সালামে গাউসিয়্যাহ (ফিৎনাবাযের ফৎওয়াবাযীর প্রেক্ষাপটে)

সালামে গাউসিয়্যাহ

(ফিৎনাবাযের ফৎওয়াবাযীর প্রেক্ষাপটে)
✍️ আল্লামা বোরহান উদ্দিন মুহাম্মদ শফিউল বশর 
—————————————————————–
মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বাহর অনুসারীদের মাঝে প্রচলিত সালামী 
یا غوث سلام علیک،یا مرشد سلام علیک،
یا مولیٰ سلام علیک، صلوات اللہ علیک-
“ইয়া গাউসু সালাম আলায়কা, ইয়া মুর্শিদ সালাম আলায়কা,
ইয়া মাওলা সালাম আলায়কা, সালাওয়াতুল্লাহ আলাইকা” 
শতাব্দী অধিককাল ধরে চর্চিত হয়ে আসছে।
সর্বজনবিদিত যে, এ সালামীতে সালাত বা দুরূদও যুক্ত রয়েছে।
নবীকুল সম্রাট মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামার প্রতি সালাতুচ্ছালাম নিবেদান্তে تبعا বা অনুবর্তিতায় এ সালামী পেশ করা হয়। 
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো জন্য بالإستقلال বা স্বাতন্ত্র্য সালাত বা দুরূদ এর বিধান বিষয়ে উলামায়ে কিরামের মতানৈক্য থাকলেও নবীর অনুবর্তিতায় বা ক্রমধারায় সালাত বা দুরূদ পেশের বৈধতার ক্ষেত্রে জ্ঞানীদের কোন প্রকার মতভেদ নেই। প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম এ পর্যন্ত সালামে গাউসিয়্যাহ নিয়ে কোন প্রকার দ্বিমতও করেননি। আত্তাফসীরাতুল আহমদীয়্যাহ ফী বয়ানিল আয়াতিশ্ শারিয়্যাহ গ্রন্থের ৬১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
أن الصلاة على غيره وآله بطريق التبعية جائزة
অর্থাৎ- তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ভিন্ন অন্য কারো এবং তাঁর আলের প্রতি দুরূদ অনুবর্তিতায় বা ক্রমানুসারীয় পদ্ধতিতে জায়িয বা বৈধ। 
মুস্তাকিল বা স্বাতন্ত্র্য সালাত বা দুরূদও গণমুহাক্বিক্বীনের মতে বৈধ। 
قال القاضي وفقه الله، عامة أهل العلم متفقون على جواز الصلاة على غير النبي صلى الله عليه وسلم –
কাযী বলেন, (আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সামর্থ্য দিন) গণজ্ঞানীগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যের ওপর সালাত বা দুরূদ এর বৈধতায় একমত। কাযী আয়্যাদ্বের আশশিফা বিতা’রীফি হুক্বুক্বিল মুস্তফা দ্বিতীয় খণ্ড ৯৯ পৃষ্ঠা।
মাইজভাণ্ডারীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর অনুবর্তিতায় এ সালামী আরয করেন বিধায় স্বাতন্ত্র্য সালাত বা দুরূদ বিষয়ক মতানৈক্যের আলোচনা না পাড়লেও চলে, তবুও সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পেলাম।
♦ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও আম্বিয়া আলায়হিমুচ্ছালাম ব্যতীত অন্যের জন্য দুরূদের বৈধতার প্রবক্তাদের মতের পক্ষে কালামে মাজীদের দলীল নিম্নরূপ
এক.
أُولَـئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
তারা সে সমস্ত লোক, যাদের ওপর তাদের রবের দুরূদসমূহ এবং রহমত বর্ষিত হয় এবং এসব লোকই হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সূরাতুল বাক্বারাহ্ ১৫৭ নম্বর আয়াত।
দুই.
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلاَتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
হে হাবীব! তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন,যদ্ধারা আপনি তাদের পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করবেন এবং তাদের ওপর সালাত বা মঙ্গলের দু’আ করুন; নিশ্চয় আপনার দু’আ তাদের জন্য প্রশান্তি এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। সূরাতুত তাওবাহ্ ১০৩ নম্বর আয়াত।
তিন.
هُوَ ٱلَّذِى يُصَلِّى عَلَيْكُمْ وَمَلَٰٓئِكَتُهُۥ لِيُخْرِجَكُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ ۚ وَكَانَ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا (الأحزاب – 43)
তিনিই তোমাদের প্রতি সালাত বা দুরূদ বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফিরেশতাগণও ; যেন অন্ধকার থেকে তোমাদের আলোকে বের করে আনেন; এবং তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু। সূরাতুল আহযাব ৪৩ নম্বর আয়াত।
♦ হাদীসে পাকের প্রমাণ নিম্নরূপ।
عن عبد الله بن أبي أوفىٰ قال كانَ النبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ إذَا أتَاهُ قَوْمٌ بصَدَقَتِهِمْ، قالَ: اللَّهُمَّ صَلِّ علَى آلِ فُلَانٍ، 
فأتَاهُ أبِي بصَدَقَتِهِ، فَقالَ: اللَّهُمَّ صَلِّ علَى آلِ أبِي أوْفَى
অর্থাৎ- আব্দুল্লাহ বিন আবূ আওফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট কোন জনগোষ্ঠী যাকাত নিয়ে এলে তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! তাদের ওপর সালাত (রহমত) বর্ষণ কর। অতএব, আমার বাবা তার যাকাত নিয়ে নবীর খিদমতে উপস্থিত হলে তিনি (নবী) বলেন, হে আল্লাহ! আবূ আওফার বংশের ওপর সালাত (রহমত) বর্ষণ কর। এ হাদীসটি সহীহ বুখারী শরীফ এর কিতাবুয্ যাকাত, কিতাবুল মাগাযী, কিতাবুদ্ দাওয়াতে; সহীহ মুসলিম শরীফের কিতাবুয্ যাকাত বাবুদ দু’আয়ি লিমান আতা বিসাদাক্বাতিহীতে; আবু দাউদ ও নাসাঈ কিতাবুয্ যাকাতে সংকলন করেছেন।
স্বাতন্ত্র্য সালাত বা দুরূদ নাজায়িয পক্ষীয়রা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার উক্তি এবং হাদীসে তাশাব্বুহ এবং উরফে আমকে দলীল হিসেবে নিয়েছেন। মুহাক্বিক্বগণ ওই দলীল প্রমাণ বিশ্লেষণ করে মাকরূহে তানযীহ্ বা খিলাফে আওলা মর্মে মত ব্যক্ত করেন; তাও নামোচ্চারণ বা লিখনোত্তর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলা বা লিখা সংশ্লিষ্ট। নববীর শরহে মুসলিম দ্রষ্টব্য।
সম্প্রতি এক খত্বীবের জুমু‘আহর বয়ানের একটি ভিডিও আমার গোচরে আনীত হয়। লা হাওলা ওয়া লা কূওয়াতা! দেখতে যেন ফখরে যমান!!! তিনি এ সালামীকে হারাম হারাম বলে ঢের চেঁচামেচি করলেন; অন্যদের মূর্খও আখ্যায়িত করলেন অবলীলায়! ওই বক্তা যেই মসজিদের মেহরাবে বসে এ ফিৎনার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন, ওই মসজিদের নাম মসলকে আলা হযরত জামে মসজিদ!
এবার ফাযিলে ব্রেলভী আলাইহির রহমাহ্ লিখিত দু’টি পংক্তি দেখুন।
کاملان طریقت پہ کامل درود،
حاملان شریعت پہ لاکھوں سلام
কামিলানে ত্বরীক্বত পেহ্ কামিল দুরূদ,
হামিলানে শরীয়ত পেহ্ লাখোঁ সালাম।
(হাদায়িক্বে বখশিশ ১৩৮ পৃষ্ঠা)
আমার মনে হয়, অনুবাদ নিষ্প্রয়োজন; বাঙালীরা এই টুকুন উর্দু অবশ্যই বুঝেন। এখন আপনারাই বলুন, তার ফৎওয়া মর্মে ফাযিলে ব্রেলভী আলাইহির রহমাহ্ এর ক্বসীদাহর এ পংক্তি দুটির কি হুকুম?
আশা করি ফাযিলে ব্রেলভী আলাইহির রহমাহ্ এর নামে যারা মাঠ গরম করেন, তাঁরা যদি দুধপায়ী মজনু না হয়ে গোস্তদায়ী মজনু হন; তবে তাকে অবশ্যই খবর করবেন, মুখোশ খুলে তার আসল চেহারা মানুষকে দেখাবেন।
তিনি নিজেকে তৈয়্যব শাহ্ হুজুরের মুরীদ বলে পরিচয় দেন। আঞ্জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট প্রকাশিত “শজরা শরীফ” সিলসিলায়ে কাদেরিয়া আলিয়া, দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া- শেতালু শরীফ, সিরিকোট, হরিপুর, পাকিস্তান এর তেইশতম সংস্করণের ৮২ পৃষ্ঠায় রয়েছে,
“কামেলানে ত্বরীক্বত পে কামেল দুরূদ,
হামেলানে শরীয়ত পে লাখোঁ সালাম।”
 
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে ক্বিয়ামে এটি যুগ যুগ ধরে চর্চিত। উক্ত মাওলানার ফৎওয়া মতে তাও হারাম, মূর্খতা এবং গুনাহ সাব্যস্ত হয় বৈকি!
আশা করি তার ব্যাপারে গাউসিয়া কমিটি ও আন্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া এর দায়িত্বশীলরা সজাগ হবেন; অন্যথায় শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালার শিক্ষার্থী কুমির ছানার পরিণতি অনিবার্য।
🔸 আরো উল্লেখ্য যে, তিনি আপন নামের শেষে আলকাদেরীও যুক্ত করেন। এবার গাউসুল আ’যম শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ফৎওয়া দেখুন,
و بجوز أن يقول الرجل لغيره: صلى الله عليك، وصلى الله علىٰ فلان بن فلان، لما روى أن عليا عليه السلام ( و في المطبوعة رضي الله عنه) قال لعمر [ رضي الله عنه]: صلى الله عليك، والنبي صلى الله عليه وسلم قال: اللهم صل على آل أبي أوفىٰ –
অর্থাৎ, কোন ব্যক্তির অন্যের জন্য “সাল্লাল্লাহু আলায়কা” বা (আল্লাহ তোমার ওপর সালাত বর্ষণ করুন) এবং “সাল্লাল্লাহু আলা ফুলানিবনি ফুলান” বা (অমুকের পুত্র অমুকের ওপর আল্লাহ সালাত বর্ষণ করুন) বলা জায়িয বা বৈধ; যেহেতু বর্ণিত আছে যে, আলী আলাইহিচ্ছালাম (প্রকাশনান্তরে রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উমর [রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে] বলেছেন, “আল্লাহ তোমার ওপর সালাত বর্ষণ করুন” এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে আল্লাহ আবূ আওফার বংশের ওপর সালাত বর্ষণ করুন” আলগুনিয়াতু লিত্বালিবায় ত্বরীক্বিল হাক্ব্ক্কি আয্যা ওয়া জাল্লা ফীল আখলাক্বি ওয়াত্ তাসাওউফি ওয়াল আদাবিল ইসলামীয়্যাতি ২৭৮ পৃষ্ঠা।
মাওলানার ঐহেন ফৎওয়াবাযীতে গাউসুল আ’যম শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ফৎওয়া প্রশ্নবিদ্ধ এবং অকথ্য কথনে শান আক্রান্ত হয় বৈকি!!!
আশা করি, নিষ্ঠাবান কাদেরী এবং গাউসে পাকের প্রকৃত ভক্ত অনুরাগী অনুরক্তরা ওই মৌলভীর জিভ টেনে ধরতে যত্নবান হবেন।
আ-হ্যাঁ, এখনো তার নাম পরিচয় বলা হয়নি! আসলে আমি ভেবেছিলাম যে, এমনিতেই সবাই চিনে যাবেন। পরন্তু তার কাসুন্দিতে অল্পের জন্য মসলা কম পড়ুক আর পাঠক মজা মিস্ করুক, তা চাইনা বলেই নাম ধামও বলে নিচ্ছি । ওই খত্বীব মহোদয় হলেন, হাইদচকিয়া নিবাসী হযরতুল আল্লামা জনাব মাওলানা গাজী শফিউল আলম আলকাদেরী।
★★★

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *