নবীজির গোলামীর মাঝে কি যে আছে

মাওলানা মুহাম্মদ নূর হুসাইন হারুনী
 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র গোলামীর যে স্বাদ, তা জগতের অন্য কোথাও মিলেনা। এ মজা, এ তৃপ্তির তুলনায় আযাদীতো নয়ই, বাদশাহীও ম্লান। কবি কতইনা সুন্দর বলেছেন,
‘রাসূলে খোদা কী গোলামী মে কিয়া হে,
যরা তুম গোলামী মে আ-কর তূ দেখো;
গোলামী ইয়ে হে বাদশাহী ছে বেহতর,
ইধর আও কিসমত  জাগা কর তূ দেখো’।
‘নবীজির গোলামীর মাঝে যে কি আছে,
গোলামীতে টুকু এসে তোমরা দেখ,
তাঁহার গোলামী শাহী থেকে উত্তম,
এথা এসে ভাগ্য বিছারিয়ে তোমরা দেখ’।
 
আজ আমরা নবীজির এমন এক গোলামের কাহিনী আপনাদের সমীপে তুলে ধরছি, যিনি জন্মদাতা পিতার স্নেহের কোলে ফিরে যাওয়ার ওপর নবীজির গোলামীকে প্রধান্য দিয়েছেন। তিনি ওই সৌভাগ্যবান সাহাবী, যাঁর নাম পবিত্র কুরআনে রয়েছে। কালামুল্লাহ শরীফ পাঠের সময় ত্রয়বর্ণের ওই নামটি উচ্চারণ করে একজন তিলওয়াতকারী ত্রিশটি পুণ্য লাভ করেন। আপনারাতো জানেন, হাদীসে পাকে রয়েছে, ‘যে পবিত্র কুরআনের একটি বর্ণ পাঠ করবে, তার জন্য দশটি পুণ্য রয়েছে’।
আজকালতো আমরা নাটক-নোবেল পড়তে, সরি, দেখতেই দিনরাত কাটিয়ে দিই, কুরআন তিলাওয়াতের সে ফুরসত আমাদের মিলে কৈ? পরন্তু সকলের মনে রাখা দরকার যে, জীবনদাতা আমাদেরকে মূল্যবান জীবন, ওই সব কাজে ব্যয় করার জন্য দেয়নি।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। এতক্ষণে অবশ্যই ওই সৌভাগ্যবান সাহাবীর নাম আপনাদের জানা হয়ে গিয়েছে। আমরা তবুও বলছি, শুনে রাখুন, তিনি হলেন, যায়িদ বিন হারিসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। কাহিনীর চুম্বকাংশ এখনই শুরু হচ্ছে, আপনারা মনোযোগী হোন।
হযরত যায়েদ বিন হারিসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জাহেলী যুগে মায়ের সাথে নানার বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে বনু কায়স ওই কাফেলা লুণ্ঠন করে। ডাকাতদল কিশোর যায়িদকে মক্কায় এনে বিক্রয় করে দেয়। হাকীম বিন হেযাস তার ফুফী হযরত খাদিজার জন্য তাকে কিনে নেয়। শুরু হয় যায়িদের দাসত্ব জীবন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র সাথে খদিজা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহা’র বিবাহ হলে তিনি হাদিয়া স্বরূপ নবীজির খেদমতে তাকে পেশ করেন। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র দাসত্বে যায়িদের ভাগ্য পাল্টে গেলেও তার পিতার পুত্র-শোক হ্রাস পেলনা বরং দিন দিন বাড়তে রইল।
ছেলে-সন্তানের ভালবাসা মানুষের স্বভাবজাত। এ ভালবাসার ধন হারানোর বেদনা বড়ই কঠিন। এ বেদনা বয়ে চলার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই থাকে। অতি অল্প সংখ্যক মানুষই পারে পুত্র শোক নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে। যায়িদের পিতাও পারলেন না, তিনি প্রায় উম্মাদ হয়ে ওঠেন। যায়িদ নিখোঁজ হওয়ার, পর থেকেই তার পিতা বিলাপ করে কেঁদে কেঁদে অলি-গলি তাকে খুঁজে ফিরতেন। তিনি প্রায়শ যে বিলাপগাঁতা গাইতেন, তার সার সংক্ষেপ হল, ‘আমি যায়িদের স্মরণে কাঁদছি। অথচ আমি জানিনা যে, সে আজও কি জীবিত আছে যে, পথ চেয়ে অপেক্ষা করবো; না মৃত্যু তার সবকিছু সাবাড় করে দিয়েছে যে, নৈরাশ হয়ে যাবো? আল্লাহর শপথ! আমি এ-ও জানিনা যে, হে যায়িদ! সমতলের নরম মাটিতে তোমার দেহ নিশেষ হয়েছে, না পাহাড়ের পাথুরে ভূমিতে? তুমি ফিরে কভুও আসবে কিনা যদি জানতাম। পুরো জগতটাতে আমার একমাত্র কামনা তোমার আগমন। সূর্য ওঠার সময় তোমার কথা মনে পড়ে। বারিপাতের সময় তোমার স্মরণ আমাকে কষ্ট দেয়। বায়ুপ্রবাহ তোমার বিচ্ছেদ-বেদনা বাড়িয়ে দেয়। যায়িদ ছাড়া আমার জীবন জগত সবই আঁধার। জানিনা, আমার দুঃখ-শোক আর দুশ্চিন্তার অবসান ঘটবে কিনা? তার সন্ধানে আমি সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াব। মরুর জাহাজ উট থেমে গেলে থেমে যাবে, কিন্তু আমি থামবোনা। আমি গ্রাম-গঞ্জ, নগর-বন্দর, পাহাড় পর্বত বন-জঙ্গল সর্বত্র তাকে খুঁজে ফিরব। ঝড়-বৃষ্টি, শীত, গরম কিছুতেই আমি নিবৃত্ত হবোনা। যায়িদ ছাড়া আমার শান্তি নাই, স্বস্তি নাই। অবশ্যই মরণ এলেই বাঁচি। কারণ মৃত্যুই সকল আশা বিলীন করে দেয়। পরন্তু আমি আমার আত্মীয়-স্বজন সকলকে অসিয়ত করে যাবো যে, তারাও যেন আমার মত যায়িদের সন্ধান করে’।
হজ্ব উপলক্ষে যায়িদের গোত্রের কতেক লোক মক্কা শরীফ এলে দৈবক্রমে তার সাক্ষাৎ পায়। তারা তাকে চিনতে পেরে তার পিতার অবস্থা, বিলাপ-গীতি এবং বিরহ-বিচ্ছেদের কাহিনী শুনাল। যায়িদও কয়েক পংক্তি কবিতার ছন্দে নিজের ঠিকানা বিবৃত করলেন। হজ্ব শেষে তারা বাড়ি গিয়ে তাঁর পিতাকে সব সংবাদ দিল। যায়িদের পিতা ও তাঁর চাচাসহ কালবিলম্ব না করে মুক্তিপণ নিয়ে তাঁকে দাসত্ব হতে মুক্ত করার জন্য মক্কায় এসে পৌঁছল।
তাঁরা খোঁজ-খবর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র খেদমতে উপস্থিত হয়ে আবেদন জানাল, হে হাশেমী পরিবারের সন্তান ও আপন গোত্রের সরদার! আপনারা হরম শরীফের বাসিন্দা, আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। দাসমুক্তি আপনাদের বংশের স্বভাব। বিশেষতঃ দাসত্ব-মোচন ও ক্ষুধার্তকে আহার দানে আপনার মহানুভবতা দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। আমরা আপন সন্তানের সন্ধানে আপনার নিকট এসেছি। আমাদের ওপর দয়ানুগ্রহ করুন। ফিদিয়া বা মুক্তিপণ গ্রহণ করে তাকে আযাদ করে দিন। স্বাভাবিক মুক্তিপণ অপেক্ষা আরো অধিক দিতেও আমরা প্রস্তুত, আপনি আমাদের প্রতি একটু সদয় হোন।
তাঁদের আবেদন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা বললেন, বেশ! এ টুকুই? তারা বলল, হুযূর! কেবল এ আবেদনই। তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা বললেন, তাকে ডেকে মতামত যাছাই কর। সে যদি যেতে চায় তবে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই সানন্দে তাকে তোমাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আর যদি যেতে না চায় তবে কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছু চাপিয়ে দিতে পারিনা।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র কথা শুনে তারা বলল, আমাদের চাওয়ার চেয়ে আপনার দান আরো মহৎ। আপনি বড় অনুগ্রহই করলেন। আমরা আনন্দের সাথে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম।
অতএব যায়িদকে উপস্থিত করা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এদের চিন?
যায়িদ: জী-হ্যাঁ, চিনি। ইনি আমার পিতা আর উনি আমার চাচা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা: আমার সম্পর্কেও তুমি জান। এখন তোমার ইচ্ছা যে, আমার সাথে থাকতে চাও-তো, থাকতে পার, তাদের সাথে যেতে চাইলেও যাওয়ার অনুমতি আছে।
যায়িদ (স্বতস্ফূর্ত):  হুযূর! আপনার মোকাবিলায় বলুনতো আমি কাকে পছন্দ করতে পারি? আপনি আমার বাপ-চাচা সবই।
যায়িদের বাবা ও চাচা সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, যায়িদ! গোলামীকে আযাদীর ওপর প্রধান্য দিলে? বাপ-চাচা ও পরিবারের সকলের নিকট আদরের দুলাল হয়ে থাকার মোকাবিলায় দাস হয়ে থাকাই বেচে নিলে?
যায়িদ: হ্যাঁ! আমি ওনার (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র প্রতি ইঙ্গিত করে) মাঝে এমন কিছু দেখেছি, যার মোকাবিলায় জগতে আর কিছু ভাবতে পারিনা।
কিশোর যায়িদের উত্তর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, আমি তাকে আপন পুত্র করে নিলাম। মনিব ও গোলামের আবেগঘন মুহূর্ত দেখে যায়িদের বাবা-চাচা অত্যন্ত খুশি হলেন এবং আনন্দিত মনে তাকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লামা’র নিকট রেখে বাড়ি ফিরে গেলেন।
‘উৎসর্গ ওই মনিবের দাস-পালন রীতি পরে;
যার দাসত্বের হয়না তুলনা, দুই জগত ভরে।’
 
 
 

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *