চলিত ভাষায় রূপান্তর : মঈনুদ্দীন মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ
[বি. দ্র.: ১৯৮৭ সনের ১২ রবিউল আওয়াল আঞ্জুমানে তৌহীদ বতোফায়লে রশীদের উদ্যেগে হারুয়ালছড়ি গাউসিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মাহফিলে সভাপতির ভাষণে প্রদত্ত ত্বাকরীরের চুম্বকাংশ]
পর্ব-৫ [মাদ্রাসা ও আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার হাক্বিক্বত]
(ইলমে যাহির ইলমে বাত্বিনের দীক্ষা)
হে পিয়ারে মুসলমানো! আমি এ মাদ্রাসা করলাম, আঞ্জুমান করলাম। দুইটি জিনিস আপনাদেরকে আমি নগন্য দিয়ে যাচ্ছি। আমি দিয়ে যাচ্ছি না, আল্লাহ দিচ্ছেন, আল্লাহর হাবীবে দিচ্ছেন, গাউসুল্লাহ দিচ্ছেন, মুরশিদ মাওলা আপনাদেরকে দিচ্ছেন। আমাকে কুশপুত্তলিকা স্বরূপ বানিয়ে এ গুলো করেছেন। তোমাদের আমি দুটি জিনিস সৃষ্টি করে দিলাম; আমি দিইনি, আমার বাপ দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী কেউ দেয়নি, খোদ খোদা মাওলা আহকামুল হাকেমীন পাক পরওয়ার দিগারে আলম দিয়েছেন। মগর (কিন্তু) ওছিলা খুঁটি একটি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। একটি মাদ্রাসায়ে গাউসিয়া রহমানিয়া ছুন্নিয়া অপরটি আঞ্জুমানে তৌহীদ। যে তৌহীদের বর্ণনা এতক্ষণ পর্যন্ত দিয়ে আসলাম। ইলম বহু রকমের আছে, ইলম মোটামুটি দু’ কিছিম আছে, ইলম ১২ কিছিম আছে, মূসা কলিমুল্লাহ যে সময় পাথরে লাটি মেরেছেন ১২ টি ঝরণা বের হয়েছে, ১২ ঝরণার সাথে ১২ টি ইলমের কানেকশন আছে, এমনি ২২ ইলম ২৩ ইলম ২৪ ইলম হাজার ইলম আছে, মগর (কিন্তু) ইলম ১২, ২২ সব বাদ দিয়ে মোটামুটি দু’টি ইলম সব ইলমকে পরিবেষ্টনকারী। একটি ইলমে যাহির অপরটি ইলমে বাতিন। একটি পাখির দুটি পাখা ধরুন, একটি যাহির অন্যটি বাতিন। দুই পাখার দ্বারা ওড়ে যদি দেখ, পাখি রূপে আরশে মুয়াজ্জম, আরশে মুয়াল্লার মধ্যে ওঠতে পারবে। মগর (কিন্তু) একপাখা যদি ভেঙে যায় আর এক পাখা দিয়ে ওড়লে, সারা জীবন ওড়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যাবে- কখনো উপরের দিকে যেতে পারবেনা। এই দুই পাখার মধ্যে একটি ইলমে যাহির, অন্যটি ইলমে বাতিন। ইলমে যাহির দরস-তদরিসের মাধ্যমে হাসিল হবে। মাওলানা সাহেবরা বালাগত, হিকমত, উসুল, ফিকহ, হাদীস, তফসীর, কুরআন যে গুলো পড়াচ্ছেন এ জিনিস দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার আমর এবং নেহীযা করতে বলা হয়েছে সে মতে চলা, যা নিষেধ করছেন ঐ দিকে না যাওয়ার জ্ঞান লাভ হবে। এগুলো এক ডানা, এ ডানা দিয়ে সারা জীবনও যদি ওড়ে যাও মুস্তফা (দ.)’র যে জ্যোতি নূরের তজল্লিয়াতের জলওয়া, যা তোমার ক্বলবে আমানত রেখেছে তার নাগাল তথা আল্লাহর জাতে পাকের দীদার-দর্শন পাবে না। তোমাদের ত্বরিকতের ডানা-পাখা নিতে হবে। এ ত্বরিকতের পাখা যা অদেখা, তা আরিফ বিল্লাহদের নিকট রয়েছে; ভিতর-বাহির (ইলমে যাহির ও ইলমে বাতিন) উভয়টি দিয়ে ওড়তে হবে। কারণ উপরেরটি তোমাকে দলীল রূপে সাহায্য করবে, ভিতরেরটি তোমাকে শক্তি দান করবে। এই শক্তি তথা ভিতরের ইলম যদি না হয়, ইশকে মাওলা, ইশকে মুস্তফা (দ.) লাভ হবে না। এ কারণে তুমি পন্থা পাবে না। খারেজী, রাফেজী, শিয়া, মু’তাযিলা প্রত্যেকে মাদ্রাসা করছে, প্রত্যেকের মাদ্রাসায় হাদীস, কুরআন বয়ান হচ্ছে। আমরাও আজ হারুয়ালছড়ির বুকে মুষ্টিমেয় সাধারণ টুটা-ফাটা মানুষ মাদ্রাসা করলাম, যার নাম গাউসিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া রাখা হয়েছে, গাউসুল আ’যম (জিলানী ও মাইজভাণ্ডারী) এর নামও আছে, সুলতানে আ’যম বাবাভাণ্ডারীর নামও আছে, ছরকারে দো’আলম (দ.)’র নামও আছে; সমস্ত শক্তির নাম এখানে দিয়েছি। কেননা নামে পাকের তাওয়াজ্জু, ফয়য-বরকত হাসিলের মাধ্যমে মাদ্রাসা যেন সু-প্রতিষ্ঠিত হয় । আমার মনো-আকাঙ্ক্ষা
তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি, এ মাদ্রাসা খারেজী, তাবলিগী, রাফেজী, মওদুদীর মাদ্রাসার মত মাদ্রাসা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এ মাদ্রাসার ভিতর দিয়ে ঐ জিনিস দিতে চাই, ‘ওয়া’তাসিমু বিহাবলিল্লাহি জমিয়া’ তোমরা প্রত্যেকে আল্লাহর রশিকে মজবুত করে আঁকড়ে ধর। (সূরা আল-ই-ইমরান ১০৩ নং আয়াত) আল্লাহর রশির এতক্ষণ পর্যন্ত বয়ান হল, রশি কোনদিক হয়ে কোন দিক দিয়ে ঘুরে এসেছে তোমাদেরকে প্রকাশ্য বলার আর প্রয়োজন নেই। ঐ রশি তৌহীদের রশি, তৌহীদের রশি ধরে তোমার ক্বলবের যে আমানত মরে গিয়েছে, তা যদি জিন্দা কর তবে দীদারে ইলাহীর আশা রাখতে পার।
কেননা শরীয়তে মুস্তফা (দ.), ত্বরীক্বতে মুস্তফা (দ.), মা’রিফতে মুস্তফা (দ.), হাকীক্বতে মুস্তফা (দ.)’র সমষ্টিতে দ্বীন-এ ইসলাম। দেখুন, এ চেয়ার এ টেবিলটির চারটি খুঁটি আছে; তিন খুঁটি বাদ দিলে এক খুঁটিতে চেয়ার-টেবিল কখনো থাকবে না।
মুস্তফা (দ.) ধর্ম চার খুঁটির উপর স্থিত। এ কারণে শরীয়ত, ত্বরীক্বত, হাক্বীক্বত ও মা’রিফত সব লাগবে। আমি আশা করি এ মাদ্রাসার ভিতর দিয়ে, এ আঞ্জুমানে তৌহীদের ভিতর দিয়ে, আঞ্জুমানে তৌহীদের বীর পুরুষদের ভিতর দিয়ে, গাউসিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার মুদাররিস এবং তালিবে ইলমের ভিতর দিয়ে ওই তৌহীদের ডঙ্কা বিশ্বের নগরে নগরে বাজতে থাকবে। আহ্কামুল হাকেমীন পাক পরওয়ারদিগার আমার এই ফরিয়াদ কবুল করুন। যদিও আমার মত নালায়েক আপনার সৃষ্টির মধ্যে আর কেউ নেই। মগর (কিন্তু) আমার আকাঙ্ক্ষা, আমার আশা, এই যে, আঞ্জুমানে তৌহীদ এবং মাদ্রাসায়ে গাউসিয়া রহমানিয়ার ভিতর দিয়ে আপনি খোদার খোদায়ীত্বকে এবং আপনার হাবীবের নূরের তজল্লিয়াতকে মানুষের মাঝে প্রস্ফুটিত করে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়া। গাউসিয়া রহমানিয়ায় পড়ে এক পাখা ওয়ালা পাখি হবে,তা আমার চাওয়া নয়। দুই পাখায় ওড়ে আল্লাহর দরবারে দিদার পর্যন্ত পৌঁছিবার তৌফিক ক্যাপাসিটি তোমরা (ছাত্ররা) জোগাড় কর। ‘আঞ্জুমানে তৌহীদ’ সংগঠনকে মজবুত কর। আমার তাক্বরীর আর দীর্ঘায়িত করতে যাচ্ছিনা। রাত কিছুক্ষণ হয়েছে, আপনাদেরও কষ্ট হচ্ছে। আমার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সংক্ষেপে বলে দিলাম, এখন আমি সংক্ষিপ্তভাবে শেষ করে দিচ্ছি। আমার ওই ফরিয়াদ আল্লাহর দরবারে আপনাদেরও জানিয়ে দিচ্ছি, কারণ কখন মৃত্যুর পরওয়ানা এসে পড়ে তার ঠিক নেই। মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে এ কথা বলছি এটা ঐ রকম অকেজো মাদ্রাসা হবে, তা আমার কাম্য নয়। মুস্তফা (দ.)‘র নূরের তজল্লিয়াতের নূর দ্বারা জ্যোতিষ্মান চর্ম চোখে জগতে যা দেখা যাচ্ছে কিংবা দেখছ কিন্তু অন্তর চক্ষুর অভাবে ভিতরগত চক্ষু দ্বারা যা দেখতে হয় কিংবা দেখা যায়,ওইগুলো আজও অদেখা হয়ে রয়েছে। অতএব অন্তরের চক্ষু খোলার (ফুটাবার) চেষ্টা কর।
হে আঞ্জুমানে তৌহীদের সদস্যরা তোমরা নিজের চক্ষু খুলিয়ে মানুষকে খোলানোর পন্থা দেখাও। তোমরা যারা গাউসিয়া রহমানিয়ার তালিবে ইলম আছ, তোমরা নিজেকে প্রস্ফুটিত করে অপরকে করার চেষ্টা কর; তবে তোমাদের তৌহীদের খুশবো আরশ হতে পরশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।
একটি উদাহরণ দিয়ে কথা শেষ করছি, সামান্য কষ্ট করুন, দুই-চার মিনিট। দিল্লীতে একজন মুহাদ্দিস ছিলেন, তাঁর নাম ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)। তিনি একদিন স্বপ্নে মুস্তফা (দ.)’র দর্শন লাভ করেছেন, এবং মুস্তফা (দ.) নিজের দু’টি চুল মোবারক তাঁকে দিয়েছেন। সকালে ঘুম হতে জাগ্রত হয়ে তাঁর বালিশের নিচে মুস্তফা (দ.)‘র চুল মোবারক দু’টি পেলেন। স্বপ্ন সঠিক কিনা, সারা দিন পরীক্ষা করলেন। তিনি এটাকে নিয়ে চোখে-মুখে লাগিয়ে-চুমো খেয়ে দুপুরে রোদে বের হয়ে দেখলেন, বের হওয়ার সাথে সাথে দুটি আবর (মেঘ) এসে তাঁকে ছায়া দিল। তিনি একবার ঘরে ঢুকেন আবার বের হন। তিনি ঢুকে গেলে আবর (মেঘ) চলে যায়, আবার বের হলে এসে পড়ে। এভাবে সারা দিন সূর্য থাকা পর্যন্ত তাঁর এ ডিউটি চলল। অতএব তা যে মুস্তফা (দ.)’র চুল মোবারক, সত্যিকার তাবাররুক, হাক্বীক্বতান তাবাররুক ওই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হলেন। এটা আমার আগাগোড়া তাক্বরীরের সারকথা। মুস্তফা (দ.)’র চুল মোবারক-কেশ মোবারকের বদৌলতে-বরকতে সূর্যের তাপ হতে রক্ষা করতে যদি মেঘ এসে ছায়া দেয়; তবে মুস্তফা (দ.)’র ওই নূরে পাকের তজল্লিয়াতের যে আমানত আমাদের ক্বলবে আছে ওই আমানত আমরা-আপনারা প্রস্ফুটিত করতে পারলে ১২ সূর্যের তাপ কি আমাদের পোড়াবে? কখনো পোড়াবে না। আমরা ছায়া কোথায় পাব? আরশে আ’লার নীচে। কেননা মুস্তফা (দ.)’র নূরের তজল্লিয়াত, আল্লাহর সত্তার নূর বা জ্যোতি; এ নূরের তজল্লিয়াতকে যদি আমরা আপন জমিনে তথা ক্বলবে প্রস্ফুটিত করি, আমাদের জমিনে যদি তা জিন্দা করি, তবে ক্বিয়ামত নয়, আবদান-আবাদ, হাশর-নশর নয়, জাহান্নাম-দোযখ নয়, তার চেয়ে বড় কিছুও আমাদের কিছু করতে পারবে কি? কখনো কিছু করতে পারবেনা। আমাদের জন্য কোন ভয়-ডর, দুশ্চিন্তা থাকবে না। আল্লাহ তা’আলা কুরআনে মজীদে ইরশাদ করেছেন, “আলা-ইন্না আওলিয়া-আল্লাহি লা খাওফুন আলায়হিম ওয়ালাহুম ইয়াহযানূন” খবরদার! জেনে রাখ নিশ্চয় আল্লাহর ওলি-বন্ধু-দোস্তদের জন্য না কোন ভয় আছে, না কোন দুঃখ-দুশ্চিন্তা। আমরা যদি আল্লাহকে চিনতে পারি, আল্লাহর দর্শন লাভ করতে পারি, তা হলে আমাদের নামও ডর-ভয়হীনদের ঐ দপ্তরে যাবে। থাকবে না কোন ডর আর ভয়। জাহান্নামের আগুন, ১২ সূর্যের তাপ, পুলসিরাতের কঠিন পুল; কোথাও ঠেকব না। প্রত্যেকে ওই নূরের তজল্লিয়াতকে প্রস্ফুটিত করুন। আমার কথা এই পর্যন্ত শেষ, আর বেশী বলবনা।
অতঃপর আমাকে প্রকাশ্যে একটি মাসয়ালা বলতে হচ্ছে বলে, “ওয়া ওয়াজাদাকা দ্বোয়াল্লান ফাহাদা” আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক আলোচনা উপস্থাপন করে ত্বাকরীর এবং মীলাদ-ক্বিয়াম-মুনাজাতের মাধ্যমে মাহফিল সমাপ্ত করেন।