মি’রাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
মি’রাজ হল আল্লাহর কুদরত ও মহানবী (দ.)’র অন্যতম মু’জিযাহ। স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহ যখন ‘সুবহানাল্লাযী আসরা বা পবিত্রতা ওই সত্তার, যিনি রাতের ক্ষুদ্র অংশে পরিভ্রমণ করান’ বলে পরিভ্রমণের সম্বন্ধ নিজের সাথে করেন, তখন আল্লাহর কুদরতে বিশ্বাসী কেউ মি’রাজের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্নই তুলতে পারেনা। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে মানুষ যখন মঙ্গল গ্রহে বসবাসের চিন্তা করছে, তখন মহানবী (দ.)’র স্বশরীরে মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দস হয়ে পর্যায়ক্রমে সপ্ত আসমান অতিক্রম করে সিদরাতুল মুনতাহা পিছনে ফেলে আর্শে আযীম তথা স্থান-কালের উর্ধ্বে গমনকে স্বাপ্নিক বলা ঘুমন্ত বিবেকেরই পরিচায়ক। আমরা জানি এবং মানি যে, মহানবী (দ.) ইন্দ্রিয় চোখেই আল্লাহর দর্শন লাভ করেন। এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলীল-প্রমাণতো রয়েছেই, সে সাথে বিজ্ঞানসম্মত বিবেকগ্রাহ্য যুক্তিও ঢের আছে। ওই সব যুক্তি-প্রমাণের অবতারণা ও মি’রাজুন্নবীর আলোচনা না করে আলোচ্য নিবন্ধে আমরা মি’রাজ প্রাসঙ্গিক এমন এক বিষয়ের আলোচনায় মনোনিবেশ করবো, যা সচরাচর আলোচিত হয়না। কেননা রাসূলুল্লাহ (দ.)’র মি’রাজ তথা প্রভুনৈকট্য বা মিলনের বর্ণনা সাধ্যাতীত। কবি কতইনা সুন্দর বলেছেন,
‘জিব্রাঈল রহে বুররাক্ব থকে রফরফ ভী আগে জা নাঃসকে
রব উদনু মিন্নী হাবীবি কহে তেরে ক্বুরবে খোদাকা কিয়া কহনা’।
‘জিব্রাঈল, বুরাক্ব সবই থামিল, রফরফও আগে না বাড়িল;
প্রভু বলেন, ‘প্রিয় নিকটে এসো’ তোমার সেই নৈকট্যের বলিব কিরে?’
মি’রাজ সিঁড়িকে বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (দ.)’র জন্য এক নূরানী সিঁড়ি স্থাপন করা হয়, যাতে করে তিনি (দ.) কে উর্ধ্বলোক পরিভ্রমণ করানো হয়; যার প্রকৃত অবস্থা আল্লাহ ও তাঁর হাবীব (দ.)ই ভাল জানেন।
আমরা জানি যে, নামায মুসলমানদের জন্য মি’রাজ শরীফের তুহফা। অর্থাৎ মহানবী (দ.)’র মি’রাজ কালেই নামায ফরয হয়; এ নামাযের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়, যা মি’রাজের প্রতিচিত্র, আত্তাহিয়্যাত-এ মি’রাজের আলোকরাজি ও জ্যোতির বিচ্ছুরণাদির উপলব্ধি অর্জিত হয়। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (দ.) নামাযকে মু’মিনদের মি’রাজ আখ্যায়িত করেছেন।
আর একটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাসূলুল্লাহ (দ.)’র মি’রাজ ছিল যে, তিনি আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হন এবং কোন রূপ পর্দা ছাড়াই আল্লাহর সৌন্দর্য অবলোকন করেন। পরন্তু হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত এ দুনিয়ার পার্থিব জীবনে শারীরিক চোখে আল্লাহর দর্শন লাভ না কারো হয়েছে, না হবে। এ জন্যই আমাদের মি’রাজ হল হুযূর (দ.) পর্যন্ত পৌঁছা; এ রূপে যে, হুযূর (দ.)’র এতই নৈকট্য আমাদের অর্জিত হবে, যাতে আমরা এ দুনিয়ায় জাগ্রতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (দ.)’র পবিত্র সৌন্দর্য আপন চোখে দেখার সৌভাগ্য লাভে ধন্য হবো।
উক্ত দর্শনালোকেই তাশাহহুদে ‘আসসালামু আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বরাকাতুহু’র শব্দাবলী রাখা হয়েছে। নামাযে স্বেচ্ছায় আল্লাহ ভিন্ন কাউকে ডাকা নামায বাতিল হওয়াকে আবশ্যক করে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (দ.) কে সম্বোধন সূচক শব্দে আহ্বানই ওয়াজিব বা আবশ্যক। জানা গেল যে, মু’মিন নামায অবস্থায় হুযূর (দ.)’র উপস্থিতি দ্বারা ধন্য হয়। অতএব সে যদি আপন আত্মার পবিত্রতা-পরিশুদ্ধি, প্রেম-ভালবাসা ও আন্তরিকতা এত শক্তিশালী করে নেয় যে, ‘আসসালামু আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু’ বলার সময় তার ধ্যান ও জ্ঞান নয়নে ‘নূরে জমালে মুহাম্মদী (দ.)’ অবলোকন করে; তবে তা-ই তার মি’রাজ। কেননা হুযূর (দ.) পর্যন্ত পৌঁছা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছা, তাঁকে দেখা আল্লাহকেই দেখা। হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে ‘মন রায়ানী ফাক্বাদ রায়াল হক্ব’ যে আমাকে দেখেছে, সে হক্ব বা অখণ্ডিত সত্য তথা চিরন্তন সত্য আল্লাহকে দেখেছে। এ জন্যই হজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গযযালী (রা.) ইহ্ইয়াউল উলূম গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ওয়াহদ্বির ফী ক্বলবিকা আন্নবীয়্যা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওয়া শখসাহুল করীম ওয়াক্বুল আসসালামু আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বরাকাতুহু’ অর্থাৎ নামাযাবস্থায় আপন অন্তরে রাসূলুল্লাহ (দ.) ও তাঁর সম্মানিত ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত কর এবং বল ‘আস্সালামু আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বরাকাতুহু’। (ইহ্ইয়াউল উলূমিদ্দীনি ১ম খণ্ড ১৭৫ পৃষ্ঠা)
আল্লাহর সৌন্দর্য অবলোকনের দর্পণ হল মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (দ.)। এ জন্যই সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আপন ধ্যান-জ্ঞানে সদা জগৎগুরু রহমতুল্লিল আলামীন (দ.)’র ধ্যান রাখতেন এবং রূহানী উৎফুল্লতা ও ফয়য-বরকত অর্জন করতেন। আমর বিন হারিস (রা.) বলেন, ‘কা-আন্নী আনযুরু ইলা রাসূলিল্লাহি আলাল মিম্বরি’ অর্থাৎ ‘আমি যেন ধ্যান-নেত্রে রাসূলুল্লাহ (দ.) কে মিম্বরের ওপর দেখছি’ (মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড ৪৪০ পৃষ্ঠা)।
সাহাবায়ে কিরাম (রাদ্বি.)’র এ রীতি-নীতির আলোকে সূফীয়ায়ে ইজাম শায়খের ধ্যানকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছার ভিত্তি সাব্যস্ত করেন। শাহ অলীয়ুল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) আল্ কাওলুল জমীল গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আররুকনুল ‘আযমু রবত্বুল ক্বলবি বিশশায়খি আলা ওয়াসফিল মুহব্বতি ওয়াত্তা’যীমি ওয়া  মলাহিযাতু সূরাতিহী’ অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্যে গমন পন্থায় প্রধান স্তম্ভ হল, অনুসৃত শায়খের সাথে অন্তরের ভালবাসা ও শ্রদ্ধাপূর্ণ সংযোগ এবং তাঁর (শায়খের) আকার-আকৃতি অবলোকন-নিরীক্ষণ-ধ্যান করা’। যা আরিফে কামিল বাহরুল উলুম আবুল বরাকাত সৈয়্যদ মুহাম্মদ আবদুল গনি কাঞ্চনপুরী (রা.)’র ভাষায়-
‘বসাইব হৃদাসনে, নিরীক্ষিব তাঁর পানে;
অহরহ এ জীবনে আর কিছু হেরিব নারে’
মর্মে ব্যাখ্যায়িত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, শায়খ হল জমালে মুস্তফায়ী দেখার আয়না। ইবনে হাব্বান কিতাবুদ্দ্বু’ফা-এ এবং দায়লমী মসনদুল ফিরদাউসে আবু রাফে এর সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘আশশায়খ ফী কওমিহী কান্নবীয়্যি ফী উম্মতিহী’ পীর আপন মুরীদদের মাঝে, ঠিক নবী যেমন উম্মতগণের মধ্যে’। এ হাদীসটির ক্ষেত্রে জাল কিংবা পরিত্যক্ত মর্মে কেউ কেউ মন্তব্য করলেও জালালুদ্দীন সুয়ূতীর জামিউস সগীর গ্রন্থের বর্ণনা আলোকে প্রমাণিত হয় যে, এটি জাল কিংবা পরিত্যক্ত মোটেও নয়। অবশ্য সুয়ূতীর বর্ণনায় শব্দের কিঞ্চিৎ তারতম্য রয়েছে। তিনি লিখেছেন ‘আশশায়খু ফী আহলিহী কান্নবীয়্যি ফী উম্মতিহী’ অর্থাৎ শায়খ আপন আহল বা সম্প্রদায় তথা ভক্তকুলে ঠিক তেমনই যেমন নবী আপন উম্মতের মাঝে’।
অতএব প্রমাণিত হয় যে, শায়খকে দেখা নবীকে দেখা আর নবীর দর্শন স্বয়ং আল্লাহরই দীদার। আল্লামা জালালুদ্দীন রূমী (রা.) লিখেছেন,
‘চূঁ তূ যাতে পীর রা করদি ক্ববূল,
হাম খোদা শামিল ব যাতাস্ত হাম রাসূল।’
‘যখন তুমি পীরের সত্তা গ্রহণ করেছ, খোদা ও রাসূল ওই সত্তায় শামিল রয়েছে’।
সুতরাং বলা যায় যে, তাসাওউরে শায়খ বা আপন পীর-মুরশিদের ধ্যানের মাধ্যমে জমালে মুস্তফায়ী (দ.)’র দর্শন লাভ ঘটলেই নামায হবে ‘আসসালাতু মি’রাজুল মু’মেনীন’ অন্যথায় ‘ফাওয়াইলুল্লিল মুসাল্লীন’। এখানে সূফী কবি মাওলানা বজলুল করীম মন্দাকিনী (রহ.)’র ‘নামায জ্ঞান’ নামক নিম্নোক্ত গীতির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করছি।
নামাজী, শুদ্ধ নামাজ পড়!
যেই নামাজে ‘তনহা আনিল ফাহ্শায়ে ওয়ালমুনকর’ ॥
‘আকিমুচ্ছালাতের’ মর্ম বুঝিয়ে কর খোদার কর্ম,
নইলে পরে আছে ভারী ‘ওয়াইল দোজখের’ ডর॥
হুজুরি দেল নাই যার, হয় না নামাজ তার,
ফর্ম্মালেন হযরত নবী দীন-পয়গম্বর ॥
প্রকৃত নামাজী যারা, আপন ভাবে মগ্ন তারা,
নিজের নামাজ হচ্ছে কিনা ভয়েতে কাতর ॥
আপন ভাবে আপে মরে, কেবা পড়ে, কে না-পড়ে,
সেই কথা ভাবিতে তার কোথা অবসর ॥
কেহ তো নামাজ পড়ে, সেই নামাজের গর্ব্বে মরে
পররে করয় হিংসা তাদের জন্য ডর ॥
শুনরে নামাজী বড়, সত্য গুরু তালাশ কর,
পরের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে নিজের চিন্তা কর ॥ 
ষড়রিপু বিনাশিতে, হুজুরী দেল বানইতে,
করিম, শ্রীগুরু মাইজভাণ্ডারীর চরণ ধর ॥
আল্লাহ আমাদের সে রূপ নামায প্রতিষ্ঠার তৌফিক ইনায়ত করুন।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *