দরবারে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার আদব (বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবধেয় ক’টি দিক)

আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর

সমূহ প্রশংসা প্রশস্তি আল্লাহরই জন্য। দুরূদ-সালাম আল্লাহর মাহবূব হুযূর করীম রউফুর রহীম সর্বসৃষ্টির মূল মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম’র প্রতি নিবেদিত। তাঁর পূতপবিত্র আল ও শুভ্রচিত্ত আসহাব সকলের তরেও সালাতুস সালামের অর্ঘ্য উৎসর্গিত।
‘ব-মুস্তফা বরসাঁ খেশরা কেহ দ্বীন হামা উস্ত;
আগার বাউ নরসীদি তামাম বূলাহবী আস্ত’।
‘নবীর সনে বাঁধ নিজে দ্বীন স্বয়ং তাঁর সত্ত্বা;
যদি না মজ তাঁর মাঝে সবই আবূলাহাবী ভূক্ত’
(আরমগানে হিজায, ড. আল্লামা ইকবাল ৪৯ পৃষ্ঠা)
দরবার এ মুস্তফা (দ.)’র আদব রক্ষায় সর্বদা সজাগ থাকা আবশ্যক। এখানে ন্যূনতম অমনোযোগিতার পরিণতিও ভয়াবহ। কভুও যদি অশিষ্টতা প্রকাশ পায় তবে ঈমান-আমল সবই যাবে রসাতলে। মহাগ্রন্থ আল্ কুরআনের সূরা হুজুরাত’র ২নং আয়াত মর্মে বিঘোষিত, ‘এতে তোমাদের আমলসমূহ তোমাদের অজান্তেই বিফলে যাবে’।
ওই মহান দরবারের আদব শেখার জন্য তাঁরই সাহচর্যধন্য সাহবায়ে কেরামের শিষ্টাচার পদ্ধতি নিরীক্ষণ জরুরি। এ আদবের উপমা জগতের কোন রাজদরবারে মিলেনা। যা অবলোকনে হুদায়বিয়ার সন্ধির আলোচনা কালে কুরাইশদের প্রতিনিধি ওরওয়াহ ইবনে মাসউদ (যিনি তখনও ঈমান আনেননি) যে মন্তব্য করেন তা একটু পর্যবেক্ষণ করুন। ‘অতঃপর ওরওয়াহ গভীর দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ (দ.)’র সাহবীদের পর্যবেক্ষণ করছিল। বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ! রাসূলুল্লাহ (দ.) থুথু ফেল্লেই তা তাঁদের (সাহবীদের) কোন না কোন ব্যক্তির হস্ততালুতেই পড়ে; আর সে তা দ্বারা তাঁর মুখ ও শরীর মর্দন করেন। তিনি যখন তাঁদের (সাহবীদের) কোন কাজের আদেশ দেন, তা পালনে তারা দ্রুত ছুটে যান এবং তিনি যখন ওযু করেন তাঁর ওযুর অবশিষ্ট পানির কাড়াকাড়িতে যুদ্ধের উপক্রম হয়। আর তিনি যখন কথা বলেন তাঁরা তাঁর সমীপে তাঁদের স্বর নীচু করে নেন এবং তাঁর সম্মানে চোখ তুলে তাকান না। ওরওয়াহ (ওই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে) তার সাথীদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে বলল, হে লোকেরা। আল্লাহর শপথ! আমি (বহু) রাজা-বাদশাহ’র দরবারে গিয়েছি, আমি রোম সম্রাট, পারস্য সম্রাট ও আবিসিনিয়ার শাসনকর্তার দরবারেও গিয়েছি, আল্লাহর কসম! আমি কোন বাদশাহ’র মোসাহেবদের দেখিনি বাদশাহকে এত সম্মান করতে, যত সম্মান মুহাম্মদ (দ.)’র সাহবীগণ মুহাম্মদ (দ.)’কে করেন। আল্লাহর শপথ! তিনি থুথু ফেললেই তা তাঁদের (সাহবীদের) কারো না কারো হাতের তালুতেই পড়ে, আর সে ব্যক্তি তা দ্বারা তাঁর চেহরা ও শরীর মালিশ করেন। যদি তিনি তাঁদের আদেশ দেন, তাঁর আদেশ পালনে তাঁরা দ্রুত ছুটে যান। তিনি যখন ওযু করেন, তাঁর ওযুর অবশিষ্ট পানি নেওয়ার জন্য তাঁদের মাঝে যুদ্ধের উপক্রম হয়। তিনি যখন কথা বলেন, তাঁরা তাঁর প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকান না’। (সহীহ বুখারী শরীফ ১ম খণ্ড, একাদশ পারা, কিতাবুশ শুরূতি, বাবুশ শুরূতি ফীল জিহাদি ওয়াল্ মুসা-লাহাতি মা‘আ আহলিল্ হারবি ওয়া কিতাবাতিশ্ শুরূতি মা‘আন্নাসি বিল্ কওলি-৩৭৯ পৃষ্ঠা, আল খাসায়িসুল কুবরা ১ম খণ্ড (উর্দু) ৪৫৩ পৃষ্ঠা, আসাহুস্ সিযর ১৭৩ পৃষ্ঠা ও সাহবাহ কা ইশকে রাসূল ২৭-২৮ পৃষ্ঠা)।
ওটি এমন এক স্থান, যেখানে দম নিতেও আঁতকে ওঠেন সুলতানুল আরেফীন বায়েযীদ বুস্তামী ও সাইয়্যেদুত ত্বায়িফাহ জুনায়্যিদ বাগদাদী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা। কবি কতইনা সুন্দর বলেছেন,
‘আদব গাহাস্ত যেরে আসমাঁ আয্ আর্শ নাযুকতর;
কেহ নফস গুম করদাহ মী আয়দ জুনাইয়িদ বায়েযীদ ইঁ জা’।
অর্থাৎ ‘আকাশের নীচে আর্শ অপেক্ষাও সূক্ষ্মতর আদবের স্থান (দরবারে মুস্তফা)। এখানে বায়েযীদ ও জুনায়্যিদ শ্বাস হারিয়ে আসেন; অর্থাৎ শব্দ করে দম নেয়না’।
বিষয় বস্তুর অনুকূলে প্রতিটি দিকের আলোচনা এ ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়। বাংলা ভাষায় এ বিষয়ক রচনাবলীও ঢের রয়েছে বিধায় ব্যাপকতা পরিহার পূর্বক সময়ের চাহিদা মতো বিশেষ ক’টি দিকেই মনোনিবেশ করছি। এ প্রাসঙ্গিকতায় সূরা আননূর’র ৬৩নং আয়াতের উল্লেখ সঙ্গত মনে করি। ‘রাসূলের আহ্বান তথা রাসূলের ডাক কিংবা রাসূলকে আহ্বান করা, রাসূলের দু’আ অথবা রাসূলের জন্য দু’আকে তোমাদের পরস্পরের আহ্বান ও দু’আর মতো স্থির করোনা। নিশ্চয় আল্লাহ কারো আড়ালে চুপে চুপে বহির্গামীদের বিষয়ে অবগত। সুতরাং রাসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণকারীদের ভয় করা উচিৎ যে, কোন বিপর্যয় (পার্থিব জগতে) তাদের পেয়ে বসবে অথবা বেদনাদায়ক শাস্তি (পরকালে) তাদের ওপর আপতিত হবে’।
নমস্য পাঠক “দু’আর রাসূল” ছোট্ট শব্দ দু’টো রাসূলের পক্ষ থেকে আহ্বান, রাসূলকে আহ্বান, রাসূলের দু’আ ও রাসূলের জন্য দু’আ-এ চারটি অর্থ অন্তর্ভূক্তকারী। এটি আমার মুখের বুলি মাত্র নয় বরং বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের বিবৃতিতে আলোচিত। নিম্নে তা পর্যায়ক্রমিক ভাবে উপস্থাপিত হল।
ক.প্রথম অর্থে আয়াতের মর্মার্থ: ‘বিনা-অনুমতিতে প্রত্যাবর্তন এবং সাড়া দানে ঢিল ও উপেক্ষার বৈধতায় তোমাদের পরস্পরের আহ্বানের ওপর তোমাদেরকে তাঁর (রাসূলুল্লাহর) আহ্বানকে অনুমান করোনা’। (আত্তাফ্সীরাতুল্ আহমদীয়্যাহ ফী বয়া-নিল্ আয়াতিশ শরঈয়্যাহ্ মা’আ তফরী ‘আতিল মসা-য়িলিল ফিকহীয়্যাহ, শায়খ আহমদ মোল্লা জীওয়ান ৩৮৫ পৃষ্ঠা) অর্থাৎ পরস্পরের আহ্বানের ক্ষেত্রে সাড়া দেওয়া- না দেওয়া কিংবা বিলম্বে উপস্থিত ও বিনা-অনুমতিতে প্রস্থানের যে অবকাশ রয়েছে, আল্লাহর রাসূলের আহ্বানের ক্ষেত্রে সে ইখতিয়ার নেই; বরং আহ্বান মাত্রই সাড়া দেওয়া ফরয। আল কুরআনের অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মু’মিনগণ! আল্লাহ ও রাসূল (দ.)’র আহ্বানে হাজির হও, রাসূল যখন তোমাদের কে সে বস্তুর জন্য আহ্বান করেন, যা তোমাদেরকে জীবন দান করবে’। সূরা আনফাল ২৪ নং আয়াত সংক্ষেপিত। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতে দু’জন তথা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বলেছেন। অধিকন্তু স্পষ্ট যে, বিনা মাধ্যমে আল্লাহর আহ্বান আসে না। অতএব সুস্পষ্ট যে, রাসূল (দ.)ই আহ্বান করবেন এবং তাঁর আহ্বানই আল্লাহর আহ্বান। এজন্যই একটু পরে ‘ইযা দা’আকুম’ যখন ‘তোমাদেরকে আহ্বান করে’  একবচন এনে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বুখারী শরীফ কিতাবুত তাফসীরে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বিবৃত, ‘আবূ সাঈদ বিন মুয়াল্লা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নামায পড়তেছিলাম। এমতাবস্থায় আমার পাশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (দ.) গেলেন। তিনি (দ.) আমাকে আহ্বান করলেন। আমি তাঁর নিকট আসিনি, যাবৎ না নামায সমাপন করলাম। অতঃপর তাঁর খেদমতে উপস্থিত হই। তিনি (দ.) বললেন, তোমাকে আসতে বাঁধা দিয়েছে কিসে? আল্লাহ্ কি বলেননি যে, আল্লাহ্ ও রাসূলের আহ্বানে হাজির হও, যখন তিনি (দ.) ডাকবেন’। (বুখারী শরীফ ২য় খণ্ড, ৬৬৯ ও ৬৮৩ পৃষ্ঠা, মকতবায়ে মুস্তফায়ীয়া, দেওবন্দ, ইউপি-ইন্ডিয়া) উক্ত হাদীসে টীকায় রয়েছে, ‘তোমাকে আসতে বাঁধা দিয়েছে কিসে’? এর স্থলে আবূযর, ওসাইলী ও ইবনু আসাকি’র বর্ণনায়, ‘তোমাকে আমার নিকট আসতে বাঁধা দিয়েছে কিসে’? এবং শুরুতে ‘অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি নামায পড়তেছিলাম’ অতিরিক্ত রয়েছে। ‘অতঃপর নবী করীম (দ.) বললেন, আল্লাহ কি বলেননি?’ থেকে শেষ পর্যন্ত বুখারীর বর্ণনার অনুরূপ। অনেক ফুকাহা বলেন, ‘নবী (দ.)’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে খেদমতে উপস্থিত হলে নামায ভঙ্গ হবে না। কেননা, তাঁর (দ.) আহ্বানে সাড়া দেওয়াই নামায। হাদীসের বিবৃতিও এটি প্রমাণ করে’। (কুস্তালানী)।
উক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, নবী (দ.)’র আহ্বান আসা মাত্রই সাড়া দিতে হবে। আহুত ব্যক্তি যে অবস্থায় থাকুক না কেন? সাড়া দেওয়া অপরিহার্য। নামাযী নামায রেখে খেদমতে উপস্থিত হয়ে ফরমায়েশ আঞ্জাম দেবে; এতে নামায ভঙ্গ হবে না। কেনইবা নামায ভঙ্গ হবে? সে নামাযী কথা বলেছেতো কার সাথে বলেছে? তাঁরই সাথে বলেছে, যাকে নামাযে সালাম দেওয়া ওয়াজিব। তাশাহুদে রয়েছে “হে নবী (দ.) আপনার উপর সালাম”। কিন্তু অন্য কাউকে সালাম দিলে নামায ভঙ্গ হয়। কাবার দিক হতে বক্ষ ফিরিয়েছেতো কোন দিকে ফিরিয়েছে? তাঁরই পানে ফিরিয়েছে, যিনি কাবার ক্বিবলা। বাহরুল উলূম আল্লামা আবূল বরাকাত আব্দুল গণি কাঞ্চনপুরী (রা.) বলেন,
‘মক্কা মদিনা কো কিয়া খোদা তা‘আলার পূজস্থান,
সব কিবলো কা ক্বিবলা হুতুম পিয়ারে জানি মুহাম্মদ’।
সে গমন করেছেতো, কোন দিকে করেছে? বারগাহে মুস্তফার দিকেই; যা আইনে ইবাদত। কবি বলেন,
‘রিয়াযত নাম হে তেরী গলী মে আনে জানে কা
তাসাওউর মে তেরী রহনা ইবাদত উসকো কেহতে হেঁ।
‘তোমার গলিতে আসা-যাওয়ার নাম রিয়াযত হয়;
ধ্যানে তোমার বিভোর থাকা ইবাদত ওটাকে বলা হয়’।
নামাযীর ওযূ টুটে গেলে পানির দিকে গমন তার জন্য বৈধ। এতে কাবার দিক হতে বক্ষ ফিরে গেলে কিংবা অতিরিক্ত কাজ করলেও নামাযে মশগুল মর্মে গণ্য। আর হুযূরে আন্ওয়ার (দ.) তো আল্লাহর দয়ার সাগর। কুরআনে পাকের ঘোষণা, ‘হে রাসূল (দ.) আমি আপনাকে সমগ্র জগতের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি’। সুতরাং তার দিকে গমন করলে নামায ফাসেদ হবে কেন? বরং সে নামাযে নিয়োজিত হিসাবেই গণ্য হবে। বাকী নামায উক্ত নিয়্যতের উপরই আদায় করতে পারবে। না নূতন করে নিয়্যত করতে হবে? না শুরু থেকে আবার পড়তে হবে?
খ.দ্বিতীয় অর্থে আয়াতের মর্মার্থ: ‘তোমরা একে অপরকে নাম বা উপনামে যে রূপ ডাক, নবী (দ.) কে সে রূপ ইয়া মুহাম্মদ-ইয়া আবাল কাসিম বলে আহ্বান করো না। বরং মিহি স্বরে বিনয়, বিনম্র ও কোমলতায় ইয়া নবীয়্যাল্লাহ্, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ বলে আহ্বান করো’। (তাফসীরে জালালাইন, ৩০২ পৃষ্ঠা, কুতুবখানা রশীদীয়া, দেওবন্দ) এ আয়াতের টীকায় তাফসীরে সাভীর উদ্ধৃতিতে বিবৃত, ‘বরং পরিপূর্ণ আদব ও সম্মানের সাথে ভক্তি ও মর্যাদাপূর্ণ শব্দে ইয়া রাসূলাল্লাহ্, ইয়া নবীয়্যাল্লাহ্, ইয়া ইমামাল মুরসালীন, ইয়া রাসূলা রাব্বিল আলামীন, ইয়া খাতিমান্ নবীয়্যিন ও অন্যান্য সম্মানজনক শব্দে আহ্বান ও সম্বোধন করো’।
আত্ তাফসীরাতুল আহমদীয়্যাহ গ্রন্থে বিবৃত, ‘তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ডাকার মত তাঁর সম্বোধনকে নাম ধরে উচ্চ স্বরে ইয়া আহমদ! ইয়া মুহাম্মদ! নির্ধারণ করোনা, বরং ইয়া নবীয়্যাল্লাহ! ইয়া রাসূলাল্লাহ’র মত মহান উপাধিযোগে ডাক’। (৩৮৫ পৃষ্ঠা)
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী বিরচিত-আল খাসায়িসুল কুবরা গ্রন্থে বিবৃত, “আবূ নু’আইম বলেন, তিনি (দ.)’র বৈশিষ্ট্য সমূহের একটি হলো অন্যান্য নবীদের মতো তাঁকে নাম ধরে ডাকা তাঁর উম্মতের ওপর হারাম বা নিষিদ্ধ হওয়া। কেননা, অন্যান্য উম্মতগণ তাদের নবীদের নাম ধরে সম্বোধন করতেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘তারা বলল, হে মূসা! তাদের যেমন উপাস্যসমূহ রয়েছে, আমাদের জন্যও তেমন উপাস্য স্থির করো’। (সূরা আ’রাফ ১৩৮ নং আয়াত) ‘যখন হাওয়ারীগণ বলল, ‘হে মারয়াম তন্বয় ঈসা!’ (সূরা মায়িদাহ ১১২ নং আয়াত) অধিকন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মত তথা উম্মতে মুহাম্মদী (দ.) কে বলেন, ‘তোমরা পরস্পর পরস্পরকে যেরূপ আহ্বান করো, নবী (দ.) কে সেরূপ আহ্বান করোনা’।
আবূ নু’আইম দাহ্হাকের সূত্রে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা সংকলন করেন তিনি বলেন, তাঁরা ইয়া মুহাম্মদু! ইয়া আবিল কাসিম! বলে ডাকতেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী (দ.)’র সম্মানার্থে তাঁদেরকে এরূপ আহ্বান করতে নিষেধ করেন। অতএব, তাঁরা ইয়া নবীয়্যাল্লাহ ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ডাকেন।
ইমাম বায়হাকী আলকামাহ ও আস্ওয়াদ’র সূত্রে এ আয়াতের মর্ম বর্ণনায় বিবৃতি উদ্ধৃত করেন যে, তিনি বলেন, তোমরা ইয়া মুহাম্মদ বলো না বরং ইয়া রাসূলাল্লাহ্, ইয়া নবীয়্যাল্লাহ্ বল। আবূ নু’আইম হাসান ও সাঈদ বিন জুবাইর (রা.) হতেও অনুরূপ বর্ণনা সংকলন করেছেন’। (আল খাসায়িসুল কুবরা, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রা.) ওফাত ৯১১ হিজরী, ২য় খণ্ড-১৯০ পৃষ্ঠা, মুদ্রণ মরকযে আহলে সুন্নাত বরকাতে রেযা-গুজরাট)।
উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের কোথাও তাঁর হাবীবকে নাম ধরে আহ্বান করেননি। বরং ইয়া আইয়্যুহান্নাবীয়্যু, ইয়া আইয়্যুহার রাসূল, ইয়া আইয়্যুহাল মুদ্দাসসিরু ও ইয়া আইয়্যুহাল মুযযাম্মিলু বলে আহ্বান করেছেন। (প্রাগুক্ত, ১৯০ পৃষ্ঠা)।
সম্মানিত পাঠক! হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.)’র বর্ণনাটির প্রতি গভীর মনোযোগ দিন। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে, ‘তাঁরা (সাহাবায়ে কিরাম) নবী করীম (দ.)কে নাম-উপনামে ডাকতেন’। অতএব বুঝা যায়, এরূপ আহ্বান তখনও পর্যন্ত বৈধ ছিল। ‘অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আলোচিতআয়াত মর্মে তাঁর নবী (দ.)’র সম্মানার্থে এরূপ আহ্বান করতে নিষেধ করেন’। সুতরাং এ নিষেধাজ্ঞার অনুবলে পূর্ববর্তী বৈধতা রহিত হয়। ‘ফলে তাঁরা ইয়া নবীয়্যাল্লাহ, ইয়া রাসূলাল্লাহ ডেকেছেন’। পূর্বরূপ নাম উপনামে আর ডাকেননি। অধিকন্তু পূর্ববর্তী বর্ণনাসমূহ হাদীসে পাকে রয়েছে। তাই বলে ঐগুলো রহিত।
উল্লেখ্য যে, নবী করীম (দ.)’র প্রতি সম্বোধনের এ রীতি তাঁর জাহেরী জীবনে যেমন পাল্য ঠিক এখন, তেমন পালনীয়। আলোচিত আয়াতের টীকায় তাফসীরে সাভী’র উদ্ধৃতিতে জালালাইন ৩০২ পৃষ্ঠার ১০ নং পাদটীকায় বিবৃত, ‘আয়াত থেকে অবহিত হওয়া যায় যে, নবী করীম (দ.)’র ইহলৌকিক ও ওফাত-উত্তোর জীবনে সম্মান জ্ঞাপক নয় এমন সম্বোধন তার জন্য জায়েয নয়। সুতরাং জানা যায় যে, যে ব্যক্তি তিনি (দ.)’র সম্মানে-সম্বোধনে অবজ্ঞা করবে সে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত-কাফির’।
গ.তৃতীয় অর্থে আয়াতের মর্মার্থ: ‘নবী (দ.) কর্তৃক তাঁর প্রভুর সকাশে যে দু’আ, তাকে তোমাদের ছোট্টরা বড়দের নিকট, দরিদ্ররা ধনীর সমীপে যেরূপ আবেদন-নিবেদন কর, যা কখনো শুনা হয় আবার কখনো শুনা হয় না; এমন স্থির করো না। কেননা, তাঁর (দ.)’র দু‘আ আল্লাহর দরবারে শ্রুত ও গৃহীত’। (তাফসীরে সাভীর উদ্ধৃতিতে জালালাইন ৩০২ পৃষ্ঠার ১০ নং টীকা)।
‘তোমাদের বিপরীত তাঁর দু’আকে একে অপরের বিপক্ষে যে রূপ বদদু‘আ কর, যা কখনো কবুল হয় আবার কখনো হয়না; এমন স্থির করোনা। কেননা অবশ্যই তাঁর দু‘আ (আল্লাহর নিকট) শ্রুত ও কবুলকৃত’। (আত্ তাফসীরাতুল আহমদীয়্যাহ ৩৮৫-৩৮৬ পৃষ্ঠা)।
তিনি (দ.) কারো অনুকূলে কিংবা প্রতিকূলে যেরূপ দু‘আই করুন না কেন তা আল্লাহর দরবারে কবূল হয়ে যায়। অধিকন্তু তাঁর (দ.) দয়া স্বভাব হেতু কখনো কাউকে অভিশাপ দেননি বললেই চলে, তবে আশীর্বাদ দিয়েছেন প্রচুর। তাঁর (দ.) দু‘আ কবূল হওয়ার বিষয়ে বিবৃত বর্ণনা বিপুল সম্ভার হাদীসের পাতায় মেলে। কলেবরে বৃদ্ধির আশঙ্কায় নিম্নে শুধু দু’টি উপস্থাপিত হল।
(এক.) তিনি (দ.) হযরত ওমর (রা.)’র দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করার দু’আ করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। হাফেজ জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রা.) রচিত তারিখুল খুলাফা গ্রন্থের ৮৭ নং পৃষ্ঠায় বিবৃত ‘ইমাম হাকেম আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘নিশ্চয় নবী করীম (দ.) বলেন, হে আল্লাহ! বিশেষ করে ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) কে দিয়ে ইসলামকে শক্তিশালী কর’। তবরানী আওসতে হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা.) এবং কবীরে সাওবান (রা.)’র বরাতে উক্ত হাদীস বর্ণনা করেন’। (তারিখুল খুলাফা ৮৭ নং পৃষ্ঠা, আল্ মকতবাতুত্ দেওবন্দ)
প্রিয় পাঠক! আবূ জাহলের ঘোষিত পুরস্কারের মোহ ও নিজ ধর্মের সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে নবী করীম (দ.)কে হত্যা করার মানসে হযরত ওমর একদিকে তরবারী খাপ ছাড়া করলেন, অপরদিকে হযরত রহমতে আলম (দ.)’র নূরানী যবান থেকে উক্ত দু‘আর নির্গত হলো। একদিকে হযরত ওমরের কঠোরতার রুদ্রমূর্তি, অপরদিকে রহমতুল্লিল আলামীনের দয়ার বারিধারা। শেষতক বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পর নবী (দ.)’র দয়ার বন্যায় ভেসে গেল ওমরের সমুদয় রাগ। হৃদয়ে জন্মিল নবী (দ.) ও ইসলামের প্রতি প্রবল অনুরাগ। চরম শত্রু পরম বন্ধু হয়ে লুটে পল নূর নবীজির নূরানী চরণে, আশ্রয় নিল ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। মকামে নবূয়ত, ছাহেবযাদা সৈয়্যদ ইফতিখারুল হাসান যায়দী, ১৩৩-১৩৭ পৃষ্ঠার সার সংক্ষেপ)।
(দুই.) তাফসীরে রূহুল বয়ান ৪র্থ খণ্ড ১৪০ পৃষ্ঠায় বিবৃত, যখন সূরা ‘ওয়ান্নাজমি’ অবতীর্ণ হল, হুযূর করীম (দ.) পবিত্র হরম শরীফে কুরাইশদের সম্মুখে সূরাটি আবৃত্তি করলেন। তখন আবূ লাহাব তন্বয় উতাইবা বলল, ‘আমি এ সূরা অবতরণকারী প্রভুকে অস্বীকার করি’। সেসাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণসহ নূর নবীর নূরের ঠুকরো যে নবীযাদী তখনও তার বিবাহ বন্ধনে ছিলেন, তাঁকেও তালাক দিয়ে দিল। অতএব, নবী করীম (দ.) বললেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার কুকুরদের কোন এক কুকুর তার ওপর চড়াও করে দাও’। নবী (দ.)’র পবিত্র মুখ হতে বাক্য নির্গত হল, আর সময় অতিবাহিত হতে লাগল। কিছুদিন পর সে তার পিতা আবূ লাহাবের সাথে ব্যবসায়িক সফরে শাম অভিমুখে যাত্রা দিল। পথিমধ্যে তাঁদের কাফেলা এক জঙ্গলে তাবু স্থাপন করল। আবূলাহাব সফরসঙ্গীদের বলল, ‘তোমরা আমার ছেলে উতাইবাকে সারা রাত পাহারা দিয়ে রাখবে।’। সঙ্গীরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, ‘আমি আশঙ্কা করছি যে, মুহাম্মদ (দ.)’র দু‘আ তার ওপর আবর্তিত হবে’। আবূ লাহাবের কথা মতো কাফেলার যাত্রীরা চতুর্পাশে বিছানা বিছিয়ে উতাইবাকে মধ্যখানে শুয়ে দিল। কিন্তু অর্ধরাত অতিক্রমান্তে জঙ্গল হতে একটা সিংহ তাবুতে এল। সকলের মুখের ঘ্রাণ নিয়ে বুঝতে পারল যে, নবী (দ.)’র সাথে ঔদ্বত্যাচরণকারী এরা নয়। তাই তাদের ছেড়ে দিল। পরন্তু উতাইবার মুখের দুর্গন্ধ পেতেই টের পেল,এ বদবখতই আমার মুনিবের শত্রু। সুতরাং সাথে সাথেই তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিল, কিন্তু তার অপবিত্রতার কারণে তাকে ভক্ষণ করেনি। (মকামে নবূয়ত, ১৩৩ পৃষ্ঠা, মকতবায়ে নঈমীয়া, মুরাদাবাদ ইউপি)
ঘ.চতুর্থ অর্থে আয়াতের মর্মার্থ: তোমরা পরস্পর পরস্পরের জন্য যেরূপ দু‘আ করো, নবী (দ.)’র জন্য দু‘আ করাকে সেরূপ স্থির করো না। তাঁর জন্য দু‘আ করার বেলায় যেনতেন শব্দের ব্যবহার অনুচিৎ। যেমন- রহমত শব্দের প্রয়োগ ও ঈসালে সাওয়াব তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাঁর শানে সালাতুসসালামের সমার্থক দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহারও বর্জনীয়। তাঁর মহান দরাবারে হাদিয়া সালাতুসসালাম ও দ্ব্যর্থহীন শব্দমালা দ্বারাই হতে পারে।  আল খাসায়িসুল কুবরা গ্রন্থে বিবৃত, বিষয়ে ‘নবী করীম (দ.)’র বৈশিষ্ট্যসমূহ হতে একটি হচ্ছে তাঁর পদমর্যাদা তাঁকে তাঁর জন্য রহমতের দু‘আ থেকে উর্ধ্বে উপনীত করেছে। ইবনু আব্দিল বর বলেন, নবী (দ.)’র নাম মোবারক উচ্চারণ ও শ্রবণোত্তর ‘রহিমাহুল্লাহ্’ বা ‘আল্লাহ্ তাঁকে দয়া করুক’ বলা কারো জন্য বৈধ নয়। কেননা তিনি (দ.) ‘মন সল্লা আলায়্যা’ বা ‘যে আমার ওপর দুরূদ পড়ে’ বলেছেন; অথচ ‘মন তারাহ্হামা আলায়্যা’ বা ‘যে আমার ওপর রহমত বর্ষণ করে’ ও ‘মন দ’আ লী’ বা ‘যে আমার জন্য দু‘আ করে’ বলেননি। সালাত’র অর্থ রহমত হলেও তাঁর সম্মানার্থে সালাত শব্দটি নির্ধারিত। অতএব শব্দটি সমার্থবহ অন্য শব্দে রূপান্তরিত করা যাবে না। মহান আল্লাহর বাণী, ‘নবী (দ.)’র দু‘আকে তোমরা পরস্পরের দু‘আর মতো স্থির করো না’ আয়াতে উক্ত দাবির সমর্থন মিলে। ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেছেন, উক্ত ব্যাখ্যা উত্তম ও বিশুদ্ধ। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরবী আল মালেকী এবং ছায়দালানী আশশাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহিমাও অনুরূপ উল্লেখ করেছেন। ‘ইরশাদ’ ব্যাখ্যাতা আবূল কাসেম আনসারী (রহ.) বলেন, ‘রহমত’ শব্দের একক প্রয়োগ নবী (দ.)’র জন্য নাজায়েয। কিন্তু সালাত সহযোগে বৈধ। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘যখীরাহ’ গ্রন্থে ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)’র বরাতে বিবৃত, ‘নবী (দ.)’র শান সংকোচনের সম্ভাবনা হেতু ‘রহমত’ শব্দের প্রয়োগ মকরূহে তাহরীমি। কেননা, ‘রহমত’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি ও দণ্ডনীয় অপরাধের বেলায় ব্যবহার হয়ে থাকে’। আল্ খাসায়িসুল কুবরা, ২য় খণ্ড, ৪৫৮-৪৫৯ পৃষ্ঠা, বৈরুত-লেবানন।
শ্রদ্ধেয় পাঠক! উক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘রহমত’ সালাতের একার্থবোধক শব্দ। এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি ও দণ্ডনীয় কাজের বেলায় প্রযোজ্য। তাই এতে নবী (দ.)’র মান সংকোচিত হবে সম্ভাবনা বিদ্যমান। সুতরাং শব্দটি ব্যবহার নবী (দ.)’র জন্য নিষিদ্ধ। আসুন এ দৃষ্টিকোণে নবী (দ.)’র রূহে কিংবা রওযায় সাওয়াব পৌঁছানোর বিষয়টি একটু পর্যালোচনা করি। এ প্রাসঙ্গিকতায় প্রথমে ‘সাওয়াব’র সংজ্ঞা জেনে নিই। আল্লামা সৈয়্যদ শরীফ জুরজানী হানাফী (৭৪০-৬১৬) লিখেছেন,
সাওয়াব: যা দ্বারা আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘রহমত’ বা ‘দয়া’ ও ‘মাগফিরাত’ বা ক্ষমা এবং নবী (দ.)’র পক্ষ থেকে ‘শাফা‘আত’ বা ‘সুপারিশ’র যোগ্য হয়। (আত্তারীফাত, ৫৩ পৃষ্ঠা) এবার লক্ষ করুন, ‘হে আল্লাহ্ আমরা যা কিছু পড়েছি তার সাওয়াব তোমার হাবীব (দ.)’র রূহে বখশিশ কর কিংবা নবী (দ.)’র মাযার শরীফে পৌঁছে দাও’ বাক্যের অর্থ কি দাঁড়ায়? এ কথাই কি বলা হচ্ছে না যে, ‘হে আল্লাহ! তুমি তোমার হাবিব (দ.) কে দয়া ও ক্ষমার যোগ্য কর’। নাউযূবিল্লাহ! ‘রহমত’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি ও দণ্ডনীয় কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মর্মে আমরা পূর্বেই অবগত হয়েছি। এবার মাগফিরাত ও শাফা‘আত কি জন্য ব্যবহৃত হয়? তাও একটু পর্যবেক্ষণ করি।
‘অধীনস্থ হতে প্রকাশিত মন্দ কর্তৃত্ববান কর্তৃক গোপন করাই ‘মাগফিরাত’। সুতরাং প্রভুর তিরস্কারের ভয়ে দাস কর্তৃক মুনিবের মন্দ গোপনকে ‘মাগফিরাত’ বলা যাবে না’। (আত্তারীফাত, ১৫৫ পৃষ্ঠা)
‘অপরাধে জড়িত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধ হতে নিস্কৃতির আবেদন বা সুপারিশকে ‘শাফ‘আত’ বলে। আত্তারীফাত, ৯২ পৃষ্ঠা। সাওয়াব মানে যেহেতু রহমত, মাগফিরাত ও শাফা‘আত কামনা, সেহেতু নবী (দ.)’র জন্য সাওয়াব বখশিশ সমীচীন হবে কি?
প্রণাম্য পাঠক! অনেকে বলে থাকেন, আমরা বেশি করে পাওয়ার ও দু‘আ কবূল হওয়ার জন্য ‘সাওয়াব’ বখশিশ করে থাকি। বেশি করে পেতে কি হাদিয়া পাঠাতে হবে?  নূর নবীজির নূরানী যবানীতে শুনুন, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে আমার উপর একবার দুরূদ শরীফ পড়বে আল্লাহ তার উপর দশটি দয়া করবেন, তার দশটি পাপ মার্জনা করবেন এবং তার মর্যাদা দশস্তর উন্নীত করেন’। (মিশকাত শরীফ, ৮৬ পৃষ্ঠা, মেরাজ বুক ডিপো)।
দু‘আ কবুল হওয়ার জন্যতো হযরত আদম (আ.)’র প্রার্থনা হতে শুরু করে যুগ-যুগান্তরের সব দু‘আয় মহানবী (দ.)’র মহানামের ওসিলা নেওয়ার শিক্ষাই দীপ্যমান। তবুও এসব বাদ দিয়ে সওয়াব বখশিশের প্রতি এত ঝোঁক কেন? কোন বর্ণনায়তো এরূপ দেখা যায় না যে, সাওয়াব না পৌঁছালে দু‘আ কবূল হয়না। বরং এরূপ বর্ণনা রয়েছে, ‘হযরত ওমর (রা.) বলেন, দু‘আ আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে ঝুলন্ত থাকে, ওটার কোন অংশই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না; যাবৎ না আগে-পরে নবী (দ.)’র ওপর দুরূদ পড়া না হয়’। (মিশকাত শরীফ ৮৭ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতিতে মকামে নবূয়ত ১৪৯ পৃষ্ঠা)।
মাননীয় পাঠক! নবী করীম (দ.) স্বয়ং কি রূপ দু‘আর প্রণালী শিক্ষা দিয়েছেন? একটু দেখুন, ‘ফাদ্বালাহ বিন ওবাঈদ বলেন, নবী করীম (দ.) শুনেছেন যে, এক ব্যক্তি নামাযান্তে দু‘আ করছে কিন্তু নবী (দ.)’র ওপর দুরূদ পড়েনি। নবী করীম (দ.) বললেন, এ ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করেছে। অতঃপর তাকে ডেকেছেন। তারপর তাকে কিংবা অন্য একজনকে বললেন, তোমাদের কেউ যখন নামায সমাপন করবে তখন সে যেন আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান দ্বারা শুরু করে, অতঃপর নবী (দ.)’র ওপর সালাত পাঠ করে, তারপর যা চায় প্রার্থনা করে’। হাদীসটি হাসান সহীহ। (তিরমিযী শরীফ, ১ম খণ্ড ১৮৬ পৃষ্ঠা, কুতুবখানা রশীদিয়া, দেওবন্দ)।
উক্ত পদ্ধতিতে দু‘আ করায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)কে নবী করীম (দ.) বলেন, তুমি যা চাও তোমাকে দেওয়া হবে অর্থাৎ তোমার দু‘আ কবূল হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ ৮৭ পৃষ্ঠা, মেরাজ বুক ডিপো)।
পাঠক মহোদয়! অনেকে বলে থাকেন, আমরা হাদিয়া-তুহফা স্বরূপ সাওয়াব পৌঁছাই। তাঁদের চিন্তা করা উচিৎ যে, নবী (দ.)’র দরবারের হাদিয়া কি হওয়া চায়? এ বিষয়ে আল্লাহ্ আমাদেরকে কি শিক্ষা দিয়েছেন? তিনি কি বলেননি, ‘হে ঈমানদারগণ’! তাঁর নবীর ওপর দুরূদ ও উত্তমরূপে সালাম পেশ কর’। (সূরা আহযাব ৫৬ নং আয়াত সংক্ষেপিত)।
মান্যবর পাঠক! মহানবী (দ.)’র ইন্তিকালের পূর্বে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) নবী করীম (দ.)’র ইমামতিতে বহু নামাযে জানাযা পড়েছেন। কিন্তু নবী (দ.)’র ক্ষেত্রে সে পদ্ধতি অনুসরণ করেননি তাঁরা। বরং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রীতিতে নামায আদায় করেছেন। এ নামাযে না গতানুগতিক ধারার দু‘আ ছিল, না নবী ভিন্ন অন্য কারো ইমামতি। হযরত আলী (রা.) বলেন, নবী করীম (দ.) তোমাদের ইমাম ছিলেন এখনও তিনিই ইমাম। নর-নারী সকলই দলে দলে নামাযে শরীক হন। প্রথমে আহলে বায়ত-ই রাসূল (দ.) নামায আদায় করেন। অন্যরা বুঝতে পারেননি যে, কি পড়বেন? তাই তাঁরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি হযরত আলী (রা.) থেকে জেনে নিতে বললেন। তাঁরা হযরত আলী (রা.)কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর ফিরিশ্তাগণ নবী (দ.)’র প্রতি দুরূদ প্রেরণ করেন, হে ঈমানদারগণ তাঁর প্রতি দুরূদ ও উত্তম সালাম পেশ করো। হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা তোমারই সমীপে প্রার্থনায় নিয়োজিত যে, আলোকোজ্জ্বলকারী প্রদীপ, তোমারই পানে তোমারই নির্দেশে আহ্বানকারী সুসংবাদদাতা চাক্ষুষদর্শী, রাব্বুল আলামীনের রাসূল, মুত্তাকীদের ইমাম, রাসূলদের সম্রাট, সর্বশেষে নবী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ্ (দ.)’র প্রতি করুণাময় দয়ালু আল্লাহ, নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশ্তা, নবীগণ, সিদ্দিকীন, শহীদগণ, সালেহীন এবং হে রাব্বুল আলামীন তোমারই তাসবীহ পাঠরত সবকিছুর সালাত হোক বর্ষিত এবং তাঁর ওপর হোক নিষ্কলুষ সালাম’। (মাদারিজুন্নবূয়ত ২য় খণ্ড, ৭৪৯ পৃষ্ঠা (উর্দু), আসাহুস্ সিয়ার ৫৪২-৫৪৩ পৃষ্ঠা)।
উক্ত দু‘আটি মহানবী (দ.)’র সালাতে জানাযায় পঠিত দু‘আ। এ দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন, মুমিনদের মাওলা, জ্ঞাননগর মহানবী (দ.)’র জ্ঞান শহরের দরজা, খায়বর বিজেতা, হায়দরে কররার, ছাহেবে যিলফিক্বার, ইয়াদুল্লাহিল জব্বার, আসাদুল্লাহিল কাহ্হার আলী (রা.)। তিনি (রা.) কুরআনে পাকের আয়াত উদ্ধৃত করে সালাত আলান্নবী’র পদ্ধতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আয়াত মর্মে আল্লাহর নির্দেশের অনুকূলে প্রমাণিত যে, নবী (দ.)’র জন্য অন্যান্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র দু’আ হওয়া চায়। যে দু’আয় এমন কোন শব্দ থাকবে না, যা দ্বারা নবী (দ.)’র শান সংকোচিত হতে পারে। অতএব এরূপ দু‘আই তিনি শিক্ষা দিয়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা.) পড়েছেন। এতে আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্দেশিত পন্থায় সালাতুসসালামের হাদিয়াই নবী (দ.)’র প্রতি প্রদত্ত হয়েছে।
পাঠক বন্ধুরা! উক্ত দু‘আর প্রতিটি শব্দ ও বর্ণ গভীর মনোযোগে আরেকবার পড়ুন। অতঃপর জানাযার নামাযে ছানা ও দুরূদ ছাড়া অন্য যে দু‘আটি পড়া হয় তাও একবার স্মরণ করুন।
‘হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত-মৃত, উপস্থিত-অনুপস্থিত, ছোট-বড় ও নর-নারী সকলকে ক্ষমা কর। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যাকে জীবিত রাখ তাকে ইসলামের ওপর জীবিত রাখ আর আমাদের মাঝে যাকে মৃত্যু দান কর তাকে ঈমানের ওপর মৃত্যু দাও’। মৃতব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কলে যে দু‘আ পড়া হয় তাও লক্ষ্য করুন। ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য তাকে অগ্রগামী করে নাও এবং আমাদের জন্য প্রতিদানের ওসিলা ও সঞ্চিত ধন করে নাও। এবং আমাদের জন্য তাকে সুপারিশকারী ও গ্রহণযোগ্য সুপারিশ করে নাও’। এবার চিন্তা করুন, প্রাপ্ত বয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্কের দু‘আয় এ তারতম্য কেন? আবার নবী করীম (দ.)’র দু‘আ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কেন? এ নীতির অবলম্বনে নবী (দ.)’র জন্যতো সালাতুসসালামের হাদিয়া প্রেরণই সঙ্গত। তা না করে সাধারণ রীতি অনুসরণ করা হচ্ছে কেন? সাধারণের রূহে সাওয়াব পৌঁছানো হয়, নবী (দ.)’র জন্যও অনুরূপ ঈসালে সাওয়াব করা হচ্ছে কেন? সাওয়াবকে হাদিয়া বলা হোক কিংবা তুহ্ফা যা-ই বলা হোক না কেন, তা কিন্তু মাগফিরাত কামনারই অপর নাম। নবী করীম (দ.)’র জন্য ক্ষমা প্রার্থনার মার্জিত রূপ। নাউযূবিল্লাহ। যা জুরজানী কর্তৃক বিবৃত সাওয়াব’র সংজ্ঞা মর্মে আমরা অবগত হয়েছি। অতএব নবী (দ.)’র ক্ষেত্রে সাওয়াব শব্দের প্রয়োগ বর্জনীয়। উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, নবী করীম (দ.)’র দরবারের যথার্থ হাদিয়া-তুহ্ফা হচ্ছে সালাতুসসালাম। দু‘আ আল্লাহর দরবারে কবূল হওয়ার জন্য কিংবা আল্লাহর অনুগ্রহ বেশি করে পেতে এর বিকল্প নেই। সুতরাং নবী (দ.)’র রূহ মোবারকে সাওয়াব বখশিশ নয় বরং কদম মোবারকে আসুন সালাতুসসালামই নিবেদন করি। সম্মিলিত কণ্ঠে বলি,
‘হে মাওলা! তোমার হাবীব, সৃষ্টির মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (দ.)’র প্রতি সদাসর্বদা দুরূদ ও সালাম প্রেরণ কর।
হে মুমিনগণ! তাঁর প্রতি দুরূদ পড়, যেমন দুরূদ প্রেরণ করেছেন আল্লাহ এবং উম্মতদের সুপারিশকারী (দ.)’র উপর সর্বদা সালাম পেশ কর।
তাঁর সত্তার প্রতি সম্বন্ধ কর, যত চাও মর্যাদার এবং তাঁর মরতবায় যুক্ত কর সকল বুযুর্গীর।
হে সৃষ্টির সেরা! তুমি বিনে আমার এমন কেউ নেই, সর্বব্যাপী বিপদ আপতিত হবার সময় যে, আশ্রয় নেব’। (কসিদায়ে বুরদাহ)।
পাঠক মহাশয়! আল্লামা শরফুদ্দীন বুছুরী (রহ.) রচিত কসিদার উদ্ধৃত অংশে নবী করীম (দ.)’র সত্তা ও পদবীর সাথে মর্যাদা ও বুযুর্গীর সম্বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং নবী (দ.)’র উচ্চ মর্যাদা ও পবিত্র সত্তার সম্মানে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এমন শব্দাবলীর সম্বন্ধ অনুচিৎ। ঈসালে সাওয়াবের মাধ্যমে যারা এ অনুচিৎ কাজটিই করছে, তাদের খেদমতে পুনর্বিবেচনার নিবেদন রইল। বিতর্কের স্বার্থে স্থূল-যুক্তির অবতারণা নয়, আযমতে মুস্তফা লক্ষ্যে ভক্তির অনুপ্রেরণাই প্রত্যাশিত।
শানে মুস্তফা (দ.)’র শব্দ চয়নে প্রান্তিক সচেতনতা অপরিহার্য। এখানে একটু এদিক ওইদিক হলেই বেখবরে ঈমান-আমল নিস্ফল হয়ে যায়। সুতরাং দরবারে মুস্তফা (দ.)’র আদব রক্ষায় ফতওয়া নয়, তাক্ওয়াই অবলম্বনীয়। ফত্ওয়ার মারপ্যাঁচে নবী (দ.)’র জন্য ঈসালে সাওয়াবের বৈধতা হয়তো প্রমাণ করা যেতে পারে, কিন্তু তাক্ওয়ার প্রশ্নে সে সুযোগ নেই। কেননা, মুত্তাকী হওয়ার জন্য দৃশ্যত অসুবিধা নেই এমন কাজও অসুবিধার আশঙ্কায় বর্জন করা জরুরী। (মিশকাত শরীফ ২৪২ পৃষ্ঠা) নবী (দ.)’র জন্য হাদিয়া-তুহ্ফা অর্থে ঈসালে সাওয়াব কেউ কেউ দোষের মনে না করলেও প্রকারন্তে শানে মুস্তফায় শিষ্টাচার লংঘন হয় বিধায় দোষনীয়। এ বিষয়ক ধারণা পূর্বোক্ত আলোচনা হতে আপনারা অবশ্যই লাভ করেছেন। এবার নবী (দ.)’র জন্য ঈসালে সাওয়াবের আক্বিদা যে ক্রমান্বয়ে বাতিল আক্বিদার প্রতি টেনে নিচ্ছে, এরূপ একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বিদা-বিশ্বাস মতে রাসূলুল্লাহ (দ.) মা‘ছুম বা নিষ্পাপ তথা দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে। সুন্নী মাত্রই এ আক্বিদায় বিশ্বাস করে এবং নবী (দ.)কে যারা দোষে গুণে মানুষ বলে, তাদেরকে বাত্বিল ফিরক্বার অন্তর্ভুক্ত বলেই জানে। দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, নবী (দ.)’র জন্য হাদিয়া-তুহ্ফা স্বরূপ ঈসালে সাওয়াব দর্শনে বিশ্বাসী ‘সুন্নিয়া ট্রাস্ট’ তাদের শাখা সংগঠনের পরিচিতি জ্ঞাপক এক প্রকাশনায় দোষ গুণের দর্শনকে জোরালো সমর্থন যোগাতে দেখা যায়। তাঁদের ভাষায় ‘এক অদ্বিতীয় গ্রন্থ’ এর গুরুত্ব বর্ণনায় রয়েছে, ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামার’র — গুণাগুণ (গুণ ও দোষ) — বর্ণনাসহ — এক অপূর্ব বর্ণনা সম্ভার’। উদ্ধৃত শব্দমালায় প্রশংসিত গ্রন্থটি আমার পুরো পাঠগত হয়নি; সুতরাং তাতে মা‘ছূম নবী (দ.)’র গুণের সাথে ‘অগুণ’ ও বিবৃত কিনা, জানিনা। তাঁদের বর্ণনা মতে যদি হয়ে থাকে, তবে ওই গ্রন্থ ও গ্রন্থকার বাতিল বলে পরগণিত এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কর্তৃক পরিত্যক্ত হতে বাধ্য। আর যদি ‘অগুন’ বর্ণনা না হয়ে থাকে, তবে এটি উক্ত গ্রন্থ ও গ্রন্থকার মহোদয়ের ওপর জঘন্য অপবাদই বটে। গ্রন্থ ও গ্রন্থকার বিষয়ক ফয়সালা যা-ই হোক, তবে প্রকাশক সংস্থা নবী (দ.)’র ক্ষেত্রে “গুণাগুণ” শব্দের প্রয়োগ জ্ঞাতে করলে অন্যান্য বাতিল ফিরক্বার জন্য প্রযোজ্য ফত্ওয়া আর অজ্ঞাতে করলে বেখবরে সমুদয় আমল নিস্ফলের সূরা হুজুরাতের ২নং আয়াতে আল্লাহ ঘোষিত ওয়’ঈদ কার্যকর হবে। সর্বোপরি ওই ট্রাস্টের সাথে আলেম-ওলামাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের সংশ্লিষ্টতা হেতু জ্ঞানীদের ইন্তিকালের মাধ্যমে জ্ঞান তুলে নেওয়ার এ যুগে নবপ্রজন্ম ওই বাতিল আক্বিদাকে ‘সুন্নিয়ত’ ভাবতে শুরু করবে এবং ক্রমান্বয়ে সুন্নী এলাকা বাতুলতার জোয়ারে প্লাবিত হবে। সুন্নীদের প্রকাশনায় নবী (দ.)’র শানে ‘গুণাগুণ’ (গুণ ও দোষ) শব্দের প্রয়োগ নবী (দ.)’র জন্য ঈসালে সাওয়াব সাব্যস্তের দর্শনের কুফলসমূহের বহিঃপ্রকাশ বলে আমার ধারণা। সুতরাং নবী (দ.)’র ক্ষেত্রে ঈসালে সাওয়াব এখনই বর্জন করে সালাতুসসালামের হাদিয়া-তুহ্ফা প্রেরণ এবং নবী (দ.)’র উসিলায় দু‘আ কবুলের ফরিয়াদে মনোনিবেশ অত্যাবশ্যক।
নবী করীম (দ.) কে নাম ধরে ডাকা কিংবা তাঁর প্রতি সাওয়াব প্রেরণের বিষয়টি শিষ্টাচার সংরক্ষন ও লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল বলার অবকাশই নেই। কারণ মুসলমানদের ‘রা-‘ইনা ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলা ‘হে আল্লাহর রাসূল আমাদের প্রতি লক্ষ্য বা মনোযোগ দিন’ অর্থেই ছিল। শব্দটি ‘আলমরা‘আ-তু’ থেকে অবকাশ-অবসর দেওয়া অর্থে তার মূল হচ্ছে ‘আররি’আ-য়াতু’ মানুষের কল্যাণ-মঙ্গলে মনোযোগ দেওয়া। পক্ষান্তরে সাহবায়ে কিরাম এ অর্থেই ‘রা-ইনা’ শব্দটি প্রয়োগ করতেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এ নিবেদন জানানো যে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে অবসর-অবকাশ দিন অর্থাৎ ধীরে বলুন, যাতে বুঝে নিতে পারি। অধিকন্তু ইয়াহূদীদের পরিভাষায় শব্দটি ব্যবহারের সুবাধে ইয়াহূদীরা ‘রা-ইনা’ হে আহমক অর্থে ব্যবহার শুরু করে দেয়। ‘রা-‘ইন’ এর শেষের ‘আলিফ’ আওয়াজ দীর্ঘ করা ও আহ্বান অর্থেই ব্যবহৃত। হযরত সা‘আদ বিন মু‘আয ইয়াহূদীদের পরিভাষা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। তিনি তাদের মুখে শব্দটি শুনে বললেন, ‘হে আল্লাহর শত্রু! তোমাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত। যদি এ অশোভন বাক্য দ্বিতীয়বার কারো মুখে শুনি, অবশ্যই থাকে হত্যা করবোই’। প্রত্যুত্তরে তারা বলল, ‘তুমি আমাদের ওপর রাগ করতেছো, অথচ মুসলমানরাও তো এ রূপ বলে’।
এতে দুঃখভারাক্রান্ত মনে তিনি রাসূলুল্লাহ (দ.)’র দরবারে উপস্থিত হলেই ‘রা-ইনা-’ বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ‘রা-ইনা-’ বলোনা বরং তার পরিবর্তে  ‘উনযুুরনা-’ (হে আল্লাহর রাসূল আমাদের প্রতি সদয় দৃষ্টি দিন) এবং শুরু থেকে গভীর মনোযোগে শুন। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’। (সূরা বাক্বারাহ ১০৪ নং আয়াত, সূত্র তাফসীরে জালালাইন ১৬ পৃষ্ঠা, তাফসীর-টীকা ও সাফ ওয়াতুত তাফা-সীর ৭২ পৃষ্ঠা)।
উক্ত আলোচনা মর্মে সুস্পষ্ট যে, আযমতে মুস্তফার ক্ষেত্রে নিয়্যাতের দোহাই অচল বরং দ্ব্যর্থবোধক শব্দে যদি দুশমনদের দ্বারাও শানে মুস্তফা হালকা করনের ন্যূনতম সম্ভাবনা থাকে, তবে ওই ধরণের শব্দের ব্যবহার পরিতাজ্য।
পরিশেষে মহান আল্লাহর আলীশান দরবারে বারগাহে রিসালতের আদব রক্ষা করে চলার তৌফিক প্রার্থনা করছি। কবি কতইনা সুন্দর বলেছেন,
‘আয্ খোদ জূয়ম তৌফিকে আদব;
বে-আদব মাহরূম মান্দ আয্ ফদ্বলে রব’।
‘খোদার দরবারে চাহি আদবের শক্তি,
বে-আদব রয় বঞ্চিত হয়না প্রভুকৃপা প্রাপ্তি।
ওয়া সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলা খাইরি খাল্কিহী মুহাম্মদিওঁ ওয়া আলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন।

Sharing is caring!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *