ইক্বামতের শব্দাবলী ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

ইক্বামতের শব্দাবলী ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

🖋️ আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরূদ ও সালাম মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়া সাল্লাম ও তাঁর আল-আসহাব সকলের তরে, তাহিয়্যাহ-অভিবাদন আল্লাহর প্রিয়ভাজন আওলিয়াদের প্রতি  নিবেদিত।
আমাদের জানা মতে এ দেশের অধিকাংশ মুসলমান সুন্নী-হানাফী। এখানে আযান, ইক্বামত, নামায, রোযা ইত্যাদি হানাফী মাযহাবেরই রীতি-নীতি অনুসারে পালিত হয়। হানাফী মাযহাবের ফিক্হ-ফতওয়ার কিতাবাদিই মক্বতব-মাদ্রাসায় পঠন-পাঠন চলে। কোন ব্যক্তি যদি অন্য তিন মাযহাবের কোন একটির অনুসারী পরিচয়ে আপন মাযহাব মতে ধর্ম-কর্ম পালন করে, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। পরন্তু হানাফী মাযহাবের কোন রীতি-পদ্ধতির বিষয়ে আপত্তি উত্থাপিত হলে, এ সবকে কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী আখ্যায়িত করা হলে, একজন নিষ্ঠাবান হানাফী নীরব থাকতে পারেনা।
বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায় যে, অতিসম্প্রতি এক দিকভ্রান্ত মাইকের স্পীকারে বলে বেড়াচ্ছে, ‘ইক্বামতের শব্দ হাদীসে এগারটিই আছে, সতেরটি নয়; দুই পাতার মৌলভীদের ইক্বামতের জ্ঞানও নেই’। তার এ বক্তব্যে হযরত সৈয়্যদুনা ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র হাদীস সম্পর্কীয় জ্ঞানও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বস্তুতঃ ওই অভাগা যদি অন্য তিন মাযহাবের  কোন একটির অনুসারী হতো, তবে এ রূপ বাক্য আওড়াতে পারতনা। জানি না, সে অবশেষে আহলে হাদীস নামে হাদীস অস্বীকারকারী ফির্কায় নাম লিখাল কিনা। সুন্নী-হানাফীর ছদ্মাবরণে সাধারণ জনতাকে ধোঁকা দেওয়ার ওই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে এ ক্ষুদ্র নিবন্ধের অবতারণা।
প্রথমে ইমামগণের দৃষ্টিতে হযরত সৈয়্যদুনা ইমাম আ’যম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মর্যাদা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি; যাতে ওই নব্য লামাযহাবী তিন মাযহাবের কোন একটির অনুসারী দাবীতে আহলে হক্ব পরিচয়ে প্রতারণার সুযোগ না পায়। অতঃপর ইক্বামতের শব্দাবলী সতেরটি হওয়ার পক্ষে বিস্তারিত প্রমাণাদি হাদীসে রাসূল সল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়া সাল্লামা’র আলোকে উপস্থাপন করবো, যাতে তার দাবীর অসারতা প্রমাণের সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়া সাল্লামা’র ওপর মিথ্যারোপের বিষয়টিও উম্মোচিত হয়। 
ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে ইমামগণের অভিমত: 
এক. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদরীস আশ্ শাফি‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
‘প্রত্যেক মানুষ ফিক্হ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রে আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র পোষ্য তথা মুখাপেক্ষী’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া কেউ ফিক্হশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারেনি’। (আবুল কাসিম আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন ইহইয়া বিন হারিস আস্ সা’দী পরিচিত নাম: ইবনি আবীল আওয়াম, ইন্তিকাল: ৩৩৫ হিজরী রচিত ফদ্বায়িলু আবী হানিফাতা ওয়া আখবারুহু ওয়া মানাকিবুহু ৮৭ পৃষ্ঠা, আবুল মাওয়াহিব আবদুল ওহ্হাব বিন আহমদ বিন আলী বিন আহমদ আশশাফি’ঈ, আল মিসরী, আশ্ শা’রানী, ইন্তিকাল: ৯৭৩ হিজরী রচিত আলমিযানুল কুবরা, প্রথম খণ্ড ৭৫ ও ৭৭ পৃষ্ঠা)
দুই. ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে ইমাম মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
‘এমন ব্যক্তির বিষয়ে তোমরা কী বল যে, যিনি এ স্তম্ভের অর্ধেক পাথর আর অর্ধেক স্বর্ণ বা রুপা- এ বিষয়ে আমার সাথে বিতর্ক করলে তবে অবশ্যই প্রমাণ দ্বারা তা প্রতিষ্ঠা করবেনই’। (আল্ মিযানুল কুবরা ১ম খণ্ড, ৭৫ ও ৭৭ পৃষ্ঠা) 
উক্ত দুই ইমাম যখন ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে এরূপ উন্নত মন্তব্য করেছেন, সুতরাং অনুসারীদের জন্য তাঁদের অনুসরণে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনই আবশ্যক। ইমাম শাফি‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র উক্তি মতে পুরো দুনিয়া ফিক্হ শাস্ত্র বুঝার জন্য যার মুখাপেক্ষেী, ইমাম মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মন্তব্য মর্মে যার বক্তব্য আপাত দৃষ্টিতে উল্টো মনে হলেও জোরালো দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত; সে মহান ইমাম যদি ইক্বামতের শব্দাবলী সতেরটি বলেন, আর তা হাদীসে থাকবেনা কিংবা হাদীসের বিপরীত হবে, এমন কি হতে পারে? ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই বলবেন, না এমন হতেই পারেনা; বরং এরূপ প্রলাপের প্রবক্তাই হাদীসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামা সম্পর্কে পূর্ণ মূর্খ। মোটা অংকের টাকার লোভে লামাযহাবী না বনলে কিংবা প্রসিদ্ধির মোহে প্রলাপ বকার প্রবণতা পেয়ে না বসলে ইক্বামতের শব্দাবলী সতেরটি হাদীসে খুঁজে পেতে কিংবা ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ওপর আস্থা রেখে হাদীসে আছে বিশ্বাস করতে মোটেও বেগ পেতে হতোনা। হাদীস শরীফে কী আছে, কী নেই, মন্তব্যের মাধ্যমে বড় মুহাদ্দিস রূপে আত্মজাহিরের অপপ্রয়াস; তা-ও আবার ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র অভিমতকে আক্রান্ত করে, চরম অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। এতে প্রসিদ্ধি অর্জিত হবে বটে, তবে বড় মুহাদ্দিস রূপে নয়, মস্ত মূর্খ হিসেবেই। সেকি ছার? ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র তুলনায় ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রাহমতুল্লাহি আলায়হিও ছাত্র তুল্য।
আল্লামা শা’রানী রাহমতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘নিশ্চয় ফখরুদ্দীন রাযী ইমাম আবু হানিফার তুলনায় ছাত্র সদৃশ অথবা মহান সম্রাটের সাথে সাধারণ প্রজাবৎ অথবা সূর্যের সামনে একটি তারকা রূপ। যেমনিভাবে ওলামাগণ সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল প্রমাণ ছাড়া মহারাজের ওপর অপবাদ- দোষারোপ প্রজার জন্য হারাম সাব্যস্ত করেছেন, তেমনি একজন অনুসারীর জন্য ব্যাখ্যার অবকাশমুক্ত সুস্পষ্ট দলীল ছাড়া আইম্মায়ে দ্বীনের ওপর আপত্তি উত্থাপন ও অপবাদারোপ হারাম’। (আল মিযানুল কুবরা, ১ম খণ্ড ৭৮ পৃষ্ঠা।)
ইক্বামতের শব্দাবলী: এবার ইক্বামতের শব্দাবলী প্রসঙ্গে আসা যাক। এ বিষয়ে ইমামদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। 
এক.ইক্বামতের শব্দাবলী প্রসঙ্গে ইমাম শাফি‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র তিনটি মত রয়েছে। যথা- আটটি (অপ্রচলিত), দশটি (প্রাচীন) ও এগারটি (প্রসিদ্ধ); শেষোক্তটিই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং তাঁর অনুসারীদের মাঝে বর্তমান প্রচলিত। 
দুই. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র দু’টি অভিমত পাওয়া যায়। যথা- সতেরটি (অপ্রসিদ্ধ বর্ণনায়), এগারটি; শেষোক্ত উক্তিই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং তাঁর অনুসারী জগতে প্রচলিত।
তিন. ইমাম মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মতে ইক্বামতের শব্দাবলী দশটি। 
চার.ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, ইমাম ইবনুল মুবারক, ইমাম সুফিয়ান সওরী ও ইমাম ইব্রাহীম নখ‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’র মতে ইক্বামতের শব্দাবলী সতেরটি।
মোটকথা বর্তমান বিশ্বে চার মাযহাবের অনুসারীরা দশ, এগার ও সতের শব্দে ইক্বামত বলেন। নিম্নে ওই শব্দাবলী বিবৃত হল। 
ক. ১. আল্লাহু আকবর, ২. আল্লাহু আকবর, ৩. আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, ৪. আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, ৫. হাইয়া আলাস্ সালাহ, ৬. হাইয়া আলাল ফালাহ, ৭. ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাত, ৮. আল্লাহু আকবর, ৯. আল্লাহু আকবর, ১০. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। (মালেকী মাযহাব অনুসারে প্রচলিত ইক্বামতের শব্দাবলী)
খ. ১. আল্লাহু আকবর, ২. আল্লাহু আকবর, ৩. আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, ৪. আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, ৫. হাইয়া আলাস্ সালাহ, ৬. হাইয়া আলাল ফালাহ, ৭. ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাত, ৮. ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাত, ৯. আল্লাহু আকবর, ১০. আল্লাহু আকবর, ১১. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। (শাফি‘ঈ ও হাম্বলী মাযহাব অনুসারে প্রচলিত ইক্বামতের শব্দাবলী)
গ. ১. আল্লাহু আকবর, ২. আল্লাহু আকবর, ৩. আল্লাহু আকবর, ৪. আল্লাহু আকবর, ৫. আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, ৬. আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, ৭. আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, ৮. আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, ৯. হাইয়া আলাস্ সালাহ, ১০. হাইয়া আলাস্ সালাহ, ১১. হাইয়া আলাল ফালাহ, ১২. হাইয়া আলাল ফালাহ, ১৩. ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাত, ১৪. ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাত, ১৫. আল্লাহু আকবর, ১৬. আল্লাহু আকবর, ১৭. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। (হানাফী মাযহাব মতে প্রচলিত ইক্বামত)
ইমাম মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র অভিমতের পক্ষে দলীল:
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘অতএব বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দেওয়া হল যে, আযানকে জোড় (দুই দুইবার) এবং ইক্বামতকে বিজোড় (একবার) করতে’। (বুখারী শরীফ ১ম খণ্ড, তৃতীয় পারা, কিতাবুল আযান, বাবু বদয়িল আযানি, বাবুল আযানি মাছনা মাছনা – ৮৫ পৃষ্ঠা; সুনানুন্ নাসাঈ, ১ম খণ্ড, কিতাবুল আযানি, বাবু তাছনিয়াতিল আযানি ৭৩ পৃষ্ঠা; তিরমিযী শরীফ, ১ম খণ্ড, বাবু মা জাআ ফী ইফরাদিল ইক্বামাতি, ৪৮ পৃষ্ঠা; মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, কিতাবুস সালাতি, বাবুল আমরি বিশাফ্‘ইল আযানি ওয়া ইতারিল ইক্বামাতি ইল্লা কালিমাতান ফাইন্নাহা মুছান্নাতান ১৬৪ পৃষ্ঠা, ৭৪৩ ও ৭৪৫ নং হাদীস; মিশকাতুল মাসাবীহ ৬৩ পৃষ্ঠা)
ইমাম শাফি‘ঈ ও ইমাম  আহমদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মতের পক্ষে দলীল:
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আদিষ্ট হলেন যে, আযানকে জোড় (দুই দুইবার) এবং ইক্বামতকে ‘ক্বাদকামাতিস সালাত’ ব্যতীত বিজোড় (একবার) করতে’। (বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ৮৫ পৃষ্ঠা; মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, ১৬৫ পৃষ্ঠা, ৭৪২ নং হাদীস; মিশকাতুল মাসাবীহ ৬৩ পৃষ্ঠা)
ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র অভিমতের পক্ষে দলীল: 
হযরত ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র অভিমত যেহেতু জনৈক আহম্মক কর্তৃক আক্রান্ত, সেহেতু এ প্রসঙ্গে ব্যাপক প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়াস পেলাম।
এক. ‘হযরত আবু মাহযূরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা তাকে আযান শিখিয়েছেন উনিশ শব্দ এবং ইক্বামত সতের শব্দ’। (মিশকাতুল মাসাবীহ ৬৩ পৃষ্ঠা; ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ বিন ঈসা তিরমিযী, ইন্তিকাল ২৭৯ হিজরী সংকলিত জামিউত্ তিরমিযী ১ম খণ্ড ৪৮ পৃষ্ঠা; ইমাম আবু দাউদ সুলায়মান বিন আশ্‘আছ সিজিস্তানী, ইন্তিকাল ২৭৫ হিজরী, সুনানে আবু দাউদ ১ম খণ্ড ৭৩ পৃষ্ঠা; সুনানে নসাঈ ১ম খণ্ড ৭৩ পৃষ্ঠা; মসনদে আহমদ; সুনানে দারমী; সুনানে ইবনে মাজাহ) 
উল্লে­খ্য যে, ইক্বামতের শব্দাবলী তখনই সতেরটি হবে, যখন ইক্বামতও আযানের ন্যায় দুই দুইবার বলা হবে।
দুই.আবু মাহযূরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,  ‘আমাকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা ইক্বামত শিক্ষা দিয়েছেন সতের শব্দ’। (শরহি মা‘আনীয়িল আসারি, ১ম খণ্ড, কিতাবুস সালাতি, বাবুল ইক্বামাতি কায়ফা হিয়া)
তিন. ‘হযরত আবদুল্লাহ বিন যায়িদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র যুগে আযান-ইক্বামত (উভয়ের শব্দাবলী) জোড় জোড় (দুই দুইবার) পড়া হত’। (তিরমিযী শরীফ ১ম খণ্ড ৪৮ পৃষ্ঠা) 
চার.  ‘হযরত আবদুর রহমান বিন আবু লায়লা বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র সাহাবীগণ সংবাদ দেন যে, নিশ্চয় আবদুল্লাহ বিন যায়িদ স্বপ্নে (ফিরিশতাকে) আযান দিতে দেখে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র দরবারে এসে সংবাদ দিলে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা বলেন, তুমি বিলালকে তা শিখিয়ে দাও। অতএব দুই দুই শব্দে তিনি (বিলাল) আযান ও ইক্বামত দেন এবং উভয়ের মধ্যখানে স্বল্পক্ষণ বসেন’। (ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী, ইন্তিকাল ৩২১ হিজরী, শরহি মা‘আনীয়িল আসার ১ম খণ্ড, কিতাবুস সালাত, বাবুল ইক্বামাতি কায়ফা হিয়া, ৯৪ পৃষ্ঠা)
পাঁচ.ইমাম আবু দাউদ স্বীয় সনদে ইবনে আবু লায়লা হতে বর্ণনা করেন যে, যখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা নামাযের জন্য মুসলমানদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত করার পদ্ধতি সম্পর্কে উদ্যোগ করছেন, তখন একজন আনসারী সাহাবী তাঁর খেদমতে এসে আরয করলেন,  
‘ইয়া রাসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা! যখন আমি আপনাকে নামাযের  নির্দিষ্ট সময়ে মানুষদের একত্রিত করার পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহী  দেখে ঘরে ফিরলাম, তখন সবুজ দু’টি কাপড় পড়া এক ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখলাম। ওই ব্যক্তি মসজিদে দাঁড়িয়ে আযান দিল অতঃপর কিছুক্ষণ বসল। তারপর আবার দাঁড়িয়ে আযানের মত বলল এবং শেষ দিকে ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাতও বলল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা বললেন, আল্লাহ তোমাকে ভাল স্বপ্ন দেখিয়েছেন। যাও বিলালকে তা বলে আযান দিতে বল’। (সুনানে আবু দাউদ ১ম খণ্ড, ৭৪ পৃষ্ঠা; সুনানে কুবরা ১ম খণ্ড ৩৯১ পৃষ্ঠা।) 
ছয়. তাহাবী, মুসান্নফি ইবনি আবী শায়বা ও অন্যান্যদের বিভিন্ন বর্ণনা মতে সাব্যস্ত যে, হযরত আবদুল্লাহ বিন যায়িদকে স্বপ্নে আযানের সাথে ইক্বামতও শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং তা আযানের ন্যায় দুই দুই শব্দে ছিল। এ ধারাবাহিকতায় সর্বাধিক  স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ বর্ণনা মুসান্নফি ইবনি আবী শায়বা-এ বর্ণিত, 
‘আবদুর রহমান বিন আবু লায়লা বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র সাহাবীগণ সংবাদ দিয়েছেন যে, নিশ্চয় আবদুল্লাহ বিন যায়িদ আল আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবী সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামার নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা! আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, এক ব্যক্তি যেন বাগানের পিঠে দাঁড়াল এবং তার গায়ে সবুজ দু’টি চাদর রয়েছে। অতঃপর সে দুই দুই শব্দে আযান ও ইক্বামত দিল এবং উভয়ের মধ্যখানে কিছুক্ষণ বসল। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওটা (স্বপ্নবৃত্তান্ত) শুনে দাঁড়িয়ে দুই দুই শব্দে আযান ও ইক্বামত দিলেন এবং উভয়ের মধ্যখানে অল্পক্ষণ বসলেন’। (মুসান্নফি ইবনি আবী শায়বা ১ম খণ্ড, ১৩৬ পৃষ্ঠা)
সাত. হাফিয ইবনি আবী শায়বা আপন সনদে বর্ণনা করেন, 
হযরত আবদুল্লাহ বিন যায়িদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র সম্মুখে আযান দিতেন এবং আযান ও ইক্বামত উভয়ের শব্দাবলী (শাহাদতায়ন হাইয়ালাতায়ন) দুই দুইবার বলতেন’। (হাফিয আবু আব্দিল্লাহ ইবনি আবী শায়বা ইন্তিকাল ২৩৫ হিজরী, মুসান্নফি ইবনি আবী শায়বা, ১ম খণ্ড ১৩৮ পৃষ্ঠা)
আট.তিনি আরো বর্ণনা করেন,  ‘হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আযান ও ইক্বামতে শব্দাবলী দুই দুইবার বলতেন’। (প্রাগোক্ত) 
নয়.হযরত সুুওয়াইদ বিন গাফলাহ বলেন,  ‘আমি বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে আযান ও ইক্বামতে শব্দাবলী দুই দুইবার বলতে শুনেছি’। (শরহি মা‘আনীয়িল আসার ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃষ্ঠা)
দশ.সুনান-এ দার-এ কুত্বনীতে হযরত জুহায়ফা  রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, ‘নিশ্চয় বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র সম্মুখে আযানের শব্দাবলী দুই দুইবার বলতেন এবং ইক্বামতও দুই দুইবার বলতেন’। (সুনান-এ দার-এ কুত্বনী ১ম খণ্ড, ২৪২ পৃষ্ঠা)
এগার.মুসান্নফি আব্দির রযযাক-এ স্বয়ং বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বর্ণনা রয়েছে, ‘হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, তাঁর আযান ও ইক্বামত দুই দুই শব্দের ছিল’। (মুসান্নফি আব্দির রযযাক ২য় খণ্ড, ৪৬৩ পৃষ্ঠা; এ রূপ অর্থবোধক বর্ণনা শরহি মা‘আনীয়িল আসার ১ম খণ্ড ৯৪ পৃষ্ঠায়ও রয়েছে।) 
বার. ইমাম আবু দাউদ ও ইমাম ইবনে মাজাহ আপন আপন সনদে বর্ণনা করেন, হযরত আবু মাহযূরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা তাঁকে আযান ও ইক্বামত শিখিয়েছেন। 
‘ইক্বামতের সতের শব্দাবলী এ যে, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, হাইয়া আলাস্ সালাহ,  হাইয়া আলাস্ সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাত, ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাত, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ( ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইয়াযিদ ইবনি মাজাহ, ইন্তিকাল ২৭৩ হিজরী, সুনানে ইবনে মাজাহ ৫২ পৃষ্ঠা; সুনানে আবী দাউদ ১ম খণ্ড, ৭৩ পৃষ্ঠা।)
উক্ত বর্ণনাসমূহকে একত্রিত করলে দেখা যায় যে, আহনাফের আমল প্রতিটি হাদীসের মর্মানুসারে বিশুদ্ধ ও যথার্থ। ইতার বা বিজোড় তথা  এক এক শব্দে ইক্বামতের বিষয়টি তারা উভয় শব্দকে একশ্বাসে আদায় করা অর্থে দ্রুত উচ্চারণের মাধ্যমে আদায় করেন; যা অন্য বর্ণনায়, ‘এবং যখন ইক্বামত দিবে তখন দ্রুত কর’ দ্বারা ব্যাখ্যায়িত। ‘ক্বাদ ক্বামাতিস সালাত ব্যতীত’ অর্থাৎ তা দুইবার বলতে হবে; এটিও দম নিয়ে বলার মাধ্যমে হানাফীগণ আমল করেন। আর জোড় জোড়, দুই দুইবার বলার এবং সতের শব্দাবলীর বর্ণনাতো তাদের আমলগতই। অতএব ইক্বামতের ক্ষেত্রে আহনাফের অভিমত অগ্রাধিকারযোগ্য।
উপর্যুক্ত বর্ণনালোকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে, ইক্বামতের শব্দাবলী এক একবার বলার বিষয়টি ছিল কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে বিশেষ কারণে; অন্যথায় সার্বক্ষণিক সুন্নাত ছিল জোড় জোড় বা দুই দুইবার বলা, যাতে ইক্বামতের শব্দাবলী সতেরটিই হয়। অবশ্যই এক একবার বলা তথা দশ বা এগার শব্দাবলী বললেও জায়েজ হবে। এক একবার বলার রীতি সার্বক্ষণিকতায় রূপ নেয় উমাইয়া শাসন আমলে।
আল্লামা কাসানী লিখেছেন, ‘ইব্রাহীম নখ’ঈ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মত সত্যবাক ব্যক্তি ইক্বামতকে এক একবার বলার রীতিকে বিদ্‘আত ইঙ্গিত করে বলেন, মুসলমানরা সর্বদা ইক্বামতের শব্দাবলী দুই দুইবার বলে আসছে, যাবত না বনু উমাইয়া বের হল এবং ইক্বামতকে এক একবার বলার নূতন রীতি চালু করল’। (আল্লামা আবু বকর বিন মাসইদ কাসানী হানাফী, ইন্তিকাল: ৫৮৭ হিজরী, বদায়িউস্ সানায়ি‘আ ১ম খণ্ড ১৪৮ পৃষ্ঠা।)
অতএব প্রমাণিত হলো যে, ইক্বামতের শব্দাবলী সতেরটি হাদীসে না থাকার দাবী হাদীস শাস্ত্রে প্রবক্তার জ্ঞানের দৈন্যতারই পরিচায়ক। এমন গণ্ডমুর্খের বক্তব্য বিবৃতি না শুনার আহবান রইল সর্বস্তরের মুসলিম জনতার প্রতি। কেননা ইক্বামতের শব্দাবলী সতেরটি হাদীসে নেই বলে সে আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করেছে।
হাদীস শরীফে রয়েছে,‘যে ব্যক্তি আমার ওপর ইচ্ছাকৃত মিথ্যারোপ করেছে, সে আপন বাসস্থান জাহান্নামে গড়েছে’। (বুখারী, মুসলিম ও মুসতাদরিক লিল হাকিম-এ হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে সংকলন করেন) এমন  উদ্ভট কথাবার্তা শুনা কিংবা এমন লোকের সংস্পর্শে থাকার মাধ্যমে নিজের আবাস জাহান্নামে গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও ওড়িয়ে দেওয়া যায়না। সুতরাং সলফে সালেহীনদের পদাঙ্ক অনুসরণের আহবান রইল। আল্লাহ আমাদের সৎপথে দৃঢ়পদ রাখুন।

মুক্তিধারা পড়ুন, তাসাওউফ ও মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বা দর্শন সম্পর্কে জানুন

আরো জানতে ভিজিট করুন👉

মুক্তিধারা ইউটিউব চ্যানেল

মুক্তিধারা ফেসবুক পেইজ

 

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *