রহমতুল্লিল আলামীন (দ.)’র করুণা-কিরণ দীপ্ত নয়ন অনুসরণে রহমানুর রহীমের করুণাবারি বর্ষণ
✍️মাওলানা মুহাম্মদ নূরুল আবছার হারূনী
আল্লাহ তা‘আলার দয়া দৃষ্টি তাঁর মাহবূব নবী (দ.) কেই অনুসরণ করে। সদাসর্বদা কিসে মাহবূবের মনোতুষ্টি? সেটিই চান তিনি। মহাগ্রন্থ আল্ কুরআনের সূরা বাক্বারাহ ১৪৪ নম্বর আয়াতে বিঘোষিত,
” قد نرى تقلب وجهك في السماء فلنولينك قبلة ترضاها فول وجهك شطر المسجد الحرام وحيثما كنتم فولوا وجوهكم شطره“
“ক্বাদ নারা- তাক্বাল্লুবা ওয়াজহিকা ফিসসামায়ি ফালানুয়াল্লিয়ান্নাকা ক্বিবলাতান তারদ্বা-হা- ফাওয়াল্লি ওয়াজহাকা শাতরাল্ মাসজিদিল হারা-ম ওয়া হায়ছু মা- কুনতুম ফাওয়াল্লু- ওজূহাকুম শাতরাহু’ অর্থাৎ ‘আকাশ পানে আপনার চেহারা উন্মুখ করা, আমি লক্ষ্য করছি। অতএব অবশ্য আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেবো সে ক্বিবলার দিকে, যাতে আপনার সন্তুষ্টি রয়েছে। এখনই আপনি মুখ ফিরিয়ে নিন, মসজিদে হারামের দিকে; এবং তোমরা (মুসলমান) যেখানেই থেকো, সেটার দিকে আপন মুখ ফিরিয়ে নেও”।
একদা নবী করীম (দ.) উপস্থিত সাহবা-ই কিরামকে বনী ইস্রাঈলের প্রসিদ্ধ ধর্মযুদ্ধা ও আবেদ শামউন মতান্তরে শামনূনের সকাল-সন্ধ্যা সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধ এবং সাঁজ-প্রভাত অকপট ইবাদত-বন্দেগীর কাহিনী শুনালেন। এতে মুসলমানগণ আশ্চর্য এবং নিজেদের সল্পায়ু হেতু পুণ্যকাজে পশ্চাদবর্তীতায় চিন্তিত হলেন। উম্মত চিন্তিত হলো-তো উম্মত বৎসল নবী (দ.)’র দয়ার সাগর তরঙ্গিত হলো। কেনইবা এমন হবেনা, আল্ কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,
لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
“লাক্বাদ জা-য়াকুম রাসূলুম্ মিন আনফুসিকুম আযীযুন আলায়হি মা- আনিত্তুম হারিসুন আলায়কুম বিল মু’মিনীনা রাউফুর রহীম’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয় তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে ঐ রাসূল আগমন করেছেন, যাঁর কাছে তোমাদের কষ্ট দেয় এমন কিছু কষ্টদায়ক, তোমাদের অতি কল্যাণকামী; মু’মিনদের সাথে অতিশয় করুণা-নেহায়ত দয়াকারী” (সূরা তাওবা ১২৮ নম্বর আয়াত)। ফরিয়াদের হস্ত বারগাহে ইলাহীতে উত্তোলন করতঃ অনুযোগের সুরে বললেন,
يا رب جعلت أمتي أقصر الأمم أعماراً وأقلها أعمالاً
“ইয়া রব্বু জা‘আলতা উম্মতী আকসারাল উমামি আ’মারান ওয়া আকাল্লাহা আ’মা-লা” ‘হে প্রভু! তুমি আমার উম্মতকে সল্পায়ুস্মান ও অল্প আমল বিশিষ্ট করলে!’ বেশ মাহবূব বা প্রেমাস্পদ নবী (দ.)’র অভিমান হলো আর সন্তুষ্টিকামী প্রেমময় প্রভুর উপহার বিঘোষিত হল। ইরশাদ হচ্ছে, “লায়লাতুল ক্বাদরি খায়রুল লাকা ওয়া লিউম্মাতিকা মিন আল্ফি শাহরিন জা-হাদা ফীহা- যালিকার রজলু’ অর্থাৎ ‘আপনার মনোতুষ্টির নিমিত্তে আপনার উম্মতকে লায়লাতুল ক্বদর প্রদত্ত হল; যা ওই মুজাহিদের জিহাদে কাটানো হাজার মাস (তিরাশি বছর চার মাস) অপেক্ষা উত্তম” (সূত্র: সাফ্ওয়াতুত্ তাফাসীর, তৃতীয় খণ্ড ৫৬৫ পৃষ্ঠা; দারুল হাদীস আলক্বাহিরাহ)।
তাহাজ্জুদ নামাযের ফরদ্বিয়্যাত বা অতি আবশ্যকতা রহিত হওয়ার পর, সাহাবা-ই-কিরাম আপন পুণ্যকাজের উৎসাহ উদ্দীপনায় কতটুকু প্রদীপ্ত? দেখার জন্য ওই রাতেই নবী করীম (দ.) গোপনে তাঁদের ঘর সমূহ প্রদক্ষিণে বের হলেন। তিনি (দ.) তাঁদের ঘরসমূহ যিক্র ও কুরআন তিলাওয়াতের গুঞ্জনে মৌমাছির বাসার ন্যায় পেলেন। এ প্রেক্ষাপট বর্ণনায় কুরআনে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ, وَتَقَلُّبَكَ فِى ٱلسَّٰجِدِينَ
“আল্লাযী- ইয়রা-কা হীনা তাক্বূমু, ওয়া তাক্বাল্লুবাকা ফিস্সাজিদীনা” অর্থাৎ ‘যিনি (আল্লাহ) আপনাকে দেখেন, যখন আপনি দণ্ডায়মান হোন এবং সাজদাহকারীদের (নামাযীদের) মধ্যে আপনার পরিভ্রমন’ (সূরা শু‘আরা ২১৮-২১৯ নম্বর আয়াত)।
উক্ত বর্ণনা মতে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়াবলী পরিজ্ঞাত হই।
ক. নবী (দ.) যেদিকে মুখ করে নামায আদায় করেন, সেটিই ‘ক্বিবলাহ্’ তিনি (দ.) যেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, সেটি আর ‘ক্বিবলাহ’ থাকে না।
খ. উম্মত কষ্ট পেলে তিনি (দ.) ব্যথিত হন। তিনি (দ.) ব্যথিত হয়ে অনুযোগ করলেই আল্লাহ উম্মতের জন্য বিরাট পুরষ্কার ঘোষণা করেন।
গ. আল্লাহ নামাযীর নামায নয় বরং নামাযীদের মধ্যে তাঁর হাবীব (দ.)’র পরিভ্রমণই দেখেন।
এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার দয়ানুগ্রহ নবী করীম (দ.)’র দৃষ্টি অনুসরণেই বর্ষিত-সম্প্রসারিত হয়। নানা দিক বিবেচনায় নানা ‘ক্বিবলাহ’ হতে পারে। যেমন- ছাত্রদের উস্তাদ ক্বিবলাহ-হুযুর ক্বিবলাহ, মুরীদের পীর সাহেব ক্বিবলাহ ইত্যাদি। পরন্তু এসব ক্বিবলার সম্পর্ক যদি সকল ক্বিবলাহ’র ক্বিবলাহ মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (দ.)’র সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়, তবেই ক্বিবলাহ হবেন বা থাকবেন; অন্যথায় পরিত্যক্ত-পরিত্যাজ্য।