চলিত ভাষায় রূপান্তর : মঈনুদ্দীন মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ
[বি. দ্র.: ১৯৮৭ সনের ১২ রবিউল আওয়াল আঞ্জুমানে তৌহীদ বতোফায়লে রশীদের উদ্যেগে হারুয়ালছড়ি গাউসিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মাহফিলে সভাপতির ভাষণে প্রদত্ত ত্বাকরীরের চুম্বকাংশ]
পর্ব-২ হাক্বিক্বতে মুহাম্মদী (দ.)
(মানুষের আকৃতিতে মুহাম্মদ ও নামাযের অবয়বে আহমদ হায়াতুন্নবী ও ইলমে গায়ব প্রসঙ্গ )
সাজরাতুল ইয়াকীনে ময়ুর রূপে অবস্থানের সময় আল্লাহ নূরে মুহাম্মদীর প্রতি তাওয়াজ্জুহ করলে মুহাম্মদ (দ.) আত্মরূপ দর্শনে পরিতুষ্ট হয়ে আল্লাহর শোকরিয়ার্থে পাঁচটি সিজদা দেন। ওই পাঁচ সজিদার ভিত্তিতে উম্মতে মুস্তফার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয়। নামাযে আহমদ শব্দের শেকল বা আকৃতি পরিস্ফুটিত। দাঁড়ানো অবস্থা ‘আলিফ’ রুকূ ‘হা’ সিজদা ‘মীম’ এবং বৈঠক ‘দাল’ অক্ষরের ন্যায়; শেকলে আহমদের ওপর নামাযের সংঘটন। শেকলে মুহাম্মদীর ওপর ইনসান বা মানুষের সৃজন। মাথা ‘মীম’ কাঁধ ও দুই হাত ‘হা’ কোমর ‘মীম’ পা ‘দাল’। হাদীস শরীফের বর্ণনা, ‘খালাক্বাল্লাহু আদমা আলা সূরতিহী’ আল্লাহ মানুষকে তাঁরই আকৃতিতে সৃজন করেছেন; ওই দিকে ইঙ্গিত করে। আল্লাহর তজল্লী হল মুহাম্মদ (দ.) আর মুহাম্মদ নামের সুরতে মানুষ তথা বান্দা সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এ সুরতে আল্লাহ কাউকে জাহান্নামে দিবেননা। জাহান্নামের আগুন মুস্তফা (দ.)’র সুরতকে বরদাশত করতে পারবেনা। আল্লাহ তাঁর হাবীবের সম্মানার্থে ওই আকৃতিতে কোন বেদ্বীন, কাফির, ইহুদী ও খৃষ্টান কাউকে নরকে দিবেননা। প্রশ্ন জাগে কোন সুরতে দেবেন? পার্থিব জীবনের আমল অনুযায়ী শূকর-কুকুর-বিড়াল ইত্যাদির আকৃতিতে জাহান্নামে দেবে। আজ যারা শেকলে মুহাম্মদের মর্যাদা নিয়ে মুস্তফা (দ.)’র ইত্তিবা-অনুসরণ করছে, তাওয়াল্লুদ শরীফ বয়ান করছে, সিদ্কে নিয়্যতের সাথে জাঁকজমক অনুষ্ঠান করছে, আল্লাহ তাদেরকে কি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন? কখনো না। যদি তাদের কেউ জাহান্নামে পড়ে যায়, তবে জাহান্নামের আগুন নিভে যাবে।
পিয়ারে মুসলমানো! আপনারা আলেমদের মুখে শুনেছেন, নবী (দ.)’র ছায়া ছিলনা। কেন ছিলনা? যত নবী-রাসূল ছিলেন, সকলের ছায়া ছিল, নবী (দ.)’র ছায়া ছিলনা কেন? কারণ রাসূলুল্লাহ (দ.) আল্লাহর ছায়া, আল্লাহর জলওয়া, আল্লাহর নূর। ছায়ার ছায়া থাকেনা। এখন আল্লাহ কি তা রাসূল জানে আর রাসূল কি তা আল্লাহ জানে; আমি ওই দিকে যাচ্ছিনা। আমি মুস্তফা (দ.)’র কি তা’রীফ কি প্রশংসা করবো? আমার ওই শক্তি কোথায়? লা ইউমকিনুুস্ সানাউ কামা কানা হক্কাহু, বা’দে আয্ খোদা বুযুর্গ তুঈ কিসসা মুখতাসর’। মুস্তফা (দ.)’র প্রশংসার মত প্রশংসা করা কোন মানবের পক্ষে সম্ভব নয়-মুমকিন নয়; আল্লাহ রব্বুল ইযযতের পর তিনি মহান-বুযুর্গ, এখানেই কিচ্ছা শেষ। সমস্ত সাগরের পানি যদি কালি হয়, গাছ-বাঁশ যদি কলম হয়, মানব জাতির প্রতিজন যদি লিখক হয়, সবাই মিলে লিখে শানে মুস্তফা শেষ করতে পারবেনা।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ কলিমা পড়ে, কুরআন, হাদীস, ইজমা পড়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূল মরে মাঠির সাথে মিশে গিয়েছে, নবী (দ.) নাকি গায়েব জানেন না, নবী (দ.) বড় ভাইয়ের মত; নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।
বড় ভাই সবার আছে আবার তাদের ছায়াও আছে। রাসূল ভাই হলে ছায়া ছিলনা কেন? নবী (দ.)’র সাথে আমাদের আরো বহু তফাৎ আছে; এ সামান্য টুকু বুঝলেও নবীকে ভাই বলতে পারতনা। রাসূল মরিল কেমনে? রাসূল গেল কিভাবে, রইল কিভাবে; আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। পূর্বোক্ত হাদীসে জাবির মর্মে সকল নবী-রাসূল যদি রাসূল (দ.)’র নূর হতে সৃজিত হয়, তবে সকল নবীর মাঝে রাসূল (দ.) গিয়েছেন, মুস্তফা (দ.)’র নূরের তজল্লিয়াত গিয়েছে। আর্শ, কুরসি, লওহ, কলম, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ-তারা এককথায় সবকিছু যদি মুস্তফা (দ.)’র নূরের তজল্লিয়াত হতে সৃষ্টি করা হয়, তবে সমগ্র জগতে খোদার খোদায়ী জুড়ে রাসূল কি নেই? অবশ্য আছেন। চোখে দেখতে পাচ্ছনা। কেননা ওই চোখ ফুটেনি ওই চোখ খুললে তবে সব দৃষ্টির সামনে দেখতে পেতে।
রাসূল মারা গেল কোথায়? রাসূল ছিলেন, আছে এবং থাকবে। ক্বিয়ামত-ইসরাফীলের সিঙ্গায় মুস্তফা (দ.)’র ক্ষয় হবেনা। কারণ সূর্য থাকলে তার কিরণ যেমন থাকে, আল্লাহ থাকলে তাঁর তজল্লীও থাকবে। রাসূল (দ.)’র বিনাশ হয়েছে বল্লে আল্লাহ বাকী থাকে কি? মাওলানা সাহেবরা! প্যাঁচ লাগছে? (উপস্থিত আলেমদের কেউ একজন বলে ওঠলেন, ‘কুল্লু মান আলায়হা ফা-ন, ওয়া ইয়াবক্বা ওয়াজহু রাব্বিকা যূল্ জালালি ওয়াল ইকরাম’ অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে যা আছে, সবকিছুই নশ্বর। এবং চিরস্থায়ী হচ্ছে, আপনার প্রভুর চেহরা, যিনি মহান মর্যাদা ও মহিমার অধিকারী।) (সূরা আর রহমান ২৬-২৭ নং আয়াত) মাওলানা সাহেব! আপনি আমার আলোচনার গতি-প্রকৃতি বুঝেননি। আপনি জমিনের ওপরের বিষয় নিয়ে আছেন, আর আমি আলমে আরওয়াহ ও তার উর্ধ্বের লা মক্বানের আলোচনা করছি। নূরে মুহাম্মদী ও হাক্বীক্বতে মুহাম্মদীর কথা বলছি, যা পূর্বোক্ত হাদীসে কুদসী ও কুরআনের আয়াত মর্মে আল্লাহর তজল্লী, মুহাব্বত, ইরাদাহ, আমর; এটার ফানা নেই, ধ্বংস নেই। ওটার জন্য ধ্বংস স্থির করা হলে, আল্লাহর জন্যও বিনাশ মানা আবশ্যক হবে; যেহেতু হাক্বীক্বতে মুহাম্মদী আল্লাহর তজল্লী; আল্লাহ থাকবেনতো তজল্লীও থাকবে। মানুষের রূহ আমরে রব, তারও ধ্বংস নেই, কুরআনে মাজীদ ফুরকানে হামীদেরও ধ্বংস নেই। আমরা-আপনারা যা পড়ছি, তা আকসে কুরআন বা কুরআনের প্রতিফলিত রূপ। হাক্বীক্বতে কুরআন মাখলুক নয়, ওটার ধ্বংস নেই।
অতঃপর আহমদ ইবনে হাম্বল (রা.)’র ঘটনার বর্ণনা উপস্থাপন করলেন এবং তাঁর বীরত্বের প্রশংসা করলেন। সত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাণ বিসর্জনের তথা আত্মোৎসর্গের প্রয়োজনীয়তার প্রতি ইঙ্গিত দিলেন।