সর্বোত্তম সঞ্চয়
🖋️প্রমিত মুন্তাসির পান্থ
প্রিয় সোনামণিরা! তোমরা নিশ্চয় আবূ লাহাবের নাম শুনেছ। তার প্রকৃত নাম আব্দুল উযযা। আপন রূপ- লাবণ্য ও চমকদার চেহারার কারণে নিজেই নিজের নাম আবূ লাহাব বা শিখাময় রেখেছিল। এ উপনামেই সে সমধিক পরিচিত।
পবিত্র কুরআনে আবূ লাহাব ব্যতিত আরবের অন্য কোন কাফির-মুশরিকের নামোল্লেখে বিনাশ ঘোষণা ও নরক-ঠিকানার বাণী প্রচারিত হয়নি। তার সম্পদ ও সঞ্চয় তাকে উপকৃত না করার ঘোষণাও সূরাহ লাহাবে বিবৃত হয়েছে। পরন্তু একটি আমলের উপকার সে পরকালে পাচ্ছে। আমরা তার সে আমলটি সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সহীহ বুখারী শরীফসহ বহু বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থে বিবৃত, “হযরত আব্বাস (রা.) বলেন,আবূ লাহাব মৃত্যু বরণ করার এক বছর পর আমি তাকে স্বপ্নে খুব খারাপ অবস্থায় দেখলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি অবস্থা, কেমন আছ?” প্রত্যুত্তরে সে বলল, “তোমাদের ছেড়ে আসার পর কোনরূপ শান্তি-স্বস্তি পাইনি কিন্তু সুওয়ায়বাহকে আযাদ করার কারণে প্রতি সোমবার আমার শাস্তি হালকা হয়,আমি পানীয় প্রাপ্ত হই”।
সুপ্রিয় ছোট্ট বন্ধুরা! আমরা জানি দাস-দাসী আযাদ করা বড়ই পুণ্যের কাজ। কিন্তু যে কোন পুণ্য পরকালে ফলপ্রদ হওয়ার জন্য ঈমানদার হওয়া আবশ্যক। এবার তোমরা বল, আবূ লাহাব কি ঈমানদার ছিল? না, সে ঈমানদার ছিলনা।
এতদসত্তেও সে সুওয়ায়বাহকে আযাদের সুফল কেন পাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আবূ লাহাব কর্তৃক সুওয়ায়বাহকে মুক্তিদানের প্রেক্ষাপট জানা জরুরি।
আমাদের প্রিয় নবী (দ.)’র শুভাগমনের ঘটনাবলী সংশ্লিষ্ট বর্ণণাসমূহে রয়েছে, আবূ লাহাব তার দাসী সুওয়ায়বাহকে নবী করীম (দ.)’র আবির্ভাব রজনীতে হযরত আমিনাহ (রা.)’র সেবা-শুশ্রূষার জন্য পাঠিয়েছিল।আমাদের প্রিয় নবী (দ.)’র আবির্ভাব হলে সে খুশি হয়ে দৌড়ে গিয়ে আবূ লাহাবকে সংবাদ দিল, “মনিব! আপনাকে মুবারকবাদ। আজ আল্লাহ আপনার মরহুম ভাইয়ের ঘরে পুত্র সন্তান দান করেছেন।” আপন ভাতিজার জন্মের আনন্দে সে এতই খুশি হয়েছিল যে, যেমনি বসা ছিল, অমনি অবস্থায় আপন হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির ইশারায় বলল, “সুওয়ায়বাহ যাও, তোমাকে নবজাতকের আবির্ভাবের খুশিতে আযাদ করে দিলাম”।
প্রিয় নবী (দ.)’র শুভাগমনে আবূ লাহাবেরও আগে খুশি হয়েছিলেন সুওয়ায়বাহ। এ আনন্দের পুরস্কার স্বরূপ তিনি দাসত্বের জিঞ্জির হতে মুক্ত, নবী করীম (দ.)কে দুধ পান করানোর সৌভাগ্য তথা রসূলুল্লাহ (দ.)’র দুধ-মাতা হওয়ার গৌরব সর্বোপরি ঈমান ধনে ধনী হয়ে চিরস্থায়ী জান্নাতী হবার সাফল্য মণ্ডিত হন। আর আবূ লাহাবের শাস্তি নবী কারীম (দ.)’র জন্মদিবস সোমবারে হাল্কা হয় এবং যে দু’আঙ্গুলির ইঙ্গিতে দাসী সুওয়ায়বাহকে আযাদ করেছিল তা থেকে পানীয় পায়।
বুদ্ধিমান বন্ধুরা! আবূ লাহাব সুওয়ায়বাহকে কেন আযাদ করেছিল? মীলাদুন্নবী (দ.)’র খুশিতে। এবার তোমরাই বল, প্রতি সোমবার তার আযাব কেন হাল্কা হয়, কেন সে ওইদিন তৃষ্ণা-নিবারণের পানীয় পায়? মীলাদুন্নবী (দ.)’র খুশির বিনিময়ে।
উক্ত ঘটনা প্রবাহে সুস্পষ্ট যে, প্রিয় নবী (দ.)’র মীলাদ কেন্দ্রিক আনন্দ প্রকাশ একজন কট্টর কাফিরের জন্যও পরকালে ফলদায়ক, যখন অন্যান্য সকল পুণ্য নিষ্ফল। কাফিরদের পুণ্য কাজ সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা “এবং ওই সব (কর্মসমূহ পারলৌকিক বিনিময়ের হিসাবে) বিনষ্ট, যা তারা পৃথিবীতে আঞ্জাম দিয়েছিল; এবং (ওই সবকিছু) বাতিল-বেকার, যা তারা করতেছিল”। এতে প্রতিভাত যে, আল্লাহর প্রিয় হাবীব (দ.)’র সত্তাকে ঘিরে করা যে কোন আমল বা পুণ্য কাজ অন্যান্য পুণ্য কাজ অপেক্ষা আল্লাহর নিকট প্রিয়তর এবং বিনিময়ের বিচারে উত্তম। আল্লাহর পাক কালামে ইরশাদ হচ্ছে, “বলুন, (এ সবকিছু) আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার কারণে (যা রহমতুললিল আলামীন (দ.)’র সত্তার মাধ্যমে তোমাদের ওপর করা হয়েছে) অতএব ওটার ওপর তারা যেন খুশি উদযাপন করে, এটা তারা যা সঞ্চয় করে তা থেকে উত্তম”। (সূরাহ ইউনুস ৫৮নং আয়াত)।
উল্লেখ্য যে, মানুষ ইহজাগতিক সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ধন-দৌলত আর পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির জন্য পুণ্য সঞ্চয় করেন। আলোচ্য আয়াত মর্মে প্রতিভাত যে, আল্লাহর দয়ানুগ্রহ রূপে আবির্ভূত ও প্রেরিত সত্তা মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (দ.)কে পাওয়ার কৃতজ্ঞতায় আনন্দ উদযাপন সমুদয় সঞ্চয় অপেক্ষা উত্তম। এ উত্তম সঞ্চয় হতে বঞ্চিত রাখতে এক শ্রেণীর মোল্লা-মুন্সির দল মীলাদুন্নবী (দ.) উদযাপন বিদ্’আত, এতে ব্যয়কে অপচয় এবং এ অর্থ অন্য খাতে ব্যয়ের উপকারিতা রসনা-রচনায় সদা বলে-লিখে চলছে। তাদের এ বাঁকা যুক্তির উত্তর আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতে দিয়েই রেখেছেন।
সোনামণিরা! আবূ লাহাবের মত কট্টর কাফির, কুরআনে করীমে যার নাম নিয়েই ভর্ৎসনা করা হয়েছে, যাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী ঘোষণা করা হয়েছে, মীলাদুন্নবী (দ.)’র আনন্দের কারণে প্রতি সোমবার যদি তার শাস্তি হাল্কা করে দেওয়া হয়, তবে একজন মু’মিন যিনি পুরো জীবন এ আনন্দ উদযাপন করেন এবং মু’মিন রূপেই পরলোকগত হন, তাঁর সৌভাগ্যের জগত কেমন হবে? নিশ্চয় কল্পনাতীত। এ কল্পনাতীত সৌভাগ্য লাভের পথে যত বাধা ডিঙ্গিয়ে, যত ষড়যন্ত্র আর কলা-কৌশল নস্যাৎ করে আরো ধুমধামে আয়োজনই হবে আমাদের কাজ। আমরা যেন এ সর্বোত্তম সঞ্চয় নিয়ে যেতে পারি, আল্লাহ তা’আলা সে তৌফীক্ব দিন।
একটি লক্ষণীয় ও শিক্ষণীয় সূক্ষ্মতত্ত্ব আমাদের সামনে হাজির। একদিকে এ বাস্তবতা সামনে এল যে, প্রিয় নবী (দ.)’র উদ্দেশ্যে করা সাধারণ একটি কাজও আল্লাহর দরবারে বিনিময়যোগ্য; হোকনা তা একজন কাফিরেরও। অপরদিকে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত আমাদের বলছে যে, মু’মিন সারা জীবন লক্ষ-কোটি পুণ্যকাজ করতে থাকল, কিন্তু তার থেকে যদি নবী (দ.)’র শানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বেয়াদবিও হয়ে গেল, তবে মু’মিন হয়েও আল্লাহর দরবারে আপন আমলের বিনিময় পাবেনা। আল্ কুরআনের স্বাক্ষ্য, “আপন স্বর (আমার হাবীব) নবী করীম (দ.)’র স্বর হতে চড়া করোনা এবং তোমরা পরস্পর যেরূপ উচ্চরোলে কথা বলো, তাঁর সামনে সেরূপ উচ্চকণ্ঠে কথা বলোনা”।
সাহাবা-ই কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, আমার হাবীব (দ.)’র দরবার কোন সাধারণ দরবার নয়। এ দরবারে বড় সতর্কতায় নিজের স্বর নীচু রেখ। পরস্পরের কথোপকথনের মত আওয়াজ এত উচু করোনা, যাতে আমার প্রিয় মাহবূব (দ.)’র সদাহাস্য পুষ্পকোমল অধর স্পন্দিত মধুর বাণী হতে উচু হয়ে যায়। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা আপন হাবীব (দ.)’র মহান দরবারের এ আদব শিক্ষা দিচ্ছেন। অন্যথায় স্পষ্ট ভাষায় ফরমান জারি করছেন যে, আমি সতর্ক করা সত্তেও যদি না বুঝো, যদি অনবধানতাপূর্ণ কর্ম করো, তবে শুনে রেখো, “যেন তোমাদের আমলসমূহ উৎসন্নে না যায়, আর তোমাদের সেটি টের পর্যন্তও না হয়”।
এ আয়াতে না আল্লাহর একত্বের অস্বীকৃতির কথা বলা হচ্ছে, না নবী-রসূলগণের নবূয়ত-রিসালত অমান্যের, না কোন ফরয অস্বীকারের আলোচনা হচ্ছে, না সুন্নত না মানার; কেবল মুখে এত বড় রা করল, যা নবী কারীম (দ.)’র মধুর রব অপেক্ষা উচু হয়ে গেল, বেশ তার পরিণামেই পুরো জীবনের সকল পুণ্য বাতিল করে দেওয়ার অধ্যাদেশ ঘোষণা হচ্ছে।
অতএব উভয়দিক মিলিয়ে এ বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করা জরুরি যে, রাশিরাশি আমল করা মু’মিন হতেও যদি প্রিয় নবী (দ.)’র শানে ন্যূনতম বেয়াদবি পাওয়া যায়, পরকালে তাকে সমূহ আমলের বিনিময়-বঞ্চিত করে দেওয়া হয়; আর কাফির, ইসলামের শত্রু, তৌহীদ -রিসালত অস্বীকারকারীও যদি নবী কারীম (দ.)’র মীলাদ ও তাঁর সম্মানে ছোট্ট একটি কর্মও করে, তবে পরকালে তাকে ওই আমলের বিনিময় দেওয়া হয়।
“সাব্যস্ত হল যে, সকল ফরয শাখাই মাত্র;
মূলাদি মূল কেবল প্রিয় নবীরই দাসত্ব”।
যাবতীয় আমলের মূল্য ও গ্রহণযোগ্যতা ওইরূপ আমলেরই কারণে, যা প্রিয় নবীর প্রেমে করা হয়। অন্তর যদি নবী কারীম (দ.)’র প্রেম শূন্য হয়, তবে কোন পুণ্য কাজই আল্লাহর নিকট বিনিময়যোগ্য হবেনা।
আল্লাহ তা’আলা অশিষ্টতা হতে আমাদের হিফাযত করুন, যেন অনবধানতায় প্রিয় নবী (দ.)’র শানে কোনরূপ বেয়াদবি না হয়।