ইয়াযীদ নামা

ইয়াযীদ নামা

🖋️ আল্লামা বোরহান উদ্দিন মুহাম্মদ শফিউল বশর 

ইয়াযীদও আমার লেখার আলোচ্য হবে, কখনো ভাবিনি। আফসোস! দুঃখ ভারাক্রান্ত মনের বোঝা হাল্কা করতে অনন্যোপায় হয়েই লিখতে বাধ্য হলাম।

পবিত্র কুরআনে পাকে ঈমান ইসলামের বিনিময়ে যাদের প্রেম ভালোবাসা তলব করা হয়েছে, তাঁদের শত্রুতায় মুসলিম নামধারী একটি পক্ষ আদাজল খেয়ে নেমেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম খুৎবাহর মাঝখানে বিরতি দিয়ে মিম্বর থেকে নেমে যে দুই মহান ইমামকে কোলে তুলে নিতেন, আজ নবীর সদক্বায় প্রাপ্ত মিম্বারে দাঁড়িয়ে তাঁদের অন্যতম সত্তা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে রাজদ্রোহী, ক্ষমতালিপ্সু না জানি আরো কত কিছু বলা হচ্ছে!

আর ইয়াযীদের বন্দনায় শাহাদতে হুসাইনের দায়মুক্ত, খলীফায়ে বরহক্ব, মুত্তাক্বী, জন্মগত জান্নাতী, আমীরুল মু’মিনীন,খলীফাতুল মুসলিমীন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইত্যাদি ইত্যাদি বকা হচ্ছে! সুতরাং এ আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার কোন বিকল্পই আর রইলনা।

কুরআন তিলাওয়াত পূর্বে আ’ঊযু বিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম পাঠের মতো মুহাররম মাস আসার এবং কারবালার আলোচনা পূর্বে ইয়াযীদ নামার অবতারণা।

ইয়াযীদ কে? ইয়াযীদ কে? ইয়াযীদ কে?

এ বিষয়টি জানতে প্রথমে তার অনুকূলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত সনদে একটু দৃষ্টি দিই।
عن ابى درداء رضى الله عنه قال سمعت النبى صلى الله عليه وسلم يقول اول من يبدل سنتى رجل من بنى امية ، يقال له يزيد-
আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাকে বলতে শুনেছি, “প্রথম যেই ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে পরিবর্তন করবে, সে বনু উমায়্যার একজন; যাকে ইয়াযীদ নামে অভিহিত করা হবে”। [মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ বিন হাজর আলহায়তমী আলমালিকীর আস্সাওয়া’ইক্বুল মুহরিক্বাহ, 221 পৃষ্ঠা।]

و أخرح أبو يعلى في مسنده بسند ضعيف عن أبي عبيدة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لايزال أمر أمتي قائما بالقسط، حتى يكون أول من يثلمه رجل من بني أميه يقال له يزيد-
এবং আবু ইয়ালা তাঁর মসনদে দুর্বল সূত্রে আবু উবায়দাহ থেকে হাদীস সংকলন করেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “সর্বদা আমার উম্মতের নেতৃত্বে ইনসাফ কায়েম থাকবে, যাবৎ বনু উমায়্যার একজন প্রথম তা বিনষ্ট করবে ; যাকে ইয়াযীদ বলা হবে”। [প্রাগুক্ত এবং হাফিয জালালুদ্দীন সুয়ূত্বীর তারীখুল খুলাফা 166 পৃষ্ঠা।]

আলোচিত হাদীসদ্বয়ের মর্ম মতে প্রত্যায়িত যে, ইয়াযীদ সুন্নাতে নববী পরিবর্তন আর ইনসাফ বিনষ্ট করণে ফার্স্ট। সুতরাং ইয়াযীদের অনুকূলে দেওয়া খারিজী মোল্লাদের ওইসব অভিধা ভুয়া-তো বটেই, পক্ষান্তরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর বিরোধিতাও।

ইয়াযীদের শাসন থেকে সাহাবীয়ে রাসূলের ইস্তি’আযাহ বা আশ্রয় প্রার্থনা :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর পূর্বোক্ত বাণী সম্পর্কে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জ্ঞাত ছিলেন। তিনি ইয়াযীদের ক্ষমতার মসনদে আরোহিত হওয়ার সন সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। তাই তিনি ফরিয়াদ করতেন,
اللهم إنى أعوذ بك من رأس الستين و إمارة الصبيان، فأستجاب الله فتوفاه سنة تسع و خمسين-

“হে আল্লাহ আমি ছোকরার নেতৃত্ব আর ষাট হিজরীর শুরু থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাই।” আল্লাহ তা’আলা তাঁর দু’আ কবুল করেছেন, অতএব ঊনষাট হিজরীতে তাঁকে ওফাত দান করেন। [আস্সাওয়া‘ইক্বুল মুহরিক্বাহ, 221 পৃষ্ঠা।]

উফ! তোমাদের সে খলীফায়ে বরহক্ব! আমীরুল মু’মিনীন! খলীফাতুল মুসলিমীন! কত জঘন্য? যার শাসনামল থেকে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। আমি মনে করি, বর্তমানকালে ইয়াযীদের প্রশংসাকারী ইমাম, খতীব ও ওয়ায়িযদের ইমামত, খিতাবত ও ওয়ায থেকেও আল্লাহর দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা জরুরি।

ইয়াযীদ তনয় মু‘আবিয়াহর জবানবন্দি: 

(ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও আহলে বায়তে রাসূলের শাহাদাতের দায় ইয়াযীদের জিম্মায়)

أنه لما ولى صعد المنبر فقال إن هذه الخلافة حبل الله، —————– ثم قلد أبى ألأمر وكان غير أهل له ونازع إبن بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم فنقصت عمره وانبتر عقبه وصار فى قبره رهينا بذنوبه، ثم بكى و قال إن من أعظم الأمور علينا علمنا بسوء مصرعه وبئس منقلبه وقد قتل عترة رسول الله صلى الله عليه وسلم،وأباح الخمر وخرب الكعبة،ولم أذق حلاوة الخلافة، فلا أتقلد مرارتها، فشأنكم أمركم، والله لئن كانت الدنيا خيرا فقد نلنا منها حظا و لئن كانت شرا فكفى ذرية أبى سفيان ما أصابوا منها-

তাঁকে যখন ক্ষমতা অর্পণ করা হল, তিনি মিম্বরে আরোহণ করে বলেন, নিশ্চয় এ খিলাফত আল্লাহর রশি। —————- অতঃপর আমার বাবাকে ক্ষমতা অর্পণ করা হল, অথচ তিনি তার যোগ্য ছিলেন না। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নন্দিনীর পুত্রের ( দৌহিত্রের) সাথে বিবাদ বিরোধিতা করেছেন। সুতরাং তার আয়ু হ্রাস ঘটেছে, সে নির্বংশ নিরুত্তরাধিকারী হয়েছে এবং আপন ক্ববরে আপন পাপের সাথে বন্দি হয়েছে। অতঃপর তিনি কেঁদে বললেন, আমাদের জন্য বিরাট বিষয় হল, তার মন্দ মরণ ও নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান। নিকট অতীতে তিনি নবীবংশকে শহীদ করেছে, মদ বৈধ করেছে , কা’বা ধ্বংস করেছে অধিকন্তু ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন নি। অতএব আমি সে (গলদের) বারংবারতার অনুসরণ করবোনা। তোমাদের নেতৃত্ব তোমাদের বিষয়। আল্লাহর শপথ! দুনিয়া যদি ভালো হয়, তবে আমরা তার অঢেল লাভ করেছি; আর যদি মন্দ হয়, আবু সুফিয়ানের বংশ যা পেয়েছে তা ঢের। [প্রাগুক্ত 224 পৃষ্ঠা।]

ইয়াযীদ তনয় মু’আবিয়াহর উক্ত জবানবন্দি মতে, ক্ষমতার প্রত্যাখ্যান এবং স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি অবস্থায় তিরোধানের ফলে তার বৈধ বংশধারা নির্মূল হয়ে যায়; এতদসত্ত্বেও ইয়াযীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এত্তো ইয়াযীদের বাচ্চা কোত্থেকে জন্মাল? এ বিষয়ে একটি জরিপ চালানো যেতে পারে।

♦ উমায়্যাহ বংশের অষ্টম শাসক উমর বিন আব্দুল আযীযের দণ্ডাদেশ :

(ইয়াযীদকে আমীরুল মু’মিনীন বলার সাজা বিশ চাবুকাঘাত)

قال نوفل بن أبي الفرات كنت عند عمر بن عبد العزيز، فذكر رجل يزيد، فقال: قال أمير المؤمنين يزيد بن معابية، فقال: تقول أمير المؤمنين؟ وأمر به،فضرب عشرين سوطا-

নওফল বিন আবুল ফুরাত বলেন, একদা আমি উমর বিন আব্দুল আযীযের দরবারে ছিলাম, জনৈক ব্যক্তি ইয়াযীদের আলোচনার অবতারণা করল। অতএব সে বলল, “আমীরুল মু’মিনীন ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া বলেছেন”। (এতদশ্রবণে উমর বিন আব্দুল আযীয) বললেন, (ইয়াযীদকে) তুমি আমীরুল মু’মিনীন বল? এবং তার বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ দিলেন। সুতরাং তাকে বিশ চাবুক মারা হয়। [তারীখুল খুলাফা 166 পৃষ্ঠা; আস্সাওয়া‘ইক্বুল মুহরিক্বাহ 221 পৃষ্ঠা।]

♦ বাংলাদেশে কোন উমর বিন আব্দুল আযীয নেই, বাংলাদেশে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাও ইসলামী নয়, কিন্তু এ দেশতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ, এ দেশের সরকার প্রধানতো একজন মুসলিম, সৈয়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর কলিমা পড়ুয়া, সুতরাং আমার বুঝে আসেনা যে, এ দেশে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বিপরীত ইয়াযীদকে যারা আমীরুল মু’মিনীন ও খলীফায়ে বরহক্ব বলে লেখে, তাদের কেন বিচার হয়না ?

আমি এও বুঝিনা যে, যারা ওই ভাষণ দেয় এবং যাদের সামনে দেয়, তারা কি সে মুসলমান, যারা নামাযে আলে নবীর ওপর দুরূদ পড়ে?

ইয়াযীদের কৃষ্ণ কর্মের দীর্ঘ ফিরিস্তি ইতিহাসের শত সহস্র পাতায় বিদ্যমান‌। ইয়াযীদের কপালের কলঙ্ক তিলক, যা মুছতে মাহমূদ আব্বাসীর খিলাফতে মু‘আবিয়া ওয়া ইয়াযীদ, আবু ইয়াযীদ মুহাম্মদ দীন লাহূরীর রশীদ ইবনে রশীদ, মুহাম্মদ সুলাইমানের সাদাতে বনু উমায়্যাহ এর মতো খারিজী মোল্লাদের লিখিত অন্যান্য পুস্তকাদির কাগজ কালির শ্রাদ্ধে তাদের আপাদমস্তক কলঙ্কিত হওয়া সাঙ্গ হলেও কষ্মিনকালেও ওই দাগ মুছতে সক্ষম হবেনা।

পাতিলে ফুটন্ত চাউলের একটি টিপে যেমন ভাত হল কিনা বুঝা যায়, তেমনি এ অল্প আলোচনাতেই ইয়াযীদ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করি। ক্ষুদ্র এক নিবন্ধে ইয়াযীদের কালো কর্মের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ অসম্ভব; শুধু কারবালার ঘটনা, হার্রার যুদ্ধ, মক্কা আক্রমণ ইত্যাদির প্রতিটি বিষয়ে আলেদা আলেদা গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন পড়বে; সুতরাং এখানেই নিবন্ধের ইতি টানছি।

🔸🔸🔸🔸

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *