হায়রে অসহায়ত্ব
✍️ বোরহান উদ্দিন মুহাম্মদ শফিউল বশর
[প্রথম পর্ব]
একজন প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ মুফতী সাহেব যখন দলীল প্রমাণ যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রতিপাদিত বিষয় অনুসন্ধানের পরিবর্তে সম্পাদ্য স্থির করেই তদালোক তথ্য প্রমাণ সরবরাহে গলদঘর্ম; তখন তাঁর অসহায়ত্বে সত্যিই করুণার উদ্রেক হয়। হরূফে জারের প্রয়োগ দৃষ্টে মুফতীর গবেষণার উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েই যায়। “হায়রে বেচারা! জেদেরই মারা! জেদেতে হয়ে দিশেহারা; না করে পরোয়া, সংযোজন অব্যয়ের পাহারা, ঊর্ধ্বশ্বাসে (বিবেকলুপ্ত) ঘোরা ফেরা!” (কিয়া করেঁ, না করেঁ!)। মা’যূর পরে সবার করুণা হয়, ফতওয়া হয়না।
সিজদায়ে তাহিয়্যাহ এর হুরমত বা অবৈধতার উপর ফুক্বাহায়ে কিরামের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত বলে যারা দাবি করেন, যারা এটাকে মুখতালাফ ফীহ্ বা মতানৈক্য বিশিষ্ট মাসয়ালা মানতেই চান না, যারা সূফীর ভান ধরা মূর্খরাই কেবল এটার বৈধতার প্রবক্তা বলে আস্ফালন করেন, তাঁদের সদয় অবগতির জন্য ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী শায়খ আহমদ সরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহির মাকতূবাতের উদ্ধৃতি সঙ্গত মনে হয়।
بعضے از فقہاء ہر چند سجدۂ تحیت بسلاطین تجویز نمودہ آند اما لائق حال سلاطین عظام آنست کہ دریں امر بحضرت حق سبحانہ وتعالیٰ تواضع نمایند
অর্থাৎ কতেক ফুক্বাহা সম্রাটদের জন্য সিজদায়ে তাহিয়্যাহ যতইনা অনুমোদিত রায় দেন, পরন্তু সম্মানিত সুলত্বানদের অবস্থার সাথে শোভনীয় যে, এ বিষয়ে আল্লাহ পাক সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সমীপে বিনয় দেখাবেন। (সূত্র:ফটোতে সংযুক্ত)।
আক্বীদাহ্’র প্রশ্নে, বিশেষত শানে রিসালাত বিষয়ে আপোষহীন হওয়ার কারণে অনেক গোলাবী সুন্নীর এলার্জির কারণ গাযীয়ে মিল্লাত ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা সায়্যিদ আযীযুল হক্ব্ শেরেবাংলা রহমতুল্লাহি আলাইহির দীওয়ানে আযীযের উদ্ধৃতিও প্রণিধানযোগ্য; যেহেতু প্রকৃত সুন্নী বিশেষত চট্টগ্রামের উলামায়ে কিরাম, সূফীয়ায়ে ইযাম ও আওয়াম জনসাধারণের কাছে তিনি আস্থাভাজন।
حکم سجدۂ تحیہ ہم بداں، اختلاف عالماں بس اندر آں –
অর্থাৎ “সিজদায়ে তাহিয়্যাহ বা অভিবাদন প্রণতির বিধানও জেনে নাও,ওটাতে আলিমদের বেশ মতানৈক্য রয়েছে।”
ইমাম রব্বানী আর ইমাম শেরে বাংলার উক্তি মতে সুস্পষ্ট যে, সিজদাতুত্তাহিয়্যার মাসয়ালা মুখতালাফ ফীহ্ বা মতানৈক্য বিশিষ্ট এবং এই ইখতিলাফ বা মতানৈক্য ফুক্বাহা ও উলামাদের; সুতরাং হুরমতের ওপর ইজমা বা ঐকমত্যের দাবি যেমন সত্যের পরিপন্থী, তেমনি মূর্খ মুতাসাভ্ভিফ লোকেরাই কেবল বৈধতার প্রবক্তা উক্তিও সত্যের অপলাপ। সূরাতু আলে ইমরানের ৮০ নাম্বার আয়াতখানা (ওয়াও) হরফে আত্বফ বা সংযোজন অব্যয় যোগে পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সংযুক্ত। ইরশাদ হচ্ছে,
وَلاَ يَأْمُرَكُمْ أَن تَتَّخِذُواْ الْمَلاَئِكَةَ وَالنِّبِيِّيْنَ أَرْبَابًا أَيَأْمُرُكُم بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنتُم مُّسْلِمُونَ
এবার আয়াতের উর্দু অনুবাদ দেখুন,
اور نہ تمہیں یہ حکم دےگا کہ فرشتوں اور پیغمبروں کو خدا ٹھیرا لو کیا تمہیں کفر کا حکم دےگا بعد اس کے کہ تم مسلمان ہو لیے –
[কানযুল ঈমান ফী তারজুমাতিল কুরআন, ৭১ পৃষ্ঠা, কুতুখানা ইশা‘আতুল ইসলাম দিল্লি।]
এবার বাংলা অনুবাদও একটু পড়ে নিন,
“এবং না তোমাদেরকে এ হুকুম দেবে যে, ফিরিশতাগণ এবং পয়গাম্বরগণকে খোদা সাব্যস্ত করে নাও। তোমাদেরকে কি কুফরের নির্দেশ দেবে এরপর যে, তোমরা মুসলমান হয়ে গেছো।” [তারজুমা-ই-ক্বোরআন, ১২৬ পৃষ্ঠা, গুলশান-ই-হাবীব ইসলামী কমপ্লেক্স চট্টগ্রাম।]
এবার ফতোয়ার অনুবাদও একটু দেখুন,
نبی کو یہ نہیں پہنچتا کہ تمہیں حکم فرماۓ کہ فرشتوں اور پیغمبروں کو رب ٹھہرا لو کیا نبی تمہیں کفر کا حکم دے بعد اس کے کہ تم مسلمان ہو –
অর্থাৎ “নবীর এ অধিকার- ক্ষমতা নেই যে, তোমাদের নির্দেশ দিবেন যে, ফিরিশতাগণ আর নবীদের রব স্থির করে নাও। নবী কি তোমাদের কুফরের নির্দেশ দেয়, এরপর যে, তোমরা মুসলমান হও!” [আল্আত্বায়ান্নাবাবিয়্যাতি ফীল ফাতাওয়ার্রাদ্বাবিয়্যাতি, ২২ খণ্ড, ৪৩২ পৃষ্ঠা, মারকাযে আহলে সুন্নাত বরাকাতে রাদ্বা, গুজরাট।]
পরিপূর্ণ ইনসাফের সাথে কেউ কি এই উত্তর দিবেন যে, একই আয়াতের অনুবাদ দুই জায়গায় দুই ধরনের কেন? ফতোয়াস্থ অনুবাদে نبی کو یہ نہیں پہنچتا کہ বা (নবীর এ অধিকার-ক্ষমতা নেই যে,) কথাটি আয়াতের কোন শব্দের অনুবাদ? উদ্ধৃত আয়াতে কোথাও ওই কথাটি কি আছে? যদি না থাকে তবে এটা মনগড়া ব্যাখ্যা কেন হবে না? যদি বলা হয় যে, পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সংযুক্ত হিসেবে এমন অনুবাদ করা হয়েছে, তবে সংযুক্ত বুঝা যায় এমন و ( ওয়াও) অব্যয় উদ্ধৃত আয়াতে স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও অনুবাদে কেন এড়িয়ে যাওয়া হলো?
শানে নুযূল সম্পর্কে এবং মাসনদে আব্দ বিন হুমাইদ এর উদ্ধৃতিতে সংকলিত শানে নুযূল, যার ভিত্তিতে আলোচিত আয়াত সিজদার অনুমতি প্রার্থী মুসলমানদের ব্যাপারে অবতীর্ণ মর্মে দাবি করা হচ্ছে, যথাস্থানে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। বিনা তদন্তে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যারা ইবারত চুরির অভিযোগ আনছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও তাঁরা আপন নির্দোষিতা প্রমাণ করতে পারবেন না। ওয়াহিদী, সুয়ূতী ও ইবনে হাজরের সাফাই সাক্ষ্যও তাঁদের কোন কাজে আসবে না; যেহেতু তাঁরা মাসনদের রেফারেন্সেই তা বর্ণনা করেছেন এবং করছেন, পরন্তু অনুসন্ধানে ওই গ্রন্থটির কোন কপি বিশ্বের কোন যাদুঘরেও আছে বলে তথ্য মেলে না ।
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে 👉 ক্লিক করুন