আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
বংশ ও শায়খ পরম্পরায় খাতুনে জন্নাত ফাত্বিমাহ বতুল বিনতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লাম ও শাহানশাহে বিলায়ত মাওলায়ে কায়েনাত হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা’র শোণিত ও ভাবধারার ধারক, শরীয়ত-ত্বরীক্বত-হাক্বীক্বত-মা’ রফতের জ্ঞানভাণ্ডার, জাহের-বাত্বেন ইলমের মহাসাগর, সুন্নিয়তের কর্ণধার, সানী ইমামে আ’যম গাউসে যমান, আমীনে আমানতে সুবহান, শায়খুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন, হযরতুল হাজ্ব আল্লামাহ সৈয়্যদ আমীনুল হক্ব ফরহাদাবাদী রাদ্বিয়ানহুল্লাহুল হাদী পরিচয়-পরিচিতির অমুখাপেক্ষী রবি-তুল্য নিজেই নিজের যথেষ্ট পরিচয়। শরীয়ত ও ত্বরীকত জগতে বিশেষত মাইজভাণ্ডারী ত্বরীকার পরিমণ্ডলে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ অনিস্বীকার্য অবদান হেতু তিনি প্রাতঃস্মরণীয় সত্তা রূপেই প্রতিষ্ঠিত। তাঁর পরিচিতি তুলে ধরার জন্য নয়, বরং অপরিশোধ্য ঋণের দায় ও অশেষ অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা স্বীকারার্থেই এ নিবন্ধের অবতারণা।
চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার ফরহাদাবাদ গ্রামের সৈয়্যদ কাযী মাওলানা আব্দুল করীম (রহ.) ও হাটহাজারী থানার বুড়িশ্চর গ্রামের মীর পাড়া নিবাসী সৈয়্যদাহ নাসিমা খাতুন (রহ.)’র ঔরসে ও গর্ভে ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন প্রবন্ধের আলোচিত মহাপুরুষ। সুবিজ্ঞ আলিমে দ্বীন পিতার তত্ত্বাবধান ও স্থানীয় মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে চট্টগ্রাম মুহসিনীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তথায় অধ্যয়নকালে দিবসে শ্রেণীর পাঠ আর নিশীতে বুযুর্গানে দ্বীনের মাযার যিয়ারত, কুরআন তিলাওয়াত, নফল ইবাদত, তাহাজ্জুদ গুজারী, দু’আ-মুনাজাত ইত্যাদিই ছিল তাঁর নিত্যকর্ম। ফাযিল শ্রেণীতে পাঠ্যাবস্থায় শহর কুতুব শাহ আমনত (রা.)’র মাযার শরীফে মুরাক্বাবাহ অবস্থায় সাহিবে মাযারের দর্শন লাভ, মুখে পাকা বরই পুরে দেওয়া, তন্দ্রা ছুটতেই মাযারের পার্শ্বস্থ কুল গাছ হতে বেমৌসুমী বরই পড়া ও তা ভক্ষণ, স্বপ্নে শাহ আমানত (রা.) কর্তৃক শত-সহস্র কিতাবের পৃষ্ঠা ধারাবাহিক চোখের সামনে ওল্টানো ইত্যাদি ফুয়ূযাতে বাত্বেনী ধন্য ফরহাদাবাদীর জাহেরী জ্ঞানের বিস্তৃতি পৌনঃপুনিক বেড়ে চলল। ছাত্র জীবনেই তিনি আপন শিক্ষক মহোদয়গণ কর্তৃক ‘মুফতী আমীন’ খেতাবে বিভূষিত হন। কৃতিত্বের সাথে ফাযিল পাশ করে ওয়ায-নসিহত, ফত্ওয়া-ফরায়েয প্রদান ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেন।
জাহেরী জ্ঞানে অপ্রতিরুদ্ধ আলিম ফরহাদাবাদী (রাদ্বি.)’র দৃষ্টিতে মাইজভাণ্ডারী ত্বরীকার কতেক কর্মকাণ্ড বিশেষত সেমা‘ বা রাগ-ধর্ম-সঙ্গীত শ্রবণ শরীয়ত গর্হিত ঠেকলে তিনি ওয়ায মাহফিলে সেমা‘ এর বিপক্ষে বক্তব্য দিতে থাকেন। এমতাবস্থায় একদা রাতে হযরত গাউসুল আ’যম শাহানশাহে মাইজভাণ্ডার শায়খ সৈয়্যদ মাওলানা আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র স্বপ্ন-দর্শন লাভ করে খিদমতে উপস্থিত হয়ে শিষ্যত্ব বরণ পূর্বক শুভদৃষ্টি লাভে ধন্য হন। গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র সাহচর্যে জাহেরী ইলম তথা ফিকহ’র জ্ঞানে জ্ঞানী ফরহাদাবাদী বাত্বেনী ইলম তথা তাসাওউফ’র জ্ঞান সমন্বয়ে মুহাক্কিক বা তত্ত্বজ্ঞানী হয়ে খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব প্রাপ্তিতে খলীফাহ বা পীর-মুর্শিদের প্রতিনিধি সাব্যস্ত হন।
এখানে হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। “আমার আমিন মিঞাকে আমার ছয়টি কেতাব হইতে একটি দিয়াছি”। (সূত্র: বেলায়তে মোতলাকা, লিখক: খাদেমুল ফোকরা সৈয়্যদ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী, ৯ম সংস্করণ, ৪৬ পৃষ্ঠা।) অভিধানে ‘মিয়াঁ’ যে সকল অর্থে প্রযোজ্য তন্মধ্যে গুরুর মুখে শিষ্যকে সম্বোধন হেতু ‘ওয়ারিশ’ ও ‘সাহেবজাদা’ অর্থই এখানে যথার্থ। অতএব সুস্পষ্ট যে, আল্লামা ফরহাদাবাদী (রাদ্বি.) গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রাদ্বি.)’র জ্ঞানের উত্তরাধিকারী ও পরিবারের সদস্যভুক্ত। ‘আল্ উলমাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া’ বা ‘আলিমে হক্কানীগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী’ ও ‘সালমানুম্ মিন আহলি বায়তী’ বা ‘সালমান (পারস্যের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও) আমার পরিবারের সদস্য’ হাদীসদ্বয় ধ্যানই দ্বিধান্বিত মনের দ্বিধা-দ্বন্ধ নিরসনে যথেষ্ট। সকলই পরিজ্ঞাত যে, হাদীসে রাসূল (দ.)’র মর্মমতে নবীগণ (আ.)’র উত্তরাধিকার অর্থ-বিত্ত নয় বরং ইলম বা জ্ঞানই। আল্লামা ফরহাদাবাদী (রাদ্বি.)ও গাউসুল আ’যম (রাদ্বি.)’র উত্তরাধিকার স্বরূপ জ্ঞানই লাভ করেছেন; যা বাণীর দ্বিতীয়াংশ ‘ছয়টি কেতাব হতে একটি দিয়াছি’ মর্মে সুপ্রতিভাত। কেতাব যে, জ্ঞানের আকর, তা সর্বজন বিদিতই। এ ক্ষেত্রে খলিফায়ে গাউসুল আ’যম আল্লামা বজলুল করীম মন্দাকিনী (রা.)’র একটি গীতি দৃষ্টির ক্ষীণতা বিদূরণে সহায়ক বিবেচিত বলেই উদ্ধৃত হল।
‘মাওলানা আমিনুল হক ফরহাদাবাদ বাসী,
উজ্জ্বল করিলেন ধরা পাপের তিমির নাশি।
মন গুরুকল্পতরু, সর্বপূজ্য ধর্মগুরু,
জ্ঞানের গগনে যেন ভাসিয়াছে পূর্ণ শশি।
বিদ্যার সাগর বটে, জ্ঞানের তটিনী তটে,
জ্ঞানদানে রত হয়ে, সর্বদা রয়েছেন বসি।
জ্ঞান ভিক্ষা নিতে কত-নরনারী শতশত,
দীক্ষা সূত্রে বদ্ধ হয়ে, হয় তাঁর দাসদাসী।
মাইজভাণ্ডারীর দত্তধন করছেন সদা বিতরণ,
যত ছাড়ে তত বাড়ে অফুরন্ত ধনরাশি।
ধর্মগুরু কর্মনেতা সুহৃদয় দয়াল দাতা,
দর্শনে তাপিত প্রাণ, আনন্দেতে যায় ভাসি।
সমাজে আনিলেন শান্তি- নাশি লোকের ভুল ভ্রান্তি,
রচনা করিয়ে কত ধর্মগ্রন্থ রাশি।
সুপ্রসিদ্ধ কাজী বংশ, হয়ে ছিল প্রায় ধ্বংস,
পুনর্জীবন দিয়াছেন তিনি ইহলোকে আসি।
এ দীন করীম হীন, অনুগত অনুদিন,
স্মরণ রাখিও বাবা আমি তোমায় ভালবাসি।
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, আল্লামাহ ফরহাদাবাদী (রা.) জাহের-বাত্বেন জ্ঞানের সমাবেশে এক অনুপম মুহাক্কিক বা তত্ত্বজ্ঞানী তথা দার্শনিক সত্তা। সুতরাং তাসাওউফ বিবর্জিত ফিকহ চর্চাকারী ফাসিক আর ফিকহ বর্জিত তাসাওউফ চর্চাকারী যিন্দিক; উভয় শ্রেণীর নীমে মোল্লা আর মূর্খ ফক্বীররা-তো তাঁর বিরুদ্ধে ফিস্-ফিস্ করার চেষ্টা করবেই। হাদীসে পাকের ভাষ্যমতে এ অপচেষ্টা নস্যাৎ হতে বাধ্য। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমার উম্মতের একদল সদা-সর্বদা আল্লাহর হুকুমের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবেন; যারা তাঁদের অপদস্থ ও বিরোধীতা করবে, তারা তাঁদের কোন ক্ষতিই করতে পারবেনা’।
সুন্নীয়্যাত বলুন কিংবা ত্বরীক্বত, উভয় পরিমণ্ডলেই ইতিহাসের বক্র যাত্রায় আল্লামাহ্ ফরহাদাবাদী (রাদ্বি.)কে পাশ কেটে যাওয়ার প্রবণতা, সত্যের অপলাপে নগ্ন অপচেষ্টার রূপ পরিগ্রহ করেছে। অথচ ইমামে আহলে সুন্নাত, গাযীয়ে দ্বীনো মিল্লাত আল্লামাহ্ শেরে বাংলা (রা.)’র দিওয়ানে আযীযস্থ প্রশংসা গীতি আমলে নিলেই সুন্নীয়্যাতের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়-বরণীয় সত্তা রূপেই প্রতিভাত হয়। হায়রে অকৃতজ্ঞ জাতি! দৃষ্টি মেলে দেখো, শেরে বাংলা (রহ.) কি বলেছেন,
‘দর মদহে পে-শ্ওয়া-য়ে- ‘আ-লেমাঁ-, মুক্বাতাদা-য়ে ফাযেলাঁ-, ফখরে ‘আ-রেফাঁ-, সাইয়্যেদুল মুনা-যেরী-ন, রা’ঈ-সুল মুতাকাল্লিমী-ন, ‘আ-লেমে ক্বমক্বা-ম, ফা-দ্বেলে ত্বমত্বা-ম, ‘আ-লেমে ‘ইয়ালমা‘ঈ-, ফা-দ্বেলে লাওযা‘ঈ-, আলহিবরুল ক্বমক্বা-ম ওয়ান্ নাহরী-রুত্ব ত্বমত্বা-ম, মারজা‘উল মাশা-ইখিল আ’লা-ম, সানাদুল মুহাক্বক্বিক্বী-ন, তা-জুল মুদাক্বক্বিক্বী-ন, সা-হিবুত্ তাহরীর্- ওয়াত তাসনী-ফ, হুজ্জাতুল খালফ, বাক্বিয়্যাতুস্ সালাফ, শায়খুল ইসলা-ম, হযরাতুল হা-জ্জ, ‘আল্লা-মাহ্ শা-হ্ আমী-নুল হাক্ব ফরহা-দ্ আ-বা-দী-, চা-টগা-মী- হা-টহাযা-রভী- ‘আলায়হি রাহমাতু রাব্বিহিল বা-রী-।’
মারহাবা- সদ মারহাবা- সদ মারহাবা- সদ মারহাবা-
আয্ বরা-য়ে- ফা-যেলে ফরহা-দা-বা-দী- মারহাবা-
না-মে পা-কশ শা-হ্ আমী-নুল হক্ব বেদা-নী-বে-গুমাঁ-
চা-টগা-মী-রা- শরফ হা-সেল শুদাহ্ আয্ যা-তে আঁ-
সা-হেবে তাহরী-র্ ও তাসনী-ফা-ত্ আ-ঁ ফখরে যমাঁ-
‘আ-রেফে সা-হেবে কামা-ল্ ও পে-শওয়া-য়ে-সা-লেকাঁ-
নি’মতে ওযমা- বেলা-শক্ বূ-দ্ বাহরে সুন্নিয়াঁ-
যহরে ক্বা-তিল বূ-দ্ লে-কিন্ আয্ বরা-য়ে- ওয়াহবিয়াঁ-
বূ-দ্ হাম্ কিবরী-তে আহমর আয্ বরা-য়ে- সুন্নিয়াঁ-
মিসলে মূ-সা- ‘আহদে ফির‘আউন বূ-দ্ বাহরে ওয়াহবিয়াঁ-
মৌলভী ফয়যুল্লাহ্ রা- দিল শুদ চূঁ লা-লাহ দা-গদার্-
বর খেলাফশ্ চূঁ শাওয়া-হিদ পে-শ্ করদ আঁ-না-মদা-র
পে-শওয়া-য়ে- ফা-যেলাঁ- ও তা-জে ফখরে ‘আ-রেফাঁ-
মিসলে ঊ- হারগিয্ মুহাক্বক্বিক্ব মন নাঃ বীনম দর জাহাঁ-
‘আম্মে না-যেম ফা-যেলে মামদূ-হ বদা-নী- বে-গুমাঁ-
রুকনে আ’যম বূ-দ্ বে-শক আয্ বরা-য়ে- সুন্নিয়াঁ-
তরবতশ রা- বা-গে জন্নাত সা-য্ রব্বে জাহাঁ-
ইস্তাজিব ইয়া- রব ত্বোফায়লে সরওয়ারে পয়গাম্বরাঁ-
আন্দর আঁ- ফরহা-দা-বা-দাস্ত রওযায়ে পুরনূ-রে ঊ-
মরদুমাঁ- পুরফয়য বা-শন্দ দা-ইমান আয্ যা-তে ঊ-
ঈঁ- হামাহ গুলহা-যে বা-গে আহলে সুন্নাত বে-গুমাঁ-
জুমলাহ্ ‘আ-লম কর্দ শায়দা- বূ-য়ে- ঈঁ- গুলহা- বেদাঁ-
না-মে না-যেম গরতূ- খা-হী- শে-রে বাঙ্গা-লাহ বেদাঁ-
মুনকেরা-নে সুন্নিয়াঁ- রা সায়ফে বোররাঁ- বে-গুমাঁ-
অর্থাৎ ‘আলিমগণের পথপ্রদর্শক-ইমাম, জ্ঞান-প্রজ্ঞা-পুণ্য-ন্যায়-বী রত্বসহ সমূহ পরিপূর্ণতায় সর্বাত্মক মর্যাদাবানদের অনুসৃত, খোদা-পরিচয় লাভকারীদের গৌরব, মূলতত্ত্ব ও প্রকৃতি নির্ধারণে পারস্পরিক চিন্তা বিনিময়কারীদের সরদার, কালাম শাস্ত্রবিশারদ তথা বিবেকগ্রাহ্য প্রমাণাদি দ্বারা ধর্মীয় বিষয়াবলী প্রমাণকারীদের প্রধান, সুবিশাল জ্ঞানী, সুবৃহৎ মাহত্ম্যের অধিকারী, সুবিবেচক জ্ঞানী, সুবিজ্ঞ মহাজ্ঞানী, তরঙ্গমান তত্ত্বজ্ঞানী, সুবিচক্ষণ জ্ঞানসাগর, প্রখ্যাত মশায়িখে কিরামের প্রত্যাবর্তনস্থল, তত্ত্বজ্ঞানীদের সত্যায়নপত্র, সূক্ষ্মজ্ঞানীদের মুকুট, সৃজনশীলতা ও রচনার অধিরাজ, উত্তরসূরিদের দলীল, পূর্বসূরিদের অবশিষ্টজন, শায়খুল ইসলাম বা ইসলামের সর্বপ্রধান জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হযরতুল হাজ্জ আল্লামাহ্ শাহ আমীনুল হক্ব ফরহাদাবাদী চাটগামী হাটহাজারভী আলায়হি রহমতু রব্বিহিল বারী’র প্রশংসায়-
প্রশংসা শত স্তুতিবাদ শত মারহাবা শত প্রশংসাবাদ;
জ্ঞান-গুণে সর্বাত্মক মর্যাদাবান ফরহাদাবাদীর জন্য প্রশংসাবাদ।
তাঁর পবিত্র নাম নিঃসন্দেহে শাহ আমীনুল হক্ব জান;
ঐ সত্তার বরকতে চট্টগ্রামবাসীদের মর্যাদা লাভ হয়েছে।
ওই যুগগর্ব ছিলেন, সৃজনশীলতা ও রচনার অধিরাজ,
আধ্যাত্মিক পূর্ণতার অধিকারী আরিফ বিল্লাহ ও খোদাপথযাত্রীদের ইমাম।
নিঃসন্দেহে তিনি সুন্নীদের জন্য মহানুগ্রহ ছিলেন;
পরন্তু ওহাবীদের জন্য প্রাণ-বিধ্বংসী বিষ।
সুন্নীদের জন্য পরশমণিমূলও (যদ্ধারা স্বর্ণ উৎপাদক পরশপাথর তৈরি হয়) ছিলেন। ওহাবীদের জন্য ফিরাউন যুগের মূসা রূপই ছিলেন তিনি।
মৌলভী ফয়যুল্লাহর (ওহাবীদের গুরু) অন্তর কাল দাগযুক্ত লাল ফুলের ন্যায় দাগি হয়ে গিয়েছিল, তার খণ্ডনে যখন ওই সুখ্যাত ‘শাওয়াহিদুল ইবত্বিলাত’ পেশ করেছেন।
জ্ঞান-গুণে সর্বাত্মক মর্যাদাবান সত্তাদের পথ প্রদর্শক ও খোদা পরিচয় লাভকারীদের গর্বমুকুট; তাঁর মত তত্ত্বজ্ঞানী জগতে আমি কভু দেখিনি।
প্রশংসিত জ্ঞান-গুণে সর্বাত্মক মর্যাদাবান সত্তা নিঃসন্দেহে গীতিকারের জেটা জান; নিঃসন্দেহে তিনি সুন্নীদের জন্য মহান স্তম্ভ ছিলেন।
হে জগৎ পালক! তাঁর কবর শরীফকে জন্নাতের বাগিচায় পরিণত করুন; হে প্রভু! নবীকুল সম্রাট (দ.)’র উসিলায় (এ ফরিয়াদ) কবূল করুন।
তাঁর আলোময় রওযা শরীফ ওই ফরহাদাবাদে অবস্থিত; তাঁর সত্তা হতে মানুষরা সদা-সর্বদা ফয়যপূর্ণ হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে এ সব পুস্পসম্ভার আহলে সুন্নাতের বাগানের; এ পুস্পসম্ভারের সুগন্ধে সমগ্র জগৎ প্রেমবিভোর করেছে।
গীতিকারের নাম জানতে চাইলে শেরে বাংলা জান, নিঃসন্দেহে সুন্নীদের অস্বীকারকারীদের জন্য তরবারি’।
(দীওয়ানে আযীয, ১ম প্রকাশ, ৮২-৮৩ পৃষ্ঠা)
শেরে বাংলা (রহ.)’র উক্ত প্রশংসা গীতি ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপন জরুরি বিবেচিত হলেও কলেবরে বৃদ্ধির আশঙ্কায় বর্জিত হল; অন্য কোন নিবন্ধে ইনশা আল্লাহ আলোচিত হবে।
আল্লামাহ্ ফরহাদাবাদী (রাদ্বি.)’র রচিত ‘তুহফাতুল আখইয়ার’ ও ‘তাওজীহাতুল বহিয়্যাহ্’ গ্রন্থদ্বয় মাইজভাণ্ডারী ত্বরীকার অনুসারীদের প্রতি বিরোধীদের কুফর-শিরক-বিদ্‘আতের ফত্ওয়ার তীর-তরবারির আক্রমণ প্রতিহত করণের অব্যর্থ ঢাল। তাঁর ‘তুহ্ফাতুল আখইয়ার ফী দফ’ই শরারাতিল আশরার’ বা ‘বজ্জাতদের বজ্জাতি ব্যর্থে পুণ্যবানদের সওগাত’ নাম দৃষ্টেই দুষ্টের (মাইজভাণ্ডারী ত্বরীকা বিরোধীদের) দমনে শিষ্টের (ত্বরীকত পন্থীদের) পালনে তাঁর সাহসী ভূমিকার বিষয় সুপ্রতিভাত।
গ্রন্থটির রচনা-প্রেক্ষাপট একটু বিবেচনায় আনয়ন জরুরি।
গ্রন্থকার মহোদয় লিখেছেন, “নিশ্চয় এ মহৎ যুগে আল্লাহ তা‘আলা হিদায়ত দান ও সৎপথ প্রাপ্তির দ্বার উম্মোচন করেছেন। যথার্থ সত্যপন্থা অবলম্বীদের জন্য মাইজভাণ্ডার শরীফের উদয়াচল হতে মা’রফত বা খোদা পরিচয় রবি উদয় হয়েছে। সর্বস্থানে তাঁর কিরণের ছটা দীপ্তিময় হয়েছে বিধায় তদ্ধারা সমগ্র জগৎ আলোক উদ্ভাসিত হয়েছে। সুতরাং প্রশংসাবাদ! আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত পূর্ণ-আস্থাশীলদের জন্য, যারা ওই কিরণ-আহরণে প্রাণপণে সর্বাত্মক প্রচেষ্ঠায় পূর্ণশক্তিতে চেষ্টা করে। আফসোস! অপূর্ণ-আস্থার লোকদের জন্য, বাদুড়বৎ দৃষ্টিশক্তি যার আলোহীন হয়েছে বিধায় ওই ত্রুটি হেতু কিরণ আহরণের শক্তি রাখেনা। (অতঃপর গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র জাতে পাক দানে ধন্য করায় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা, গাউসে পাক (রা.)’র স্তুতি, তাঁর কৃপা-দৃষ্টিতে অন্তরে প্রেমাগ্নি দান, তাতে অজদ প্রকাশ পাওয়া ও সেমা‘আর প্রতি আসক্তি, সেমা‘আস্থ আল্লাহর রহস্য, তদসময়ে আহলে সেমা‘আদের অবস্থা, তা আল্লাহর নৈকট্যের উত্তম মাধ্যম হওয়া ও অজ্ঞ-মূর্খ গর্দভের ন্যায় লোকের তা অস্বীকার করার বর্ণনাত্তোর লিখেছেন,) অতঃপর যখন এ ত্বরীকা গ্রাম্য ও শহুরে লোকদের মাঝে প্রকাশ পেল, কতেক নির্বোধ সাগরের জলের ওপর জাহাজ দেখে ছোট্ট শিশুর (মর্ম না বুঝে) আশ্চর্য হওয়ার ন্যায় আশ্চর্য হল এবং এ ত্বরীকার অনুশীলনকারীদের চরম অপবাদ দিল। ওটাকে নিজের গর্ব মনে করল, অথচ তার অনিষ্ট যে, নিজের দিকেই প্রত্যাবর্তন করছে, তা ভাবলই না; যেহেতু এতে দ্বীনে ইসলামের পূর্ববর্তী সকল মান্য অনুসরণীয় পুণ্যবানদের ওপরও অপবাদারোপ হয়। নাঊযুবিল্লাহ।
——-সৈয়্যদুল মুরসালীন (দ.) যে বলেছেন, ‘আমার উম্মতের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির ন্যায়, শুরু ভাল না শেষ ভাল, বুঝা দুষ্কর’ সে বিষয়ক জ্ঞান না থাকায়, এ যুগে আউলিয়া-বুযুর্গ হবেনা ধারণা করে, চক্ষুসমূহের অন্ধত্ব হেতু তাতে তাদের কি ক্ষতি রয়েছে, তা চিন্তা না করে, চরম বিরোধীতা এবং মূলতত্ত্ব ও রহস্যের অনুধাবন ব্যতীত কঠোর গোঁড়ামিতে উগ্র হল। — মহাপরাক্রমশীল এক আল্লাহকে ভয় না করে, মালিক মুখতার নবী (দ.) যে বলেছেন, “হযরত আবূ যর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে কাফির কিংবা আল্লাহর শত্রু মর্মে সম্বোধন করবে, যদি (বাস্তবতা) ঐ রূপ না হয়, তবে তা তার (সম্বোধনকারীর) ওপরই প্রত্যাবর্তন করবে’ (বুখারী-মুসলিম) তা আমল না করে, যদ্ধারা কাফিরদের তিরষ্কার করা হয়, তা দ্বারা শত্রুতামূলক তাদের (কামিলদের) তিরষ্কার করল। —
কতেক বদবখ্ত আল্লাহর নূর তার মুখের ফুৎকারে নিভাতে সংকল্প করে এবং বিশ্বাস করলনা যে, অপছন্দকারীদের অনীহা সত্ত্বেও আল্লাহ তাঁর নূরকে পরিপূর্ণ করবেন। অজ্ঞ-মূর্খরা অসন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় যথার্থ পথে হিদায়ত করেন। অতএব ‘ওহে হিংসুকের দল! তোমাদের হিংসার অনলে তোমরা যদিও মর’ তবুও আল্লাহ তাঁর রাস্তায় প্রচেষ্টাকারীদের স্বীয় অনুগ্রহে পথ দেখাবেনই।
আমি যখন দেখলাম যে, এ ত্বরীকার অনুসারী পরিসংখ্যন-পরিগণনের চেয়ে অধিক হল এবং গ্রাম-গঞ্জ, শহর বন্দর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল আর অবস্থার প্রকৃত জ্ঞান শূন্যতা হেতু লোকেরা তাঁদের বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মেতেছে, সুতরাং দেশে অনিষ্ট ব্যাপকতা পেয়েছে আর মানুষ ঝগড়া-বিবাদে পতিত হয়েছে, তখন আমার সামর্থ্যরে স্বল্পতা সত্ত্বেও দানশীল আল্লাহর সাহায্য নির্ভরতায় এ বিষয়ে যা সঠিক তা বর্ণনা ও সার-বাকলের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপন করে একখানা পুস্তিকা রচনা করতে ইচ্ছা করলাম। প্রভু সুমহানের করুণায় রচনা যখন শেষ হল, ‘তুহফাতুল আখইয়ার ফী দফই শরারাতিল আশরার’ বা ‘বজ্জাতদের বজ্জাতি ব্যর্থে পুণ্যবানদের সওগাত’ নাম রাখলাম। অতঃপর তা আমাদের মুর্শিদ গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র সমীপে ‘হাদিয়াহ-তুহফা’ স্বরূপ পেশ করলাম এবং এ কিতাব হতে অংশ বিশেষ তাঁর সম্মুখে পাঠ করলাম। তিনি (রা.) যখন তা শুনলেন (আনন্দিত হয়ে) আমাকে মঙ্গল ও পুণ্যের দু‘আ করলেন, তজ্জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা’। (তোহফাতুল আখইয়ার, পঞ্চম প্রকাশ ১৩-২৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
তিনি (রাদ্বি.) ফত্ওয়ার ষ্টিম রোলারে পিষ্ট হওয়া থেকে মাইজভাণ্ডারীদের আত্মরক্ষার অব্যর্থ হাতিয়ার দিয়ে যেমন বলিষ্ট করেছেন, তেমনি অজ্ঞানতা বশত কুফরীর ফত্ওয়া দিয়ে নিজের পরিণতি মন্দকারীদের সতর্ক করে আত্মমঙ্গল ঘনিষ্ট হওয়ার অবকাশও অবারিত করেছেন। এতদদৃষ্টে তাঁকে ‘মুহসিনে আ’যম’ বা ‘মহান উপকারকারী’ বললেও অত্যুক্তি হবেনা। উপকারে লাটির গুঁতার দর্শন চর্চায় অমঙ্গল ছাড়া হিতকর কিছুই নেই। বস্তুত উপকারকারী ব্যক্তির অকৃতজ্ঞতা, আল্লাহরই অকৃতজ্ঞতার শামিল। ‘যে মানুষের কৃতজ্ঞতা করেনা, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাই করেনা’ (তিরমিযী শরীফ, ২য় খণ্ড, ১৭ পৃষ্ঠা, মুখ্তার এন্ড কোম্পানী নাশেরানে ইসলামী কুতুব, দেওবন্দ ইউপি-ইন্ডিয়া)। কৃতজ্ঞতায় প্রভু অনুগ্রহের প্রবৃদ্ধি আর অকৃতজ্ঞতায় গুরুদণ্ডের ঘোষণায় পাক কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে অবশ্য অবশ্য আমি তোমাদের আরো বাড়িয়ে দেব আর যদি অকৃতজ্ঞতা করো, তবে (জেনে রাখ) নিশ্চয় আমার শাস্তি অতি কঠোর’ (সূরা ইব্রাহীম ৭ নং আয়াত)। আমাদের ইহ্সান ফরামূশী বা অকৃতজ্ঞতায় ওই মুহসিনে আ’যম বা সুমহান উপকারীর কিছু যায়- আসেনা। পরন্তু নিজের হিতাহিত বিবেচনাতো প্রত্যেকের থাকা উচিৎ।
মতানৈক্য ও সমসাময়িকতা সত্ত্বেও ইমাম শেরে বাংলা (রহ.)’র পীর-মুর্শিদ আল্লামাহ্ সৈয়্যদ আব্দুল হামীদ বাগদাদী (রহ.) যা বলেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। “মাওলানা সৈয়্যদ আব্দুল হামীদ বাগদাদী ছাহেব ‘হরম শরীফ’ বা কাবা শরীফের বারান্দায় উপস্থিত আরববাসীদিগকে তাঁহার পরিচয় দিতে গিয়া তাঁহার ডান হাত ধরিয়া বলিয়াছিলেন, ‘এই সরু হাতগুলি হাড়ের নহে; হীরার বলা যাইতে পারে। তাঁহার লিখার মধ্যে হীরার ধার আছে। বাংলা মুলুকে এইরূপ লায়েক আলেম আমি দেখি নাই। যদিও কোন কোন মছায়ালাতে আমি তাঁহার সহিত একমত নহি” (বেলায়তে মোতলাকা, নবম সংস্করণ, ৪৬ পৃষ্ঠা)।
আলোচিত মহা মনীষী ৭৯ বছর বয়সে ২৭ যিলহজ্জ ১৩৬৩ হিজরী ২৭ অগ্রহায়ণ ১৩৫১ বাংলা ১৩ ডিসেম্বর ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দ যুহরের সময় প্রভুর মিলন আলিঙ্গনে পারলৌকিক জীবন বরণ করেন। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’। প্রতি বছর ২৭ অগ্রহায়ণ তাঁর রওযাহ শরীফ প্রাঙ্গণে মহাসমারোহে উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। আল্লাহ ওই যাতে পাকের উসিলায় দু’কূলের সাফল্য আমাদের নসীব করুন। আমীন ছুম্মা আমীন।