নির্লোভ-নির্মোহ নির্বিলাস জীবনের পথিকৃৎ

মুহাম্মদ সুলায়মান

নির্লোভ-নির্মোহ নির্বিলাস জীবনের পথিকৃৎ ছিলেন, আমাদের মুরশিদ গাউসে যমান হযরতুল আল্লামা কাযী সৈয়দ হারূনুর রশীদ (রা.)। তাঁর ছনের ঘর আর পাটি দেখে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শত বছর আগের মদীনার সে খেজুর পাতার ঘর আর খেজুর পাতার মাদুরের কথা স্মরণে আসে। রাসূলুল্লাহ (দ.)’র আদর্শের বাস্তব নমুনাও ভেসে ওঠে নয়নে। নিজের পেশাগত দায়িত্ব, আপন প্রতিষ্ঠানের দেখা-শুনা ও মাইজভাণ্ডারী ত্বরীকা-দর্শনের পরিচর্যায় কর্মমুখর জীবনে ক্বায়লুলাহ তথা মধ্যাহ্নভোজোত্তর নিদ্রার সুন্নতটি পালনের অবকাশ প্রায়শ না পেলেও নিজের মুখের গ্রাস অন্যের মুখে তুলে দিয়ে নিজে অভুক্ত থাকার সুন্নত কিন্তু বাদ পড়েনি।
রাসূলে খোদা (দ.)’র মহাবাণী ‘দারিদ্র্য আমার গৌরব’। আমার মুরশিদ স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যকে গৌরব রূপেই বরণ করে নিয়েছেন। ১৯৬৪ কিংবা ৬৫ খ্রীষ্টাব্দ, তখন আমি টগবগে যুবক। হারুয়ালছড়ি হাই স্কুল মাঠে রূপবানের গান হচ্ছে। তখন এ সবের  প্রতি আমার আগ্রহ ছিল প্রবল। আমাদের বাড়ি হতে উক্ত স্থানে যাওয়ার সোজা পথ পুরান যোগিনী ঘাট দিয়ে হালদা পার হয়ে নদীর পার ধরে হাঁটতে শুরু করি। এ হালদা নদীরই অনতি দূরে জীর্ণ এক কুঠির দেখতে পাই। এমন ঘরও কোন মানুষের থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও অতীত। গৃহবাসীর আর্থিক অনটনের কথা ভেবে, কেন জানি, আমার মনটা ব্যথিত হয়ে ওঠল। তখনও কিন্তু আমি জানতামনা এ গৃহ কার? আরো বহু বছর পর যখন হরিণাদীঘির জনাব আব্দুর রহমানের সাথে হারুয়ালছড়ি দরবার শরীফে আসি, তখন দেখি, এ কুঁড়েঘরই হারুয়ালছড়ি দরবার শরীফ। এতেই বাস করেন আব্দুর রহমান ভাইয়ের পীর সাহেব। অবশ্য আব্দুর রহমান ও মফযল আহমদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে ইতঃপূর্বেও তাদের পীর সাহেব হুযূরকে চিনতাম। তাঁকে নিয়ে কোন রূপ পরিচয়পূর্বের একটা বিস্ময়কর স্মৃতিও আমার রয়েছে। সনটি পুরোপুরি মনে পড়ছেনা। ১৯৬৮ কিংবা ৬৯ হবে। বৃন্দাবন চৌধুরীর হাটে আমি মুড়ি কিনতে গেলে দেখি, এক মাওলানা সাহেবও মুড়ি কিনছেন। মুড়ি বিক্রেতা মুড়ির বস্তায় পতিত এক চৌ-আন্নি তুলে নিয়ে বল্ল, হুযূর! ধরুন আপনার পয়সা। মাওলানা: আপনি এ পয়সা আমার পকেট হতে পড়তে কি দেখেছেন? বিক্রেতা: না, দেখিনি। তবে আপনিই তো এখানে টাকা বের করে আমাকে দিয়েছেন। মাওলানা: না দেখে কিভাবে বল্লেন যে, আমার পয়সা? এটাতো অন্য কারোও হতে পারে। এ বলে পয়সা না নিয়েই তিনি প্রস্থান করলেন। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, যে কোন মানুষইতো পয়সাটা নিত। কিন্তু এ মাওলানা নিলেননা কেন? ইনি আবার কেমন মানুষ? সেদিন অবশ্য নির্বিচারে প্রত্যেক মৌলভী-মাওলানাকে লোভী মনে করার ধারণাটা আমার পাল্টায়। পরবর্তীতে হারুয়ালছড়ি দরবার শরীফে আসা-যাওয়া শুরু করলে দেখতে পাই, তিনি শুধু আমাদের থেকে নয় বরং সচরাচর মৌলভী-মাওলানা ও পীর-ফকীর হতে সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ।
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, একটা চার আনার লোভ সামলানো কি বিরাট ব্যাপার? পরন্তু যে পরিবেশ-প্রতিবেশে আমাদের বসবাস, তাতে তা ছিল আমার জন্য রীতিমতো আশ্চর্যের। যেখানে পরের টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা, সেখানে নিশ্চিত রূপে নিজের হওয়ার প্রমাণ না পাওয়ায় যেচে দেওয়া পয়সা প্রত্যাখ্যান!
১৯৬৪-৬৫ ইংরেজীর দিকে দেখা সে কুঁড়েঘরটি কাল পরিক্রমায় কখনো কখনো মেরামত হলেও অদ্যাবধি কুঁড়েঘরই রয়েছে। ওই হুজরা শরীফেই অতিবাহিত হয়েছে আমাদের পরম শ্রদ্ধাষ্পদ মুরশিদে করীমের পুরোটা জীবন। অথচ তিনি ইচ্ছা করলে অট্টালিকায় বসবাস করতে পারতেন। হতে পারতেন বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির মালিক। কিন্তু তাঁর পবিত্র অন্তরে ওই সব লোভ-মোহের স্থান মোটেও ছিলনা। ইন্তেকালের পাঁচ দিন মাত্র আগের ঘটনা। ৯ জুন ২০১১ খ্রীষ্টাব্দ, আমি পাইন্দং নিবাসী সুলায়মান ও জনাব আব্দুর রহমান উভয় একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী কর্তৃক দু‘আর জন্য প্রদত্ত নগদ ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা নিয়ে বাবাজানের খেদমতে আসি। তিনি তাচ্ছিল্যের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা শত অনুনয়-বিনয় করেও গ্রহণ করাতে না পেরে অগত্যা যার টাকা তাকে ফেরৎ দিই।
বিলাসিতাতো নয়ই, অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও তিনি চাকচক্য পছন্দ করতেন না। ২০০০ ইংরেজীর দিকের ঘটনা। সে বছর শীতের প্রকোপ ছিল প্রবল। শৈত্য প্রবাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। বাঁশের বেড়ার  ফাঁক গলে  হু হু করে বাতাস ঢুকছে বাবাজানের হুজরায়। আমরা ত্বরীকতের ভাইদের উদ্যোগে শৈত্য প্রবাহ নিবারক হিসেবে হুজরা শরীফের অভ্যন্তরে  পিসবোর্ড লাগাই। বাবাজান প্রবেশ করেই বল্লেন, আমার দম আটকে যাচ্ছে, এ সব খুলে বাইরে লাগিয়ে দাও। আমরা বল্লাম বাইরে লাগালে সুন্দর হবেনা। বাবাজান বল্লেন, তোমাদের এ সুন্দর আমার কি দরকার? আমি যা বলছি তা-ই কর। অবশেষে আমরা তা খুলে বাইরে লাগাতে বাধ্য হই।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উসিলায় লোভ-মোহ তথা ষড়রিপুর বিনাশ-সামর্থ্য আমাদের দান করুন। আমীন ছুম্মা আমীন।

1 thought on “নির্লোভ-নির্মোহ নির্বিলাস জীবনের পথিকৃৎ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *