জানার অনাগ্রহে রটনা ঘটনায় রূপ পায়

জানার অনাগ্রহে রটনা ঘটনায় রূপ পায়

[প্রসঙ্গ: মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন আলী খালিদী দেহলবী ৬৩৩ – ৭২৫ হিজরী]

🖊️আল্লামা বোরহান উদ্দিন মুহাম্মদ শফিউল বশর 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর বংশধর কিছু সংখ্যক মানুষ দীন প্রচারের জন্য বুখারা থেকে দিল্লি হয়ে বাদায়্যুনে এসে বসতি স্থাপন করেন। ওই দাওয়াতী কাফেলায় চাচাতো জেঠাতো ভাই সম্পর্কের সায়্যেদ আরব বুখারী ও সায়্যেদ আলী বুখারীর পরিবারও ছিল। সায়্যেদ আলী বুখারীর ছেলে সায়্যেদ আহমদ এবং সায়্যেদ আরব বুখারীর কন্যা সায়্যেদাহ্ যুলায়খা পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ওই দম্পতির কোল আলো করে ২৭ সফর ৬৩৩ মতান্তরে ৬৩৬ হিজরীতে জন্ম নেন সায়্যেদ মুহাম্মদ।

সায়্যেদ মুহাম্মদ এর বয়স পাঁচ বছরে পৌঁছতেই বাবা ইন্তিকাল করেন। পরিবারে দেখা দেয় অভাব অনটন। স্নেহময়ী মা দিনরাত সূতা কেটে মোটামুটি অন্নের সংস্থান করলেও সপ্তাহে এক দুই দিন উপোস করতেই হতো। ওই সংগ্রামী মহিলা না কারো দান দাক্ষিণ্য নিয়েছেন, না ছেলে-মেয়ের লালন পালন ও শিক্ষা দীক্ষায় পিছপা হয়েছেন।

যেদিন অন্নের যোগাড় হতো না, সেদিন মা শিশু মুহাম্মদকে বলতেন, “বাবা আজ আমরা আল্লাহর মেহমান”। এতেই ছেলে বুঝে যেতেন আজ ঘরে খাবার নেই; সুতরাং খুশি খুশি অভুক্ত উদর দিনটি কাটিয়ে দিতেন। এভাবে আল্লাহর মেহমান হওয়টা তাঁর কাছে প্রিয়তর হয়ে ওঠে। পরপর কয়েক বেলা ঘরে রান্না হলেই মাকে জিজ্ঞেস করতেন, “মা! আমরা আবার কখন আল্লাহর মেহমান হবো?” প্রত্যুত্তরে শ্রদ্ধেয় আম্মাজান বলতেন, “বাবা! এটিতো আল্লাহর মর্জির ওপর নির্ভর করছে, তিনিতো কারো মুখাপেক্ষী নন। জগতের সবকিছুই তাঁর হাতে, তিনি যখন ইচ্ছা তোমাকে আপন মেহমান বানিয়ে নিবেন”।

মায়ের মুখে এ কথা শুনে শিশু ক্ষণিকের জন্য নীরব হয়ে যেতেন, অতঃপর সানন্দে ফরিয়াদ করতেন, “হে আল্লাহ! তুমি তোমার বান্দাদের প্রতিদিন আপন মেহমান বানিও”।

আল্লাহর আতিথেয়তার সুস্পষ্ট মর্ম এটিই ছিল যে, ওইদিন ক্ষুধার সাথে লড়তে হবে। এতদসত্ত্বেও পাঁচ বছরের এক শিশুর এ ফরিয়াদ, এ আকাঙ্ক্ষা- অভিপ্রায়! দুনিয়াদারদের নিকট বিষয়টি বড় অত্যাশ্চর্য মনে হবে। পরন্তু আল্লাহ তা’আলা যাকে জগত সংসারের প্রকৃত রহস্য অনুধাবনের ক্ষমতা দিয়েছেন, যার মন-মগজ বিস্তৃত করে দিয়েছেন, সে এ নিগূঢ় রহস্য জানেন যে,এমনটি কেন হয়।

শৈশবেই এমন সবুঝ ও স্রষ্টানুরাগী শিশু যে অন্য যেকোনো সাধারণ শিশুর মতো নয়, তা-তো নিশ্চয় অনস্বীকার্য। কালে এ শিশু আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম হবেন, তাও-তো মধ্যাহ্নরবিবৎ সুস্পষ্ট।
না বললেও আপনারা হয়তো বুঝে গিয়েছেন, এতক্ষণ ধরে কার আলোচনা হচ্ছে? তবুও যাদের মস্তিষ্কে সিগন্যাল পৌঁছতে বিলম্ব হয়, তাঁদের জন্য বলা। তিনি হলেন, হযরত শায়খ খাজা সায়্যেদ মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন আওলিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।

আসলেই আমাদের আলোচিত হযরত নামের চেয়ে উপাধিতে সমধিক পরিচিত। তাঁর উপাধির কয়েকটি হল, নিযামুদ্দীন, মহবূবে ইলাহী, সুলত্বানুল মাশায়িখীন, সুলত্বানুল আওলিয়া, সুলত্বানুস্ সালাত্বীন, যরী যর বখ্শ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি শাহ নিযামুদ্দীন আওলিয়া, শায়খ নিযামুদ্দীন আওলিয়া, শাহ নিযাম আওলিয়া, নিযাম দেহলবী, নিযামুদ্দীন খালিদী দেহলবী, বাহ্যাস ও মাহফিল শেকন এবং নিযাম ও নারগিসী কাব্যিক নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
বাদায়্যুনে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে মায়ের সাথে দিল্লি গমন করেন এবং সেখানেই ইলমে যাহির অর্জনে পূর্ণরূপে পরিপূর্ণতা লাভ করেন।

দিল্লিতে হযরত নিযামুদ্দীন (রা.)’র বাসার কাছেই ছিল বাবা ফরীদের ভাই হযরত শায়খ নজীবুদ্দীন মুতাওয়াক্কিল (রা.)’র বাসস্থান। তিনি অধিকাংশ সময় তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতেন। তাঁর মুখেই হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন গঞ্জে শক্কর (রা.)’র মর্যাদা- মাহাত্ম্যের আলোচনা প্রায়শই শুনতে থাকেন। যত শুনতেন ততো বিমুগ্ধ হতেন। এভাবে না দেখেই শায়খে শুয়ূখে আলম বাবা ফরীদুদ্দীন গঞ্জে শক্কর (রা.)’র ভক্ত হয়ে যান। তাঁর মনে বাবা ফরীদের সাক্ষাতাকাঙ্খা দিন দিন বাড়তে থাকে।

অবশেষে অস্থির হয়ে আজূধন (পাক পেতান) শরীফের উদ্দেশ্য যাত্রা দিলেন। পথিমধ্যে সফরসঙ্গীদের একজনকে দেখলেন প্রতিটি সমস্যায় আপন পীরকে স্মরণ করছেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই! তোমার পীর মুর্শিদ কে? সহযাত্রী জানান, বাবা ফরীদুদ্দীন গঞ্জে শক্কর (রা.)। এতদশ্রবণে তাঁর অন্তরে ভক্তি-বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল। তিনি শায়খের দরবারে পৌঁছতেই তাঁকে দেখে শায়খ আওড়ালেন,

اے آتش فراقت دلہا کباب کردہ،
سیلاب اشتیاقت جانہا خراب کردہ –

তব প্রেমাগুনে দিলসমূহে করিল কবাব;
তব অনুরাগ- বানে প্রাণাদি করিল বরবাদ।

অতঃপর তিনি শায়খের হাতে বায়’আত গ্রহণ করে বাত্বিনী পরিপূর্ণতা অর্জনান্তে খলীফাহ্ নিযুক্ত হন। তিনি মুজাররদ বা আজীবন অবিবাহিত ছিলেন।

তিনি ১৮ রবিউস সানী ৭২৫ হিজরী রোজ বুধবার বাদে আছর ইন্তিকাল করেন এবং দিল্লিতে তাঁর রওযাহ্ শরীফ অবস্থিত। আল্লাহ তাঁর ফুয়ূযাত সকলের জন্য অবারিত করুন।

উল্লেখ্য যে, এক দুর্ধর্ষ হন্তারক ও ডাকাতের ওলী হয়ে ওঠার একটি গল্প সর্বসাধারণের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় ও চর্চিত। আমি জানিনা যে, এটি সত্যি ঘটনা, নাকি বনী ইসরাইলের সেই সেঞ্চুরিয়ান হন্তারকের তাওবাহ্ কবুল প্রাসঙ্গিক সহীহ বুখারী শরীফের বর্ণনার কল্পনা মিশ্রিত রূপায়ণ। পরন্তু সেটি যখন নিযামুদ্দীন মাহবূবে ইলাহীর মতো নাজীবুত্ব্ ত্বরফাইন বা পিতৃ ও মাতৃ উভয়কূলে সায়্যেদ, শৈশবেই উপোসপ্রিয় নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী সত্তার প্রতি করা হয়, তখন সেটি কাহিনী আর গল্প থাকেনা; মিথ্যা রটনা ও সুস্পষ্ট অপবাদারোপ হয়ে যায়। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিকা। আল্লাহ তা’আলা সকলকে সুমতি দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *