ইয়াহূদী হে নসারা হে হাকীকত মে বহী কমবখ্ত জিসে গাউসে খোদা সে কুছ বদিল ইনকার হূজাবে

আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
মকবূলে বারগাহে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী, বাহরে উলূমি আসরারে জব্বারী, আবূল বরাকত হযরত মাওলানা সৈয়্যদ আব্দুল গনী আচ্ছাফী আল্ মকবূল কাঞ্চনপুরী রহমতুল্লাহিল বারী’র গযলের উক্ত কলি শিরোনাম করে তদালোক অল্প-স্বল্প আলোচনার প্রয়াস পাবো। প্রথমে কলিটির অনুবাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করছি।
‘ইয়াহূদ বা নাসারা মূলে সে-ই ভাগ্যহত,
গাউসে খোদায় যার টুকু মনোঘৃণা হবে।’
 
‘কুছ বদিল ইনকার’ বা সামান্যতম আন্তরিক ঘৃণা-অস্বীকার হেতু দু’কূল বরবাদ হওয়ার দু’টি ঘটনা আঈনায়ে বারী গ্রন্থে ‘দর বয়ানে মসলূবুল বিলায়ত হূজানে এক অলিয়ে মশহূর কে’ ও ‘দর বয়ানে মসলূবুল বিলায়ত হূজানে এক অলিয়ে সাহেবে কারমত কে’ শিরোনামে বিবৃত। উক্ত গ্রন্থের বর্ণনা মতে ওই দুইজনই ছিলেন বড় মাপের অলিয়ুল্লাহ। অপর দিকে গাউসুল আ’যম (রা.)’র প্রতি আন্তরিক ভক্তি-বিশ্বাস হেতু এক হিন্দু বারইয়ের মরণকালে স্বতঃস্ফূর্ত কালিমা-ই শাহাদত ও তৌহীদ পাঠ এবং অগ্নিদগ্ধ করতে না পারার ঘটনাও একই গ্রন্থে সবিস্তারে বিবৃত।
একদিকে ঘৃণা হেতু অলির বিলায়ত যাওয়া অপরদিকে ভক্তিতে হিন্দুর ঈমান পাওয়া; উভয় দিক বিশেষভাবে লক্ষণীয় ও শিক্ষণীয়। অন্যথায় ঈমান-আমল অজ্ঞাতেই যাবে রসাতলে।‘আন তাহ্বাত্বা আ’মালুকুম ওয়া আনতুম লা তাশ্উরূন’।
 
কুছ বদিল ইনকার বা সামান্যতম আন্তরিক ঘৃণা বিভিন্ন পর্যায়ের হতে পারে। (ক) বিলায়ত স্বীকার করে বিশেষ শানকে অস্বীকার করা, (খ) বিশেষ শানসহ বিলায়ত স্বীকার করে অধঃস্থ কাউকে সমকক্ষ মানা ইত্যাদি-ইত্যাদি। আমরা দ্বিতীয় তথা তুলনামূলক লঘু পর্যায়টির পরিণতি নিয়ে আলোচানায় মনোনিবেশ করছি।
প্রথমে এমন এক প্রসিদ্ধ মাওলানার ভ্রষ্টতায় নিমজ্জনের চিত্র তুলে ধরবো, যিনি নানা স্ববিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র অধঃস্থ এক মহান সত্তাকে গাউসুল আ’যম প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। গাউসুল আ’যম শাহানশাহে বাগদাদ (রা.) কর্তৃক তুল্য সমকক্ষ বন্ধু এবং গাউসুল আ’যম শাহানশাহে মাইজভাণ্ডার (রা.) কর্তৃক ভাই ও সোনালী অক্ষরে নাম লেখা থাকার ঘোষণার মাধ্যমে সমকক্ষতার বলিষ্ঠ প্রমাণকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে নিজের দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছেন। তার দুর্ভাগ্যের কিছু নিদর্শন নিম্নে হুবহু উপস্থাপিত হল।
১. ‘নবুয়তের প্রথমাবস্থার “রূহে হায়ওয়ানী” ও “রূহে ইনছানী” সংশ্লিষ্ট সসীম শক্তিশালী মানব রছুলুল্লাহ (দঃ) এর পক্ষে অসীম শক্তিমান “রুহুল কুদছের” বা জিব্রাইল (আঃ) অথবা আল্লাহ তাআলার “ছিফতে জিব্রাইলী”র সহিত রূহের সংযোগ সাধন পূর্বক “ওয়াহি” গ্রহণ করা মহা কষ্টসাধ্য হইয়াছিল। পরম কারুনিক আল্লাহ্ তাআলা খাছ রহমত করিয়া তাঁহার “লতিফা” সমূহকে উন্মুক্ত ও প্রসারিত করিয়া ওয়াহী গ্রহণ তাঁহার পক্ষে সহজসাধ্য করতঃ তাঁহা হইতে মহা ভারী বোঝা অপসারণ করিয়াছিলেন।”
 
২. ‘বাস্তবিক আল্লাহ তাআলার সহিত দাস ও মনিবের ন্যায় যাহাদের সম্বন্ধ তাহারা সম্পূর্ণ পাপ হইতে মুক্তি লাভ করিয়া আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ বা বেহেস্ত লাভের সম্পূর্ণ আশা করতে পারেনা। কারণ আল্লাহ তাআলার সম্যক দাসত্ব সমাধা করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই সমুদয় পাপ কাজ হইতে সম্পূর্ণ বিরত থাকাও মানুষের সাধ্যাতীত। কোন নবী (আ.)-ও অনিচ্ছাকৃত পাপ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত হইতে পারেন নাই। যেমন হজরত মুছা (আ.) নরহত্যা করিয়াছিলেন, আমাদের রছুলুল্লাহ (দ.)-এর শানে ছুরা-আবাছা অবতীর্ণ হইয়াছিল ইত্যাদি। যখন আল্লাহ তাআলার পূর্ণ দাসত্ব সমাপন করা বা সমুদয় পাপ হইতে সম্পূর্ণ বিরত থাকা মানুষের সাধ্যাতীত, তখন মানুষ মাত্রেই আল্লাহ তাআলার নিকট অপরাধী।’
 
৩. “জিছমে খাক আয্ এশকে বর আফলাকে শোদ
কোহে দর রকছ আমদ ও চালাকে শোদ”
(জিছমে খাক) মাটিরর শরীর- এই স্থলে হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) ও হজরত ইছা (আ.)কে বলা হইয়াছে।
অনুবাদ: “মাটির শরীর [হজরত মোহাম্মদ (দ.) ও হজরত ইছা (আ.)] এশকের দ্বারা আছমানে আরোহন করিয়াছেন এবং কোহেতুর বা সীনা পর্ব্বত প্রেমানন্দে নৃত্য পরায়ন হওয়ায় আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ লাভ করিয়াছে।”
হজরত ইছা (আ.) ও হজরত মোহাম্মদ (দ.) উভয়েই মানুষ সুতরাং মাটির দেহ বিশিষ্ট। কিন্তু এশকের উৎকর্ষের দ্বারা হজরত ইছা (আ.) জীবিত অবস্থায় সশরীরে চতুর্থ আছমানে এবং হজরত মোহাম্মদ (দ.) জাগ্রতাবস্থায় সশরীরে সপ্তম আছমান, আরশ, কুরছি, স্থান, কাল, ইত্যাদি অতিক্রম করিয়া আল্লাহ তাআলার অতি নিকটে গমন করত: তাঁহার সহিত নব্বই হাজার কালাম করিয়া বেহেস্ত দোজখ ইত্যাদি পরিদর্শন করতঃ মুহূর্তের মধ্যে নিজ শয্যায় ফিরিয়া আসিলেন,- যাহাকে ‘মে’রাজ শরীফ বলা হয়। হজরত মুছা (আ:) সীনা পর্ব্বতে গিয়া আল্লাহ্তাআলার দর্শন প্রার্থী হইলে আল্লাহ্ তাআলা বলিয়াছিলেন- ‘তুমি কখনও আমাকে দেখিতে সমর্থ হইবেনা, কিন্তু তুমি (সীনা) পাহাড়ের দিকে তাকাও! যদি পাহাড়ের স্থান বা অস্তিত্ব টিকিয়া থাকিতে পারে, তবে শীঘ্রই তুমি আমাকে দেখিবে।
পাহাড় আল্লাহ্তাআলার এই পবিত্র বাণী শ্রবণ করিয়া প্রেমানন্দে নাচিয়া উঠিয়াছিল। অতঃপর পাহাড়ের উপর আল্লাহতাআলা জলওয়া বা জ্যোতিঃ বিকাশ করিলেন। তাই, সীনা পর্ব্বত পৃথিবীর যাবতীয় পর্ব্বত হইতে শ্রেষ্ঠ ও মর্য্যাদা সম্পন্ন হইল।”
উক্ত বক্তব্য সম্পর্কে কোন মন্তব্যই আমরা করবোনা। শুধু বলবো, গাউসুল আ’যম কুতবুল আফখম হযরত শাহসূফী সৈয়্যদ আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র শানে ঔদ্ধত্যের পরিণতি এমনই হয়।
 
“খমবকত ইসেহী কাহতা হে, খমবতী এয়সাহী হৌতাহে,
বসববে আন্ধাপন স্রেফ ইয়ে নযরোঁ সে উঝল রেহতী হে।’
‘দূর্ভাগা ইহাকেই বলে, দূর্ভাগ্য এমনই হয়,
অন্ধত্ব হেতু কেবল ইহা দৃষ্টির আড়ালে রয়।”
এবার আমাদের সমকালীন এক মাওলানার বক্তব্যও একটু লক্ষ্য করুন, যিনি পূর্বোক্ত মাওলানার চর্বিত তৃণের জাবর কেটেছেন।
 
“তাই আল্লাহ্তায়ালা “আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম, ওয়াতমামতু আলাইকুম নি’মাতী … বলা সত্ত্বেও নবী (দ.)’র সাহাবীরাও পরবর্তী ওলামা, ফকিহ, বুজর্গানেদ্বীনগণ দ্বীন ধর্মের চাহিদাকে পূর্ণতা দান করবেন।”
 
উক্ত বক্তব্য আল্লাহ্তায়ালা কর্তৃক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র মাধ্যমে দ্বীনে ইসলামের পরিপূর্ণতাদানের অস্বীকৃতি দুষ্ট বিধায় অজ্ঞাতেই ঈমান-আমল বিনষ্ঠের সুস্পষ্ট নিদর্শন কিনা বিবেচ্য। পরিশেষে আপন ঈমান-আমল রক্ষায় ‘কুছ্ বদিল ইনকার’ বা সামান্যতাম আন্তরিক ঘৃণা-অস্বীকারের পথ পরিহারের উদাত্ত আহ্বান রইল।
 
তরফদারীর চশমা খুলে দেখ ওহে বন্ধু সকল,
ঘুরচে ঘূর্ণি মূর্খ্যতার যাচ্ছে স্বদল রসাতল
উল্লেখ্য যে, কারো ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করার অনীহা হেতু উদ্ধৃতি সমূহের তথ্যসূত্র সন্নিবেশনে নিবৃত্ত রইলাম। এ আন্তরিকতাকে দুর্বলতা না ভাবার সবিনয় অনুরোধ রইল।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *