খিদ্বরে রাহে ইরফান


খিদ্বরে রাহে ইরফান

মুহাম্মদ নূর হুসাইন হারূনী

আমার পরম পূজ্য মুরশিদে করীম (রা.) সম্পর্কে লিখতে বসে কি লিখব, কূল-কিনারা পাচ্ছিলামনা। প্রাণাধিকপ্রিয় মুরশিদের বিচ্ছেদের দগদগে ক্ষত ও সোনালী অতীতের স্বপ্নিল রাজ্যের হাজারো মধুময় দৃশ্য; স্মৃতিতে দুই বিপরীতের অবস্থান ও দু’রকমের অনুভূতিতে মনোপ্রাণ কাহিল। মাকে হারানোর বেদনা, পিতৃস্নেহের হাহাকার, অনিশ্চিত শিক্ষা-জীবন; সকল দুঃখ-গ্লানি যার পরশে এক নিমিষে উদাও, তাঁকে নিয়ে কিছু লিখা, তাও আবার তাঁর মহাপ্রয়াণোত্তর, সত্যিই দুরূহ। তবুও বিরহী অন্তরের সান্তনা স্বরূপ কিছু স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস পেলাম।
খুবই ছোট্ট বয়সে মাকে হারাই। বাবা আবার বিয়ে করেন। কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় চাষের মৌসুমে নিয়মিত মাদ্রাসায় যাওয়া হতোনা। কাজের চাপে ক্লাসের পাঠ প্রস্তুত করা হয়ে ওঠতোনা বলেই প্রায়শ শিক্ষকদের ভর্ৎসনা শুনতে হতো।  
উনিশ শত বিরাশি খ্রীষ্টাব্দ। তখন আমি কালারপুল ওহিদিয়া সিনিয়র মাদরাসায় ইয়াযদাহুম-এ পড়তাম। সকালে খড় রোদে দিয়ে মাদ্রাসায় যাই। পড়ন্ত বিকালে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন ক্ষুধায় কাতর। ঘনকালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়েছে। পিনপিন বৃষ্টি পড়ছে, যখন-তখনই মুষলধারে বারিপাত শুরু হতে পারে। বাবা খড় স্তুপ করছিলেন, ঘামে তাঁর সর্বশরীর ভেজা। আমাকে দেখেই তিনি চিৎকার করে ওঠলেন যে, খাওয়ার সময় সবই থাকে, কাজের জন্য কাউকে পাইনা। ক্লান্ত বাবা আরো বহু বকাবকি করতে লাগলেন। আমি কিছুটা বাবার মায়ায় কিছুটা ক্ষোভে বই-খাতা রেখে না খেয়েই কাজে লেগে যাই। পরদিন হতে মাদরাসায় যাওয়া বন্ধ করে গৃহস্থির কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করি। কেননা বাড়ির কাজ আর লেখাপড়া-এ দু’টানায় কোনটাই ঠিকভাবে হয়ে ওঠেনা। 
মাদরাসায় যাওয়া বন্ধ করলেও লেখাপড়ার জন্য আমার মন সর্বদা অস্থির হয়ে থাকত। কোথাও শান্তি পেতামনা। অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা স্কুল, মাদরাসায় যাচ্ছে দেখে মন কাঁদত কিন্তু কাজের চাপে দু’ফোটা অশ্রুপাতের অবসরও মিলতনা। মায়ের আঁচলও ছিলনা যে, তাতে মুখ লুকিয়ে শান্তি খুঁজব। পরন্তু রাতের নির্জনতায় আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদকালে নয়নে জোয়ার বয়ে যেত। এ ভাবে দিন বয়ে চলল আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে অস্থিরতাও। 
অমনি সময় একদা রাতে স্বপ্নে দেখলাম যে, সবুজ জুব্বা ও পাগড়ী পড়া এক সুদর্শন শায়খ আমাদের গৃহে আগমন করেছেন। তাঁর সাথে কালারপুল মাদরাসার মুদাররিস আমার শিক্ষক মাওলানা হাফেয আহমদ সাহেবও আছেন। উভয়কে বসিয়ে ভাত-তরকারি এনে দিলাম। মেহমান ভোজন শেষে বললেন, তুমিতো মাদরাসায় যাবে, চলে যাও। আমি বললাম, মাদরাসায় যা পড়বো, তাতো আপনার নিকটও পড়তে পারি। তিনি বললেন, তাহলে কিতাব নাও। আমি তা’লীমুল ইসলাম ১ম খণ্ড ও আনওয়ারুল আদব নিলাম। স্বাপ্নিক মহাপুরুষ আমাকে উভয় পুস্তক হতে সবক পড়ালেন। (কি পড়িয়েছিলেন তা এ মুহুর্তে মনে পড়ছেনা)। পড়া শেষে মাওলানা হাফেয আহমদকে জিজ্ঞাসা করলাম, হুযূর! উনি কে? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, পীরানে পীর দস্তগীর (রাদ্বি.)। অতঃপর স্বপ্ন ছুটে গেল আর আমি জেগে গেলাম, ফজরের আযানও ভেসে এল কানে। 
এ স্বপ্ন দেখার পর থেকে লেখাপড়ার বিষয়ে দুশ্চিন্তা বিদূরীত হয়ে গেল। অজানা এক আত্মবিশ্বাসে দৃঢ় ধারণা হল যে, অবশ্য আমি শিক্ষা সমাপন করতে পারবো। পরন্তু স্বপ্নদর্শিত মহাপুরুষের সন্ধান কোথায় পাবো, সে চিন্তা পেয়ে বসে। কারণ পীরানে পীর (রাদ্বি.) বাগদাদ নিবাসী আর তিনিতো জাহেরী জীবনেও নেই। এ ভাবনায় দিবারাত্রি কেটে যেতে লাগল আর মনের আয়নায় ভাসতে রইল সে মোহন মুরত। 
একদা আমি জমিতে হাল বাইতে ছিলাম। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের পাড়ার মাদরাসা পড়ুয়া দুই ছাত্র। তারা নিকটে এলে বললাম, তোরা পড়বি আর আমি হালচাষ করবো নাকি? তাদের মাঝে অপেক্ষাকৃত বড়জন বলল, তা হলে তুই যাবি আমাদের সাথে! বললাম, কোথায়? বলল, ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়িতে। বললাম, পড়ার খরচ পাবো কোথায়? বলল, সেখানে পৌঁছতে পারলেই ব্যবস্থা হবে। বললাম যাবো। বলল, তা হলে চল।
অতঃপর ঘরে ফিরে গোসল সেরে কাউকে না বলে এক লুঙ্গি এক পাঞ্জাবীতে বেরিয়ে পড়লাম। আমার মামাত ভাই জনাব মুহাম্মদ ইউসুফ থেকে  ভাড়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা নিয়ে তাদের সাথে অজানা উদ্দেশ্যে রাওয়ানা দিলাম। লেখাপড়া করতে পারবো ভাবনায় মন খুশিতে নেচে ওঠলোতো আবার খরচের চিন্তায় কেঁপে ওঠছে। 
তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিলনা। দিনের এগারটায় পটিয়ার কোলাগাওঁ হতে যাত্রা দিয়ে নাজিরহাট হতে প্রায় তের-চৌদ্দ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রাত্রি ১১ টায় পৌঁছলাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতার বাড়িতে। প্রতিষ্ঠাতা হুযূর তখন বাড়িতে ছিলেননা। দায়রা শরীফে বসে খাওয়া-দাওয়া করে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। (দায়রা শরীফ/খানকাহ শরীফ বলতে অনেকে আলীশান ইমারত বুঝেন। কিন্তু উল্লিখিত দায়ারা শরীফ ছিল বাঁশ আর ছনের। অবশ্য এখন তা দালানে রূপান্তরিত হয়েছে।) বাবাজানের হুজরা শরীফ ছিল বাঁশের বেড়া আর টিন-ছনের ছাউনি; এখন ওপরে ছন না থাকলেও টিনের আর বাঁশের বেড়ার কুঁড়েঘরটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
অবশেষে তিনি মাওলানা আবদুর রশীদ সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে বাড়ি ফিরলেন। চার চোখের মিলন হতেই দেখলাম স্বপ্নের মহাপুরুষ আমারই সামনে। অবশ্য পোষাক ও শরীরে কিঞ্চিৎ তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। স্বপ্নে দেখা পোষাক ছিল সবুজ আর বাস্তবাতায় দেখছি সফেদ সাদা, স্বাপ্নিক মহাপুরুষের চেয়ে সাক্ষাৎ মহাপুরুষ দেখতে সামান্য কৃশকায়। 
মনের দ্বিধা-সংশয়, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি সবই মুহূর্তে উবে গেল প্রতিষ্ঠাতা হুযূরকে দেখে। নিজের অজান্তেই কিশোর মন উৎসর্গিত হল তাঁর চরণে। মায়ের বিয়োগ ব্যথা, বাপ-ভাইদের ছেড়ে আসার দুঃখ সবই বেমালুম ভুলে গেলাম।
সহযাত্রী একজনের লজিং-এ গিয়ে নিশীযাপন করলাম। পরদিন হারুয়ালছড়ি গাউসিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া মাদরাসায় গিয়ে ভর্তি হলাম। দুপুরের ভাত মাদরাসার হোষ্টেলে খেয়েছি আর রাত হতে লজিং তথা ছেলে পড়ানোর বিনিময়ে অন্ন আর বাসস্থান। শুরু হল নূতন এক জীবনযাত্রা। পরিশ্রম আছে কিন্তু দুঃখ নাই।
এখানে আমার স্বপ্নমর্মের কিঞ্চিৎ বর্ণনা সঙ্গত মনে করি। বাবাজানকে সবুজ পোষাকে দেখার হেতু হল খদ্বরভী শান নির্দেশক। হযরত খিদ্বর (আ.)’র কাজ হল পথভুলা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দান। বাবাজান ক্বিবলা আমাকে ইলমে দ্বীনের সন্ধান দেওয়ার জন্যই স্বপ্নে ওই পোষাকে আবির্ভূত হন। দু’টি পুস্তকের সবকদানের মাধ্যমে  ইলমে যাহির ও বাত্বিন তথা মহানবী (দ.)’র উভয়বিদ ইলমের উত্তরাধিকারী ও বিতরণকারী রূপেই আত্মপ্রকাশ করেন। সত্যিই তিনি পর্ণকুঠিরে বসে আজীবন যাহিরী-বাত্বিনী জ্ঞান অকাতরে বিলিয়ে যান। অধুনা বিশ্বের গতানুগতিক পীরি-মুরীদির বিপরীত যথার্থ অর্থে ত্বরীকত চর্চা ও অনুশীলনের এক বিরল দৃষ্টান্ত আমার মুরশিদ গাউসুল ওয়াক্ত হযরতুল আল্লামা কাযী সৈয়্যদ হারূনুর রশীদ (রাদ্বি.)। তিনি সিদকে সিদ্দীক, ‘আদলতে ফারূক, হায়ায়ে যূন নূরাইন ও সাখাওয়াতো ফকরে হায়দরীর মূর্ত প্রতীক ছিলেন।
এক সফল ও মহান প্রতিষ্ঠাতা রূপে আমার মুরশিদে করীমকে যেমন দেখেছি, ছোট্ট একটি ঘটনার মাধ্যমে তার বর্ণনা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।  আমার লজিং ছিল বাবাজানের বাড়ি হতে ঘুরপথে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। একবার আমি দুই দিন মাদারাসায় আসিনি। তখন শীতের দিন। কনকনে ঠাণ্ডা ও ঘন কুয়াশা। রাত বারটার দিকে আমার রুমের দরজায় হাল্কা করাঘাত শুনি। বুঝতে পারলাম আমার বাবাজান এসেছেন। কারণ সন্ধ্যা হতেই অনুভূতিতে তাঁর আগমন টের পচ্ছিলাম। আমি যেন এ অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলাম। তড়িৎ দরজা খুলে দিলাম। গায়ের চাদর চৌকিতে বিছিয়ে দিলাম। বাবাজান প্রবেশ করে তাতে উপবেশন করতেই তাহিয়্যাহ-অভিবাদন আদায় করি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, দুই দিন মাদরাসায় না গিয়ে কি করছিস? বল্লাম, শরীরের অবস্থা ভাল যাচ্ছিলনা। এমন সময় লজিং এর সবাই এসে হাজির। তারাও অভিবাদন জ্ঞাপন করে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবাজান! কী করে এলেন! অতঃপর আমার টেবিলের ডেস্কে রাখা উপন্যাস দু’টি এবং হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র বিশিষ্ট খলিফা হযরত আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী রচিত গানের বই রত্ন সাগর হাতে তুলে নিয়ে যাত্রা দিলেন। আমিও সঙ্গে ছুটলাম। পথিমধ্যে গল্পছলে অনেক কথা বললেন। আমি কিন্তু নিরুত্তর। কেননা তিনি ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, মাদরাসায় না যাওয়ার কারণ শরীর নয় মন। মনের এ আচ্ছন্নতার হেতু উপন্যাস দু’টি। বাবাজানের রোগ নির্ণয় ও প্রতিষেধক দানের বিষয়টি আমাকে যারপরনা বিষ্মিত করল।  
বাবাজান আমি একার নয় এমনিভাবে সকল ছাত্র-শিক্ষকের খবর নিতেন। আমি আজও অবাক হই যে, একজন প্রতিষ্ঠাতা আপন দায়িত্ব সম্পর্কে কত সচেতন হলে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও একজন ছাত্রের অনুপস্থিতির খবর রাখেন এবং লজিং-এ গিয়ে তালাশ করেন! এত মহৎ-মহান ও সচেতন মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতা সত্যিই বিরল। বাবাজানের  উদারতা মহানুভবতার বর্ণনা অধমের সাধ্যাতীত। হাদীসের মর্মালোকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামা’র  পর সর্বাধিক উদার-মহৎ-দানশীল ব্যক্তিত্ব তিনি, যিনি ইলম শিখেছেন এবং তা বিস্তার করেছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবুল ইলম) আমার মুরশিদে করীম ইলমে দ্বীনের প্রসারে শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নেন, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, ওয়ায-নসীহত করেছেন, মাদরাসায় থাকা, খাওয়া ও শিক্ষা সামগ্রী বিনামূল্যে প্রদানের ব্যবস্থাসহ নানা প্রকার প্রদক্ষেপ নেন। 
পরিশেষে আল্লাহর মহান দরবারে মুরশিদে করীমের পদাঙ্ক অনুসরণের শক্তি-সামর্থ্য কামনা করি। আমীন বিহুরমতি সায়্যিদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন।
লিখক
মুদাররিস
কুলাগাঁও গাউসিয়া মাদরাসা
পটিয়া, চট্টগ্রাম

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *