হাদীয়ে যমান-এর দু’টি ঘটনা প্রসঙ্গে: তথ্য বিভ্রাট নিরসনে প্রকৃত সত্য-তথ্য প্রকাশ

হাদীয়ে যমান-এর দু’টি ঘটনা প্রসঙ্গে:

[তথ্য বিভ্রাট নিরসনে প্রকৃত সত্য-তথ্য প্রকাশ]

কুত্ববুল আক্বতাবে যমান হযরত বাবাভাণ্ডারী (রাদ্বি.) ও হাদীয়ে যমান গাউসুল ওয়াক্ত আল্লামা কাযী সৈয়্যদ হারূনুর রশীদ (রাদ্বি.) সংশ্লিষ্ট, আধ্যাত্মিকভাবে সংঘটিত দু’টি ঘটনা-প্রাসঙ্গিকতায় প্রকাশিত কিছু তথ্য বিভ্রাট নিরসনকল্পে আমাদের এ নিবন্ধ। 
‘কারামাতে গাউছুল আ’যম বাবাভাণ্ডারী (ক.)’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশক, আলহাজ্ব শাহজাদা মাওলানা ছৈয়দ নজরুল হুদা আল-হাছানী আল- মাইজভাণ্ডারী (ম.) গাউছিয়া রহমান মনজিল, মাইজভাণ্ডার শরীফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। প্রথম প্রকাশ: ২৯ শে আশ্বিন, ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ইং। তফসিলোক্ত গ্রন্থের ২২৪-২২৫ পৃষ্ঠা জুড়ে ‘রওজা থেকে হস্ত প্রসারিত করে বায়আত ও ফয়েজ দান’ শীর্ষক এবং ২২৫-২২৭ পৃষ্ঠা জুড়ে ‘টাকা ভর্তি ব্যাগ দিয়ে আযমীর শরীফে যাওয়ার নির্দেশ’ শীর্ষক ঘটনা প্রবাহে বেশ কিছু তথ্য বিভ্রাট প্রকাশ পায়; যা সংশোধনের নিমিত্তে প্রকাশক মহোদয় বরাবরে অনুরোধ সম্বলিত পত্র সম্প্রতি আমরা প্রেরণ করি। কিন্তু সংশোধনী আনায়ন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা অবকাশে বিভ্রান্তি প্রসারিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায় বিধায় তা রোধ ও নিরসন কল্পে জরুরী ভিত্তিতে আমাদের এ প্রকৃত সত্য-তথ্য প্রকাশ। 
হাদীয়ে যমান গাউসুল ওয়াক্ত আল্লামা কাযী সৈয়্যদ হারূনুর রশীদ (রাদ্বি.) চট্টগ্রামস্থ ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি গ্রামে ২৭ আগষ্ট ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ, ১০ ভাদ্র ১৩৩০ বাংলা, ১৪ মুহররম ১৩৪২ হিজরী সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন। পারিবারিক ভাবে ও গ্রাম্য মক্তবে বাল্যকালীন শিক্ষা শেষে অধিক জ্ঞানার্জনের প্রেরণায় ও দৃঢ় সংকল্পে তিনি পরিবারস্থদের স্নেহের বন্ধন ও সংযোগ ত্যাগ করে ১০ বছর বয়সে বেরিয়ে পড়েন, আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা  করে। কারণ পারিবারিক  কাজে সহযোগিতা না করে জ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা গ্রহণে ভাইদের সঙ্গত আপত্তি আসতেই পারে! অতএব খোঁজে পাবার সম্ভাবনা নেই এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় সীতাকুন্ড মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হন ১৯৩৩ খ্রিষ্ট সালে। তখন ধর্মীয় ও ত্বরীক্বা সম্পৃক্ত বিবিধ বিষয়ে সর্বত্র বিজয়ী ও অপ্রতিদ্বন্ধী  মুনাযিরে আ’যম ইমামুল আইম্মায়ে যমান শায়খুল ইসলাম গাউসে যমান আল্লামা শাহসূফী সৈয়্যদ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (রাদ্বি.) সীতাকুন্ড, ফেনী ও কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চলেও বিবিধ মুনাযিরার মাধ্যমে সর্বত্র আলোচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিধায় মাদ্রাসায় অধ্যয়নের পাশাপাশি তাঁর সান্নিধ্য লাভের জন্যও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন। অতএব সাপ্তাহিক ও সাময়ীক বন্ধসমূহে তিনি অত্যন্ত দুর্গম পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে সীতাকুন্ড থেকে ফরহাদাবাদ দরবার শরীফে গমনাগমন করতে লাগলেন। এভাবে সাময়ীক বন্ধেতো বটেই প্রতি সাপ্তাহিক বন্ধেও এক বীর কিশোরের অত্যন্ত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে গমনাগমনসহ একাগ্রচিত্ততা যোগে ১৯৩৬ খ্রিষ্ট সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি গাউসে যমান আল্লামা ফরহাদাবাদীর হস্ত মোবারকে ‘বাইআত’ লাভে ধন্য হন। উক্ত মাদ্রাসায় তিনি প্রায় ৮ বছর অধ্যয়ন করতঃ মাধ্যমিক সমমানের প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পন্ন করেন। সেই সাথে আপন মুরশিদ মওলার সান্নিধ্যে শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের গভীর জ্ঞানার্জনে সমৃদ্ধ হয়ে ১৯৪০ খ্রিষ্ট সালে ১৭ বছর বয়সে ত্বরীক্বতের ‘খিলাফত-খিরক্বাহ্’ লাভে ধন্য হন। অতঃপর মুরশিদ মাওলার নির্দেশে মাইজভাণ্ডার শরীফ গমন করতঃ যথারীতি হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র রওযা শরীফে তাহিয়্যাহ্ আরযান্তে যাবতীয় আবেদন-নিবেদন পেশ করলেন। সেখান থেকে বাবাভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র রওযা শরীফে গিয়ে তাহিয়্যাহ্-অভিবাদনান্তে ধ্যান মগ্নাবস্থায় বাবাভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র আধ্যাত্মিক দিগনির্দেশনা প্রাপ্ত হন আজমীর শরীফ যাবার জন্য। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখতে পান যে, বাবাভাণ্ডারী (রাদ্বি.) তাঁর হাতে ট্রেনের দু’টি টিকেট দিয়ে আজমীর যেতে বলছেন। এমতাবস্থায় আপন মুরশিদ মাওলার অনুমোদন-অনুমতি মর্মীয় নির্দেশনাও লাভ করলেন- ‘ঠিক আছে, যাও।’ অতএব আজমীর শরীফের উদ্দেশ্যে সে দিনই রওয়ানা দিবেন সংকল্পে তিনি বাড়ী থেকে বিদায় নিতে আসলে আম্মাজানের হাতে কোন টাকা-পয়সা ছিলনা বিধায় কয়েকদিন পর যেতে বলার প্রেক্ষিতে ‘টাকা না থাকলেও যেতে অসুবিধা হবেনা’ উত্তর দিয়ে তিনি রওয়ানা দিলেন। কারণ টাকা বিহীন এ যাত্রা দুর্গম হলেও কতইনা বন্ধুর হতে পারে সে জ্ঞান তাঁর ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে। মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রথম বাড়ী থেকে বের হয়ে অধ্যয়ন চালিয়ে যাওয়ার নিশ্চিত ব্যবস্থাও টাকা বিহীন হয়েছে। অতঃপর বিগত ৭ বছরের মধ্যে হাতে গুনা কয়েকবারই-তো মাত্র তিনি বাড়ী এসেছিলেন; তখনো-তো আম্মাজান কর্তৃক স্বেচ্ছায় দেয়া অল্প-স্বল্প টাকা ছাড়া কিছুই তিনি চেয়ে নেননি! আজ ১৭ বছরের যুবক অবস্থায় টাকার জন্য থেমে থাকার পাত্র তিনি নন, অতএব রওয়ানা হয়ে গেলেন।
বেলা ডুবার সময় আর বেশী বাকি নেই। আট মাইল প্রায় পথ পায়ে হেঁটে নাজিরহাট গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। নাজিরহাটের কাছাকাছি পৌঁছলে পথিমধ্যে অছি মিয়া ফকির নামে পরিচিত এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞাসিত হলেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? উত্তর দিলেন- ‘আজমীর শরীফ যাব।’ ফকির সাহেব বললেন- পূর্ব বাংলায় খাজায়ে আজমীরী (রাদ্বি.)’র নতুন বাড়ী তো রয়েছে, পুরাতন বাড়ীতে যাবে কেন? উত্তর দিলেন- ‘পুরাতন হলেও বাড়ী যখন আছে, কাজও থাকতে পারে; গিয়ে দেখি কি কাজ করতে হয়।’ এতে ফকির সাহেব পাশ কেটে গন্তব্যের পথ ধরলেন এবং তিনিও অগ্রসর হলেন। অতঃপর নাজিরহাট থেকে ট্রেন যোগে বটতলী এবং সেখান থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত বিনা টিকেটে পৌঁছতে কোন টিটিই টিকেট খোঁজ করেনি। বাবাভাণ্ডারী প্রদত্ত পাথেয় দুই টিকেট মর্ম এখানে শেষ, বাকী পথের জন্য মনিব-মাওলাই ভরসা! সেখান থেকে বোম্বাইগামী ট্রেন যোগে বোম্বাই পৌঁছলে ষ্টেশন থেকে বের হবার পথে টিকেট চেক করছিলেন এবং টিকেট বিহীনদেরকে আটক করছিলেন। টিকেট না থাকা সত্ত্বেও ভরসা না হারিয়ে অগ্রসর হওয়াতে দেখা গেল- ‘আমার টিকেটের জন্য টিটি কোনরূপ অপেক্ষা না করেই আমাকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন!’
‘বোম্বাই ষ্টেশনের বাইরে একটি গাছ তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন আমি ৫ দিনের উপোস, অথচ সাথে একটি কানাকড়িও নেই। এমতাবস্থায় একজন বৃদ্ধ লোক এসে আমাকে এক মুঠো ধাতব টাকা হাতে দিয়ে পকেটে রাখতে বললেন এবং প্রয়োজন মত খরচ করতে বলে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপর খাওয়া-দাওয়াসহ আজমীর পর্যন্ত যাতায়াত খরচ এবং সেখানে থাকা-খাওয়ার নিশ্চিত ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ঐ টাকা থেকেই ব্যয় করলাম। সেখানে খাজা গরীব নাওয়াযের মাযার শরীফ নিত্য যিয়ারতের পাশাপাশি ওসমানীয়া মাদ্রাসায় দরসে নেযামিয়্যাহ বিভাগে ভর্তি হয়ে লিল্লাহ বোডিং-এ উঠলে অবশিষ্ট টাকা পকেট থেকে বের করে গুনে দেখলাম, তখনো ১১/১২ আনা অবশিষ্ট ছিল। আরো উল্লেখ্য যে, এরপর থেকে আমার শিক্ষাজীবন শেষ না হওয়া পর্যন্ত একেবারে পকেট খালী অবস্থাও আর কখনো দেখা দেয়নি।’
তিনি পাঁচ বছরাধিক কাল আজমীর শরীফ অবস্থান করেছিলেন। সেখানে খাজা গরীব নাওয়াযের মাযার শরীফ নিত্য যিয়ারতের পাশাপাশি পূর্বোক্ত মাদ্রাসায় দরসে নেযামীয়্যাহ ভিত্তিক অধ্যয়নসহ বহু রিয়াযত, মোরাকাবা-মোশাহেদা ও নাফেলাহ ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখার সম্পূর্ণ বিবরণ বর্ণনাতীত।
তদ্মধ্যকার অংশ বিশেষ এরূপ- হোষ্টেলের ছাত্ররা ঘুমিয়ে পড়লে তিনি কখনো কখনো রাস্তায় প্রজ্জ্বলিত লাইটের আলোতে সারারাত কিতাব অধ্যয়ন করেও কাটিয়েছেন। কখনো গিরিগুহায় অবস্থান নিয়ে সারারাত এক বসায় ধ্যানমগ্ন থাকার এমন রিয়াযতও করেছেন যে, প্রচন্ড ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পা মোবারক সোজা করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়তো এবং অনেক্ষণ সময় লাগতো সোজা করতে। তিনি আরো বলেন- ‘শীত মৌসুমে আনা সাগরের পানিতে গোসল করতে গিয়ে ঠাণ্ডায় মানুষ মারাও যেতো, সেরূপ প্রচন্ড ঠাণ্ডা পানিতে রাত্রি কালে গোসলও আমি করেছি, কোন কোন নফল ইবাদতের উপকারিতা লাভের ক্ষেত্রে নতুন করে গোসল করা শর্ত থাকার কারণে! কিন্তু কিতাবের প্রতিটি হরফে হরফে খোদা দেখতে পাওয়া যায় এমন জ্ঞান চর্চার স্বাদই আলাদা!’
তিনি বলেন- এক পর্যায়ে খাজায়ে খাজেগাঁ সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নাওয়াযের রওযা মোবারকের এক কোনায় অবস্থান নিয়ে এক বসায় এক নাগারে ২৭/৩১ দিন পানাহার ও দুনিয়াবী হাজত বর্জন করে কাটানো অবস্থায় খাজা গরীব নাওয়াযের ইরশাদ প্রাপ্ত হই- “আমার সম্পূর্ণটাই তোমাকে দিয়ে ফেলেছি, আর বিন্দু-বিসর্গও আমার কাছে নেই; তুমি এখন চট্টগ্রামের ফরহাদাবাদ চলে যাও, সেখানেও আমার একটি মাযার আছে, যিয়ারত করতে পারবে।”
এতে করে ১৯৪৫ খ্রিষ্ট সালের শুরুতে দেশে ফিরে বাড়ীতে আসার আগেই সর্বপ্রথম ফরহাদাবাদ দরবার শরীফ গেলাম। সেখানে যখন বাবাজান ফরহাদাবাদীর মাযার শরীফ নিকটবর্তী হলাম, তখন দেখলাম খাজা গরীব নাওয়ায মাযার শরীফে শুয়ে আছেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছেন! ক্ষণিক পর বললেন- ‘আমি তোমার সাথে পরে কথা বলব, এখন কাছারী ঘরে যাও, বিশ্রাম নাও।” অতঃপর কাছারী ঘরে এসে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন রওযা শরীফ থেকে বাবাজান ফরহাদাবাদীর স্বকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসল- ‘আনা বি কুল্লে শাইয়িম্ মুহিত’ (অর্থাৎ: আমি সব কিছুই পরিবেষ্টনকারী)। এরপর দেখতে পেলাম তিনি আমার নিকটেই উদয় হলেন এবং বললেন- ‘খাজারা দর খাজায়ে খোদ মাহ্ব দাঁ; বুঝে নাও, বি কুল্লে শাইয়িম্ মুহিত খাজাকে (মুর্শিদ মাওলার প্রতি ইঙ্গিতকৃত) আপন সত্তার মধ্যে (সম্বোধিত সত্তার প্রতি ইঙ্গিতকৃত) গুপ্ত জানো।’ তারপর নির্দেশ করলেন- ‘বাড়ীতে গিয়ে যদি পার সময় করে আমার ভাই ভূজপুরীর সাথেও একটু দেখা করো।’ তিনি তাই করলেন। যখন হযরতুল আল্লামা শাহসূফী মাওলানা সৈয়্যদ আবদুস্ সালাম ভূজপুরী ক্বিবলার নিকট গিয়ে পৌঁছলেন, তখন তিনি কিতাবের ছোট্ট একটি থলে সাথে নিয়ে কোথায় যেন যাবার জন্য প্রস্তুত। পৌঁছামাত্র তাহিয়্যাহ-অভিবাদন বিনিময় শেষ হতেই উভয়ে একই গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। পথিমধ্যে যথারীতি আদব রক্ষায় কিতাবের থলেটি বহন করে নিতে চাইলে পারবে না কি প্রশ্নোত্তর শেষে তাঁকে দিলেন। কিতাবের ছোট্ট থলেটি প্রথমে খুব হালকাই মনে হলো, কিন্তু কিছুদূর যাবার পর এটি ভারী থেকে ভারীতর হতে লাগলো। এক পর্যায়ে এটি বহন করতে তাঁর সমস্ত শিরা উপশিরা ফুলেই উঠেছে; এমনতর ভারী হয়ে পড়লো। তখন তিনি সচেতন হয়ে দৃঢ়চিত্তে সংকল্প নিলেন যে, এটি যতই ভারী হোকনা কেন, কোথাও কালক্ষেপন না করে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেবেনই। এহেন সংকল্প নেওয়ার মুহূর্তকাল পর এটি আর ভারী বোধ হচ্ছেনা, ঠিক আগের মতো হালকাই মনে হচ্ছে এবং সেই সাথে গন্তব্যেও এসে পড়েছেন, এক মুরীদের বাড়ীতে। পৌঁছামাত্র তাঁকে এ বলে বিদায় দিলেন যে, ‘তোমার এখানে আর কাজ নেই, ফরহাদাবাদই চলে যাও।’ অত্যন্ত ঘর্মাক্ত অবস্থায় এভাবে বিদায় দিতে দেখে গৃহকর্তা মুরীদটি কিছু মুখে দিয়ে বিশ্রামের জন্য সুপারিশ করলে তিনি বললেন- ‘এ ছোট্ট ছেলেটির ভিতর মাওলা মাইজভাণ্ডারী কি সীমাহীন খেলাই যে খেলছেন।’
অতঃপর ফরহাদাবাদ দরবার শরীফ হয়ে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে উপস্থিত হলে সেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক (কতজন বলেছিলেন তা আমি বর্ণনাকারী আহাদীর এখন স্মরণ নেই) মানুষ দিতে হযরত ক্বিবলায়ে আলম গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়া আনহুল্লাহুল বারীর এক আধ্যাত্মিক আদেশ প্রাপ্ত হন।অতএব মানুষ খোঁজার ব্রত নিয়ে কিছুদিন ঘোরাফেরা করলেন। তারপর মাদ্রাসা শিক্ষায় সনদ লাভের প্রয়োজনে ইষ্ট বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ডের অধীনে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামস্থ রাউজানের গহিরা মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৫৫ সনে পটিয়াস্থ কালারপুল সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ফাযিল পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য যে, এ পর্যায়ে মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালীন সময়েও তিনি মানুষদেরকে মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বামুখী করার ব্রত অব্যাহত রাখেন। ফলে গহিরা মাদ্রাসায় অধ্যয়ন কালীন সাথী বন্ধুদের কয়েকজনকে আল্লামা ভূজপুরী (রাদ্বি.)’র নিকট নিয়ে গিয়ে বাইআত করিয়ে দিতে সক্ষম হন। তদ্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- চট্টগ্রামস্থ রাউজানের চিকদাইর নিবাসী শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুস্ সালাম কাজেমী (রহ.), ফটিকছড়ির ধর্মপুর নিবাসী মৌলভী আবদুল আজিজ, খিরাম নিবাসী মৌলভী আবুল হোসাইন (রহ.) ও মৌলভী সুলতান আহমদ (রহ.) প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যেকই আল্লামা ভূজপুরী’র নিকট মুরীদ হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে, শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুস্ সালাম কাজেমী (রহ.) হাটহাজারী কওমী মাদ্রাসায়ও কিছুদিন অধ্যয়ন করেছিলেন। তখনো পর্যন্ত তিনি আল্লামা ভূজপুরী (রাদ্বি.)’র সান্নিধ্যে যাতায়াত করতেন। অতঃপর ভারতের দেওবন্দ খারেজী মাদ্রাসায় গিয়ে ১৯৫৮ সনে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পর সাময়ীক কিছুদিন আক্বীদাহ্গত পরিবর্তন দেখা দিলে ১৯৬০ সনে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রহ.)’র সাথে ঘরোয়া পরিবেশে একাধারে তিন দিন, মত বিনিময় করতঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদায় পুনরায় ফিরে আসেন। কিন্তু মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বার বিরুদ্ধে তখনো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬১ সনে হাদীয়ে যমানের নিকট এ সংবাদ নিয়ে আসলেন মাওলানা আবুল মোহসিন শামসী সাহেব। হাদীয়ে যমান তাঁর সাথে প্রকাশ্য মুনাযিরার আহবান ছুড়ে দিতে বললেন। এতেকরে চিকদাইরস্থ ফইল্লাতলী হাটে (কাযেমী সাহেবের বাড়ীর অতি নিকটে) প্রকাশ্য মুনাযিরার দিন-তারিখ ধার্য হয়। উভয় পক্ষের মানিত আমীন সাব্যস্ত হন হাটহাজারীস্থ মির্জাপুর নিবাসী মুফতী রশীদ আহমদ (রহ.) সাহেব। মাইজভাণ্ডারীগণের পক্ষে প্রধান মুনাযির হিসেবে হাদীয়ে যমান আল্লামা কাযী সৈয়্যদ হারূনুর রশীদ (রাদ্বি.) যথা সময়ে উপস্থিত হলেন। উভয় পক্ষের মানিত আমীনও উপস্থিত হন। অপর পক্ষের কেউ তখনো উপস্থিত না হওয়ায় আল্লামা কাযেমী সাহেবকে ডেকে আনতে লোক পাঠানো হলে বাড়ীতে তাঁর খোঁজ মেলেনি মর্মে সংবাদ পাওয়া যায়।
মুনাযিরার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল বাদে আছর, কিন্তু মাগরিব পর্যন্ত অপেক্ষা করা সত্ত্বেও কাযেমী সাহেব উপস্থিত না হওয়াতে বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় মাইজভাণ্ডারীগণের বিজয় ঘোষিত হল। তখন উপস্থিত বিপুল জনতার জোরালো আবেদনের প্রেক্ষিতে হাদীয়ে যমান মাইক যোগে বাদে মাগরিব থেকে শুরু করে এক টানা ৫ ঘন্টা মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বা-দর্শনের উপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পুরজোশ্ তাক্বরীর পেশ করেন। তাক্বরীরের এক পর্যায়ে উজ্জীবিত মানুষের একটিদল আল্লামা কাযেমী সাহেবকে ধরে আনতে ছুটে গেলে তিনি হাদীয়ে যমানের বক্তব্য শুনেছেন এবং মেনে নিয়েছেন মর্মে লিখা পাঠিয়ে তাদেরকে আশ্বস্থ করেন।
এ তাক্বরীর শুনে সেদিন যারা অধিক উজ্জীবিত হয়েছিলেন তাদের একজন হলেন চিকদাইরস্থ মাওলানা আবুল মুহ্সেন শামসী সাহেব। ইতোপূর্বে হাদীয়ে যমানের সাথে তাঁর পরিচয় থাকলেও তেমন ঘনিষ্টতা ছিলনা। এবার ঘনিষ্ট হয়ে হাদীয়ে যমানের সাথে তিনি সময় সুযোগে সাক্ষাৎ করতঃ মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বা-দর্শন সম্পর্কিত বিবিধ বিষয়ে মত বিনিময়  করতে লাগলেন। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হলে এক পর্যায়ে তিনি মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বায় বাইআত গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে একজন উপযুক্ত পীরের সন্ধান জানতে চাইলেন। হাদীয়ে যমান তাঁকে ইস্তিখারাহ্ করে দেখতে বললেন। উপদেশ মতো ইস্তিখারাহ্ করলে তিনি উপযুক্ত পীর হিসেবে হাদীয়ে যমানকেই স্বপ্ন যোগে দেখতে পান। কিন্তু সমবয়সী একজনকে পীর হিসেবে গ্রহণ করতে মনে সায় দিচ্ছেনা বিধায় তিনি বারংবার ইস্তিখারাহ করলেন। প্রত্যেক বারই তিনি হাদীয়ে যমানকেই দেখতে পেলেন। এতেও তিনি দ্বিধাগ্রস্ততা কেটে উঠতে না পেরে জাগ্রত অবস্থায় যাচাই করে নিবেন মনস্থ করলেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি বললেন- হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারীকে আমি দেখিনি বিধায় দেখলেও চিনবনা, বাবাভাণ্ডারীকে ছোট বেলায় দেখেছি হিসেবে তাঁকে দেখলে আমি চিনতে পারব। অতএব আপনি বাবাভাণ্ডারীকে জাগ্রত অবস্থায় দেখাতে পারলে আপনার হাতে বাইআত নিতে আমার আর কোন দ্বিধা থাকবে না। 
এ শর্তে হাদীয়ে যমান চোখ মোবারক একটু বন্ধ করলেন আবার খোললেন এবং একটু গরম সুরে বললেন- ঠিক আছে, চল আমার সাথে মাইজভাণ্ডার শরীফ। অতএব উভয়ে একসাথে মাইজভাণ্ডার শরীফ গিয়ে উপস্থিত হলেন। প্রথমে হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র রওযা শরীফে তাহিয়্যাহ আরয পূর্বক আবেদন-নিবেদন পেশ করলেন। অতঃপর গিয়ে বাবাভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র রওযা শরীফে প্রবেশ কালে শামসী সাহেব আগুনের হল্কার মতো প্রচণ্ড গরম অনুভব করলেন। ভিতর দিকে যতো অগ্রসর হচ্ছেন গরমের তীব্রতা ততবেশী লাগছে। এক পর্যায়ে চোখে ঘোর দেখে পড়ে যাবার উপক্রম হলে হাদীয়ে যামানের হাত ধরে বসে পড়লেন। এমতাবস্থায় চোখের সামনে আরেক দৃশ্য ভেসে উঠল যে, তিনি বাবাভাণ্ডারীর হাত ধরে বসে আছেন এবং বাবাভাণ্ডারী বলতে লাগলেন- ‘তোমাকে কার হাতে বাইআত নিতে বলা হচ্ছে, তা আমার এ হাত ধরা অবস্থায় বাস্তবে দেখে নাও।’ তখন শামসী সাহেব বাস্তবে দেখতে পাচ্ছেন যে, তিনি হাদীয়ে যমানের হাত ধরেই বসে আছেন। অতঃপর হাদীয়ে যমান গাউসুল ওয়াক্ত শাহসূফী আল্লামা হারূনুর রশীদ (রাদ্বি.)’র দস্ত মোবারকে শামসী সাহেব বাইআত গ্রহণ করেন।
১৯৭৬-১৯৮১ ইং পর্যন্ত আমি (আহাদী) ও আমার বড় ভাই এক সাথে ছিপাতলী মাদ্রাসায় অধ্যয়ন কালীন সময়ের শেষার্ধে শামসী সাহেব উক্ত মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু আমাদের প্রতি কোন দিন শিক্ষক সূলভ ব্যবহার করেননি, বরং আপন পীরের সন্তান হিসেবে ঠিক আগে থেকে করে আসা সম্মানই দেখাতেন। এমনকি আমাদের শ্রেণীর নির্ধারিত শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে ক্লাস নিতে পাঠানো সত্ত্বেও পাঠদানে বিরত থাকতে দেখেছি। আমাদের বাবাজান ক্বিবলা হাদীয়ে যমানকে উক্ত মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হুজুরসহ তৎকালীন ছাত্র-শিক্ষক সকলেই চিনতেন বটে; বাহ্যিক শান-শওকতহীন সাদাসিধে বেশের একজন পীরে ত্বরীক্বত যে, শামসী সাহেবের মতো দক্ষ একজন ওস্তাযুল্ ওলামার পীর হন, তা জেনে অনেকেরই কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি অকপটে বলতেন- আমার পীরকে তোমরা সাধারণ বেশভূষার দেখলেও তিনি আধ্যাত্মিকভাবে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। একদিন উক্তরূপ জিজ্ঞাসার এক পর্যায়ে শামসী সাহেব বললেন- আমার পীর কে? তোমরা জাননা, আমার পীর বাবা ভাণ্ডারী! তাঁর হঠাৎ এমন উত্তরের মর্ম আমার বুঝে না আসায় বাড়ীতে আসলে বাবাজান ক্বিবলা হাদীয়ে যমান সমীপে জিজ্ঞেস করি- ‘আমরা জানি শামসী সাহেব আপনার মুরীদ হন এবং তিনিও ইতোপূর্বে সবাইকে তাহাই বলতেন, কিন্তু এখন বিপরীত কথা বলছেন যে, তাঁর পীর নাকি বাবাভাণ্ডারী?’ আমার এ জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে উপরোক্ত প্রকৃত ঘটনা জ্ঞাত হই। অতঃপর শামসী সাহেবের সাথেও এ বিষয়ে আমার আলাপ হয় যে, বাবাভাণ্ডারী মর্মীয় এ ঘটনা প্রকাশ করা তাঁর উপর বারণই ছিল।
-সাজ্জাদানশীন ও প্রতিনিধিবৃন্দ, হারুয়ালছড়ি দরবার শরীফ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *