নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র নাম শ্রবণে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র নাম শ্রবণে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন

🖋️ মুহাম্মদ নূরুল আবছার আল্ হারূনী
হুযুর করীম রউফুর রহীম (দ.)’র নাম শুনে চুমু দেওয়া অতি বরকতময় আমল। নবী (দ.)’র নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করতঃ চোখের ওপর রাখা সন্দেহাতীত ভাবে বৈধ; বৈধতায় আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র আমল এবং পূর্ববর্তী শীর্ষস্থানীয় ওলমাদের কথা ও কাজ প্রমাণবহ। বর্তমানে কিছু সংখ্যক আলেম বেশধারী লোক ওই বরকতময় কাজ থেকে মুসলিম মিল্লাতকে নিবৃত্ত করার প্রয়াসে বিদ্‘আত-নাজায়েয ইত্যাদির ধোয়া তুলছে। সুতরাং নিজের অযোগ্যতা সত্ত্বেও  আল্লাহর ওপর ভরসা করে এ বিষয়ে দলীল-প্রমাণ ভিত্তিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হলাম।
আদি পিতা হযরত আদম (আ.)’র আমল: হযরত আদম (আ.) জন্নাতে অবস্থান কালে সরকারে দো’আলম (দ.)’র সাক্ষাত প্রয়াসী হলে আল্লাহ তাঁর প্রতি অহী করলেন যে, নবীয়ে আখেরুযযমান আপনারই ঔরসে হবেন। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (দ.)’র সাক্ষাতের ফরিয়াদ করলে আল্লাহ তাঁর প্রতি অহী করলেন এবং নূরে মুহাম্মদী (দ.) কে তাঁর (ডান হাতের) বৃদ্ধাঙ্গুলীতে প্রতিফলিত করলেন। অতঃপর ওই নূর আল্লাহর তসবীহ পড়লেন; ওই কারণেই ওই আঙ্গুলকে ‘মুসাব্বিহা’ বা তাসবীহ পাঠকারী নামে ভূষিত করা হয়। যেমন আররওদ্বুল ফায়িক গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে- অথবা আল্লাহ তাঁর হাবীবের সৌন্দর্য দর্পণের ন্যায় আদম (আ.)’র দুই বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখের সচ্ছতায় প্রকাশ করেছেন। অতএব আদম (আ.) উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখ চুম্বন করে চোখে বুলালেন। সুতরাং আদম সন্তানের জন্য ওই কাজ সনদ হয়ে গেল। হযরত জিব্রাঈল (আ.) যখন ওই ঘটনা রাসূলুল্লাহ (দ.) কে শুনালেন, তখন তিনি (দ.) বললেন, যে ব্যক্তি আযানে আমার নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ চুমে উভয় চোখে বুলাবে, সে কখনা অন্ধ হবেনা। [রূহুল বয়ান সপ্তম খণ্ড, ২২৯ পৃষ্ঠা।]
মুহাম্মদ (দ.)’র নাম চুম্বনে মূসা (আ.)’র অবাধ্য উম্মতের ক্ষমা প্রাপ্তি :  ওহাব বিন মুনাব্বাহ কর্তৃক বর্ণিত যে, বনী ইস্রাঈলের এক ব্যক্তি অতি পাপিষ্ঠ ছিল। সে শতবর্ষ ধরে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত রয়। যখন ওই ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল, লোকেরা তাকে ময়লার স্তুপে ফেলে দিল। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ.) কে প্রত্যাদেশ করলেন যে, ওই ব্যক্তিকে ওখান থেকে বের করে জানাযার নামায পড়। মূসা (আ.) আরয করলেন, হে প্রভু! বনী ইস্রাঈল স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ওই ব্যক্তি শত বছর পর্যন্ত তোমার নাফরমানীতে লিপ্ত ছিল। আল্লাহ বললেন, তা সত্য বটে; তবে তার রীতি ছিল যে, যখনই তাওরিত খুলত এবং মুহাম্মদ (দ.)’র নাম দেখত , তখন চুমু দিয়ে তা দু’চোখের ওপর রাখত। ওই পুণ্যকাজের বিনিময়ে আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি এবং সত্তরজন হুর তার বিবাহ বন্ধনে দান করেছি। [আসসিরাতু হালবীয়্যাহ ১ম খণ্ড, ৮৩ পৃষ্ঠা। ]
পূর্ববর্তী নবীর একজন পাপিষ্ঠ উম্মত যদি হুযুর (দ.)’র নামের প্রতি শিষ্টাচার হেতু ক্ষমা ও উক্তরূপ দানে ধন্য হয়, তবে আমরা তাঁর উম্মত হয়ে তাঁর নাম শ্রবণে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে চোখে বুলালে আমাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর দানের জগত কেমন হবে!
খলিফাতুর রাসূল আবূ বকর সিদ্দীক (রাদ্বি.)’র আমল: হযরত আবূবকর সিদ্দীক (রাদ্বি.) মুয়াযযিনকে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদার রাসূলুল্লাহ’ বলতে শুনলে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু রদ্বিতু বিল্লাহি রব্বান ওয়া বিল ইসলামি দ্বীনান ওয়া বিমুহাম্মদীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা নবীয়্যান’ বলে উভয় শাহাদত আঙ্গুলীর আভ্যন্তরীণ অংশ চুমে দু’চোখে বুলাতেন, এতে রাসূলুল্লাহ (দ.) বললেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রিয় বন্ধুর ন্যায় কাজ করবে, তার জন্য আমার শফা‘আত হালাল হবে’। [আল্ মাকাছেদুল হাসনাহ, সাখারী, ১ম খণ্ড, ৩৮৪ পৃষ্ঠা; আল্ মাওদ্ব‘আতুল কুবরা, মোল্লা আলী ক্বারী ৩১৬ পৃষ্ঠা।]
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীস বর্ণনার পর সাখাবীর মন্তব্য ‘এ হাদীস মারফূ (সাহবী কর্তৃক নবীর বাণীর সংবাদ) হওয়া বিশুদ্ধ নয়’ দ্বারা ওই হাদীসের ওপর আমল করা কিংবা ওই হাদীসকে দলীল রূপে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনরূপ বিপত্তি আবশ্যক করেনা। কেননা, মোল্লা আলী ক্বারী ওই হাদীসের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, যদি ওটা সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.)’র আমল হওয়া সাব্যস্ত হয়, তবে আমলের জন্য যথেষ্ট। কেননা রাসূলুল্লাহ (দ.) এরশাদ করেন, তোমাদের ওপর আমার এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অপরিহার্য। মুহাদ্দেসীনদের ‘সহীহ নয়’ মন্তব্য দ্বারা ওই হাদীস উসূলে হাদীসের মানদণ্ডে সহীহ হাদীসের নিচ পর্যায়ের বুঝায়। “বিশুদ্ধ নয় মন্তব্যের মর্ম এ নয় যে, ওই হাদীস ভিত্তিহীন; এর দ্বারা দলীল নেওয়া যাবেনা। মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, ‘বিশুদ্ধ নয়’ মন্তব্য দ্বারা কোন হাদীসের ‘হাসান’ হওয়াকে বারণ করেনা”। [আল্ আসরারুল মরফূ‘আহ ফীল আখবারিল মাওদ্বু‘আহ, ২৩৬ পৃষ্ঠা।] মুহাম্মদ বিন হুমাম বলেন, ‘কোন হাদীসের ব্যাপারে হাদীস বিশারদের “এ হাদীস বিশুদ্ধ নয়” মন্তব্য মেনে নেওয়া হলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ হাদীসের দলীল হওয়া শুধু সহীহ হওয়ার ওপর স্থিত নয়, বরং হাসান যথেষ্ট’। [মেরকাত শরহে মেশকাত, তৃতীয় খণ্ড, ১৮৩ পৃষ্ঠা।] তাছাড়াও আমলের ফযিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের দলীল হওয়ার যোগ্যতা ইমামগণের ঐকমত্যে সাব্যস্ত। ইমাম নাওবভী বলেন, ‘আমলের ফযিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের ওপর আমল করা আলেমগণের মতৈক্যে বৈধ সাব্যস্ত’। [শরহে আরবাঈন, ৫ পৃষ্ঠা।] 
বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বনের বৈধতায় ইমাম ও ফকীহগণের মতামত : ইমাম ও ফকীহগণ রাসূলুল্লাহ (দ.)’র নাম শুনা মাত্রই বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ চুম্বন করে চোখে বুলাতেন। তাঁরা ওই মঙ্গলময় কাজকে মুস্তাহাব ও জায়েয মনে করতেন নিম্নে এ প্রাসঙ্গিক কয়েকটি উদ্ধৃতি বিবৃত হল- 
(ক)  ইবনে আবেদীন শামী (রহ.) তাঁর প্রসিদ্ধ ফতওয়াগ্রন্থ রদ্দুল মুহতার আলা দুররিল মুখতার- এ লিখেছেন, আযানের প্রথম শাহাদত শুনে সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ এবং দ্বিতীয় শাহাদাত শুনে কুররাতু আইনী বিকা ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে চোখের ওপর রেখে ‘আল্লাহুম্মা মাত্তা‘আনী বিস্সম‘য়ি ওয়াল বছর’ বলা মুস্তাহাব। কেননা রাসূলুল্লাহ (দ.) এ কাজ সম্পাদনকারীকে নিজের পিছু-পিছু জান্নাতে নিয়ে যাবেন’। [রদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, ৩৭৮ পৃষ্ঠা।]
(খ) ত্বাহত্বাবী স্বীয় ফতওয়ায় লিখেছেন, কহস্তানী কনযুল ইবাদের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেন, ‘আযানে প্রথমবার আশহাদু আন্না মুহাম্মদার রাসূলুল্লাহ’ শুনে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ’ দ্বিতীয়বার শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চ্ম্বুন করে দু‘চোখের ওপর রেখে ‘কুররাত আইনী বিকা ইয়া রাসূলাল্লাহ আল্লাহুম্মা মাত্তা‘আনী বিস্সম‘য়ি ওয়াল বছর’ বলা নিশ্চয় মুস্তাহাব। কেননা ওই বরকতময় কাজকারীকে নবী করীম (দ.) নিজের সাথে জান্নাতে নিয়ে যাবেন’। [হাশিয়া আলা মারাকিইল ফালাহ শরহে নূরিল ইযাহ ১ম খণ্ড, ১৩৮ পৃষ্ঠা।]
মুহাম্মদ (দ.)’র নামে চুম্বন দেওয়ার বরকত : হুযুর নবী করীম (দ.)’র নাম শ্রবণে চুমু দেওয়ার অফুরন্ত বরকত রয়েছে। তম্মধ্যে একটির উল্লেখ ইমামগণ বিশেষভাবে করেছেন, তা হল- চোখের যাবতীয় অসুখের নিরাময়। এতে অন্ধত্ব ও চোখ ওঠা থেকে মুক্তি মিলে। এরূপ কয়টি উক্তি, ঘটনা ও স্বাক্ষী নিম্নে প্রদত্ত হল।
 
. তাউস বলেন, আমি শমস মুহাম্মদ বিন আবি নসর বুখারী হতে হাদীস শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি মুয়াযযিনকে শাহাদত (আশহাদু আন্না মুহাম্মদার রাসূলুল্লাহ) বলতে শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ চুম্বন করে চোখে ঘষতে ঘষতে ‘আল্লাহুম্মা আহফিয হাদাকাতাইয়া ওয়া নাব্বিরহুমা বিবরকাতি হাদাকাতাই মুহাম্মদির রাসূলিল্লাহি ওয়া নূরেহিমা’ বলবে সে কখনো অন্ধ হবে না’। [আল মাকসেদুল হাসনাহ, ২৮৫ পৃষ্ঠা। ]
২. ফকীহ মুহাম্মদ বিন সয়া-বা (রহ.)’র ভাই বর্ণনা করেন যে, ‘একদা জোরালো বাতাসে কিছু পাথরক্ষণা আমার চোখে ঢুকে পড়ে। তা বের করতে আমি ব্যর্থ হই আর আমার চোখে বিষম যন্ত্রণা শুরু হয়। এমতাবস্থায় আমি মুয়াযযিনকে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদার রাসূলুল্লাহ’ বলতে শুনে উক্ত দু‘আ পড়ে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করতঃ চোখে মালিশ করলে পাথরক্ষণা গুলো আঁখি কোটর হতে বেরিয়ে আসে। [কশফুল খিফা, ২য় খণ্ড, ২৭০ পৃষ্ঠা।]
৩. ইবনে ছালেহ বলেন, আমি ফকীহ মুহাম্মদ বিন যরন্দীকে কতেক ইরাকী অথবা আ’জমী শায়খ হতে বর্ণনা করতে শুনেছি, ‘তারা চোখে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় মালিশ করার সময় ‘সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া সাইয়েদী ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবা ক্বালবী ওয়া ইয়া নূরা বছরী ওয়া ইয়া কুররাতা আইনী’ বলতেন। এবং তাঁরা উভয় (ইরাকী ও আ’জমী শায়খদ্বয়) বলেন, এ কাজ শুরু করার পর থেকে কখনো আমার চোখে ব্যাথা হয়নি’। [আল্ মাকছেদুল হাসনাহ ২৮৪ পৃষ্ঠা, কাশফুল খিফা, ২য় খণ্ড, ২৭০ পৃষ্ঠা।]
আলোচ্য আলোচনা মর্মে প্রতিভাত হয় যে, নবী করীম (দ.) নাম মোবারক শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন এক পুণ্য ও বরকতময় কাজ। এ কাজে চোখের সুস্থতা, নবী (দ.)’র শাফ‘আতের যোগ্যতা ও নবী (দ.)’র সাথে জান্নাতে প্রবেশের সৌভাগ্যের সাথে সাথে দুনিয়া-আখিরাতের বহু মঙ্গল নিহিত রয়েছে। এ মুস্তাহাব কাজ থেকে বিরত রেখে বহু মঙ্গল-প্রাচুর্য হতে বঞ্চিত করার অপপ্রয়াসে যারা লিপ্ত, যারা বিদ্‘আত-মাকরূহের ধোয়া তুলে; তাদের ওই সব খোঁড়া যুক্তি উক্ত জোরালো দলীলের প্রাবল্যে খড়ের মতো ওড়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (দ.)’র নামের বরকতে মঙ্গলধন্য করুন। আমিন।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *