দুই গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র দ্বীনী সংস্কার

-আল্লামা এস এম জাফর ছাদেক আল আহাদী
উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী সত্তা যখন আপন পদমর্যাদায় বহাল থেকে নিম্ন পদেও কার্য সম্পাদন করেন, তখন তা তুলনামূলক মহান ও অসাধারণ পরিগণিত হয়। গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমার দ্বীনী সংস্কার ও অনুরূপ মহান ও অসাধারণ । তাইতাে হযরত গাউসুল আ’যম জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শুধু মুজাদ্দিদে দ্বীন নন, বরং দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী মুহীউদ্দীন খেতাবে বিভূষিত হওয়ার কথা সর্বজন বিদিত। আর হযরত গাউসুল আ’যম শাহ সাইয়্যদ আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুও একইরূপ দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী সাব্যস্ত হওয়ার কথা প্রতিভাত হয় উভয় গাউসুল আ’যম’র বাণী মর্মে।
বাইরুত- লেবনান মুদ্রিত বাহজাতুল আসরার ৫৫ পৃষ্ঠায় হযরত গাউসুল আযম জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় অন্তরাত্মা (ক্বলব) সংশ্লিষ্ট বর্ণনাংশে নামােল্লেখ না করলেও ‘পরস্পর সমকক্ষ বন্ধু বা সাথী’ বলে বিঘোষিত এবং বৈশিষ্ট্যাবলী উল্লেখে পরিচিহ্নিত সত্তাই হন, হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তিনি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও আপন মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের কথা বিবৃত করেন এভাবে-
(ক.) ‘আমার নাম পীরানে পীর ছাহেবের নামের সাথে সােনালী অক্ষরে লিখা আছে’ (বেলায়তে মােতলাকা, নবম সংস্করণ-৮২ পৃষ্ঠা)।
(খ) ‘রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র হস্ত মােবারকে দুইটি ‘তাজ’ ছিল; একটি ‘তাজ’ আমার মাথায় পরিয়ে দেন, অপরটি আমার ভাই পীরানে পীর শায়খ আবদুল কাদের জীলানী সাহেবের মাথায় পরানাে হয়।’
(গ) ‘আমি একদিন আমার ভাই পীরান পীর ছাহেবের সহিত কাবা শরীফে ঢুকিয়া দেখিতে পাইলাম- রছুল করিম (দ.)-এর ছদর মােবারক (ছিনা) এক অসীম দরিয়া। আমরা উভয়ে উহাতে ডুব দিলাম’ (জীবনী ও কেরামত ষষ্ঠ সংস্কার ২০০ পৃষ্ঠা)। অতএব উভয় গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা পরস্পর সমকক্ষতায়, সমক্ষমতায়, সমপদমর্যাদায় ও সমাবস্থানে আসীন বিধায় একইরূপ উচ্চাঙ্গের মুজাদ্দিদে দ্বীন, উপরন্তু দ্বীনকে পূনর্জীবিতকারীও সাব্যস্ত হন।
দ্বীনী সংস্কার ও দ্বীন পরিচিতি: দ্বীনী সংস্কার বিষয়ে অবগতির মৌলিক সূত্র হল- সাইয়্যদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান : নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শিরােভাগে এমন কাউকে পাঠাবেন, যিনি তাদের তরে তাদের দ্বীন সংস্কার করবেন (আবু দাউদ শরীফ : মিশকাত ৩৬ পৃষ্ঠা)।
এখানে ‘তাদের দ্বীন’ তথা এ উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামার দ্বীন বলতে যা বুঝায় তা যথার্থরূপে উপলব্ধি করতে না পারলে, দ্বীনী সংস্কার এবং যুগসংস্কারক সম্পর্কেও যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যাবে না। পবিত্র হাদীস শরীফের আলােকে অনাবিল এ দ্বীনের সংক্ষিপ্তসার পরিচিতি নিম্নরূপ।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার নিকট থাকাকালীন হঠাৎ অধিকতর কালােচুল বিশিষ্ট ধবধবে সাদা পােষাকধারী এমন এক ব্যক্তি উদয় হলাে, যার মাঝে মুসাফেরীর চিহ্নও দেখা যাচ্ছেনা এবং আমাদের কারাে পরিচিতও নয়। আগন্তুক এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র নিকটবর্তী হয়ে তাঁর দু’হাঁটু মােবারকের সন্নিকটে দোজানু পেতে উভয় হাত উভয় উরুর উপর রেখে বসলেন।
এমতাবস্থায় সে বলল ; হে অধিক প্রসংশিত সত্তা-মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে পরিজ্ঞান দান করুন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন ; ইসলাম হল- তােমার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ভিন্ন কোন উপাস্য নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা) আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, রমযানের রােযা রাখা এবং সামর্থ্য-সুযােগ হলে বাইতুল্লায় হজ্বব্রত আদায় করা। আগন্তুক বলল : আপনি সত্য বলেছেন। (বর্ণনাকারী হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন) আমাদেরকে তাজ্জব করল যে, সে নিজেইে তাঁকে জিজ্ঞেস করছে, সেই সাথে প্রত্যায়নও করছে! আগন্তুক বলল: অতঃপর ঈমান সম্পর্কে জ্ঞাত করুণ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান; তােমার বিশ্বাস আনায়ন করা আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও শেষ দিবসের উপর এবং ভালাে মন্দ তাক্বদীরের উপর বিশ্বাস করা। আগন্তুক বলল: আপনি ঠিক বলেছেন। অতঃপর বলল: ইহসান সম্পর্কে অবগত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান : (ইহসান হচ্ছে) আল্লাহ তা’আলার ইবাদত এভাবে করা যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছাে; যদি তাঁকে দেখতে না পাও তবে (ধ্যান করবে যে) নিশ্চয় তিনি তােমাকে দেখছেন। আগন্তুক বলল: কিয়ামত সম্পর্কে বিবৃত করুন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এ ব্যাপারে জিজ্ঞেসিতজন জিজ্ঞেসকারীর চেয়ে অধিক জ্ঞাত নয়। আগন্তুক বলল: তার নিদর্শনাবলী সম্পর্কে সংবাদ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করলেন: দাসী তার মালিককে প্রসব করা এবং খালি পা বিশিষ্ট বস্ত্রহীন অত্যন্ত অভাবগ্রস্ত ছাগলচারকদেরকে দালান নির্মাণে অহংকারযুক্ত প্রতিযােগিতা করতে তােমার দেখা। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন-অতঃপর আগন্তক ব্যক্তি চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা আমাকে বললেন, হে ওমর! প্রশ্নকারীটি সম্পর্কে জানকি? উত্তর দিলাম, আল্লাহ ও তার রাসূল অধিকতর জ্ঞাত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা) বললেন : উনি জীব্রাঈলই, তােমাদের মাঝে এসেছে তােমাদেরকে তােমাদের দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত- ১১ পৃষ্ঠা)।
এ হাদীসে জীব্রাঈলীর মধ্যে দ্বীনে উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এবং ওটার শিক্ষা বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। এতে করে এ দ্বীনের সংক্ষিপ্তসার হল-দরবারে মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার আদব রক্ষা ঈমান, ইসলাম, ইহসান এবং অদৃশ্যজ্ঞান এ পাঁচটি বিষয়ের সমন্বিত রূপ। আরেকটু খােলাসা করে বলতে গেলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাশীল না হলে ঈমান আনার প্রশ্নই আসেনা এবং ঈমান ব্যতীত ইসলামও মূলত: কোন কাজে আসেনা। আবার ইহসান ব্যতীত ইসলাম পালনও অন্তঃসারহীন এবং অদৃশ্যজ্ঞান অর্জিত না হলে পরিপূর্ণ ইহসানের দাবীও দলিলহীন মিথ্যাচার বৈকি!
অতএব উক্ত পাঁচটি বিষয়ের সমন্বিত রূপই পরিপূর্ণ দ্বীনে উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তদসংশ্লিষ্ট সংস্কারই দ্বীনী সংস্কার হিসেবে পরিগণিত হবে। এতেকরে যাবতীয় শাখা-প্রশাখাসহ ওই পাঁচটি বিষয়ের ক্ষেত্রে যে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা ধৃষ্টতাকে শােধরিয়ে, এমনকি প্রয়ােজনে ওসবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও যথার্থ কার্যকরি নতুন কৌশল উদ্ভাবন পূর্বক হলেও এ দ্বীনের মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম করে তােলার মধ্যেই এ দ্বীনী সংস্কারের সার্থকতা প্রতীয়মান হয়।
তদসত্ত্বে এ দ্বীনী সংস্কারের সাথে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের বিষয়টিও এখানে লক্ষণীয়। সাইয়্যদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার পবিত্র সত্তা কেন্দ্রিক এ জ্ঞান বিবর্তিত বুঝা যায়, উক্ত হাদীসে জীব্রাঈলীর অবতারণার ধরণ ও ভাষ্য মর্মে। কেননা হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম এ জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে গেলেন, নিজে শিক্ষার্থী হয়ে সাইয়্যদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শিক্ষাদাতার মহিমামণ্ডিত আসনে বাস্তবিকই সমাসীন অবস্থায় প্রদর্শন যােগে। অতএব ওই কেন্দ্রিকতায় বিবর্তিত জ্ঞানের উত্তরাধিকারীত্বই এ দ্বীনী সংস্কারের ক্ষেত্রে বিবেচিত। এতে করে অদৃশ্য জ্ঞানর তথা ইলমে বাতেনতাে বটেই ইলমে জাহেরের উত্তরাধিকারীত্বও বিবেচিত হওয়া অনিবার্য। কেননা হাদীস শরীফের বর্ণনালােকে জ্ঞানের দু’টি প্রকার রয়েছে। যেমন- হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ইলম বা জ্ঞান দু’প্রকার। এক প্রকারের জ্ঞান অন্তর সংশ্লিষ্ট যা বিশেষ উপকারী জ্ঞানই বটে। অপরটি মৌখিক, যা আদম সন্তানের উপর মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তা’আলার দলিল (দারেমী; মেশকাত-,৩৭ পৃষ্ঠা)। এ মর্মে আল কুরআন প্রাসঙ্গিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার একটি বাণীও প্রণিধানযােগ্য। ইরশাদ হচ্ছে- ওটার প্রত্যেকটি আয়াতের রয়েছে একটি বাহ্যিক অর্থ এবং একটি অভ্যন্তরীণ অর্থ।(শরহুসসুন্নাহ; মিশকাত-৩৫ পৃষ্ঠা)।
অতএব উক্তরূপ জাহের ও বাতেন উভয় প্রকারের যথার্থ জ্ঞান এ দ্বীনী সংস্কারের ক্ষেত্রে বিবেচিত হওয়ার অনিবার্যতা বলাই বাহুল্য। অন্যথায় কোন না কোন প্রকারের জ্ঞানের অভাবে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বুঝতে ব্যর্থ কারাে দ্বারা পূর্ণাঙ্গ দ্বীনী সংস্কারের ধারণা আদৌ সঙ্গত নয়।
উভয় গাউসুল আ’যম’র সংস্কার উপযােগিতা: দ্বীনী সংস্কার বিষয়ক পূর্বোক্ত হাদীস শরীফের আলােকে ওই সংস্কার সংশ্লিষ্ট দুটি উপযােগিতা তথা যথার্থ দ্বীনী জ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়া এবং শতাব্দির শিরােভাগে সংস্কারমূলক অবদান রাখার অবকাশযুক্ত হওয়াকে পরিচিহ্নিত করা যায়। এ মর্মে উভয় গাউসুল আ’যম’র এ দ্বীনী সংস্কার উপযােগিতা নিম্নরূপ।
হযরত গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উচ্চজ্ঞানার্জনের সাধনায় নিজ জন্মভূমি ছেড়ে জ্ঞানের তদানীন্তন প্রাণকেন্দ্র বাগদাদে গমন করতঃ উপযােগী সর্বোচ্চ মার্গের দ্বীনীজ্ঞান তথা জাহেরী ও বাতেনী যথার্থজ্ঞান সমৃদ্ধ হন। কার্যক্ষেত্রে তাঁর যুগান্তকারী ওয়ায-নসিহত, লিখনী ও অসংখ্য কারামাত প্রকাশের বদৌলতে আপন যুগস্থ উচ্চমার্গের অন্যান্য জাহেরী জ্ঞানীরা যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছু হঠতে বাধ্য হন, তেমনি বাতেনী জ্ঞান সমৃদ্ধ অন্যান্যরাও তার অধস্তনতা স্বীকার করতঃ সৌভাগ্যবান হন। তিনি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হিজরী পঞ্চম শতাব্দির ৪৭০/৪৭১ সনে জন্ম গ্রহণ করতঃ শতাব্দির ৫৬১ সনে বেসাল প্রাপ্ত হন এবং ষষ্ঠ শতাব্দির শিরােভাগে দ্বীনী সংস্কারে শ্রেষ্ঠ অবদান রাখার অবকাশ ধন্য হন।
অনুরূপ হযরত গাউসুল আ’যম শাহ সাইয়্যদ আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও উচ্চজ্ঞানার্জনের সাধনায় সুদূর কোলকাতা গমন করতঃ একইরূপ সর্বোচ্চমার্গের দ্বীনীজ্ঞান তথা জাহেরী ও বাতেনী যথার্থ জ্ঞান সমৃদ্ধ হন। সেখানে কোলকাতা আলীয়া থেকে জাহেরী জ্ঞানের সর্বোচ্চ সনদ অর্জন করত: পর্যায়ক্রমে শিক্ষকতা, ওয়ায-নসিহত এবং আদালতের বিচারক তথা কাজীপদে সমাসীন হয়ে উচ্চাঙ্গের বহুমুখী জ্ঞান প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ইতােমধ্যে আধ্যাত্মিক জগতের তদানীন্তন সরদারে আউলিয়া ত্বরীক্বত জগতের পূর্ণশশী গাউসে যমান হযরত শাহ সাইয়্যদ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ লাহুরী আল ক্বাদেরী কুদ্দিসা সিররুহু কর্তৃক মুরাদ নির্বাচিত হয়ে এবং তদীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কুত্ববে যমান শাহ সাইয়্যদ দিলাওয়ার আলী পাকবায কুদ্দিসা সিররুহু’র ফুয়ূযাত অর্জিত হয়ে সর্বোচ্চ বাতেনী জ্ঞান সমৃদ্ধও হলেন। অতঃপর যথা সময়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন পূর্বক অসংখ্য কারামাত প্রকাশসহ যুগান্তকারী আধ্যাত্মিক বাদশাহী ও যথার্থ পরিজ্ঞান প্রবাহে সাধারণ থেকে শুরু করে যুগের বিরল তত্ত্বজ্ঞানী-মুহাক্কিক্ব সকলকেই উদ্ভাসিত করে দেন। তাঁর প্রবর্তিত যুগান্তকারী মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বা-দর্শনের মােকাবিলায় উচ্চাঙ্গের জাহেরী কিংবা বাতেনী জ্ঞানের অধিকারী অন্যান্যদের কেউবা নতশিরে পিছু হঠতে বাধ্য হয়, কেউবা প্রশংসাকারী হয়ে এবং অধস্তনতা মেনে নিয়ে সৌভাগ্যবান হন। যুগসন্ধিক্ষণে তিনি রাদ্বিয়াল্লাহ আনহুও হিজরী শতাব্দির ১২৪৪ সনে ভূমণ্ডলে আত্মপ্রকাশ করতঃ চতুর্দশ শতাব্দীর ১৩২৩ সনে পর্দা করা যােগে চতুর্দশ শতাব্দির ও শিরােভাগে দ্বীনী সংস্কারে যুগান্তকারী শ্রেষ্ঠ অবদান রাখার অবকাশে ধন্য। এ ব্যাপারে সম্পৃক্ত নির্ভরযােগ্য জীবনী ও কেরামাত ইত্যাদি গ্রন্থাবলী নিরীক্ষণীয়।
দ্বীনী সংস্কারে উভয় গাউসুল আ’যমের বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব:  ইতিপূর্বে দ্বীনী সংস্কার ও তদসংশ্লিষ্ট উপযােগিতা বিষয়ক আলােচনা বিবৃত হয়েছে। তদভিত্তিতে এবার উভয় গাউসুল আ’যম’র দ্বীনী সংস্কার বিষয়ক পর্যালােচনায় আসা যাক। এ ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য বিষয় হল, উভয় গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার সত্তার বদৌলতে তথা উভয়েরই সান্নিধ্যে ও ত্বরীক্বাদর্শনালােকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন অসংখ্য কামিল-মুকাম্মিল ওলীয়ুল্লাহ সৃষ্টি হয়েছে (জীবনী গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য); যা তুলনামূলক উচ্চমানেরই দ্বীনী সংস্কার সাধিত হওয়ারই প্রমাণ বটে। কেননা উভয়ের সৃষ্ট ওই অসংখ্য কামিল-মুকাম্মিল ওলীয়ুল্লাহগণের প্রত্যেকই পরিপূর্ণ দ্বীনদার তথা দরবারে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার আদব রক্ষাসহ প্রকৃত ঈমান, ইসলাম, ইহসান ও অদৃশ্য জ্ঞানের ধারক-বাহক হওয়ার কথা সর্বজন স্বীকার্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য। আর এটিই দ্বীন সংস্কারে উভয় গাউসুল আ’যমের বিশেষ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ।
সাধারণতঃ হযরত গাউসুল আ’যম জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ‘দ্বীনী সংস্কার’ প্রশ্নে তাঁর লিখনী, সাড়া জাগানাে ওয়ায-নসিহত এবং কাদেরীয়্যাহ ত্বরীক্বাহ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বীনকে পুনর্জীবিত করার কথা অনেকেই তুলে ধরতে দেখা যায়। আর বস্তুবাদী গ্রীক দর্শন বিশেষত: সমসাময়িক ভ্রান্তমতবাদী শিয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের আধিপত্য বিনাশ, সর্বমােট ভ্রান্তমতবাদী ৭২ দল চিহ্নিতকরণ এবং ইসলামী দর্শন সংস্কৃতি ও সুন্নী মতাদর্শকে শক্তিশালী করে তােলাকেও তাঁর বিশেষ সংস্কার বলে পরিচিহ্নিত করতে দেখা যায়।
অনুরূপসূত্রে হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ‘দ্বীনী সংস্কার’ ও বিশেষ ভাবে পরিচিহ্নিত হওয়া লক্ষণীয়। তিনি রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আবির্ভূত হন বিশ্বমানবতার তথা সনাতন ইসলামের এমন এক বিপর্যয়কালে যখন সারা বিশ্বে দ্বীনী শাসন, শাসক গােষ্টির কুকীর্তির কারণে বিলুপ্ত হয়ে ধর্মবিহীন রাষ্ট্রনীতির পত্তন ঘটে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা হারা বিশ্বমুসলিম হয়ে পড়ে আত্মবিবেক নির্ভরশীল। ধর্মকে পুঁজি করে ফায়দা লুঠার দলেরা বাধিয়েছে নানা দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং সমাজে সর্বত্র চলছে ধর্মের নামে জঘন্য গােড়ামীরই দাপট। এমতাবস্থায় বিশ্বমানবতার মুক্তির নিমিত্তে মানুষের সৎবিবেক জাগ্রত করতঃ ধর্মীয় উদারতায় উজ্জীবিত করে তােলার মহান ত্বরীক্বা-দর্শন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন এ সফল কাণ্ডারী হযরত ক্বিবলাহ। তাঁর মহান ত্বরীকা-দর্শন ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রভাবে দ্বীনে উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা নব জীবনে উজ্জীবিত হল। তাইতাে উগ্রপন্থীদের দাপটপূর্ণ বিরােধীতা সত্ত্বেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থান তথা ধর্মসাম্যের দর্শন তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বাদর্শনের মাধ্যমে প্রকৃত ইসলামেরই আদলে পুনর্জীবিত হয়। মুসলিম না হয়েও যেমন শাহানশাহে মদীনা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার দরবারে ঠাঁই ছিল খাজা আবু তালিবের তেমনি শাহানশাহে মাইজভাণ্ডার হযরত গাউসুল আ’যম শাহ সাইয়্যদ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দরবার সংশ্লিষ্ট সর্বত্রই ঠাঁই পেতে দেখা যায় ইসলামের হিতকামী ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের। সকল ধর্মের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের একজাতীয় করণের মৌলিক ভিত্তি মদীনা সনদে যেমন স্থাপিত, তেমনি আদর্শই পুনর্জীবিত ও লালিত হয়, মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বার অন্যতম বিশেষ দর্শন তাওহীদে আইয়ান’র মাধ্যমে। ইসলামের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নবদীক্ষিত মুসলিমের জন্য জানমালের নিরাপত্তা কিংবা পুনর্বাসন ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ঈমান গ্রহণের কথা গোপন রাখার উপদেশ দ্বারা আচার ধর্ম পালনের বাধ্যবাধকতা মুক্ত থাকার সুযোগ যেমন ছিল, তেমনি আদর্শেরই সংস্কার হল মাইজভাণ্ডারী ত্বরীক্বায় পরিলক্ষিত ‘বেলায়তে মােত্বলাক্বা’ দর্শন। বাস্তবিকই একজন অমুসলিম যখন প্রকাশ্য মুসলমান হয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে শত মিনতি করেও টুকু আশ্রয় না পেয়ে পুনরায় স্বর্ধমে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, তখন এ মহান ত্বরীক্বা-দর্শনের অপরিহার্যতা ও সার্থকতা বিবেকবান মাত্রই উপলব্ধি করতে পারে। মূলত: এ যুগান্তকারী মহান ত্বরীক্বা-দর্শন যুগােপযােগী শ্রেষ্ঠ সংস্কারসহ দ্বীন ইসলামের যথার্থ মূলধারা হয় বলেইতাে এর দীপ্তালোকে অসংখ্য কামিল মুকাম্মিল ওলীয়ুল্লাহ অব্যাহত ধারায় সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *