অঞ্চল ভিত্তিক জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী এর গুরুত্ব

অঞ্চল ভিত্তিক জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী এর গুরুত্ব

✍️মুহাম্মদ হাসান আলী টিপু

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবার পরিজন ও প্রিয়জনদের প্রতি সালাতুচ্ছালাম নিবেদান্তে নিবন্ধের আলোচ্য আলোকে আলোচনার প্রয়াস পেলাম।
জশন جشن শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো, উৎসব, রাজকীয় অনুষ্ঠান, আনন্দ মেলা; [ফরহঙ্গ-এ- জাদীদ।]
জুলূস جلوس অর্থ হলো, আড়ম্বর, আনন্দ, উল্লাস, মিছিল, শোভা যাত্রা; প্রাগুক্ত
জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর অর্থ হলো, ধরাধামে নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর শুভাগমন আনন্দের রাজকীয় আনন্দ-মিছিল-শোভা যাত্রা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর শুভাগমন রজনীতে রাজকীয় মিছিল-শোভা যাত্রা নিয়ে জন্নাত থেকে হযরত আসিয়াহ ও মারিয়াম এর নেতৃত্বে হূরদল মা আমিনাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ঘর পর্যন্ত এসেছিলেন। [সূত্রঃ আসসিরাতুল হালবিয়্যাহ প্রথম খণ্ড ১০৪ পৃষ্ঠা। ]
মীলাদ রজনীতে আনন্দ মিছিল নিয়ে আসমানের ফিরিশতারা জমিনে নেমে এসেছিলেন জিব্রাইলের নেতৃত্বে। গর্বে ভূপৃষ্ঠের পাহাড়সমূহ স্ফীত, আনন্দে সাগর মহাসাগর তরঙ্গিত এবং খুশিতে ধরনীর অণু পরমাণু আনন্দ নৃত্যে বিভোর হয়ে ওঠেছিল। [সূত্রঃ আলখাসায়িসুল কুবরা প্রথম খণ্ড ৮০ ও ৮১ পৃষ্ঠা।]
জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায়,
“ধুলির ধরা বেহেশতে আজ জয় করিল দিলরে লাজ; 
আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়”।
নবীর শুভাগমন আনন্দের রাজকীয় আনন্দ-মিছিল-শোভা যাত্রা নিয়ে সেদিন উল্টো লটকিয়ে দেওয়া শয়তানের বাচ্চারা হৈচৈ করে এবং বৈধতার সনদ খুঁজে। তাদের হৈচৈয়ে কান দেওয়ার ফুরসৎ আর সনদ দেখানোর গরজ আছে বলে আমি মনে করি না। পরন্তু দুর্বল আশিক্বদের মনকে যেন দ্বিধান্বিত না করতে পারে, সেজন্য একটি সনদ প্রদর্শনের প্রয়াস নিলাম।
আনসারগণ যখন জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আসছেন, তখন মদীনার নারী পুরুষ, ছেলে বুড়ো প্রত্যহ ফজরের নামাজ শেষে শোভা যাত্রার আকৃতিতে চোখ ও অন্তর পথের বিছানা করে নবীকে স্বাগত জানানোর জন্য মদীনা হতে কয়েক মাইলের দূরত্বে ক্বুবায় একত্রিত হয়ে যেতেন। তাঁরা সকাল থেকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত পথ চেয়ে অপেক্ষা করতেন। এভাবে কয়েক দিন কেটে যায়। একদা সফরের দূরত্ব অতিক্রম করে তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় অবতরণ করেন, তখন স্বাগত জানাতে আসা লোকজন আপন আপন গৃহে ফিরে গিয়েছিলেন। সর্বপ্রথম এক ইয়াহূদী তাঁকে দেখতে পায়। সে আনসারদের তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছিল। অতএব সে উচ্চস্বরে বলল, হে বনু ক্বায়লাহ! তোমরা যার অপেক্ষায় ছিলে, তিনি এসে গিয়েছেন। এতে নারী পুরুষ সবাই রাস্তায় নেমে আসেন। —–
فصعد الرجال والنساء فوق البيت وتفرق الغلمان والخدام فى الطريق ينادون يا محمد! يا رسول الله يا محمد يا رسول الله
“সকল পুরুষ ও মহিলা আপন আপন গৃহের ওপর ওঠে যান, বালক ও খাদেমগণ রাস্তায় না’রা দিচ্ছিল যে, হে পরম প্রশংসিত! হে আল্লাহর রাসূল! ইয়া মুহাম্মদ! ইয়া রাসূলাল্লাহ!” সহীহ মুসলিম কিতাবুয্ যুহদি বাবুন ফী হাদীসিল হিজরাতি, হাদীস নম্বর ৭৩৮২।
আলোচ্য হাদীসে জুলূসের সুবূত যেমন রয়েছে, তেমনি ইয়া রাসূলাল্লাহ স্লোগানের দলীলও। এখনতো ধর্মান্ধরা জুলূসকে বিদ‘আত আর ইয়া রাসূলাল্লাহ স্লোগানকে ফালতুও বলে! আল্লাহ এসব ফালতু ফতোয়াবাজ থেকে আমাদের হিফাযত করুন।
উম্মুল মু’মিনীন আয়িশাহ সিদ্দীক্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন,
لما قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم المدينة جعل النساء والصبيان والولائد يقلن: 
 طلع البدر علينا، من ثنيات الوداع،
وجب الشكر علينا، ما دعا لله داع –
أيها المبعوث فينا، جئت بالأمر المطاع،
جئت شرفت المدينة، مرحبا يا خير داع-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন (তাঁকে খোশ আ-মদীদ জানিয়ে) রমনী, বালিকা ও যুবতীরা বলতেছিলেন,
উচ্চারণঃ
“ত্বালা‘আল বাদরু আলায়না,
মিন্ ছানিয়্যাতিল ওয়াদা’ই,
ওয়াজাবাশ্ শুকরু আলায়না,
মা দা‘আ লিল্লাহি দা‘ঈ।
আয়্যুহাল মাব‘ঊসু ফীনা,
জি’তা বিল্ আমরিল মুত্বা‘ই,
জি’তা র্শারাফতাল মদীনাহ্,
মারহাবান ইয়া খায়রা দা‘ঈ।”
ভাবানুবাদঃ
“চাঁদ ওঠেছে মোদের ওপর,
ওয়াদা’রই মোড়াচলে,
কৃতজ্ঞতা আবশ্যক মোদের পরে,
খোদার পানে ডাকলো যে দা‘ঈ।
হে প্রেরিত মোদের মাঝে,
লয়ে বাণী মান্যবর,
ধন্য করিলে মদীনা চরণধুলায় ,
স্তুতিবাদ হে উত্তম দা‘ঈ।”
[সীরাতে হালবিয়্যাহ দ্রষ্টব্য।]
উল্লেখ্য যে, দা‘ঈ (داع) শব্দের অর্থ আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিবেশী হওয়ার মর্যাদাধন্য হয়ে নাজ্জার গোত্রের ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা দফযোগে গান ধরেছিল,
نحن جوار من بنى نجار، يا حبذا محمد من جار –
ভাবানুবাদ:
“বনু নাজ্জারের মেয়ে মোরা ভাগ্যবতী,
শাবাশ মুহাম্মদ এথা গড়িলেন বসতি!”
শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁদের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আমাকে ভালোবাসো? উত্তরে তাঁরা বললেন, نعم يا رسول الله হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন,
 الله يعلم أن قلبي يحبكن، وفي رواية وأنا والله أحبكم، وأنا والله أحبكم، وأنا والله أحبكم،
অর্থাৎ “আল্লাহ জানেন যে, আমার অন্তর তোমাদের ভালোবাসে।” অন্য বর্ণনায় রয়েছে, “আল্লাহর শপথ! আমিও তোমাদের ভালোবাসি, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের ভালোবাসি, আল্লাহর শপথ! আমিও  তোমাদের ভালোবাসি।” [আসসিরাতুল হালবিয়্যাহ দ্বিতীয় খণ্ড ৭১ পৃষ্ঠা।]
এ বর্ণনা সূত্রে প্রমাণিত যে, দফযোগে গীত গীতি স্বয়ং দীনি বিধানের বিধায়ক সর্বাধিক জ্ঞান ও তাক্বওয়ার অধিকারী সত্তা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম শুনেছেন। আফসোস! আজ কিছু অতিজ্ঞানী? আতিপরহেযগার? বকধার্মিককে সরোষে সদর্পে দফ আছড়িয়ে ভাঙ্গতেও দেখা যায়! আল্লাহ এমন মস্তবড় জ্ঞানী ও মুত্তাক্বী থেকে মিল্লাতকে হিফাযত করুন।
অঞ্চল ভিত্তিক জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর গুরুত্ব অপরিসীম। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে শুধু একটি বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
নূতন প্রজন্মের সঠিক পরিচর্যা তথা নবী প্রেমিক, অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের কবলমুক্ত প্রজন্ম সৃষ্টিতে এ ব্যবস্থার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সর্বজন বিদিত যে, কোমলমতি শিশু কিশোর মাত্রই অনুকরণ প্রবণ। শুনা যে কোন গানের পুনরাবৃত্তি আর নির্বাচনোত্তর তাদের মুখে মুখে উচ্চারিত স্লোগান চোখে আঙ্গুল দিয়েই আমাদের সে প্রবণতা দেখিয়ে দেয়। এ কোমলমতিরা যদি জশনে জুলূস দেখে এবং তাতে পঠিত ঈমান তেজোদীপ্ত  হামদ, না’ত, দুরূদ শরীফ ও স্লোগান শুনে, তবে তাদের নির্মল হৃদয়ে সৃজনগত ভাবে গচ্ছিত নবী প্রেমের যে বীজ রয়েছে, তা অঙ্কুরিত হয়ে কালক্রমে ফুলে ফলে ফলিত মহীরুহে পরিণত হবে; নবী বিদ্বেষের ঝড় তুফান প্লাবনে তা আর কখনো উপড়ে ফেলতে পারবেনা। তারা মুখে মুখে সেই হামদ, না’ত, দুরূদ ও স্লোগান আওড়াতে থাকবে, যা তাদের অপসংস্কৃতি থেকে দূরে রাখবে এবং ইসলামী সংস্কৃতির চর্চায় করবে মনোযোগী। তাই প্রয়োজন প্রতিটি অঞ্চলে অঞ্চলে জশনে জুলূসের বিস্তার ও প্রসার।
প্রতিজন সুন্নী মুসলমানের প্রচেষ্টা ও অংশগ্রহণে প্রতিটি এলাকা হোক “ইয়া রাসূলাল্লাহ” স্লোগানে মুখর, বাসন্তী সজীবতায় হোক সজীব আশিক্বে রাসূলের অন্তর, দুশমনে রাসূল কৃষ্ণমুখ ঢুকে যাক গর্তের ভিতর।
ফাযিলে ব্রেলবী আলায়হি রহমতু রব্বিহিল বারীর ভাষায় আহ্বান জানাই,
غیظ میں جل جائیں بے دینوں کے دل،
یا رسول اللہ کے کثرت کیجیۓ –
গয়য ম্যাঁ জ্বল জায়েঁ বেদীনোঁ কে দিল,
ইয়া রাসূলাল্লাহ কী কছরত কিজিয়ে।
“ক্রোধে জ্বলে যাক বেদীন জিগর;
‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ ধ্বনি বাড়াও নিরন্তর।”
অনুবাদের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল ভাষান্তর যেনো ভাবান্তর হয়ে না যায়, তবুও ভুল ভ্রান্তি হতেই পারে; ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির প্রত্যাশা থাকল। আমি মূলত কন্ঠশিল্পী, কথাশিল্প আমার সাধ ও সাধ্যের কর্ম নয়। তাই অক্ষমতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনাযোগে ইতি টানছি।
মা‘আসসালাম।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *