নানাজানের দৈনন্দিনের টুকিটাকিও ছিল অলৌকিকতায় ভরা

নানাজানের দৈনন্দিনের টুকিটাকিও ছিল অলৌকিকতায় ভরা
🖋️আমাতুল মুস্তফা ফাহিমা
নানাজান (রাদ্বি.)’র পুরো জীবনই ছিল অলৌকিকতায় পরিপূর্ণ। এক অলৌকিক সত্তা হিসেবে নানাজানকে উপলদ্ধির বয়স থেকেই তাঁর প্রতিটি বিষয় আমাকে আলোড়িত করতো। এমন এক মহানের আত্মজার মেয়ের এ ভাবনা দুরন্ত শৈশবের দুরন্তপনায় পদে পদে বাঁধা সাজতো। 
আজ নানাজানকে নিয়ে লিখতে বসলে হাজারো স্মৃতির ভিড়ে কোনটি রেখে কোনটি লিখি, সে চিন্তায় খেই হারিয়ে ফেলি। তবুও আমাকে লিখতেই হবে, এমন অদম্য স্পৃহা ও সম্পাদক মামার চাপে কাঁচা হাতের এলোমেলো কিছু কথা পাঠকদের সামনে হাজির করলাম। 
ক. তখন আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। থাকতাম নানার বাড়িতে। একদা আসরের পর হাতের লিখা প্রস্তুতের জন্য পড়ার টেবিলে গিয়ে দেখি আমার কলমটি নেই। কলম না পেয়ে স্বগতোক্তি করছিলাম যে, একটি কলম পর্যন্ত যথাস্থানে পাইনা; কি লিখা-পড়া করবো? পুরো ঘর খুঁজে নিজের কিংবা অন্যের কোন কলমই  না পেয়ে রাগে-ক্ষোভে বকাবকি করতে লাগলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে নানাজান এসে বললেন, মসজিদে গিয়েছিলাম কতক্ষণ অবস্থানের জন্য, ফাহিমার জন্য পারলাম কৈ? সে-তো কলমের জন্য বাড়ি-ঘর মাথায় তুলতে শুরু করেছিল। ‘এই ধর তোর কলম নেয়’। এতে আমি যতইনা লজ্জিত হয়েছি, তার চেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হলাম। নানাজান কলম নিলেন, আর আমি না জেনে বকাবকি করলাম; এ জন্য লজ্জার সাথে সাথে বিস্মিত হলাম যে, আমার আওয়াজতো মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছার কথা নয়, তবুও নানাজান শুনলেন কী করে!
খ. একদা নানাজান আমাদের বাসায় আসলেন। তখন আমরা চট্টগ্রাম নাজির পাড়ার হীরাবানু ম্যানসনে ভাড়ায় থাকতাম। প্রচণ্ড গরমের দিন। বিদ্যুৎ গেলতো আসার নামগন্ধ থাকতোনা; এটাই নিত্য-নৈমিত্তিক ছিল। সে দিনও মাগরিবের সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। শুরু হয় গরম ও মশার যন্ত্রণা। আমি হাত পাকা নিয়ে নানাজানকে বাতাস করতে থাকি। নানাজান ‘কা-রণ এখন-অ ন আইলজি না’ অর্থাৎ (কারেন্ট এখনও আসলনা যে) বলতেই বিদ্যুৎ এসে গেল। প্রাত্যহিক নিয়মের বিপরীত বিদ্যুৎ এসে পড়ায় আমি বিস্ময় অনুভব করি। এতে নানাজান বললেন, কাউকে বলোনা। আমি রুম হতে বের হয়েই নিষেধের কথা বেমালুম ভুলে সবাইকে বলে দিই। 
গ. ২০১১ সনের ১৪ জুন মঙ্গলবার আমার জীবনের সর্বোপরি বেদনার্ত একটি দিবস। ওই দিন সুবহে সাদিকের সময় নানাজান আমাদের ছেড়ে আপন প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন। ক’দিন আগেই নানাজানকে দেখে এসেছিলাম আবার ফোন পেয়ে অতি প্রত্যুষে সপরিবারে নানার বাড়ি যাত্রাকালেও মনে আসেনি যে, নানাজান আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। এমনকি বাড়ির কাছে এসে লোকজনকে কাঁদতে দেখেও তা মনে হয়নি। নানাজানের হুজরায় প্রবেশ মাত্রই নিদারুণ বিদায়ানুভূতিতে হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। সবার চোখে পানি। কেউ সরবে কেউ নীরবে কাঁদছে আর কাঁদছে। কারো নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার ২টা পর্যন্ত নানাজানের খাট মোবারকের পাশে বসে অবিরাম অঝোর কান্নায় বুক ভাসাতে থাকি। আর এক ঘন্টা পর নানাজানকে চোখের সম্মুখ হতে নিয়ে যাওয়া হবে ভাবনায় বুকফাটা শব্দ বেরিয়ে এলে নানাজান বললেন, ‘আহা এনকা লা’লি’ অর্থাৎ (আহা এমন কেন করছিস)। এতেই আমার কান্না থেমে গেল, অশ্রু বন্ধ হয়ে গেল। নানাজান প্রদত্ত সান্ত্বনায় পূর্ণ শান্ত হয়ে গেলাম। আজও নানাজানের অনুপস্থিতি অনুভূত হতেই আমি যেন ওই সান্ত্বনা বাণী শুনতে পাই। 
এক অপরিপক্কের স্মৃতি হাতড়ানো কাঁচা লেখাটি কারো বিরক্তি-উদ্রেকের কারণ হলে; আমি ক্ষমাপ্রার্থী। নানাজানের ‘কাউকে বলোনা’ সাবধান বাণী তাঁর পার্থিব জীবনে নিজেকে গোপন রাখার জন্য হলেও আজও স্মৃতিতে অম্লান অনেক অলৌকিকতা প্রকাশে আমি দ্বিধান্বিত তাই এখানেই ইতি টানছি। 

Sharing is caring!

1 thought on “নানাজানের দৈনন্দিনের টুকিটাকিও ছিল অলৌকিকতায় ভরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *