের ছায়ায় শুধু নয়, ইচ্ছা হলে আমার শুভ্র পলকে রাত যাপন করতে পারেন।
এক জটপাকা বিষ্ময়ের ভিড়ে হযরত আবূ বকর রাহিবের নির্জন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। গির্জার একটি কক্ষে শুইয়ে পড়লেন। সারা রাত রাহিবের কথাগুলো মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্তরে নানা রকমের ধারণার ঝড় বইতে রইল। দু’চোখের পাতায় মুহূর্তের জন্যও ঘুম নামলনা।
সকালে বিদায় হচ্ছিলেন-তো রাহিবের বিদায়ী সাক্ষাত বড়ই বেদনাবিধুর ছিল। সজল নয়নে কপাল চুম্বন করে বললেন, ‘আপনার জীবনে প্রভুজ অনুগ্রহের ওই শুভসকাল যখন উদিত হবে, তখন সৌভাগ্যমণ্ডিত দু‘আয় আমাকেও স্মরণ রাখবেন।’ রাহিবের এ কথা মক্কা ফেরা অবধি তাঁর মনে অংকিত ছিল।
কয়েক মাস পর আজ হযরত আবূ বকর আপন ব্যবসায়িক সফর শেষে বাড়ি ফিরছেন। দিবারাত্র চলতে চলতে মক্কার দূরত্ব মাত্র এক দিনের পথ। খেজুরের ঝাড় অতিক্রমকালে রাহিবের কথাগুলো স্মৃতিকে অবিরত নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আদিনগর মক্কার পাহাড়সমূহ দৃষ্টিত হতেই এক অদৃশ্য তুফানে মনোজগত উলট-পালট হতে লাগল। প্রভুজ প্রকৃতির আকর্ষণে উটের চলা দ্রুত হল।
কিছুদূর এগুতেই মক্কার বসতি নজরে এল। অনুরাগ-আকর্ষণের তরঙ্গে বাহন হতে নেমে পড়লেন। বিশ্বস্ত গোলাম উটের লাগাম আঁকড়ে ধরল। মহল্লায় প্রবেশ করতেই কোথা হতে আবূ জাহল এসে পড়ল। ডাক দিয়ে দৌঁড়ে নিকটে পৌঁছল। বড় অধৈর্যে বলতে লাগল, ‘আপনি মনে হয় বহুদিন পর সফর হতে ফিরছেন। আপনার অবর্তমানে এখানে কি ঘটে গেল; সম্ভবত জানেন না।’
হযরত আবূ বকর উত্তর দিলেন, ভিনদেশে থেকে কীকরে জানবো? সত্যিই যাওয়ার পর থেকে এখানকার বিষয়ে আমার কোন অবগতি নেই। যদি বিশেষ কিছু হয়ে থাকে, বলুন।
আবূ জাহল বিদ্রুপাত্মক সুরে বলল, ‘আব্দুল্লাহর বেটা মুহাম্মদকে আপনিও চিনেন-জানেন। সে নিজ গোত্রে কত সম্মানী ও প্রিয় তা-তো সকলের জানা। পুরো শহর তাকে মর্যাদা মাহাত্ম্য ও পবিত্রতার লৌহমানব মানত। পরন্তু আপনিও আশ্চর্য হবেন যে, কিছুদিন ধরে সে এক উদ্ভট কাহিনী রটিয়ে যাচ্ছে! সে বলে বেড়াচ্ছে যে, আমি আল্লাহর শেষ নবী! আমার নিকট একজন ফিরিশতা আসমান হতে ওহী নিয়ে আসে! এখন সে ভিতরে-বাইরে আপন বাপ-দাদার উপাস্যদের নিন্দাবাদে অবতীর্ণ হয়েছে! লাত ও হুবালের দ্বার হতে ফিরিয়ে মানুষকে এক অদেখা প্রভুর উপাসনার দিকে আহ্বান করছে! আরব বিশ্বের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের বিপরীত এ বিদ্রোহী প্রদক্ষেপে পুরো মক্কায় রাগ-ক্ষোভের অনল জ্বলছে।
বর্তমানে আবূ তালিবের তত্ত্বাবধানে থাকায় কেউ কিছু করছেনা। পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যে, তিনি সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিলে মক্কার ভূমি সুবিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তার জন্য সংকীর্ণ হয়ে যাবে।
জাতির কাছে আপনার বুদ্ধি-বিচক্ষণতা প্রবাদতুল্য। সকলের নিকট আপনার মতামতের আলেদা গুরুত্ব রয়েছে। আমি দৃঢ় আশাবাদী যে, এ বিদ্রোহ দমনে আপন নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখে আপনি নিজ সম্প্রদায়কে কৃতজ্ঞ করবেন।’
আবূ জাহলের কথা শুনে হযরত আবূ বকরের চোখের সামনে এক নবজীবনের ভবিষ্যৎ ঝলমল করে ওঠল। রাহিবের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবতার কিরণে উদ্ভাসিত মনে হল। বড় কষ্টে আবেগ সংবরণ করে বললেন, ‘মাত্রই-তো সফর হতে ফিরলাম। হাত-মুখ পর্যন্ত ধুয়া হয়নি। সার্বিক পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ না করে কিছু বলা ঠিক হবেনা।’
আবূ জাহল হতে ছাড়া পেয়ে সোজা নিজ গৃহে গেলেন। মালপত্র রেখে পোষাক-পরিচ্ছেদ পরিবর্তনের অবকাশ পর্যন্ত মিললনা। এক অজানা আকর্ষণ তাঁকে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর প্রতি টানছে। তিনি দ্রুত আবূ তালিবের ঘরে পৌঁছলেন। জিজ্ঞাসায় নবী করীম (দ.)’র অবস্থান জানতেই আবূ কুবাইস পাহাড়ের দিকে পা চালালেন। পৌঁছে দেখলেন বিশ্বকুল সম্রাট (দ.) পাহাড়ের পাদদেশে একটি পাথরে বসে আছেন। জ্যোতিময় চেহারা হতে রহমত ও নূরের কিরণ ঠিকরে পড়ছে। পদধ্বনি পেতেই মুখ তুলে মৃদুহাস্যে বললেন, ‘তোমার আগমন মুবারক হোক’। সম্ভাষণের ধরনে স্পষ্ট যে, তিনি (দ.) অমনি বসেছিলেন না, বরং কোন নবাগন্তুকের অপেক্ষাই ছিলেন।
নবূয়ত ঘোষণার পর হযরত আবূ বকরের এটি প্রথম সাক্ষাৎ। খুশির আলোতে রাসূলুল্লাহ (দ.)’র চেহারা ঝলমল করছে। আবূ বকর আপন ভাগ্যলিপির কারিশমা অবলোকন প্রত্যাশায় নীরব দাঁড়িয়ে রইলেন।
অমনি পবিত্র পুষ্পপাপড়ি (অধর মুবারক) স্পন্দিত হল আর হৃদয়বিজয়ী সুর অনুরণিত হল। ‘আবূ বকর! কলিমা-ই হক্বের দিকে এগিয়ে আসায় পশ্চাতাগন্তুকের অপেক্ষা করোনা। আল্লাহর শেষ নবী তোমাকে অনন্ত জীবনের প্রতি আহ্বান করছে। বিনা ইতস্ততায় গ্রহণ করো।’
আবূ বকর অবনত মস্তকে উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহর রাসূলগণের বিষয়ে আমি শুনেছি যে, তারা রিসালতের দায়িত্ব নিয়ে  পৃথিবীতে প্রেরিত হওয়ার সময় কিছু নিদর্শনাদিও নিয়ে আসেন। আমিও আত্মপ্রশান্তির জন্য কোন নিদর্শনের আশাবাদী’।
রাসূলকুল সম্রাট (দ.) তাঁর দিকে দেখে ফরমালেন, ‘নিশানাদি অতিক্রম করে এসেও তোমার নিদর্শনের প্রয়োজন রয়ে গেল! গির্জার ওই সুনসান রাত গেল-তো বেশি দিন গড়ায়নি।  তোমার ডান হাতের তিল দেখে শামী রাহিব কি বলেছিল স্মরণ করো। আমার রিসালতের সত্যায়নের জন্য আসমানি কিতাবের ওই লেখা কি যথেষ্ট নয়, যা নির্জন রাতে বৃদ্ধ রাহিব তোমাকে পড়ে শুনিয়েছে!’ তোমার মনের ওই ধারাবাহিক অস্থিরতা, যা চোখের ঘুম কেড়েছে, হাত-মুখ ধুয়ার অবকাশ দেয়নি, ধুলিধূসর এখানে টেনে এনেছে, আমার রিসালতের সুধা ছাড়া তার সুস্থিরতার অন্য কোন সম্বল আছে কি?’
বিস্ময়াভিভূত আবূ বকর তনুমনে হাক্বীক্বতের পর্দাহীন দীপ্তিতে বিভোর হয়ে রইলেন। অনুরাগ-আকর্ষণের জোশে স্বতস্ফূর্ত চিৎকার দিয়ে ওঠলেন, ‘এখন আমার কাছে অন্য কোন নিদর্শনের অপেক্ষা নিষ্প্রয়োজন। আপন চোখের জ্যোতিতে যিনি সহস্র মাইল দূরের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি নশ্বর জগতের গোপন বিষয় সম্পূর্ণ চাক্ষুষের মতো জানেন, তাঁর ক্ষেত্রে এ বিশ্বাস রাখতে সংশয় নেই যে, তিনি উর্ধ্ব জগতের হাক্বীক্বত সম্পর্কেও অবশ্য অবগত।
অন্তর-তো প্রথমেই মু’মিন হয়েছিল, এখন মুখেও স্বীকার করছি যে, আপনি আল্লাহর সত্য রাসূল এবং এক আল্লাহ ভিন্ন অন্য উপাস্য নেই।’
ইসলামের ইতিহাসে তৌহীদ ও রিসালতের এটি প্রথম স্বীকৃতি, যা রাসূলুল্লাহ (দ.)’র অদৃশ্যজ্ঞান জানার ওপর নির্ভর করে দৃশ্যপটে এসেছে। এবার বিবেকভ্রষ্ট নামধারী তৌহীদি জনতার ফিতনা-ফ্যাসাদের হাতিয়ার দেখো, যে আক্বীদাহর ভিত্তিতে ইতিহাসের সর্বপ্রথম (বয়স্ক পুরুষদের মাঝে) মুসলিমের আত্মপ্রকাশ, ওই আক্বীদাহ আজকের অমঙ্গলকামী শত্রুদলের কাছে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়ার হাতিয়ার! মাত্র একজন আবূ বকর সিদ্দীক নয়, ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য ব্যক্তিত্ব পাবে, যাদের ইসলাম গ্রহণের নিয়ামক প্রিয় রাসূল (দ.)’র অদৃশ্যজ্ঞান।
রাসূলুল্লাহ (দ.)’র এ বৈশিষ্ট্য কারো ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত ছিলনা। পুরো আরবে এতই প্রসিদ্ধ ছিল যে, মানুষ নির্জন কক্ষে স্ত্রীর সাথে কথা বলতেও ভয় পেতো যে, কোথাও নবী (দ.) শুনে না যান।
রাসূলুল্লাহ (দ.)’র অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্ক মক্কার মুশরিকদের সাধারণ আক্বীদাহ ছিল যে, কোন কিছু জানার জন্য তাঁর সংবাদকের প্রয়োজন নেই। দেওয়ালের বালি-পাথর পথের ধুলিরাশিও তাঁকে সংবাদ দেয়।
প্রিয় পাঠক! আবূ জাহলের বিষয়ে একটি ঘটনা এতই প্রসিদ্ধ যে, তা সকলেরই জানা। আপনাদেরও জানা থাকবে হয়তো। রাসূল (দ.)’র রিসালত পরীক্ষার জন্য সে কিছু কংকর আপন মুঠোয় নিয়ে নবী (দ.)’র নিকট এল। বলল, আপনি যদি সত্যিই রাসূল হোন, আসমান-যমিনের রহস্যের খবর রাখেন; তবে বলুন, আমার মুষ্টির ভিতর কি আছে?
আবূ জাহলের মতো দুর্ভাগান্তর লোকও এটি স্বীকার করতো যে, রাসূলের জন্য অদৃশ্য জানা আবশ্যক। যিনি রাসূল হবেন, তাঁর কাছে ভূখণ্ড ও নভমণ্ডলের রহস্যাধির জ্ঞান, গোপন বিষয়ের অবগতি অবশ্য থাকবে। রাসূলুল্লাহ (দ.)’র অদৃশ্যজ্ঞান অস্বীকারকারী আজকের কলিমা পড়ুয়ারা নিশ্চয় আবূ জাহলের চেয়েও দুর্ভাগা!
হায়রে দুর্ভাগা তৌহীদি জনতা!
[আরশাদুল কাদেরীর লালাঃযার অবলম্বনে।]

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *