মাওলায়ে কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র জন্মস্থান সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

মাওলায়ে কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র জন্মস্থান সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য
✍️__ বোরহান উদ্দিন মুহাম্মদ শফিউল বশর
أنت العليّ الذي فوق العلي رفعا 
ببطن مكة عند البيت إذ وضعا
আপনি আলী, উচ্চতার চূড়ায় তব অবস্থান;
আঁতুড়ঘর তব মক্কাস্থ খানায়ে কা’বা সুমহান!
আলক্বাসীদাতুল ‘আইনিয়্যাহ, ১৫ পৃষ্ঠা, আব্দুল বাক্বী আফন্দী আল্উমরী। 
মনান্তরের আশঙ্কায় আমি মতান্তর এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। ভাইরাল ফিভারে আক্রান্তদের প্রলাপের বিপরীতে বলতে গেলে তো মনান্তর শুধু নয়, লোকান্তরের সম্ভাবনাও রয়েছে। অধিকন্তু জিজ্ঞাসিত হয়ে নীরবতার অবকাশ তিরোহিত বিধায় এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের অবতারণা।   
শিয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী ওলামায়ে কিরামের মতানুসারে মাওলায়ে কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র জন্মস্থান খানায়ে কা’বাহ্। তাফসীরে রূহুল মা‘আনী প্রণেতা আল্লামা সায়্যিদ মাহমূদ আলূসী লিখেছেন, 
وفی کون الامیر کرم الله وجهه ولد فی البیت، امر مشهور فی الدنیا وذکرفی کتب الفریقین السنه و الشیعه
“আমীর কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুর জন্ম কা’বাহ্ ঘরে হওয়া জগৎ প্রসিদ্ধ একটি ঘটনা, যা সুন্নী ও শিয়া উভয়পক্ষের কিতাবসমূহে আলোচনা হয়েছে”। শরহুল খারীদাতিল গায়বীয়্যাতি ফী শরহিল ক্বাসীদাতিল আইনিয়্যাহ্ ১৫ পৃষ্ঠা। এতদসত্ত্বেও কিছু অর্বাচীন বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের অবতারণা করে ভাইরাল হতে চায়।
ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত মস্তিষ্কের জন্য উলামায়ে আহলে সুন্নাতের কিতাব থেকে  কিছু এন্টি ভাইরাস ডোজ।
👉 প্রথম: 
 ” تواترت الأخبار أن فاطمة بنت أسد ولدت أمير المؤمنين علي بن أبي طالب كرم الله وجهه في جوف الكعبة “
“বিপুল সংখ্যক বর্ণনায় এসেছে যে, ফাত্বিমাহ্ বিন্তে আসাদ আমীরুল মু’মিনীন আলী ইবনে আবী ত্বালিব কার্রামাল্লাহূ ওয়াজহাহুকে কা’বার মধ্যে জন্ম দেন” আল মুস্তাদরাক আলাস সাহিহাইন, পঞ্চম খণ্ড ২০৬ পৃষ্ঠা, আবূ আব্দিল্লাহ হাকিম নিশাপূরী।
বি.দ্র. নিশাপুরীর উক্তি ‘তাওয়াতিরাতিল আখবারু’ উক্তি দ্বারা উসূলে ফিক্ব্হ ও উসূলে হাদীসের পারিভাষিক খবরে মুতওয়াতির মর্ম না হলেও সংখ্যা গরিষ্টের মত নির্দেশক। 
👉 দ্বিতীয়:
وروی ان فاطمة بنت اسد کانت تطوف بالبیت وهی حامل بعلی (علیه‌السّلام) فضربها الطلق ففتح لها باب الکعبة فدخلت فوضتعه فیها
“বিবৃত যে, ফাত্বিমাহ্ বিন্তে আসাদ আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে গর্ভবতী অবস্থায় খানায়ে কা’বাহ’র ত্বাওয়াফ করছিলেন, এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা শুরু হলে তাঁর জন্য কা’বাহ্ ঘরের দরজা খুলে যায়; অতএব তিনি প্রবেশ করে সেখানে প্রসব করেন”। তাযকিরাতুল খাওয়াস, ১০ পৃষ্ঠা, আবূল মুযাফ্ফর শামসুদ্দীন সিব্তু ইবনিল জাওযী আলহানাফী (ইন্তিক্বাল: ৬৫৪ হিজরী)।
👉 তৃতীয়:
وفی السنة الثلاثین من مولده صلی الله علیه وسلم ولد علی بن ابی طالب کرم الله وجهه فی الکعبة
“রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার শুভাগমনের ত্রিংশ বছর আলী ইবনে আবী ত্বালিব কার্রামাল্লাহূ ওয়াজহাহু কা’বায় জন্ম গ্রহণ করেন”। ইনসানুল উয়ূনি ফী সীরাতিল আমীনিল মা’মূন আলমা’রূফ বিস্সীরাতিল হালাবিয়্যাহ্, তৃতীয় খণ্ড, ৫২০ পৃষ্ঠা, আবূল ফরজ নূরুদ্দীন আলী বিন ইব্রাহীম হালাবী আশ্শাফি‘ঈ ( ইন্তিক্বাল: ১০৪৪ হিজরী)।
👉 চতুর্থ:
وَأَوَّلُ مَنْ وُلِدَ فِي الْكَعْبَةِ مِنْ بَنِي هَاشِمٍ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ: عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ 
“বনু হাশিম ও মুহাজিরদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তিত্ব যার জন্ম কা’বাহ্ শরীফে হয়েছে: আলী ইবনে আবী ত্বালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু”। আখবারু মাক্কাতা ফী ক্বাদীমিদ দাহরি ওয়া হাদীসিহী (তারীখে মাক্কাহ্), তৃতীয় খণ্ড, ২২৬ পৃষ্ঠা,আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব ফাকিহী (ইন্তিক্বাল: ২৭৫/২৮০ হিজরী)। 
👉 পঞ্চম: বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আবূ যাকারিয়্যা ইয়াযীদ বিন মুহাম্মদ বিন ইয়াস আলআয্দিয়্যু আলমাওসিলিয়্যু (ইন্তিক্বাল: ৩৩৪ হিজরী) যাহাবীর সিয়ারু আ’লামিন নুবালার ভাষায় তিনি একাধারে হাফিয (হাফিযুল হাদীস) ইমাম ফক্বীহ ক্বাদ্বী। তিনি তাঁর তারীখে মাওসিল কিতাবে লিখেছেন, 
وکان ولد فی الکعبة ولم یولد فیها خلیفة غیر امیرالمؤمنین علی بن ابی طالب علیه السلام
“তিনি কা’বায় জন্ম গ্রহণ করেন; আমীরুল মু’মিনীন আলী ইবনে আবী ত্বালিব আলাইহিস্সালাম ব্যতীত অন্য কোন খলীফার জন্ম কা’বায় হয়নি”। তারীখু মাওসিল- কিতাবুস সালিসি আশার ৫৮ পৃষ্ঠা। 
👉 ষষ্ঠ: মুহাদ্দিসুল হরম জামালুদ্দীন মুহাম্মদ বিন ইউসুফ যরন্দী হানাফী ( ইন্তিক্বাল: ৭৫০ হিজরী) লিখেছেন, 
وولد کرم الله وجهه في جوف الکعبة
“তিনি কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু কা’বাহ’র অভ্যন্তরে জন্ম গ্রহণ করেন”। ম‘আরিজুল ওসূলি ইলা মা’রিফতি আলির রাসূলি ওয়াল বতূলি ৪৯ পৃষ্ঠা। 
👉 সপ্তম: প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবূল হাসান আলী ইবনুল হুসাইন শাফি‘ঈ আলমাসঊদী (ইন্তিক্বাল: ৩৪৬ হিজরী) লিখেছেন,
وكان مولده في الكَعبة .
“এবং তাঁর জন্ম কাবায়”। মুরূজুয্ যাহাবি ওয়া মা‘আদিনুল জাওহারি, দ্বিতীয় খণ্ড, ২৭৩ পৃষ্ঠা।
👉 অষ্টম: ইমামে আহলে সুন্নাত আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইউসুফ আশ্শাফি‘ঈ আলগঞ্জী ( ইন্তিক্বাল: ৬৫৮ হিজরী) লিখেছেন, 
ولد أمير المؤمنين علي بن أبي طالب بمكة في بيت الله الحرام ليلة الجمعة لثلاث عشرة ليلة خلت من رجب سنة ثلاثين من عام الفيل –
“আমীরুল মু’মিনীন আলী ইবনে আবী ত্বালিব মক্কায় বায়তুল্লাহিল হারামে ৩০ হস্তি বর্ষ ১৩ রজব জুমু‘আহ্ রাত জন্ম গ্রহণ করেন”। কিফায়াতুত ত্বালিব ফী মানাক্বিবি আলী ইবনি আবী ত্বালিব, ৪০৫-৪০৬ পৃষ্ঠা।
👉 নবম: নূরুদ্দীন আলী বিন মুহাম্মদ আলমা’রূফ ইবনুস্সাব্বাগ আলমালেকী (ইন্তিক্বাল: ৮৫৫ হিজরী) লিখেছেন, 
ولد علي ( عليه السلام ) بمكة المشرفة بداخل البيت الحرام في يوم الجمعة الثالث عشر من شهر الله الأصم رجب الفرد سنة ثلاثين من عام الفيل
“আলী মক্কায়ে মুশার্রাফার বায়তুল হারামের ভিতর ত্রিংশ হস্তিবর্ষ আল্লাহর মাস রজবের ১৩ তারিখ জুমু‘আহ্ বার জন্ম গ্রহণ করেন”। আলফুসূলুল মুহিম্মাহ্ ২৯ পৃষ্ঠা।
👉 দশম: শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী (৯৫৮ – ১০৫২) হিজরী লিখেছেন,
اہل سیر کہتے ہیں کہ ان کی ولادت جوف کعبہ میں ہوئی تھی-
“সিরতবিদগণ বলেন, তাঁর জন্ম কা’বাহ’র ভিতরে হয়েছিল”। মাদারাজুন নবূওয়াত, দ্বিতীয় খণ্ড, ৯১৭ পৃষ্ঠা, উর্দু অনুবাদ: গোলাম মুঈনুদ্দীন নঈমী মুরাদাবাদী, আদবী দুনিয়া, ৫১০ মাটিয়া মহল, দিল্লি।
👉 একাদশ: উপমহাদেশে কওমী ও আলিয়া উভয় ধারার উলামায়ে কিরামের কাছে নন্দিত ব্যক্তিত্ব শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী লিখেছেন,
  ”واز مناقب علي رضی اللہ عنہ کہ در حین ولادت او ظاہر شد یکی آن است کہ در جوف کعبہ معظمہ تولد یافت“
“আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র মর্যাদাসমূহে যা তাঁর জন্মের সময় প্রকাশ পেয়েছে, তদ্মধ্যে একটি হল: কা’বায়ে মু‘আজ্জামায় জন্মের মর্যাদা লাভ করেছেন”। ইযালাতুল খাফা ‘আন খিলাফাতিল খুলাফা, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা:২৬২।
👉 দ্বাদশ: সর্বজন বিদিত যে, শাহ্ আব্দুল আযীয দেহলভী রচিত “আত্তুহফাতুল ইসনা আশারিয়্যাহ” কিতাবখানা রাফিদ্বীদের খণ্ডনে লেখিত এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিমণ্ডলে সমাদৃত একটি গ্রন্থ। বিভিন্ন ভাষায় এই পুস্তকের অনুবাদ হয়েছে। মাওলায়ে কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র জন্মস্থান প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, 
والصحیح فی ذلک ان عادة الجاهلیة ان یفتح باب الکعبة فی الیوم الخامس عشر من رجب ویدخلون جمیعهم للزیارة وکانت العادة ان النساء یدخلن قبل الرجال بیوم او یومین وقد کانت فاطمة قریبة الوضع فاتفق ان ولدت هناک لما اصابها من شدة المزاحمة والمجاذبة-
“ওই সংক্রান্ত বিশুদ্ধ ঘটনা হল যে, অজ্ঞতার যুগের মানুষদের রীতি ছিল যে, ১৫ রজব কাবার দরজা খোলা হত এবং যিয়ারতের উদ্দেশ্যে তারা সবাই খানায়ে কাবায় প্রবেশ করত। মহিলাদের রীতি ছিল যে, তারা পুরুষদের এক অথবা দুই দিন পূর্বে প্রবেশ করত। ফাত্বিমা ( আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র আম্মাজান) এর প্রসব কাল নিকটবর্তী ছিল, ঘটনাক্রমে ভিড়ের চাপে সেখানে প্রসব হয়ে গেছে”। মুখতাসারুত্ তুহফাতিল ইসনা আশারিয়্যাহ, ৪৪ পৃষ্ঠা, আরবী অনুবাদ: গোলাম মুহম্মদ বিন মুহী উদ্দীন বিন উমর আলআসলামী, সংক্ষিপ্ত করণ: সায়্যিদ মাহমূদ শকরী আলআলূসী।
🔸 উল্লেখ্য যে, শাহানশাহে বিলায়ত, মাওলায়ে কায়িনাত, তাজে শুজা‘আত, বাবে ইলমো হিকমত, মম্বা‘য়ে ফদ্বলো কারামাত, ইমামে রুশদো হিদায়াত, মা’দিনে সিদক্বো সদাক্বাত, মসদরে সবরো ইস্তিক্বামত, ফাতেহ খায়বর, হায়দরে কার্রার, ছাহিবে যীল ফিক্বার, আসাদুল্লাহিল গালিব আলী ইবনে আবী ত্বালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র জন্ম সংশ্লিষ্ট অলৌকিকতা প্রসঙ্গে শিয়া মকতবাতুল ফিকরের সাথে সুন্নী মকতবার অমিল থাকলেও জন্মস্থান খানায়ে কা’বাহ্ হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সুন্নী উলামায়ে কিরাম মতৈক্য পোষণ করেছেন। এই প্রাসঙ্গিক তেরোটি রেফারেন্স এই নিবন্ধে উদ্ধৃত হয়েছে। অতএব বিশুদ্ধ সনদের অজুহাতে সনদ বিহীন ভিন্নমতকে প্রাধান্য দিয়ে নূতন করে বিতর্কের অবতারণার মাধ্যমে ফিতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টির মানসিকতা পরিত্যাজ্য। বিশুদ্ধ সনদ প্রশ্নে ভিন্নমতকে প্রাধান্য দিতে গেলে ওই মতটির পক্ষেও বিশুদ্ধ সনদ জরুরি; এই কথা বেমালুম ভুলে গেলে চলবে না। রিফদ্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে মাওলায়ে কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শানের বিরোধিতা আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের রাজপথ থেকে সটকে খুরূজের চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া বৈ কিছু নয়। সাধু সাবধান!

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *