অনিঃশেষ অবিষহ্য দহন

অনিঃশেষ অবিষহ্য দহন

✍️ রুদিত রাহী
মনে হয়েছিল, কালের আবর্তে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। যেহেতু কথায় বলে, ‘সময়ই সব ক্ষতের মলম-উপশম’। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষতের জন্য সময় ক্ষার সাব্যস্ত হল, কালের চক্রে তার যাতনা আর ক্ষরণ দু’টোই বৃদ্ধি পেতে থাকল। মঙ্গল বিবেচনায় যা এড়িয়ে যেতে মনস্থ ছিল, অবশেষে তাতেই জড়িয়ে পড়া। জানিনা, বেচারা কলম কতক্ষণ রক্তাশ্রুভার বইতে পারবে।
★ আজ কারো হিয়া জ্বলে, ‘মাওলা-ই কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কখনো মদ্য পান করেননি’ এ কথা সুন্নীদের কাছে যুক্তি-তর্কে প্রমাণ করতে হয় বলে!
★ কারো মনে নিদারুণ খেদ, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামার অভিনিবেশ যার প্রতি ছিল, আল্লাহ তা‘আলাও তাঁকেই কবুল করেছেন’ অকাট্য দলীল-প্রমাণ দিয়েও সহযোদ্ধাকে সে কথা মানাতে-বুঝাতে পারেননি বলে!
★ কারো মনে অবিষহ্য যন্ত্রণা, ‘নামাযে আল্লাহর রাসূল (দ.)’র ধ্যানকে আপন গরু-গাধার ধ্যান অপেক্ষাও জঘন্যতর বচনের বাচক ওহাবী, তাকে কোনভাবে বুযুর্গ মানা যাবেনা’ কুরআন-সুন্নাহ ও ঐতিহাসিক দলীল প্রমাণ দিয়েও আপনজনদের মানাতে পারেননি বলে! কেউ কেউ তাকে ওহাবী মানলেও ‘বুযুর্গ মানতে অসুবিধা নেই’ ফতওয়া গলদ মানতে নারাজ বলে!
★ কারো হৃদয়ের দহন, ‘শয়ত্বান আম্বিয়া-ই কিরাম আলায়হিমুস্ সালামকে ধোঁকা দিতে পারে কথাটি ইসমতে আম্বিয়া পরিপন্থী কুফরী আক্বিদাহ’ কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দলীল দিয়েও স্বজনদের মানাতে পারেননি বলে!
★ কারো অন্তরে ক্লেশ, ‘পশুশক্তি সংশ্লিষ্ট মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ কথাটি কুফরী এবং ওই উক্তির কথককে মা’দিনে ইলমো হিকমত বলে সালাম নিবেদন ঈমান বিধ্বংসী’ এ কথা স্বগোত্রীয় শায়খ এবং বন্ধুমহলের ব্যক্তিপ্রীতি এবং টাকার মোহের কাছে উপেক্ষিত বলে!
★ কারো চিত্তদাহ, ‘সিদ্দীক্ব, ফারূক্ব, যূননূরায়ন ও হায়দার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের কেউই অজ্ঞতার যুগেও চোর-ডাকাত ছিলেন না’ দলীল প্রমাণ দিয়েও এর বিপরীত বক্তার ভুল স্বীকার না করে মৌনতায় কৌশলে এড়িয়ে চলার নীতিতে!
অবিষহ্য দহনের এ ধারা অনিঃশেষ। অবশ্য ব্যক্তি ভেদে দহন ও দাহ্য বিভিন্ন। বলয় ভেদে নেত্র-উপনেত্রও ভিন্ন ভিন্ন। কারো ক্ষেত্রে নজর শিকারী বাজবৎ সতীক্ষ্ণ , চশমাও যেন আতশি কাচ; আর কারো ক্ষেত্রে চোখই যেন অন্ধ। কারোটা নিয়ে ঢেঁটরা পিটানো হচ্ছে, আরা কারোটা করা হচ্ছে গোপন। দুঃখবিলাপ হচ্ছে, সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা চলছে। ক্ষেত্রবিশেষ গালিগালাজের মাধ্যমে আপন আপন পরাক্রমের জানানও দেওয়া হচ্ছে।
‘আল্ আলশবাহ ওয়ান্নযায়ির’ কিতাবে ফিক্বহে হানাফীর একটি নীতি পড়েছিলাম। যা প্রমিত বাংলায় ‘অনিষ্ট অপসারণীয়’ এর মতে কিছু একটা হবে। নিশ্চয় করে বলতে পারছিনা, যেহেতু অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস। সে যা-ই হোক, উক্ত নীতি অবলম্বনে আপন বলয়ে অনিষ্টমুক্ত করার প্রয়াস চরম হতাশাজনক। একদম শূন্য বলা যায়না, যেহেতু কোথাও কোথাও মিনমিন শব্দ অনুরণিত; যদিও মিনমিনে লোকের মনোভাব বুঝা দায়। অতি আশাবাদী মন তবুও বলে, একদিন এ আওয়াজ ওঠবেই, ‘বিঘ্ন দাও অপসারি’।
বিচ্ছিন্ন দহনে যারা অনলবর্ষী আগ্নেয়গিরি, তাদের খেদমতে ছোট্ট একটি আবেদন বিবেচনার সবিনয় অনুরোধ রইল। জনাব! উক্ত সমুদয় দাহ্যসহ আরো অগণিত আগুনে যাদের চিত্ত সদা-সর্বদা জ্বলছে, যাদের চোখে পট্টিকা নেই, যারা পক্ষপাতের রঙিন চশমা পরা নয়, যারা সবকিছু স্বচ্ছ দেখতে পায় বা দেখতে চায়, তাদের বিষয়টা একবার ভাবুন। একগুঁয়ে, একঘরে, একঘেয়ে, সংকীর্ণ, অদূরদর্শী, মতিভ্রষ্ট ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে অপাঙক্তেয় ভাবা কিংবা প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়ে কাছে টানতে চাওয়া খুব সহজ, কিন্তু প্রকৃত সমব্যথী হওয়া বড়ই দুরূহ। যে আগুন ভিতর-বাহির সর্বত্র পরিব্যপ্ত ‘পীর যার যার, সুন্নীয়্যাত সবার’ পিচকারির জলে তা নিভার নয়। বস্তুত এ স্লোগান অগ্নিনির্বাপক পানিই নয়, বরং অগ্নিপ্রজ্বলক ঘৃতই। যার পীর শায়খুন্ নজদ, সুন্নীয়্যাত কি তারও? নামাযে রাসূলে আকরম (দ.)’র ধ্যান বাদ দিয়ে গরু-গাধার ধ্যানে বিভোর নামাযী যার পীর, সুন্নীয়্যাত কি তারও? যার পীর ‘রূহে হায়ওয়ানী সংশ্লিষ্ট সসীম শক্তিশালী মানব মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ আক্বিদাধর, সুন্নীয়্যাত কি তারও? আবার বরহক্ব ত্বরীক্বাহ’র হক্কানী পীর মাশায়িখদের বাদ দিয়েও সুন্নীয়্যাত অকল্পনীয়। কোন না কোন পীরের মুরীদ ভিন্ন নেতা আর মাওলানা প্রসূত সুন্নী শেওলা অধিক নয়, স্রোতে যেকোনো সময় ভেসে যেতে পারে।
‘আক্বীদায়ে আহলে সুন্নাত যার, সুন্নীয়্যাতও তার’ এটিই হোক স্লোগান। বেআমল বা মন্দ-আমল হলেই দীন থেকে বেরিয়ে যায়না। বুখারী শরীফের كتاب الحدود বা দণ্ডবিধি অধ্যায়ের  باب ما يكره من لعن شارب الخمر وإنه ليس بخارج من الملة বা মদ্যপকে অভিসম্পাত অপছন্দনীয় এবং সে দীন থেকে নির্গমনকারী নয় অনুচ্ছেদের এ হাদীসটিতে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। 
عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه أنَّ رَجُلًا علَى عَهْدِ النبيِّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ كانَ اسْمُهُ عَبْدَ اللَّهِ، وكانَ يُلَقَّبُ حِمَارًا، وكانَ يُضْحِكُ رَسولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، وكانَ النبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ قدْ جَلَدَهُ في الشَّرَابِ، فَأُتِيَ به يَوْمًا فأمَرَ به فَجُلِدَ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ القَوْمِ: اللَّهُمَّ العنْه، ما أكْثَرَ ما يُؤْتَى بهِ؟ فَقَالَ النبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: لا تَلْعَنُوهُ، فَوَاللَّهِ ما عَلِمْتُ إنَّه يُحِبُّ اللَّهَ ورَسولَهُ
হযরত উমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাদ্বয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত,  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম’র যুগে এক লোক ছিল, যার নাম আব্দুল্লাহ এবং উপাধি হিমার ছিল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে হাসাতেন আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে মদ্যপানের দায়ে কশাঘাত দণ্ড দিতেন। একদা সে একই অভিযোগে আনীত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দণ্ডাদেশ দেন অতঃপর তা কার্যকরও হয়। অতএব সমাবেশ থেকে জনৈক ব্যক্তি বললেন, ‘হে আল্লাহ তাকে লা’নত দাও’। কতবারই অভিযুক্ত হয়ে আনীত হয়! এতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা তাকে লা’নত বা অভিশাপ দিয়োনা; আল্লাহর শপথ! তুমি জাননা যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে’।
দাহ্য বদ-আক্বীদাহ অপসারিত হলে একত্র না হলেও ঐক্য হবে সুপ্রতিষ্ঠিত। একত্র আর ঐক্যে বড়বেশি তফাৎ আছে। একত্র হওয়া আর ঐক্য হওয়া মোটেও অভিন্নয় নয়। একত্র আর ঐক্যের তারতম্য অনুধাবনে সূরাহ বাক্বারাহ ২৫৬ ও সূরাহ হাশর ১৪ নম্বর আয়াতে মনোনিবেশ করা যেতে পারে।
আমলের সাদৃশ্যের নিক্তিতে ঈমান আর নিফাক্বের নির্ণয় হলে, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুরও আগে মসজিদে নামায পড়তে আসা নামাযীকে রাসূলুল্লাহ (দ.) মসজিদ থেকে বের করে দিতেননা।
বড় নামাযী, বড় রোযাদার হলেই দীনদার হয়ে যায়না। ইরশাদ হচ্ছে,
عن زيد بن وهب الجهني أنه كان في الجيش الذين كانوا مع علي رضي الله عنه الذين ساروا إلى الخوارج، فقال على رضي الله عنه: أيهاالناس إني سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: يخرج قوم من أمتي يقرءون القرآن ليس قرائتكم إلى قراءتهم بشيء ولا صلاتكم إلى صلاتهم بشيء ولا صيامكم إلى صيامهم بشيء يقرون القرآن يحسبون أنه لهم، وهو عليهم لا تجاوزصلاتهم تراقيهم يمرقون من الإسلام كمايمرق السهم من الرمية… الحديث. رواه مسلم
যায়দ বিন জুহনী বর্ণনা করেন যে, তিনি ওই সৈন্যদলে ছিলেন, যারা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে খারিজীদের মোকাবেলায় গিয়েছিলেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে লোকেরা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘আমার উম্মত থেকে একটি সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করবে, তারা এমনভাবে কুরআন পাঠ করবে, তাদের কিরাতের সামনে তোমাদের কিরাত কিছুইনা; না তোমাদের নামায, তাদের নামাযের সামনে কিছু; না তোমাদের রোযা তাদের রোযার মোকাবেলায় কিছু! তারা নিজেদের অনুকূলে ধারণায় কুরআন পড়বে, অথচ কুরআন তাদের বিরুদ্ধে হবে। তাদের নামায তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করতে পারবেনা। তারা ইসলাম থেকে এমনি বেরিয়ে যাবে, যেমনি তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়।…. [মুসলিম শরীফ হাদীস নম্বর ১০৬৬।]
মীলাদ, ক্বিয়াম, উরস, ফাতিহা ইত্যাদি সুন্নী-অসুন্নী নির্ণায়ক নিক্তি হতে পারেনা। এসব আচার-অনুষ্ঠানিকতার ভিত্তিতে ঐক্যের বন্ধন ক্ষেত্রবিশেষ সাপে নেউলে ঘর বাঁধার মতো হতে পারে।
আমলের ভিত্তিতে ঐক্যের প্রাসাদ নির্মিত হলে, সে অট্টালিকা হবে বালির। শিল্পীর শৈল্পিক দক্ষতায় তা সুরম্য হলেও মোটেও টেকসই হবেনা; কোন প্রকার ঝড়-তুফান ছাড়াই হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে। যে ঠিকানা স্বয়ং ঝুঁকি, তাতে ঠাঁই না নিয়ে রোদে পুড়া, ঝড়ে ভিজা ও শীতে কাঁপা নিরাপদ নয় কি? হাদীসে পাকের ধারাভাষ্যে স্পষ্ট, এমনও এক ক্রান্তিকাল আসতে পারে, যখন রাজসভা-রাজপথ অপেক্ষা ছাগল-চারণভূমি পাহাড় শীর্ষ বা বারি বরিষ্যস্থান তথা নির্জন জায়গা দ্বীন রক্ষার জন্য উত্তম হতে পারে। সহীহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান বাবুন মিনাদ্দীনি আলফিরারু মিনাল ফিতানি দ্রষ্টব্য। ফিৎনাপূর্ণ সে যুগটিই আমরা অতিক্রম করছি কিনা বিবেচ্য।
বিচার-বিবেচনাবোধ কি আমাদের জ্যান্ত আছে? থাকলে তবে সাওয়াব বা সঠিক আর খাত্বা বা ভুলের তারতম্য সত্ত্বেও মুসীব আর মুখ্ত্বীকে কী করে একই স্তরের জ্ঞান করি? এটা-তো সঠিক সত্তার প্রতি চরম অবিচারই বটে। খাত্বা-ই মুকাররার  আর মুনকারের তফাৎ ভুলে একাকার করে ফেলা হলে, সংক্ষুব্ধ পক্ষে বিক্ষুব্ধ আচরণে উদ্যতের দায়ও কিছুটা নিজ কাঁধে বর্তায়। সংক্ষুব্ধ পক্ষেরও মনে রাখা জরুরি, সীমা লংঘনের দায়মুক্তিনামা তারা পেয়ে যাননি।
মতানৈক্য বিশিষ্ট শাখা বিষয়ে মতামতের ক্ষেত্রে আরো সচেতনতা কাম্য। আশাকরি বিভিন্ন বলয়ের দায়িত্বশীলরা আমার এ আবেদন বিবেচনায় নিবেন। আল্লাহ তা’আলা এ অনিঃশেষ অবিষহ্য দহন হতে মুক্তি দিন, আল্লাহুম্মা আমীন, বিহুরমতি রহমতিল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়াসাল্লাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *