অন্তর বিজেতা সুলতানুল হিন্দ
🖋️মুক্তিধারা ডেস্ক
শত-সহস্র রাজা-বাদশাহ ভারতীয় উপমহাদেশকে খণ্ডিত কিংবা সামগ্রিকভাবে শাসন করেছেন। তাদের কেউ যুদ্ধজয়ী হয়ে মসনদে আরোহন করেছেন, কেউ উত্তরাধিকারে মসনদ লাভ করেছেন আর কেউ জনরায়ে আরোহিত হয়েছেন। পরন্তু তাদের মসনদ কালান্তরে বিলীন। তারা আজ ইতিহাসই মাত্র।
আমাদের আলোচ্য সুলতান যুদ্ধ-বিজেতা কোন সুলতান নন, বাপ-দাদার উত্তরাধিকার হিসেবেও তিনি মসনদ লাভ করেননি, জনরায়েও আরোহিত হননি। এ সুলতানের সালতানাত কাল-কালান্তরে অক্ষত, মসনদ যুগ-যুগান্তরে অলীন।
পাঠক বন্ধুরা! আমরা কার কথা বলছি, হয়তো আপনারা জেনেও গিয়েছেন, তবুও নামটা উল্লেখ করছি, যেহেতু এমন এক মহান সত্তার নাম-উল্লেখের সৌভাগ্য হাতছাড়া হোক, তা আমরা চাইনা। আমরা আত্বা-ই রাসূল, ফাতিমী ও আলাভ্ভী বাগিচার সৌম্য-সুরভিত ফুল, মূঈনুল মিল্লতি ওয়াল হক্বি ওয়াদ্দীন হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান সনজরী, আজমিরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহুর কথাই বলছি।
তিনি পিতৃকুলে হুসাইনী, মাতৃকুলে হাসানী উভয়কুলে সম্ভ্রান্ত সৈয়্যদ ছিলেন। তাঁর বাবার নাম হজরত সৈয়্যদ গিয়াসুদ্দীন এবং মায়ের নাম সৈয়্যদাহ বিবি উম্মুল ওয়ারা’ মাহে নূর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা।
তিনি (রা.) ৫৩৭ হিজরী মোতাবেক ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে সিজিস্তানের সনজরে জন্ম গ্রহণ করেন এবং খুরাসানেই তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়।
শোণিতের ধারাবাহিকতায় উচ্চ-বংশীয় খাজা (রাদ্বি.) মুত্তাকী-পরহিযগার মা-বাবার স্নেহ-মমতায় লালিত-পালিত-শিক্ষিত-দীক্ষিত হয়ে উঠেছেন। মাত্র নয় বছর বয়সে আল কুরআনুল করীম হিফয সমাপ্ত করেন। অতঃপর মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে স্বল্প সময়ে হাদীস-তাফসীর ও ফিক্হ শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
মাত্র পনের বছর বয়সে পিতার ইন্তিকাল অতঃপর মাতৃবিয়োগ সর্বোপরি তাতারীদের অত্যাচার-উৎপীড়নে অস্থিতিশীল মুসলিম বিশ্ব পরিস্থিতি কিশোর খাজার মনকে দুনিয়া ও আহলে দুনিয়ার সম্পর্ক বিরাগী এবং আহলে হক্ব ফক্বীর-দরবেশদের সাঙ্গ অনুরাগী করে তুলে।
অমনি সময় একদা উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত বাগানের পরিচর্যাকালে মজযূব অলিয়ুল্লাহ ইব্রাহীম কনদুযী (রাদ্বি.)’র আগমন, চার চোখের মিলন, খাজা কর্তৃক সসম্মানে আতিথেয়তা, সন্তুষ্ট দরবেশের পুটলি হতে বের করা রুটি অথবা খইলের টুকরো নিজে চিবিয়ে খাজার মুখে পুরে দেওয়ার ঘটনায় তরুণ খাজার জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।
উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত বাগান, যাঁতা ও সমুদয় সহায়-সম্বল বিক্রয় করে সম্পূর্ণ অর্থ ফক্বির-মিসকিনদের বিলিয়ে দিলেন। ঘর-বাড়ি ছেড়ে রিক্ত-হস্ত বেরিয়ে পড়লেন। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মরুপ্রান্তর পাড়ি দিয়ে সমরকন্দ ও বুখারার প্রসিদ্ধ শিক্ষানিকেতনসমূহকে ধর্মীয় জ্ঞানে আরো গভীর পাণ্ডিত্য অর্জনে মনোনিবেশ করেন। যাহেরী ইলম অর্জন সমাপনান্তে বিশ্ব-পরিদর্শন ও আহলুল্লাহদের সাক্ষাতে বাগদাদ, মক্কা ও মদীনাহ পরিভ্রমণ করেন। হজ্ব ও যিয়ারতে রওযাহ-ই আনওয়ার শেষে শায়খে কামিলের সন্ধানে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে নিশাপুরের হরনে হযরত খাজা উসমান হরূনী (রা.)’র আস্তানাহ শরীফে পৌঁছেন। শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সুদীর্ঘ বিশ বছর শায়খের খিদমতে স্বদেশে ও প্রবাসে অতিবাহিত করেন।
৫৮২ হিজরী মোতাবেক ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের পবিত্র ভূমিতে শায়খ (রাদ্বি.) খিলাফত, খান্দানে চিশতীয়ার ধারাবাহিকতায় হস্তান্তরিত মুস্তাফ্ভী তাবাররুকাত প্রদান পূর্বক বক্ষে লাগিয়ে মস্তক ও চক্ষু চুমিয়ে বলেন, ‘যাও, তোমাকে আল্লাহর সোপর্দ করলাম।’
শায়খ (রাদ্বি.) হতে বিদায় নিয়ে তিনি (রাদ্বি.) ফের ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ, বিভিন্ন মশায়িখ-ই কিরামের সাথে সাক্ষাৎ করে বায়তুল্লাহর যিয়ারত সেরে মদীনাহ শরীফে পৌঁছলেন।
আমরা ইতোপূর্বে বলেছি, আমাদের আলোচিত সুলতান যুদ্ধ জয় করে সালতানাত লাভ করেননি, বাপ-দাদার উত্তরাধিকারে মসনদ পাননি কিংবা জনরায়েও আরোহিত হননি। এ সুলতানের সালতানাত শাহানশাহে মদীনাহ (দ.) প্রদত্ত। সুলতানুল হিন্দ খাজা আজমীরি (রা.) যখন মদীনাহ শরীফে ইবাদত-বন্দেগী ও যিকর ফিকরে নিমগ্ন ছিলেন, তখন একদা দরবারে মুস্তফা (দ.) হতে সুসংবাদ পেলেন, ‘হে মুঈনুদ্দীন! তুমি আমার দ্বীনের সাহায্যকারী, আমি তোমাকে হিন্দুস্তানের বিলায়ত দান করেছি। সেখানে কুফর আর অন্ধকার বিস্তৃত হয়ে আছে, তোমার উপস্থিতিতে কুফরের আঁধার বিদূরীত এবং ইসলামের আলো উজ্জ্বলিত হবে।’
আদিষ্ট হয়ে খাজা (রা.) দরবারে মুস্তফায় নিজের মকবূলিয়াতের নিদর্শন পেয়ে যেমন আনন্দিত হলেন, তেমনি চিন্তিতও। আজমীর কোথায়? কোনদিকে? দূরত্ব কত? পথ কেমন? ইত্যাদি চিন্তা করতে করতে নিদ্রা এলে স্বপ্নে তাজেদারে কাওনাইন (দ.)’র দর্শনধন্য হন। নবী করীম (দ.) এক নযরেই পূর্ব থেকে পশ্চিম সমস্ত বিশ্ব দেখিয়ে দিলেন। পথের বালা-মুসিবত, আজমীরের পাহাড়-পর্বত ও কিল্লাসমূহ দৃষ্টির সামনে সম্পূর্ণ পষ্ট হয়ে গেল। রাসূলে আকরাম (দ.) একটি আনার প্রদান করে ইরশাদ করলেন, ‘আমি তোমাকে আল্লাহর সোপর্দ করেছি।’
জেগে ওঠে নবী করীম (দ.)’র নির্দেশ পালনার্থে চল্লিশ জন আওলীয়া সঙ্গে নিয়ে হিন্দুস্তানের পথে যাত্রা দিলেন। বিভিন্ন দেশ অতিক্রম করে, বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে ৫৮৭ হিজরী মোতাবেক ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে আজমীর পৌঁছেন। মদীনাহ শরীফ হতে আজমীরের পথে অগণন আওলীয়া-ই কিরামের সাক্ষাৎ ও মাযারাত যিয়ারতের মাধ্যমে ফুয়ূদ্বাত-বরাকাত যেমন লাভ করেন, তেমনি বহু খোদাপথযাত্রীকে পূর্ণতা দান পূর্বক যায়গায়-যায়গায় খলীফাহ নিযুক্ত করেন। খাজা (রা.)’র জগত-বিমুগ্ধকর সৌন্দর্য, পরশ-পাথরবৎ প্রভাবশীল কৃপাদৃষ্টি, চিত্তমুগ্ধকর চরিত্র, অমায়িক আচার-ব্যবহার, মনোরম ব্যক্তিত্ব, অলৌকিক ক্ষমতা দেখে লোকেরা দলে-দলে ইসলামে দীক্ষিত হতে শুরু করলে প্রাচীন প্রচলিত ধর্মের ভিত্তি নড়বড় হয়ে ওঠল। দিন-দিন খাজা (রা.)’র ভক্ত-অনুরক্ত যেমন বেড়ে চলল, তেমনি উগ্র হিন্দুদের বিদ্বেষও। খাজা (রা.)কে নির্গমনে পৃথ্বিরাজের সামরিক অভিযান, মোহন্তদের আক্রমন, খাজার ভক্তদের ওপর অত্যাচার, পানি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এবং যাদুকরদের যাদুবাজি মোকাবিলায় খাজা (রা.)’র ধৈর্য আর অলৌকিক ক্ষমতা তাঁকে মানুষের মনের মণিকোঠায় বসিয়েছে। সুলতানুল হিন্দ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রা.) অন্তর বিজেতা সুলতান। তাঁর সালতানাত রক্তের দাগমুক্ত। তাঁর মসনদ লক্ষ-কোটি মানুষের অন্তরে। কেনইবা এমন হবেনা! তিনি (রা.) তো ধৈর্য-সহ্য, ক্ষমা-উদারতা আর পৌরুষের মূর্তপ্রতীকই ছিলেন।
একদা এক ব্যক্তি আস্তিনে চোরা নিয়ে খাজা (রা.)কে হত্যার উদ্দেশ্যে আস্তানার দিকে যাত্রা দিলে তিনি (রা.) দিব্যদৃষ্টি দ্বারা তার উদ্দেশ্য জ্ঞাত হলেন। ওই ব্যক্তি এসে পৌঁছলে তিনি (রাদ্বি.) আপন উত্তম স্বভাব-চরিত্র অনুসারে সমাদরে কাছে বসিয়ে বললেন, ‘তুমি যে উদ্দেশ্যে এসেছ, তা পূর্ণ করো।’ এতদশ্রবণে ওই ব্যক্তি কাঁপতে লাগল, আবেদন মস্তক চরণে রেখে বলতে শুরু করল, ‘আমাকে লোভ দেখিয়ে আপনাকে হত্যার জন্য পাঠানো হয়েছে।’ অতঃপর আস্তিনস্ত ধারালো চোরা ভূমিতে ছূড়ে ফেলে বলে ওঠল, ‘আপনি আমাকে এ অপরাধের শাস্তি দিন, বরং আমার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিন।’ ধৈর্য-সহ্য, ক্ষমা-উদারতা ও পৌরুষের উত্তম প্রতীক খাজা (রা.) বললেন, ‘আমরা দরবেশদের রীতি হল, কেউ আমাদের সাথে মন্দ করলেও আমরা তার সাথে ভাল আচরণ করি। তুমি আমার সাথে মন্দ কিছু করোনি।’ এ কথা বলে খাজা (রা.) তার মঙ্গলের জন্য দু‘আ করলেন। হযরত খাজা (রা.)’র প্রভাবসম্পন্ন এ কর্মরীতি দেখে ওই ব্যক্তি তাঁর পরম ভক্তে পরিণত হল এবং পুরো জীবনের জন্য শিষ্যত্ব-দাসত্বে দাখিল হলেন। খাজা (রা.)’র সুনজরে পঁয়তাল্লিশ বার হজ্ব করার সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং হিজাযের পবিত্র ভূমিতেই তাঁর সমাধি হয়েছে।
প্রাণে মারার জন্য আসা ব্যক্তিকে যে মহান সত্তা নিঃশর্ত-নিঃস্বার্থ ক্ষমা করে দিতে পারেন, তিনি মানুষের হৃদমন্দিরে চিরপূজ্য-ভজ্য হয়েই তো থাকবেন।
৬ রজব ৬৩৩ হিজরী ১৬মার্চ ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দ সোমবার খাজা (রাদ্বি.) আপন প্রভুর প্রেমালিঙ্গণে মিলিত হন। বিসালের পর লোকেরা দেখলেন তার কপাল মুবারকে “হাযা হাবীবুল্লাহ মাতা ফী হুব্বিল্লা-হ’ অর্থাৎ ইনি আল্লাহর বন্ধু, আল্লাহর প্রেমেই মৃত্যুবরণ করেছেন” লিখা রয়েছে। আম্বিয়া-ই কিরাম আলাইহিমুসসালামে হাবীবুল্লাহ উপাধি হল, রাসূলে আকরম (দ.)’র আর আওলীয়া-ই ইজাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমে আত্বা-ই রাসূল গরীব নাওয়ায খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রা.)’র। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাহবূবীনদের সদকায় আমাদের কবুল করুন। আমিন।