আল্লাহ হতে নূর এসেছে

লেখক: আল্লামা এস এম জাফর ছাদেক আল্ আহাদী
পবিত্র কুরআন মজীদে আল্লাহ তা‘আলার বাণী ইরশাদ হচ্ছে- ‘ক্বদ্ জা-আকুম্ মিনাল্লাহি নূরুন্’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ হতে নূর এসেছে’ (সূরা মা-য়িদাহ্-১৫ আয়াতাংশ)।
উক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে সাইয়্যিদুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বি.) তদীয় তাফসীরে বলেন- ‘(নূরুন) রাসূলুন্ ইয়া’নী মুহাম্মাদান (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা)’ অর্থাৎ: “নূর বলতে এখানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাই উদ্দেশ্য।” (৯০ পৃষ্ঠা)।
তাফসীরে রূহুল মা‘আনীতে আল্লামা সৈয়্যদ মাহমুদ আলূসী-বগদাদী (রাদ্বি.) (ইন্তিকাল- ১২৭ হিজরী) বলেন- “(নূরুন) আযীমুন্ ওয়া হুয়া নূরুল আন্ওয়ারি ওয়ান্নবীউল মুখ্তারি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা; ওয়া ইলা- হা-যা যাহাবা ক্বাতাদাতু ওয়া আখ্তারাহূল্ যুজাযু”
অর্থাৎ: “এমন মহান নূর যিনি নূর সমূহেরও নূর এবং স্বাধীন ইচ্ছার অধিকার প্রদত্ত নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা) হন; যা হযরত ক্বাতাদাহ এবং ইমাম যুজায্ (রাদ্বি.)’রও অভিমত” (ষষ্ঠ খণ্ড ৯৭ পৃ.)।
প্রকাশ থাকে যে, উপরোক্ত রূপ সঠিক অভিমতের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম দ্বিমতের সূত্রপাত করতে দেখা যায়, মু’তাযিলাহ্ নামক ভ্রান্ত দলের শীর্ষ নেতা আবু আলী জবায়ী ও তাদের অন্যতম নেতা যমখ্শরীকেই। যেমন উক্ত তাফসীরে ‘রূহুল মা‘আনী’র মধ্যে উল্লেখ রয়েছে- “ওয়া ক্বালা আবু আলী আল্ জবায়ী ‘আনা-বিননূরে আল্ কুরআন… ওয়া ইক্বতাসারা ‘আলা- যালিকায্ যমখ্শরীয়ু” অর্থাৎ “আবু আলী জবায়ী বলল, নূর দ্বারা কুরআনই উদ্দেশ্য এবং যমখ্শরীও ঐ মতবাদ ধরেছে” (প্রাগুক্ত)। এতে করে আরো প্রকাশ থাকে যে, এখানে নূর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাকে বুঝা বিরোধী বিভিন্ন মতামত কোন কোন তাফসীরকারক থেকে পাওয়া গেলেও তা আদৌ গ্রহণযোগ্য মত হিসেবে ধার্তব্য নয়; কারণ ওইহেন সব ভিন্ন মতামত, সুন্নাহ্ ভিত্তিক অভিমত বিরোধী বিদ্‘আতের মধ্যেই শামিল। আর সুন্নাহ্ বিরোধী বিদ্‘আত মাত্রই গোমরাহী।
তাফসীরে আত্ত্ববরী’তে ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনু জারীর (রাদ্বি.) (ইন্তিকাল: ৩১০ হিজরী) লিখেছেন- “(ক্বদ জা-আকুম্ মিনাল্লাহি নূরুন্) ইয়া’নী বিননূরি মুহাম্মাদান সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা” অর্থাৎ: “(নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ হতে নূর এসেছে) এখানে নূর দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাই উদ্দেশ্য” (৪র্থ খণ্ড, ৫০২ পৃ.)।
তাফসীরে ম‘য়ালিমুত্ তানযীল-এ আছে- ‘ক্বদ জা-আকুম মিনাল্লাহি নূরুন্’ ই‘য়ানী মুহাম্মাদান্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’ অর্থাৎ: “নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ হতে নূর এসেছে’ অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাই (১ম খণ্ড, ২৭৩ পৃ.)।
তাফসীরে বগভীতে ইমাম বগভী (রাদ্বি.) (ইন্তিকাল- ৫১৬ হিজরী) বলেন: ‘ক্বদ্ জা-আকুম্ মিনাল্লাহি নূরুন্ ই‘য়ানী মুহাম্মাদন্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা’ অর্থাৎ: ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ হতে নূর এসেছে’ অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাই’ (১ম খণ্ড, ২১৭ পৃ.)।
তাফসীরে কবীর-এ ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রাদ্বি.)(৫৪৪-৬০৪ হিজরী) বলেন: ‘ওয়া ফীহি আক্বওয়ালুন্ আল্আউয়ালু আন্নাল্ মুরাদা বিন্নূরি মুহাম্মাদুন্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’ অর্থাৎ: “এ ব্যাপারে মত কয়টির প্রথমটি হচ্ছে- এখানে নূর বলতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাই উদ্দেশ্য’ (৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৯৪ পৃ.)।
তাফসীরে মাদারিক-এ ইমাম হাফিযুদ্দীন নাসফী বলেন: ‘ক্বদ্ জা-আকুম মিনাল্লাহি নূরুন: ওয়ান্নূরু মুহাম্মাদুন্ আলায়হিস্ সালাম’ অর্থাৎ: নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ হতে নূর এসেছে; আর নূর হচ্ছে মুহাম্মদ আলায়হিস্ সালাম’ (১ম খণ্ড, ২০৬ পৃ.)।
তাফসীরে খাযিন-এ ইমাম মুহীউসসুন্নাহ ‘আলাউদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মদ ইবনু ইব্রাহীম আল্ বগদাদী (রাদ্বি.) (ইন্তিকাল- ৭২৫ হিজরী) বলেন: ক্বদ্ জা-আকুম মিনাল্লাহি নূরুন্ ই‘য়ানী মুহাম্মাদান্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’ অর্থাৎ: নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ হতে নূর এসেছে, অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাই’ (১ম খণ্ড, ৪৪১ পৃ.)।
তাফসীরে জালালাঈন-এ সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য অভিমত সমর্থন পূর্বক তাফসীর প্রণেতা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) (৮৭১ হিজরীতে) লিখেন: ‘ক্বদ্ জা- আকুম মিনাল্লাহি নূরুন্- হুয়ান্নবীয়ূ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’ অর্থাৎ: ‘নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহ্ হতে নূর এসেছে, তিনি হলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’ (৯৭ পৃ.)।
তাফসীরে হুসাইনী প্রণেতা (ইন্তিকাল: ৮৯৭ হিজরী) বলেন: “নূর হযরতে রিসালাত পানাহ্ আস্ত; ওয়া দর বাহরুল হক্বায়িক্ব আ-ওয়ারদাহ কেহ্ ওয়াজহে তাসমিয়ায়ে আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা বনূর আঁ-নাস্ত কেহ্ আউয়াল চীযে কেহ্ হক্ব সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বনূরে ক্বিদাম্ আয্ যুলমত কাদায়ে আদম বওয়াজূদ আ-ওয়ারদাহ্ নূরে ওয়াই বূদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা কেহ্ ‘আউয়ালু
মা-খালাক্বাল্লাহু নূ-রী-’ বা’দআযাঁ ‘আ-লমরা বরায়ে যুহূরে নূর ওয়া নূরে যুহূরে ঊ মওজূদ গরদানী-দ” অর্থাৎ: “নূর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাই। বাহরুল হক্বায়িক্ব-এ সংকলিত যে, আঁ- হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাকে নূর বলার কারণ হচ্ছে: আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলা, অনস্তিত্বময় অন্ধকার থেকে সর্বপ্রথম যে অস্তিত্ব অনাদির নূর দ্বারা আনায়ন করেন, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’র নূরই ছিল; যেমনটি বর্ণিত, ‘সর্ব প্রথম আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন, তা আমারই নূর’। অতঃপর নূরের প্রকাশ ধারায় সমগ্র জগতকে এবং তাঁর প্রকাশ ধারায় নূরকে অস্তিত্বে নিয়ে আসেন।” (প্রাগুক্ত: ১৩০)।
হাদীস শরীফে বর্ণিত, ইমাম আব্দুর রাযযাক তাঁর সনদসূত্রে হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত; আমাকে বলুন, সমস্ত কিছুর প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা কোন্ বস্তু সৃজন করলেন?’ তদুত্তরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করলেন, “হে জাবির, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত বস্তুর প্রথমে ‘আপন নূর হতে’ তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করলেন। অতঃপর ওই নূর আল্লাহ্ তা‘আলার মর্জিমাফিক কুদরত সহকারে আবর্তিত হতে থাকে। ওই সময় না ছিল লাওহ, না ছিল কলম, না ছিল জান্নাত, না ছিল দোজখ, না ছিল ফিরিশতা, না ছিল আকাশ, না ছিল পৃথিবী, না ছিল সূর্য, না ছিল চন্দ্র, না ছিল জ্বীনজাতি, না ছিল মানবজাতি। অতঃপর যখন আল্লাহ তা‘আলা অপর সবকিছু সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন ওই নূরকে চার অংশে বিভক্ত
করে প্রথম অংশ হতে ‘কলম’ দ্বিতীয় অংশ হতে ‘লাওহ’ এবং তৃতীয় অংশ হতে ‘আর্শ সৃষ্টি করলেন। অনন্তর চতুর্থ অংশকে আবার চার অংশে বিভক্ত করে প্রথম অংশ হতে আর্শবাহী ফিরিশতা, দ্বিতীয় অংশ হতে কুর্সী এবং তৃতীয় অংশ হতে বাদবাকী ফিরিশতা সৃষ্টি করলেন। চতুর্থ অংশকে আবার চার অংশে বিভক্ত করে প্রথম অংশ হতে নভোমণ্ডল, দ্বিতীয় অংশ হতে ভূমণ্ডল এবং তৃতীয় অংশ হতে বেহেস্ত-দোযখ সৃষ্টি করলেন। চতুর্থ অংশকে আবার চার অংশে বিভক্ত করতঃ প্রথম অংশ হতে মু’মিনগণের চোখের নূর, দ্বিতীয় অংশ হতে তাদের ক্বলবের নূর যা আল্লাহ তা‘আলার মা’রিফাত এবং তৃতীয় অংশ হতে প্রেম-প্রেরণার নূর তথা ‘লা-ইলাহা
ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ কলেমাস্থ তাওহীদ সৃষ্টি করলেন।” (বুঝা যায় যে, এ ভাবেই ক্রমাগত সমুদয় সৃষ্টি সৃজিত হয়)। (আল্ মাওয়াহিবুল্ লাদুনিয়া ৫৫ পৃষ্ঠা; যরক্বানী ‘আলাল্ মাওয়াহিব; সীরাতে হালবীয়্যাহ্ প্রভৃতি)।
উপর্যুক্ত দলিলাদি দ্বারা সুস্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার সত্তা ‘নূর’ এবং ‘আল্লাহ তা‘আলা হতে এসেছে এমনই নূর’। অধিকন্তু আল্লাহ তা‘আলার নূরের বিকাশধারায় অপরাপর যাবতীয় নূরের উৎসমূলও উক্ত নূরে মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামার উম্মতভুক্ত হয়েও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামাকে ‘নূর’ মানতে যারা নারাজ, তাদের জন্য এখানে চিন্তার বিষয় রয়েছে! কারণ ৭৩ দলে বিভক্ত উম্মতে মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’র একটি মাত্র দল ছাড়া বাকী সবদলই জাহান্নামভুক্ত হওয়ার বর্ণনায় পবিত্র হাদীস শরীফ সূত্রে জাহান্নামমুক্ত দলটির পরিচয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা’র পবিত্র বাণী ইরশাদ হচ্ছে: ‘মা-আনা-আলাইহি ওয়া আসহাবী-’ অর্থাৎ: যার উপর আমি এবং আমার সাহাবাগণ রয়েছে’ (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ ৩০ পৃষ্ঠা)। আর এখানে উপর্যুক্ত দলিলাদির ভিত্তিতে কুরআন মজীদের আলোচ্য আয়াতে ‘নূর’ দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাকে বুঝার অভিমতটির উপরই মাত্র সাহাবীয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা রয়েছেন দেখা যায়। উপরন্তু নূর বিষয়ক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা দ্বারা তাঁর সত্তা নূর হওয়ার বিষয়টি স্বয়ং তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা কর্তৃকও স্বীকৃত অভিমত হিসেবে প্রমাণিত। অতএব উক্তরূপ সঠিক অভিমতের বিরোধীরা এমনই গোমরাহীমূলক বিদ্‘আতী দল, যারা জাহান্নামভুক্ত দলের মধ্যেই শামিল হয়ে যায়। কারণ তাদের সে ভ্রান্ত মতবাদের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাও নেই, সাহাবীয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামাও নেই।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *