খলিফায়ে গাউসুল আযম আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুস সালাম ভূজপুরী রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু

খলিফায়ে গাউসুল আযম আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুস সালাম ভূজপুরী রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু

✒ আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর

খলিফা-এ গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী কুত্ববে ওয়াক্ত গাউসে যমান হযরতুল আল্লামা মাওলানা সৈয়্যদ আব্দুস সালাম ভূজপুরী আলায়হি রাহমাতু রাব্বিহিল বারী ক্ষণজন্মা এক মহাপুরুষ। এ মহাপুরুষের সংস্পর্শে হাজারো পথহারা পেয়েছে পথের দিশা, অপূর্ণাঙ্গ পেয়েছে পূর্ণতা আর রুগ্নান্তর হয়েছে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী। সর্বোপরি ইন্তেকালের প্রায় দেড় বছর পর স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে কবর শরীফ হতে স্থানান্তরিত হয়ে দ্বীনে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপরেখা তাসাওউফ তথা মাইজভাণ্ডারী ত্বরীকা-দর্শনের সত্যতা ও হায়াতে দায়েমীর স্বপক্ষে সুষ্পষ্ট নিদর্শন হয়ে আছেন। হায়াতুন্নবী (দ.) অস্বীকারকারীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, শুধু নবী (দ.) নন, সাচ্ছা গোলামে নবী (দ.)ও জিন্দা। গবেষক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সর্বসাধারণকে এ মহাপুরুষ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা দেওয়ার প্রয়াসে এ নিবন্ধের অবতারণা।

নাম: আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুস সালাম ভূজপুরী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু।

জন্ম: ১২৪২ মঘী মোতাবেক ১২৮৭ বঙ্গাব্দ ১২ কার্তিক ২৯ অক্টোবর ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ রোজ সোমবার যুহরের সময় চট্টগ্রামের ফটিকছড়িস্থ ধুরুং ইউনিয়নের সুপ্রসিদ্ধ সৈয়্যদ ও মাওলানা পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। স্বয়ং গ্রন্থকারের ভাষায়, ‘আলেম হাফেয হাজ্বীর গোরেতে (গোষ্ঠীতে), সৈয়্যদ বংশেতে শুভ দিনেতে, ধুরুং নামেতে শুভ নগরে, প্রভু পয়দা করিয়াছে আমারে। ছাদেক খলিফা করি গোরের (গোষ্ঠীর) নাম, বার অলী স্থান শহর চট্টগ্রাম, বারশত বিয়াল্লিশ মঘীতে, মাহে কার্ত্তিক সোমবার রোজেতে, সেই মাসের বার তারিখ জুহরে, প্রভু পয়দা করিয়াছে আমারে’। (মাওলানা ছালেহ সুফিয়ান সাহেবের সৌজন্যে প্রাপ্ত ‘আপ্ত দর্পণ’ নামক পাণ্ডুলিপির ছায়া কপি)

নসব নামা: সৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুস্ সালাম ভূজপুরী তদপিতা হাফেয মাওলানা সৈয়্যদ আব্দুল ওহাব তদপিতা শাহ্ সূফী মাওলানা সৈয়্যদ মুহাম্মদ বুরহানুদ্দীন তদপিতা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ আশরাফুদ্দীন তদপিতা সূফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ ছাদেক খলিফা রহমতুল্লাহি আলায়হিম আজমাঈন।

বাল্যকাল ও শিক্ষার্জন: মাত্র এক বছর এক মাস বয়সে তিনি পিতৃস্নেহ হারান। তাঁর ভাষায়, ‘যখন হইল বয়স তের মাস, পিতাজী ছাড়িয়া গেল স্বর্গবাস’ (প্রাগুক্ত)। পিতার ইন্তিকালের পর বড় ভাই সৈয়্যদ আব্দুল আজীজ (রহ.) তাঁকে ধুরুং থেকে কাঞ্চনপুর নিয়ে যান। তথা জীবনের কয়েক বছর অতিবাহিত হয়। ছয় বছর বয়সে মাতাও পরলোকগত হন। তাঁর ভাষায়, ‘যখন ছয় সাল মোর হইল, আমায় ছেড়ে মাতা স্বর্গে চলিল’ (প্রাগুক্ত)। বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ফটিকছড়ি বিবিরহাট, চট্টগ্রাম ও কাজীরহাটের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন পূর্বক ধর্মীয় বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তাঁর ভাষায়, ‘সপ্ত সাল বয়স যবে হইল, পড়িতে আদেশ ভ্রাতা করিল। বাড়ি ঘরের নানান কাজ কারণে, পড়িতে নারিনু এ অধীনে। বিবিরহাট গিয়া পড়ি কতকাল, ললাটে লেখিলেক এই হাল। তারপর চট্টগ্রাম যাইয়া, ছয় সাল তক তথা পড়িয়া, খরচের অভাবেতে পারিনু, তথা হইতে ফিরি আমি আসিনু। কাজীর হাটে ছিল পাঠশাল, সেখানে আসি পড়ি কতকাল’ (প্রাগুক্ত)।

আধ্যাত্মিক জ্ঞান: অগ্রজ আল্লামা আবুল বরাকাত সৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুল গণি ও আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুল হাদী রহমতুল্লাহি আলায়হিমার পথ ধরে তিনিও গাউসুল আ’যম হযরত শাহসূফী সৈয়্যদ আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রা.)’র শিষ্যত্ব গ্রহণ পূর্বক আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা লাভ করে খেলাফত লাভে ধন্য হন। পুরো যিন্দেগী ত্বরীকতের খেদমতে উৎসর্গী এ মহামানব ধর্ম-দর্শন, ত্বরীকত ও আপন পীরের বন্দনায় বহু গীতি রচনা করেছেন।

সংসার জীবন: অনেক চড়াই-উতরাই এর পর ষোল বছর বয়সে ভূজপুরে বসতি স্থাপন করেন এবং সতের বছর বয়সে মরহুম করম আলীর বিদূষী কন্যা কিশোরী ওমদা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

রচনাবলী: রত্মবিন্দু, আপ্ত দর্পণ, মনশোকানল, তছনিফুচ্ছালাম ফি ইশকে গাউসিল আ’যম, নছিহতুল বারী ফি হুব্বে ভাণ্ডারী ইত্যাদি।

কারামত: এ মহা মনীষীর অগণিত কারামত আল্লাহর মর্জি মতো প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নে তাঁর কয়েকটি কারামত উপস্থাপিত হল।

এক. রাউজান নিবাসী প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুস সালাম কাযেমী (রহ.) বর্ণনা করেন, আমি (আব্দুস সালাম কাযেমী) ছাত্র জীবনে নিদ্রা-প্রাবল্যে জ্ঞানার্জনে অকৃতকার্য হওয়ায় নৈরাশ হয়ে একদা আমার পীর-মুর্শিদ কেবলার খেদমতে পাহাড়-তাপস্যে গমনের অনুমতির জোর আবেদন জানাই। প্রত্যুত্তরে হযরত কেবলা বললেন, আমি তোমাকে ময়দানে রাখতে চাই আর তুমি যেতে চাচ্ছো পাহাড়ে! আমি বল্লাম, জাগ্রতাবস্থায় একটি পাঠও নিতে পারিনা, লেখাপড়া করবো কি করে? হযরত বল্লেন, অবশেষে আমাকেই পড়তে হবে; যাও, ফী আমানিল্লাহ। অতঃপর আমি শিক্ষকদের পাঠদান কালে পূর্ববৎ ঘুমিয়ে থাকতাম কিন্তু পাঠদান শেষে সাথীদের সাথে পুনরাবৃত্তি করতাম। সহপাঠীরা সবিস্ময়ে বলতো, তুমি পুরো ক্লাসে ঘুমিয়ে থাকো; পরে হুবহু পুনরাবৃত্তি করো কী করে! আমার পরিস্থিতি ছিল এমন যে, শিক্ষকরা ক্লাসে যা বলতেন পুনরাবৃত্তি কালে তা অক্ষরে অক্ষরে মনে উদ্ভাসিত হয়ে যেত। মোটকথা আমার সমুদয় জ্ঞানই আমার মুর্শিদের কৃপাদৃষ্টির ফসল। আমি শিক্ষকতা জীবনের শুরু হতে অদ্যাবধি বিনা ইতস্ততায় সিহা সিত্তাহ ও অন্যান্য কিতাবাদির পাঠদান করে চলছি। এ পর্যন্ত ছাত্রদের পক্ষ থেকে না বুঝার কোন অভিযোগই ওঠেনি। এ সব আমার যোগ্যতা নয় বরং আমার মুর্শিদে ফা‘আলের দয়া দৃষ্টি।

দুই. আমি (কাযেমী) একদা বাবাজান কেবলার খেদমতে রওযায়ে পাক যিয়ারতে মদীনা তাইয়েবাহ গমনের অনুমতি প্রার্থনায় করজোড়ে মিনতি জানাই। প্রত্যুত্তরে হযরত বললেন, কেউ ভ্রমণের বহু কষ্ট-দুর্ভোগ পোহায়ে বন্ধুর সাক্ষাতে বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে বন্ধুর দেখা না পেলে আনন্দ পাবে না দুঃখ? বল্লাম, দুঃখই পাবে। অতঃপর ইরশাদ করলেন, আর কেউ সারা রাত আপন ঘরে আরামে ঘুমাল আর সকালে দরজা খুলতেই হঠাৎ বন্ধুর সাক্ষাৎ মিলে গেল; এতে প্রেমিকের মন উৎফুল্ল হবে কিনা? বল্লাম, অবশ্য আনন্দিত হবে। অতঃপর বললেন, যাও, ফী আমানিল্লাহ। আমি মদীনা যাওয়ার অনুমতি না পেয়ে কদমে মাথা রেখে বসে রই। তন্দ্রা আসতেই সরকারে দু‘আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র দর্শন লাভে ধন্য হই। মুর্শিদের বেলায়তী কারিশমায় তনুমন আনন্দে ভরে গেল। ‘এ সবই মনিব তব দয়া’।

তিন. খিরাম নিবাসী একজন মৌলভী আমাদের সহপাঠী ছিলেন। আমার প্রাণপ্রিয় মুর্শিদের নিকট দীক্ষাসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে তার সমকামীতার অভ্যাস ছিল। মহান মুর্শিদের পবিত্র হাতে বায়াত গ্রহণের পর মুর্শিদ বললেন, যাও বেটা! তোমার ওপর লু হাওয়া বইবে, টুকু ধৈর্য অবলম্বন করো। আমার (কাযেমীর) চাক্ষুষ ঘটনা যে, আমি নিজ চোখে তাকে দেখেছি, তিনি দিবারাত্র সদা কান্নারত থাকতেন। এমনকি দু’চার ফোটা অশ্রু ছাড়া এক গ্রাস আহারও গলাধঃকরণ করতে পারতেন না। সুন্দরী-সুশ্রী রমণী হোক বা অতি সুন্দর বালক, যে-ই তার সামনে দিয়ে যাকনা কেন, তিনি চোখ তুলে তাকাতেন না। ‘এমনই ছিল মুর্শিদে আ’যমের কৃপাদৃষ্টি’।

চার. আমাদের এক পীরভাই মৌলভী আব্দুল আযীয ধর্মপুরী নামে ছিলেন। তিনি পৌষ মাসে ধান্য চাঁদা উত্তোলন উপলক্ষে ভূজপুর গেলে ডাইরিয়া আক্রান্ত হন। মহামান্য মুর্শিদকে এ সংবাদ দেওয়া হলে বলেন, আমার দেউড়ি ঘরের সমুখস্থ পেয়ারা গাছের দু’টি কচিপাতা নিয়ে হস্তপেষণ করে খাইয়ে দাও। খাওয়ানো মাত্রই আল্লাহর দয়ানুগ্রহে তার ডাইরিয়া বন্ধ হয়ে গেল।

পাঁচ. একদা আমি (কাযেমী), হারুয়ালছড়ি নিবাসী মাওলানা হারূনুর রশীদ ও আম্মাজান (মুর্শিদ পত্মী) মুর্শিদে আ’যমের খেদমতে জোর আবেদন জানাই যে, মাওলানা আব্দুল আযীয ধর্মপুরীর প্রতি বারেক কৃপাদৃষ্টি করতে। অনেক আবেদন-মিনতির পর বললেন, যাও, ফী আমানিল্লাহ। এ কথার সাথেই উক্ত মৌলভীর ক্বলব ‘আল্লাহু’ যিকরে সচল হয়ে যায়। এমনকি তার ক্বলব হতে ঢোলকের শব্দের ন্যায় ‘আল্লাহু’ আওয়াজ বেরুত। পাঠদান কালে এ শব্দের উৎস নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাই আশ্চর্য হয়ে যেত। পরন্তু ওই দুর্ভাগা হাটহাজারী ওহাবী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস অধ্যয়নরত থাকাবস্থায় শিক্ষক আব্দুল আযীয টের পেয়ে যায়। অতএব আপন কক্ষে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায় আমার মুর্শিদ সৈয়্যেদী শাহ মাওলানা আব্দুস সালাম ভূজপুরীর পবিত্র দৃষ্টিতে আমার ক্বলবে আল্লাহু যিকর জারি হয়েছে। এতে উক্ত শিক্ষক বলল, মাইজভাণ্ডারী তোমার ক্বলবে যাদু করেছে, তুমি আমার হাতে বায়াত হয়ে যাও। শিক্ষকের কথায় সে অভাগা ওই শিক্ষকের নিকট বায়াত হওয়ার জন্য হাত বাড়াল। ওই ওহাবী মুহাদ্দিসের হাতে হাত রাখতেই তার ক্বলব হতে আল্লাহ নামের জপধ্বনি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ‘ওহাবীদের হাত এমনই অশুভ-অলক্ষুণে হাত’।
(মাওলানা মহী উদ্দীন আহমদ রেজা সাহেবের সৌজন্যে প্রাপ্ত তার পিতা শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুস সালাম কাযেমী (রহ.)’র উর্দু ভাষায় লিখিত ডাইরী হতে আলোচিত কারামত ক’টি সংকলিত)।

ইন্তিকাল ও লাশ মোবারক স্থানান্তর: তিনি ৪ পৌষ ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ ২০ ডিসেম্বর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ রোজ মঙ্গলবার আল্লাহ তা‘আলার মিলনে পরলোক গমন করেন। তাঁকে ইদলপুরস্থ প্রসিদ্ধ বুযুর্গ বোডা শাহের মাযারের পাশে দাফন করা হয়। ইন্তিকালের প্রায় দেড় বছর পর তিনি বোডা শাহের সাথে তাঁর মশরবের মিল হচ্ছেনা বলে নিজ পুত্র মাওলানা সৈয়্যদ মঞ্জুরুল হক ও মাওলানা সৈয়্যদ হাবিবুল হক ছাহেবদ্বয়কে স্বপ্নে অন্যত্র স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তাঁরা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শ করে তাবুত উত্তোলন করেন। হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে কাফন খুললে দেখা যায় যে, পূর্ণিমার চন্দ্রবৎ চেহরা মুবারক হতে মুক্তার ন্যায় বিন্দু-বিন্দু ঘর্ম নির্গত হচ্ছে আর ওষ্ঠদ্বয় নড়ছে। তাবুত, কাফন ও শরীর মুবারক একটুও পরিবর্তনতো হয়ইনি বরং পূর্বের অপেক্ষা উজ্জ্বল ও সুঘ্রাণময় হয়েছে। অতঃপর তাঁকে নিয়ে বর্তমান মাযারস্থ স্থানে দাফন করা হয়। ঘটনা অবলোকনে আউলিয়া বিদ্বেষী বহু লোক ওলীদের প্রতি আস্থাশীল আর কতেক নীরব হয়ে যায়।
প্রতি বছর ৪ পৌষ ওই মহা মনস্বী ও মনীষীর উরস-এ পাক রওযা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। আল্লাহ তাঁর আদর্শ অনুকরণে আমাদের তৌফিক দিন। আমীন বিহুরমতি সৈয়্যিদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *