ঈদে মিলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা সার্বজনীন ঈদ

মুহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দীন

সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামিনের জন্যে এবং সালাতুচ্ছালাম রাব্বুল আলামিনের মহান নেয়ামত প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (দ.) ও তাঁর আহলে বায়ত এবং সকল প্রিয়জনদের প্রতি। হিংসা-হানাহানির দাবানল যখন দাউদাউ করে জ্বলছিল, অত্যচার-অবিচারের নগ্ন খড়গ কৃপান যখন মানবতার গলে চলছিল, বিশ্ব ইতিহাসের এহেন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে আঁধারের বুক ছিড়ে শত-সহস্র সূর্যের আলো নিয়ে ৫৭০ খ্রীস্টাব্দের মহান ১২ই রবিউল আউয়াল এই ধরাধামে আবির্ভূত হন সিরাজুম্মুনীর বা আলোক উজ্জলকারী প্রদীপ দয়ার সাগর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম; যাঁর পবিত্র নূর হতে সৃজিত হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। তাই এ দিবসটি বিশ্ববাসীর আপন অস্তিত্বের স্মারক হিসেবে মহানন্দের দিন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ দিনই হচ্ছে সকল সৃষ্টির প্রাণের ও প্রেমের ঈদ, যা সকল ঈদের সেরা ঈদ বলে বিবেচ্য।
ঈদ মিলাদ ও নবী শব্দত্রয় আরবী। ঈদ যার অর্থ হচ্ছে আনন্দ বা খুশী। মিলাদ শব্দের অর্থ হল জন্মক্ষণ আর নবী মানে অদৃশ্যের সংবাদ দাতা, এখানে মহানবী (দ.)কে বুঝানো হয়েছে অতএব ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) অর্থ হল নবীর জন্ম বা আবির্ভাব দিবসের খুশী বা আনন্দ। অন্যান্য সকল ঈদের তুলনায় এ ঈদ তথা ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)ই হচ্ছে চির অনাবিল। এই দিবসটি আমাদের প্রত্যেকের মাঝে এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের অনুসৃত পথে চলার বার্তা নিয়ে আসে, যাঁর কল্যাণে পথভ্রষ্ট পেয়েছে সঠিক পথের দিশা, ভিখারী পেয়েছে অঢেল সম্পদ, অন্ধ পেয়েছে আলোর দিশা, পাপীরা পেয়েছে মুক্তিবার্তা, বিচ্ছিন্নরা পেয়েছে ঐক্যের সীশা ঢালা প্রাচীর আর সেই মহান ব্যক্তিই হলেন মুক্তির দিশারী, পাপীর কাণ্ডারী, বেছাহারার ছাহারা, বিশ্ব ত্রাণকর্তা, দয়ার নবী প্রিয় নবী রাসূলে আকরম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ দিবসটি সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে আজ অবধি পালন হয়ে আসছে। যা স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন পালন করেছেন। আল্লাহর সত্ত্বা ও গুণাবলী সমেত প্রকাশাকাংখা, নূরে মুহাম্মদ (দ.)’র সৃজন, নবীগণের থেকে অঙ্গীকার নেওয়া ও স্বয়ং স্বাক্ষী হওয়া ইত্যাদিতে এর প্রমাণ মিলে। সকল নবী মিলাদুন্নবী (দ.)’র মহান মাহফিলে অংশগ্রহণ করার প্রমাণ সূরা আল-ই ইমরানের ৮১ নং আয়াত মর্মে প্রতিভাত। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রা.) রচিত আলহাভী লিলফতওয়া গ্রন্থের ‘হুসনুল মকসেদ ফী ‘আমলিল্ মওলেদ’ অধ্যায়ের বিস্তারিত বর্ণনালোকে জানা যায় যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (দ.) আপন মিলাদ পালন করেছেন। এ দৃষ্টিকোণে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপন সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ত্বরানী, বায়হাকী, যাহবী, মকাদ্দসী ও আসকালানী হযরত আনাস (রা.)’র সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘নবী করীম (দ.) নবুয়তের ঘোষণার পর আপন আকীকা করেন’। এ হাদীসের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে ইমাম সুয়ূতী বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (দ.)’র আবির্ভাবের সপ্তম দিবসে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর আকীকা করেন। অথচ আকীকা বার বার করা হয়না। অতএব রাসূলুল্লাহ (দ.) কর্তৃক কৃত ওই কাজ আল্লাহ তাঁকে রহমতুল্লিল আলামীন রূপে নির্ধারণ ও তাঁর উম্মতকে সম্মানিত করার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে করেছেন মর্মে ধরে নিতে হবে, যেমনিভাবে নিজের ওপর নিজে দরূদ পড়তেন। সুতরাং আমাদের জন্য তাঁর আবির্ভাবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশে জনসমাবেশ, ভোজসভা ও তদ্রূপ অন্যান্য ইবাদত ও নির্দোষ আনন্দ প্রকাশ মুস্তাহাব। (হুসনুল মকসেদ ফী আমলিল মওলেদ ৬৫ পৃষ্ঠা) আবু লাহাবের মতো কট্টর কাফির, যার ধ্বংস ও নরকবাসী হওয়ার সাক্ষ্য আল কুরআনের সূরা লাহাব; নবীর আবির্ভাবের খুশীতে সুওয়াইবা নামক দাসী আযাদ হেতু নবী (দ.)’র মিলাদ দিবস প্রতি সোমবার তার তৃষ্ণা নিবারিত ও শাস্তি লঘু হওয়ার প্রমাণ বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনায় বিবৃত। একজন কট্টর কাফির যদি ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.)’র আনন্দের বদৌলতে এতটুকু নি‘মত লাভ করে, তবে আমরা উম্মত হয়ে কি বঞ্চিত রব? আসুন আল কুরআনে আমাদের জন্য কি সুসংবাদ রয়েছে তা একটু দেখি, ইরশাদ হচ্ছে, “বলুন আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতকে কেন্দ্র করে তারা যেন খুশী উদযাপন করে, এটা তারা যা সঞ্চয় করবে তম্মধ্যে সর্বোত্তম”। এ আয়াত মর্মে প্রমাণিত যে, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নি‘মত ও রহমত নবী করীম (দ.)’র আবির্ভাবে আনন্দ প্রকাশ সর্বপ্রকার সঞ্চয় তথা ইহলৌকিক জীবনের সুখ সমৃদ্ধির জন্য জমানো ধন-সম্পদ এবং পারলৌকিক জীবনের শান্তির জন্য জমাকৃত সমুদয় পুণ্যকাজ অপেক্ষা উত্তম।
মোটকথা, ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) পালনের গুরুত্ব এমনই অপরিসীম, যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। খরার পর বৃষ্টিতে যেমন ধরাপৃষ্ঠ সজীব হয়ে উঠে মীলাদুন্নবী (দ.) দিবসটির আগমনেও অনুরূপ বিশ্ব মুমিনের ঈমান বাগে বসন্তের আগমন ঘটে। তাই গাম্ভীর্যের সাথে এ দিবসটি উদযাপিত হয় প্রতিটি মুসলিম ঘরে, সমাজে ও রাষ্ট্রে। এ দিনটি সকলের অন্তরে দোলা দিয়ে যায় নবতর ঢংয়ে। কবি বলেন,
“ঈদে মীলাদুন্নবী আজ আমরা কেন দোলবনা, নূরেরি চিরবসন্ত সব বাগে আজ দোলেরে”।
মহাগ্রন্থ আল কুরাআনে ঘোষিত হচ্ছে, “ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন” অর্থাৎ ‘হে হাবীব (দ.)! আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি’। এ আয়াত মর্মে শুধু মাত্র জ্বীন ও ইনসান বুঝানো হয়নি বরং আল্লাহ ব্যতীত সকল কিছুই বুঝানো হয়েছে। কেননা তাঁর রিসালত সমগ্র সৃষ্টির জন্য উম্মুক্ত। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই মানব জাতিকে সৎপথ প্রদর্শন ও আল্লাহর বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার জন্যে যুগে যুগে নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। এ ধারাবাহিকতায় নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (দ.) এর আগে অসংখ্য নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন নবীই সারা বিশ্বের নবী বা সার্বজনীন নবী হিসেবে আসেন নি। তাঁরা সকলই ছিলেন নির্দিষ্ট গোত্রের জন্য প্রেরিত এবং নির্দিষ্ট গোত্রকেই স্ব স্ব ধর্মের প্রতি আহ্বান করেছেন। পক্ষান্তরে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) হলেন সমগ্র বিশ্বের জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট নবী। একমাত্র তিনিই সারা বিশ্বের জন্যে নবী হয়ে এসেছেন। এখানেই মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা (দ.)’র সার্বজনীনতা। আর মীলাদুন্নবী (দ.) আগমনের এই ঈদের দিনে কুলকায়েনাত খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কেননা ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামই হচ্ছে সকল ঈদের সেরা ঈদ। যে দিনের মহিমায় সমগ্র সৃষ্টির আনাচে-কানাচে রহমত বর্ষিত হয় এবং সারা জগত নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে নবপ্রাণ পায়। কবির ভাষায়, 
“আনাচে কানাচে উভয় জগতে ব্যাপিয়া রহমত হতে লাগিল,
মাহবূবে খোদার দুনিয়ায় যবে আসার সেই খুশি হতে লাগিল”।
এ খুশির দিনে আবির্ভূত সেই মহামানবের আদর্শ আঁকড়ে ধরে সাম্প্রতিক বিশ্ব পেতে পারে সঠিক পথের দিশা। কেননা আজিকার এ দিনে মানব সমাজ মনগড়া- মানবগড়া আদর্শে শান্তি-মুক্তি খুঁজতে গিয়ে চরম অশান্তিতে উপনীত হয়েছে; আর এ নাজুকতর অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল প্রিয় নবী (দ.)’র আদর্শ। ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্নাড’শ বলেন, “I believe if a man like Muhammad were to assume the dictatorship of this modern world, he could succeed in solving its problem in a way that would brig its much needed peace and happiness.” অর্থাৎ ‘আমি বিশ্বাস করি মুহাম্মদ (দ.) এর মতো কোন ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তবে এমন এক উপায়ে তিনি এর সমস্যা সমাধানে সফল হতেন; যা পৃথিবীতে নিয়ে আসতো বহু আকাঙ্ক্ষিত সুখ ও শান্তি’। তাই বলতে হয় প্রিয় নবী (দ.)’র আদর্শই মানব জাতিকে দিতে পারে শান্তি ও মুক্তি। রাব্বুল ‘আলামীনের মহাবাণী, “এবং নবী (দ.)’র মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ” মর্মে ওই আদর্শ অনুকরণের মাধ্যমেই সকল সমস্যার সমাধান আসবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত অম্লান পথে অটল থেকে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) উদযাপন করে সে আদর্শ অনুসরণ-অনুকরণ করার তৌফিক মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের দান করুন, আমিন।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *