ঈদে মীলাদুন্নবী আজ

ঈদে মীলাদুন্নবী আজ

✍️ আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর।

সব জগতের সর্বত্র আজ নূরেতে উজ্জ্বলরে:

সর্বজগতের প্রাণ,সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলী ওয়া সাল্লামা’র শুভ আবির্ভাব বা ধরাধামে আগমন লগ্নে সবকিছু নূরে ডুবে গেল; জগৎময় যেন নূরের বান ডাকিল। নভোমণ্ডল ভূমি পানে ঝুঁকে পড়ল; ঠিক যেন কারো চরণ চুমিতে চায়। এ ইনক্বিলাব বা বিপ্লব কেবল অনুভব ছিলনা; বরং এক সুস্পষ্ট বাস্তবাতার প্রকৃত চিত্রই ছিল।

ক. উম্মে উসমান ফাত্বিমাহ বিনতে আব্দিল্লাহ সক্বফী ওই সময় হযরত আমিনাহ (রা)’র নিকট উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঈমানজ্যোতি বিচ্ছুরক অত্যাশ্চার্য এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।
اخرج البيهقى والطبرانى وأبو نعيم وابن عساكر’ عن عثمان بن أبى العاص قال حدثنى أمى أنهاشهدت ولادة أمنة أم رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة ولدته قالت فما شيى أنظر اليه فى البيت الا نور وأنى لأنظر الى النجوم قد تدنو حتى أنى لأقول ليقعن على لما وضعت خرج منها نور أضاء له البت والدار حتى جعلت لا أرى الا نور-

বায়হাক্বী, ত্ববরানী, আবূ নু’আয়ম ও ইবনু আসাকীর সংকলন করেছেন, উসমান বিন আবীল আস বর্ণিত, তিনি বলেন,আমার মা আমাকে বলেন যে, তিনি রাসৃলুল্লাহ (দ)’র আবির্ভাব রজনী  নবীজননী আমিনাহর নিকট উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমি ঘরের যে বস্তুই দেখছিলাম, নূর আর নৃরই ছিল। আমি তারকারাজি নিকটে আসতে দেখলাম; এমনকি আমি সবিস্ময়ে বললাম, এ গুলো আমার ওপর টুটে পড়বে! অতএব হযরত আমিনাহ যখন প্রসব করলেন,তার থেকে নূর নির্গমন করল;যাতে ঘর-দোর সব আলোকিত হয়ে গেল। এমনকি আমি নৃর ছাড়া কিছুই দেখছিলামনা।
সূত্রঃ আল্ খাসায়িসুল কুবরা, প্রথম খণ্ড,৮১পৃষ্ঠা, দারুত তাওফীকিয়্যাহ লিততুরাস।
খ. নূরনবীর নূরে রওশন জগতের প্রতিটি অণু। ধরাধামে আগমনের শুভমুহূর্তে দীপ্ত দীপ্তি সম্পর্কে স্বয়ং মা আমিনাহ (র)’র অভিব্যক্তি একটু অনুধাবন করুন।
رأيت كأن شهابا خرج منى أضأت له الارض
আমি দেখলাম যে, যেন একটি রশ্নি আমার থেকে বেরুল; যাতে পুরো জগত উজ্জ্বল হয়ে গেল।
সূত্রঃ আত্ত্বাবক্বাতুল কুবরা লি-ইবনি সা’আদ প্রথম খণ্ড, ৮১-৮২ পৃষ্ঠা; আল্ খাসায়িসুল কুবরা লিস্সুয়ূতী প্রথম খণ্ড, ৮২পৃষ্ঠা।
গ. واخرج الحاكم وصححه والبيهقى عن خالد بن معدان عن اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم أنهم قالوا يا رسول الله أخبرنا عن نفسك فقال ((دعوة أبى ابراهيم وبشرى عيسى ورأت أمى حين حملت كانه خرج منها نور أضأت له بصرىٰ من أرض الشام-))
হাকিম ও বায়হাক্বী খালিদ বিন মা’দানের সূত্রে রাসূলুল্লাহ (দ)’র সাহাবীগণ থেকে বর্ণনা করেন, সাহাবায়ে কিরাম (রা) বললেন,ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনার ব্যক্তি সত্তা সম্পর্কে আমাদের বলুন। প্রত্যুত্তরে তিনি (দ) বললেন, “আমার পিতা ইব্রাহীমের দু’আ, ঈসার সুসংবাদ এবং আমার মা যখন গর্ভ ধারণ করেন, তখন দেখেন যে, তাঁর থেকে যেন নূর বের হয়েছে,যাতে শামদেশের বসরা আলোকিত হয়ে গেল”। আল খাসায়িসুল কুবরা প্রথম খণ্ড, ৮১ পৃষ্ঠা।
ঘ. وأخرج ابن سعد وابن عساكر عن ابن عباس أن أمنة قالت لقد علقت به فما وجدت له مشقة حتى وضعته فلما فصل منى خرج معه نور أضاء له ما بين المشرق الى المغرب ثم وقع على الارض معتمدا على يديه ثم أخذ قبضة من تراب فقبضها ورفع رأسه الى السماء
ইবনু সা’দ ও ইবনু আসাকির ইবনু আব্বাসের সূত্রে বর্ণনা করেন, আমিনাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আমি গর্ভবর্তী হলাম, কিন্তু শুরু থেকে তাঁকে জন্মদান পর্যন্ত কোন কষ্ট অনুভব করিনি। তাঁর আগমন হল নূর সমভিব্যাহারে; যার আলোতে পূর্ব-পশ্চিম মধ্যবর্তী সবকিছু আলোকিত হয়ে গেল। তিনি দু’হাতে ভর করে ভূমিতে আগমন করেন। ভূপৃষ্ঠ হতে মাটি মুষ্টি ভরে নেন এবং আকাশের দিকে মস্তক মুবারক উত্তোলন করলেন। সূত্রঃ প্রাগুক্ত ৮২ পৃষ্ঠা।
ঙ. মা আমিনাহ (র) থেকে একটি বর্ণনা এ শব্দে বর্ণিত,
أضاءت له قصور الشام واسواقها حتى رأيت أعناق الابل ببصرىٰ-
ওই নূরে শামদেশের দালান ও বাজার আলোকিত হয়ে গেল; এমনকি আমি বসরাস্থ উটের গর্দন দেখতে পেলাম। সূত্রঃ আস্সিরাতুল হালবিয়্যাহ, প্রথম খণ্ড, ৯১ পৃষ্ঠা।

কচি মুখে শাহাদতের বাণী সে শুনায়ঃ
আল্লাহর হাবীব,বিশ্বমানবতার পরম দিশারী, নবীকুল সম্রাট সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম ধরাধামে আসামাত্র আল্লাহর একত্ব ও আপন রিসালতের সাক্ষ্য দেন।
انه صلى الله عليه وسلم لما وقع على الارض رفع رأسه وقال بلسان فصيح لا اله الا الله وأنى رسول الله-
রাসূলুল্লাহ (দ) যখন ভূমিতে তাশরীফ আনলেন,তখন আপন নূরানী মস্তক মুবারক উত্তোলন করলেন এবং বিশুদ্ধ ভাষায় বললেন, আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য নেই; এবং আমি আল্লাহর রাসূল। সূত্রঃ তারীখুল খামীস প্রথম খণ্ড ২০৩ পৃষ্ঠা।

আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধুসর সাহারায়:
عن عمرو بن قتيبة قال: سمعت أبي وكان من أوعية العلم قال: لما حضرت ولادة آمنة قال الله لملائكته افتحوا أبواب السماء كلها وأبواب الجنان كلها، وأمر الله الملائكة بالحضور، فنزلت تبشر بعضها بعضا، وتطاولت جبال الدنيا، وارتفعت البحار وتباشر أهلها، فلم يبق ملك إلا حضر وأخذ الشيطان فغل سبعين غلا وألقي منكوسا في لجة البحر الخضراء، وغلت الشياطين والمردة، وألبست الشمس يومئذ نورا عظيما، وأقيم على رأسها سبعون ألف حوراء في الهواء ينتظرون ولادة محمد ، وكان قد أذن الله تلك السنة النساء الدنيا أن يحملن ذكورا كرامة لمحمد ، وأن لا تبقى شجرة إلا حملت ولا خوف إلا عاد أمنا، فلما ولد النبي ؟ امتلأت الدنيا كلها نورا و تباشرت الملائكة، وضرب في كل سماء عمود من زبرجد، وعمود من یاقوت قد استنار فهي معروفة في السماء قد رآها رسول الله : ليلة الإسراء، قيل : هذا ما ضرب لك استبشارا بولادتك، وقد أنبت الله ليلة ولد على شاطئ نهر الكوثر سبعين ألف شجرة من المسك الأذفر جعلت ثمارها بخور أهل الجنة، وكل أهل السموات يدعون الله بالسلامة
و نكست الأصنام كلها، وأما اللات والعزى فإنما خرجا من خزانتهما وهما يقولان: ویح قریش جاءهم الأمين جاءهم الصديق لا تعلم قریش ماذا أصابها، وأما البيت فأياما سمعوا من جوفه صوتا وهو يقول: الآن يرد علي نوري الآن يجيئي زواري، الآن أطهر من أنحاس الجاهلية، أيتها العزى هلكت، ولم تسكن زلزلة البيت ثلاثة أيام ولياليهن، وهذا أول علامة رأت قريش من مولد رسول الله .
হযরত আমর বিন কুতাইবাহ বলেন, আমার বাবা ছিলেন জ্ঞানের আধার, আসমানী কিতাবের জ্ঞানী, তিনি বলেন, আমিনাহর সন্তান আবির্ভাবের সময় উপস্থিত হলে আল্লাহ ফিরিশতাদের বলেন, আসমানের সকল দরজা খুলে দাও এবং বেহেশতের সকল দ্বার উম্মুক্ত করে দাও। আল্লাহ ফিরিশতাদের সেথায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। অতএব তারা অবতরণ করলেন এবং একে অন্যকে সুসংবাদ দিতে লাগলেন। জগতের পাহাড়সমূহ (খুশিতে) প্রলম্বিত হল, সমূদ্রসমূহ (আনন্দে) উদ্বেলিত হল এবং জগতবাসী পরস্পরে মুবারকবাদ দিতে লাগল। কোন ফিরিশতা বাকি রইলেননা, সকলই উপস্থিত হলেন। ইবলিসকে সত্তরটি জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে নীল সাগরের খরস্রােতে উল্টো লটকিয়ে দিল এবং অন্যান্য বিতাড়িত শয়তানকেও শিকলাবদ্ধ করা হল। ওই দিন সূর্যকে নূরের শানদার চাদর পড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর (আমিনাহর) শিয়রে শূন্যে সত্তর হাজার হুর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা মুহাম্মদ (দ.)’র আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করছিলেন। …… এমন কোন বৃক্ষ ছিলনা, যা ফলে-ফুলে ফলবন্ত হয়নি, এমন কোন ভয়-শঙ্কা ছিলনা, যা নিরাপত্তায় রূপ নেয়নি। যখন নবী করীম (দ.) আগমন করলেন, পুরো দুনিয়া আলোতে ভরে গেল। ফিরিশতারা একে অন্যকে মুবারকবাদ দিলেন। প্রত্যেক আসমানে যবরজদের একটি এবং ইয়াকূতের একটি করে স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা হল, যাতে আলো উদ্ভাসিত হল; ওই স্তম্ভগুলো আসমানে সুপরিচিত। রাসূলুল্লাহ (দ.) মি’রাজ রাতে তা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁকে বলা হল, এ গুলো আপনার আবির্ভাবের খুশিতে স্থাপিত হয়েছে। মীলাদের রজনীতে হাওদ্বে কাওসারের কূলে আল্লাহ তা‘আলা সত্তর হাজার সুবাসিত কস্তুরী বক্ষ উৎপন্ন করেন, যার ফল জন্নাতবাসীদের জন্য ধূপের কাজ দিবে। ওই রাত আসমানবাসীরা আল্লাহর দরবারে সালামতের দু‘আ করতে রইল। মূর্তিসকল মুখ থুবড়ে পড়ল। লাত ও উজ্জার শয়তান আপন আসন ছেড়ে বেরিয়ে চিৎকার করতে লাগল যে, কুরাইশরা জানেনা যে, তারা কোন অবস্থায় পৌঁছে গেল, সিদ্দীক ও আমীন তাশরীফ এনেছেন। বায়তুল্লাহর ভিতর থেকে কয়দিন ধরে এ আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল যে, এখন আমার রওশনি ফিরিয়ে দেওয়া হবে, আমার যিয়ারতকারীরা নূতন করে আসবে, আমাকে অজ্ঞতার অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করা হবে, হে উজ্জা তোমার ধ্বংস অনিবার্য। লাগাতার তিন দিন তিন রাত বায়তুল্লাহ’র আনন্দ নৃত্য বন্ধ হয়নি। এটি প্রথম নিদর্শন; যা কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (দ.)’র মীলাদে প্রত্যক্ষ করেছে। (সূত্র: আল্ খাসায়িসুল কুবরা ১ম খ- ৮৩-৮৪ পৃষ্ঠা, দারুত্ তাওফীকিয়্যাহ লিত্তুরাস)।

রাসূলুল্লাহ (দ.)’র আগমনে একদিকে মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত হৃদয়ের উচ্ছ্বাস, অপরদিকে বিনাশের শঙ্কায় শঙ্কিত মনের ভয়ার্ত মাতমের কিঞ্চিৎ চিত্র ওপরে অঙ্কিত হয়েছে। বর্তমানে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.)’র আগমনেও ঠিক একই অনুভব-অনুভূতির প্রতিফলন শ্রেণী ভেদে পরিদৃশ্যত। বস্তুতঃ ফিরিশতা স্বাভাব আর শয়ত্বান চরিত্র নিরূপণের এটি যথার্থ এক নিক্তিই বটে।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *