মীলাদ, ওরস ও ঈসাল-ই সাওয়াবধর্মী ফাতিহা

🖋️ আল্লামা এস. এম. জাফর ছাদেক আল্ আহাদী
মীলাদ: 
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের প্রশংসা, নবীবর রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা ও তাঁর আ-লগণের উপর সালাতুসসালাম এবং তাঁদের প্রিয়জন সকলেরই সমীপে সালাম-তাহিয়্যাহ্-অভিবাদন নিবেদনান্তে জ্ঞাতব্য যে, এখানে ‘মীলাদ’ বলতে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা স্মারক ধর্ম সম্মত যাবতীয় আয়োজন-উদযাপনকেই বুঝানো হয়। সরওয়ারে কায়িনাত নবীবর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র আবির্ভাব দিবস উদযাপন ক্ষেত্র বিশেষ সুন্নাত কিংবা মুস্তাহাবেরই অন্তর্ভুক্ত। দিবসটি স্বয়ং তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামাও সাপ্তাহিক, বর্ণনান্তরে মাসিক পালন করতেন মর্মীয় দলিল হাদীস শরীফে বিদ্যমান।
ইরশাদ হচ্ছে, عن عائشة رضى الله عنها قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصوم الاثنين والخميس– “আন আয়িশাতা রাদ্বিআল্লাহু আনহা ক্বা-লাত কা-না রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা ইয়াসূমূল ইছনাইনি ওয়াল খামীসে’
অর্থাৎঃ হযরত আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। (তিরমিযী; নাসায়ী; মিশকাত-১৭৯ পৃষ্ঠা)
আরো ইরশাদ হচ্ছে, عن ابى قتادة النصارى رضى الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم سئل عن صوم يوم الاثنين قال ذاك يوم ولدت فيه ويوم بعثت او انزل علىّ فيه وفى روايات انزلت علىّ فيه النبوة-  “আন আবী ক্বাতাদাতাল আনসারীয়্যু রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আন্না রাসূলাল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা সুয়িলা আন সওমি ইওমিল ইছনাইনি ক্বালা যা-কা ইওমুন ওলিদ্তু ফীহি ওয়া ইওমুন বু‘ইছতু আও আনযালা আলাইয়্যা ফীহি ওয়া ফী রাওয়াইতিন আনযালাত আলাইয়্যা ফীহিন্ নবূয়াতি”
অর্থাৎঃ হযরত আবু ক্বাতাদাহ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামার সমীপে সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ইরশাদ ফরমান, সেদিন আমি আবির্ভূত হয়েছি এবং আমার উপর নবুয়তের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিক অর্পন বা প্রথম ওহী অবতীর্ণ করা হয়। (সহীহ মুসলিম-১১৬২ নং, বায়হাক্বী- ৮১৮২ ও ৮২৫৯ নং, নাসায়ী-২৭৭৭ নং, মুসনাদে ইমাম আহমদ-২২৫৯০ ও ২২৫৯৪ নং, মুসান্নফে আবদুর রাজ্জাক্ব-৭৮৬৫ নং এবং মিশকাত-১৭৯ পৃষ্ঠা)
আরো ইরশাদ হচ্ছে, عن العرباض بن سارية عن رسول الله صلىّ الله عليه وسلم انّه قال انى عند الله مكتوب خاتم النبيين وان ادم لمنجدل فى طينته وساخبركم باول امرى انا دعوة ابراهيم وبشارة عيسى ورؤيا امىّ التى رأت حين وضعتنى وقد خرج لها نور اضاء لها منه قصور الشام- “আনিল ইরবাসিবনি সারিয়াতা আন রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আন্নাহু ক্বালা ইন্নি ‘ঈনদাল্লাহি মকতুবুন খাতিমান্নাবীয়্যিনা ওয়া আন্না আদামা লামুনজাদিলুন ফী ত্বায়নতিহী ওয়া সাউখবিরুকুম বি-আওয়ালি আমরী আ-না দাওয়াতু ইব্রাহীমা ওয়া বিশারাতু ঈসা ওয়া রূ‘য়াও উম্মীল্লাতি রায়াত হীনা ওয়াদ্বা‘তী ওয়া ক্বাদ খারাজা লাহা নূরুন আদ্বা‘আ লাহা মিনহু কুসূরাশ্শামি”
অর্থাৎঃ হযরত ইরবাক্ব ইবনে সারিয়াহ্ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর নিকট সর্বশেষ নবী হিসেবে রেকর্ডভুক্ত ছিলাম; অথচ তখনো আদম (আলাইহিস সালাম) মাটির মধ্যে অগঠিত অবস্থায় ছিলেন। অচিরেই আমি তোমাদেরকে আমার আদি বিষয়ে অবগত করবো। আমি ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম’র প্রার্থনা (অর্থাৎ কা’বা ঘর নির্মাণ পূর্বক যে রাসূল প্রেরণের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন, আমি সে রাসূল) হই; ঈসা (আলাইহিস সালাম)’র সুসংবাদ (তথা তাঁর পরে যে রাসূলের আগমণ সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়েছিলেন, সে রাসূলই আমি) হই। আর আমার আম্মাজানের সে চাক্ষুস দর্শনের বাস্তবরূপ হই; যা তিনি আমার ইহলোকে শুভাগমন কালে দেখেছিলেন যে, তাঁর (আম্মাজানের) জন্য এক ‘নূর’ আবির্ভূত হয়েছিলো, যা তাঁর জন্য (সুদুর) সিরিয়ার প্রসাদ সমূহ উদ্ভাসিত করে তোলে।” (বায়হাকী; মুসনাদে আহমদ; মিশকাত- পৃষ্ঠা ৫১৩)
আরো ইরশাদ হচ্ছে:  عن ابن عباس رضى الله عنهما انه كان يحدث ذات يوم فى بيته وقائع ولادته صلى الله عليه وسلم لقوم فيستبشرون به ويحمدون الله ويصلون عليه الصلوة والسلام اذجاء النبى صلى الله عليه وسلم وقال حلت لكم شفاعتى- “আন ইবনে আব্বাসিন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা আন্নাহু কানা ইয়ূহাদ্দিসু যাতা ইওমিন ফী বায়তিহী ওয়াক্বায়ি’আ বিলাদতিহী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা লিক্বওমিন ফাইয়াসতাবশিরুনা বিহী ওয়া ইয়াহমাদুনাল্লাহা ওয়া ইয়ূসাল্লূনা আলায়হিসসালাতু ওয়াসসালাম, ইয্ জা’আন্নবীয়্যু সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা ওয়া ক্বালা হাল্লাত লাকুম শাফা’আতী”
অর্থাৎঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একদা তিনি নিজ ঘরে লোকজন নিয়ে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামার আবির্ভাবের ঘটনাবলী বর্ণনা করছিলেন। এতে তাঁরা আনন্দিত হয়ে আল্লাহর প্রশংসা এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামার উপর দুরূদ-সালাম পাঠ করতে লাগলো। এমন সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা সেখানে তাশরীফ আনলেন এবং তা দেখে বললেন, ‘তোমাদের জন্য আমার শাফা‘আত অবধারিত হলো।’ (মাওলুদে কাবীর; আত্তান্ভীর ফী মাওলিদিন বাশীরিন্নাযীর; আদদূররুল মুনাযযাম; সুবূলুল হুদা ফী মাওলিদিল মুস্তফা)
আরো ইরশাদ হচ্ছে: عن ابى الدرداء رضى الله عنه انه مرمع النبى صلى الله عليه وسلم الى بيت عامرالانصارى وكان يعلّم وقائع ولادته عليه الصلوة والسلام لا بنائه وعشيرته ويقول هذا اليوم فقال عليه الصلوة والسلام ان الله فتح لك ابواب الرحمة والملائكة كلهم يستغفرون لك ومن فعل فعلك نجى نجاتك- “আন আবিদ্দারদায়ি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আন্নাহু মাররা মা‘আন্নবীয়্যি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা ইলা বায়তি আমিরিল আনসারীয়্যি ওয়াকানা ইয়ূআল্লিমু ওয়াক্বায়ি’আ বিরঅদতিহী আলায়হিস সালাতু ওয়াসসালামু লি আবনায়িহী ওয়া আশিরাতিহী ওয়া ইয়াকুলু হাযাল ইওমু ফাক্বালা আলায়হিস সসালাতু ওয়াসসালামু ইন্নাল্লাহা ফাতহা লাকা আবওাবার রাহমাতি ওয়াল্ মালায়িকাতু কুল্লুহুম ইয়াসতাগফিরুনা লাকা ওয়ামন ফা‘আলা ফি’লাকা নাজা নাজাতাকা”
অর্থাৎঃ হযরত আবুদ্দারদা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, একদা তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র সাথে হযরত আমের আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ঘরে গিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত আমের আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজ সন্তান-সন্তুতি ও আত্মীয় স্বজনদেরকে নিয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র আবির্ভাব সম্পর্কিত ঘটনাবলীর বিবরণ দিয়ে বলছেন যে, আজই সে আবির্ভাব দিবস। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তোমার জন্য রহমতের সমূহ দরজা খুলে দিয়েছেন, ফিরিশতা সকল তোমার জন্য সুপারিশ করছেন। আর যারা তোমার মতো কাজটি করবে তারা তোমার মতোই পরিত্রাণ লাভ করবে।’ (আত্তানভীর ফী মাওলিদিল বাশীরিন্নাযীর; সুবূলুল হুদা)
উপরোক্ত দলিল সমূহের আলোকে বিবিধ পদ্ধতিতে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা উদযাপন সুন্নাতই প্রমাণিত হলো। আর এহেন সুন্নাতকে মন্দ ও বর্জনীয় বিদ্‘আত আখ্যা দিয়ে কিংবা মোকাবিলায় নব আবিস্কৃত সীরাতুন্নাবী কিংবা ওফাতুন্নবী মাহ্ফিল উদযাপন করে তা বিলুপ্তির প্রয়াস রূপী যাবতীয় কর্মকাণ্ডই মূলত: মন্দ ও ভ্রষ্টতামূলক বিদ্‘আত বৈকি!
ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা:
বিশ্ব মানবতার মুক্তির সর্বকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ কাণ্ডারী নবীবর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা ধর্ম সম্মত পন্থায় সর্বোচ্চাঙ্গের আনন্দোদযাপনার্থেই হয়ে থাকে এবং তা মুস্তাহাবই। মূলত তা আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ পালনেরই অন্তর্ভূক্ত। যেমন কুরআন মজীদে ইরশাদ হচ্ছে:  قل بفضل الله وبرحمته فبذالك فليفرحوا هوخير مما يجمعون- “কুল বিফাদ্বলিল্লাহি ওয়া বিরাহমাতিহী ফাবিযালিকা ফালইয়াফরাহূ হুয়া খাইরুম্ মিম্মা ইয়াজমায়ূন”
অর্থাৎঃ (হাবীব!) ‘আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতকে কেন্দ্র করে তারা (আপনার উম্মতগণ) যেন আনন্দ উদযাপন করে; তা হবে তারা যা সঞ্চয় করবে তন্মধ্যে সর্বোত্তম।” (১১ পারা, সূরা ইউনুস: ৫৮ আয়াত)
আর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র শুভাগমন আমাদের জন্য আল্লাহর তা’আলার শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ ও রহমত হওয়ার বিষয় অবিদিত নয়। যেমন কুরআন মজীদেই আল্লাহ তা’আলার ইরশাদ হচ্ছে- لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا- “লাক্বাদ মান্নাল্লাহু আলাল মু‘মিনীনা ইয বা‘ছা ফীহিম রাসূলা-”
অর্থাৎঃ ‘অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা ঈমানদারগণের উপর বড়ই অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মধ্যে রাসূলকে প্রেরণ করেছেন।’ (৩ পারা, সূরা আল্-ই ইমরান:১৬৪ আয়াত)
আরো ইরশাদ হচ্ছে- وما ارسلناك الاّ رحمة للعالمين- “ওয়া মা- আরসালনাকা ইল্লা- রাহমাতুল্লিল আ‘লামীন”
অর্থাৎ: (হাবীব!) আমি আপনাকে সমগ্রজগতের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি। (১৭ পারা, সূরা আম্বিয়া: ১০৭ আয়াত)
অতএব মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ ও রহমত সাইয়্যদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামাকে নিজেদের মাঝে পাওয়া ব্যতীত আর কি হতে পারে! পক্ষান্তরে ঈমান, ইসলাম, ক্বোরআন, হিদায়ত, ইবাদত পদ্ধতি, অন্যান্য ঈদ, ইহ-পরকালীন শান্তি ও মুক্তির উপায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের উপায় সহ সর্বাত্মক সাফল্য লাভের উপায় যে মহান সত্তার বদৌলতে প্রাপ্ত, তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামার শুভাগমন স্মারক ঈদ, সকল ঈদের সেরা ঈদ বৈকি!
এতদ্বসত্ত্বে জ্ঞাতব্য যে, ‘ওরস’ শব্দটি খুশী উদযাপনের মর্মকে ধারণ করলেও তা ঈদের মতো ব্যাপক ও উচ্চাঙ্গের আনন্দোদযাপন মর্মীয় হয়না বিধায় ওরসুন্নবী উদযাপন জায়েয হলেও উত্তমের বিপরীত হেতু অযথার্থই। আর সীরাতুন্নবী কিংবা ওফাতুন্নবী মাহ্ফিল উদযাপনের অসঙ্গতা প্রসঙ্গে ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।  অতএব সকল ঈদের সেরা ঈদ তথা ঈদ-এ আ’যম হিসেবে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা উদযাপনই যথার্থ।
ওরস:
মহান আল্লাহ তা’আলার প্রিয় বন্ধু ওলীয়ূল্লাহ্গণ ইহলোক থেকে ইন্তিকাল করে আপন প্রেমাস্পদ আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে মিলিত হবার দিবসটি উপলক্ষে ওরস শরীফ উদযাপন করা হয়। ওরস শব্দটি আভিধানিক অর্থে যেমন নব দম্পতির ঐকান্তিক অবস্থান এবং তদুপলক্ষে ‘ওলীমা’ বা প্রীতিভোজের আয়োজনকে বুঝায় তেমনি মহান প্রেমাস্পদ আল্লাহ তা‘আলার একান্ত সান্নিধ্যে তাঁরই প্রিয়  বন্ধু ওলীয়ূল্লাহগণের মিলন এবং তদুপলক্ষে প্রীতিময় আয়োজনকে ওরস শরীফ বলা হয়।
মূলত: এ ওরস শরীফের  নাম পত্তন এবং  এহেন আয়োজন হাদীস শরীফ সূত্রেই বিন্যস্ত। যেমন হাদীস শরীফ মর্মে- প্রকৃত মু’মিন বান্দা যখন মুনকার-নকীর এর প্রশ্নোত্তরে সফলকাম হন তখন ফিরিশতাদ্বয় তাঁর উদ্দেশ্যে বলেন- نم كنومة العروس الذى لا يوقظه الا احب اهله اليه “নাম কানওমাতিল আরুসিল্লাযি লা ইয়ুকিযুহু ইল্লা আহাব্বু আহলিহী ইলায়হি”
অর্থাৎ: ‘ওই নব দম্পতির ন্যায় ঘুমিয়ে পড়ো, যাকে সর্বাধিক প্রিয়জন ছাড়া অপর কেউ জাগায় না।’ (তিরমিযী; মিশকাত-২৫ পৃষ্ঠা)
এ হাদীস শরীফের আলোকে উদ্ভাসিত লক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হলো-
(১) ‘নব দম্পতির মতো ঘুমিয়ে পড়ো’ তুলনা থেকে ‘ওরস শরীফ’ নাম পত্তন এবং প্রীতি ও বরকতময় তাবাররুকাত ইত্যাদি আয়োজনের যথার্থতা ফুটে উঠে।
(২) ‘ঘুমিয়ে পড়ো’ মর্মে তাঁরা আর মৃত অবস্থায় থাকছেন না।
(৩) সর্বাধিক প্রিয়জনের মাধ্যমে যে কোন সময় তাঁরা জেগেও উঠতে পারেন। এবং বাঞ্চাপূর্ণও করতে পারেন।
এতদ্সত্ত্বে আল্লাহর প্রিয় ও মক্ববুল বান্দাগণের শান-মান-মর্যাদা তুলে ধরার বার্ষিক আয়োজনের পক্ষে স্বয়ং সরওয়ারে কায়েনাত নবীবর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা এবং চার খলীফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’র কর্মপদ্ধতির মধ্যেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। যেমন হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে- كان النبى  صلى الله عليه وسلم يانى قبور الضهداء باحد على راس كل حول فيقول سلام عليكم بما صبرتم فننعم عقبى الدار والخلفاء الاربعة هكذا يفعلون- “কানান্নবীয়্যু সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা  ইয়া‘তি কুবুরাশ্শুহাদায়ি বি-ওহুদিন আলা রা‘সি কুল্লি হাওলিন ফাইয়াকূলু সালামুন আলায়কুম বিমা সাবারতুম ফানি’মা ওকবাদ্দারি ওয়াল খুলাফাউল আরবা‘আতু হাকাযা ইয়াফ‘আলূনা”
অর্থাৎ: ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা প্রতি বছরের মাথায় উহদ’র শহীদগণের ক্ববর সমূহে গমন করতঃ বলতেন, ‘তোমাদের ধৈর্যের বিনিময়ে শান্তিই তোমাদের উপর অবতারিত; অতএব পরবর্তী আবাস কতইনা উচ্চমানের!’ অতঃপর চার খলীফাও অনুরূপ করতেন। (ইবনুল মানযুর ও ইবনে মারদুব্বীয়্যাহ্, হযরত আনাস ইবনু মালিক থেকে; ইবনে জারীর, মুহাম্মদ ইবনু ইব্রাহীম থেকে; আদ্দুররুল মানছুর লিস্ সুয়ূতী; তাফসীরে কবীর ও ফতওয়ায়ে শামী ইত্যাদি)
এ হাদীস শরীফ দৃষ্টে লক্ষণীয় ও শিক্ষনীয় কয়েকটি বিষয় হলো-
(১) ‘প্রতি বছরের মাথায় গমন’ মর্মে বার্ষিক ওরস শরীফ আয়োজনের পক্ষে দলিল অর্জিত হলো।
(২) আল্লাহর প্রিয় ও মক্ববুল বান্দাগণের তথা ওলীয়ুল্লাহ্গণের মাযার শরীফে গিয়ে সাধারণ মুসলামান থেকে আলাদা ও উচ্চমানের সালাম আরয করতে হয়।
(৩) তাঁদের উচ্চ শান-মান-মর্যাদাকে স্মরণ করতে ও তুলে ধরতে হয়।
(৪) সাধারণ মুসলমানদের মতো তাঁদের রূহের মাগফিরাত বা ক্ষমা প্রার্থনা এবং ঈসালে সাওয়াব তথা রূহের উপর সাওয়াব পৌঁছানো থেকে বিরত থাকতে হবে। ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে আমরা সাধারণের জন্য ওলীয়ুল্লাহগণের স্বরণাপন্ন হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে নিজেদেরই প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী প্রার্থনা করে আল্লাহর কৃপা লাভে ধন্য হওয়া বাঞ্চনীয়। আল্লাহর দিগনির্দেশনাও তাই। যেমন কুরআন মজীদে ইরশাদ হচ্ছে-  ان رحمة الله قريب من المحسنين- “ইন্না রাহামতাল্লাহি ক্বরিবুম্মিনাল মুহসিনী’ন”
অর্থাৎ: “নিশ্চয় আল্লাহর রহমত পূণ্যাত্মাদেরই নিকটবর্তী।”
ঈসালে সাওয়াবাত্মক ফাতেহা:
পূণ্যের বা সাওয়াবের কোন কাজ করতঃ তার সাওয়াব মৃত কোন সাধারণ মুসলমানের জন্য পৌছাঁনোকেই এহেন ফাতেহা বলা হয়। এতে মৃত ব্যক্তির অনেক উপকার সাধিত হওয়া সম্ভব। কেননা সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীস মর্মে ‘খেজুর গাছের তাজা ডাল দ্বারাও শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত উপকৃত হওয়া সম্ভব’ বিধায় মানুষের পৌঁছানো সাওয়াব দ্বারাও অবশ্যই সম্ভব। তদুপরি তসবিহ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি দ্বারা উপকৃত হওয়ার পক্ষে সরাসরি হাদীসও বিদ্যমান। তবে ওলীয়ুল্লাহগণ থেকে শুরু করে তদুচ্চ মর্যাদার অধিকারী কোন সত্তার উদ্দেশ্যে এহেন ঈসালে সাওয়াব বা সাওয়াব পৌঁছানো অনুচিত; এমনকি ‘হাদীয়্যাতান তুহ্ফাতান’ তথা হাদীয়া-তুহ্ফা স্বরূপ উল্লেখ করেও তা পৌঁছানো উচিত হবেনা। কেননা কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে সরওয়ারে কায়েনাত নবীবর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা ও তদীয় আল বর্গের যথার্থ হাদীয়া-তুহ্ফা সালাতুস্ সালাম; অন্যান্য আম্বীয়া-ই কেরাম সহ সকল পূণ্যাত্মাগণের যথার্থ হাদীয়া-তুহ্ফা শ্রদ্ধাপূর্ণ সালাম-তাহিয়্যাহ-অভিবাধন; আর সাধারণ মুসলমানদের জন্য প্রীতিমূলক সালাম, দোয়া ইত্যাদি আচরণই যথার্থ। নামাযে পঠিত দুরূদ-সালামের প্রতি লক্ষ্য করলেও এহেন শ্রেণী বিন্যাস সুস্পষ্ট। জানাযার নামাযে পঠিত দুরূদ ও দোয়ার প্রতি লক্ষ্য করলেও স্পষ্ট যে, দুরূদ ওই মহান সত্তাগণের জন্য এবং দোয়া তথা ক্ষমা প্রার্থনা সর্ব সাধারণ মুমিন-মুসলামানদের জন্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র রওযায়ে আনওয়ার অন্যান্য পূণ্যাত্মাগণের রওযা শরীফ এবং সর্ব সাধারণের ক্ববর যেয়ারত কালে যথাক্রমে সালাতুসসালাম, শ্রদ্ধাপূর্ণ সালাম-তাহিয়্যাহ্-অভিবাদন এবং প্রীতিমূলক সালাম সহ প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষণীয়। অতএব ফাতেহার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা বজায় রাখা উচিত। তাই নযর-নিয়ায বা হাদীয়া-তুহ্ফা পেশ করা অর্থে আল্লাহর প্রশংসা সহ সকল মর্যাদাবানদের স্ব স্ব মর্যাদানুসারে নযর-নিয়ায পেশ তথা দুরূদ-সালাম ইত্যাদি নিবেদন এবং নিজেদের জন্য ক্ষমা, ফয়য-বরকত ও রহমত ইত্যাদি প্রার্থনা সহ সাধারণ মুমীন-মুসলমানদের জন্য ঈসালে সাওয়াব হলে ফাতেহা পাঠ বা ফাতেহা দেয়াও যথার্থ হবে।
ওয়াসসালাম।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *