পরিবর্তনের সুপ্রভাত

পরিবর্তনের সুপ্রভাত

✍️ ক্বারী মাওলানা মুহাম্মদ জহির উদ্দীন

‘আজকে যত পাপী-তাপী সব গুণাহের ফেলরে মাফি
দুনিয়া হতে বে-ইনসাফি জুলুম নিলরে বিদায়’।
বিশ্ব মানবতা অত্যাচার আর অজ্ঞতার ভয়ানক আঁধারে ছিল নিমজ্জিত। কুফর, শিরক, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্যের রাহুগ্রাস, জোর-জুলুম, অন্যায়-অবিচার, নষ্ঠ চিন্তা-চেতনা, গোত্রীয় প্রথা, চরিত্রহীন সামাজিক বন্ধন ও ভ্রষ্টতার অমানিশা ছিল দিগ-দিগন্ত প্রসারিত। আগ্রাসন, খোদাদ্রোহীতা ও উপনিবেশবাদের অপশক্তিতে জনজীবন বিধ্বস্ত। অসহায় মানবতা অত্যাচারের কবলে পর্যুদস্ত। ক্ষমতা আর সম্পদের লাগামহীন চাহিদায় শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ তারতম্য বিলুপ্ত এবং মানবতার সম্মান-সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত ও দাসত্বের জিঞ্জিরাবদ্ধ। জীবন-জীবিকার উপায়-উপকরণের ওপর করায়ত্ব প্রতিষ্ঠার পর জোর-জুলুম ও মানবাধিকার পদদলনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার যোগ্য কাউকে রাখল না। নারী তার নারীত্বের মর্যাদা বঞ্চিত বরং মৌলিক অধিকার তথা মানুষ রূপে বিবেচনাও হারাল। মানব সমাজ হত্যা আর লুন্ঠনের রাজ্যে পরিণত হল। একদিকে সারা বিশ্বের পুরো মানবতা আপন অধিকার পুনঃবহালের আপাদমস্তক ফরিয়াদী কিন্তু  পুরো দুনিয়ায় তাদের পক্ষে আওয়াজ তোলার কেউ-ই ছিলনা। অপরদিকে দুষ্ট শয়তানী শক্তি প্রতিমার পদে পূজার মহায়োজনে ব্যস্ত। সর্বত্র একই রব ছিল যে, ‘আমরা যে পন্থায় পূর্বপুরুষদের পেয়েছি তা-ই নির্ভুল, আমরা তদানুযায়ীই চলবো’। 
ওই ভয়ানক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র ধরাধামে শুভাগমন ছিল মানবতার ইতিহাসে মহা-বিপ্লবের  সূচনা; যাতে বাতিল অপশক্তির ভিতে কম্পন ধরেছে।
মূর্তিসমূহের মুখ থুবড়ে পড়া:
ক. উরওয়াহ বর্ণনা করেন যে, ওয়ারকাহ বিন নওফল, যায়িদ বিন আমর, ওবাইদুল্লাহ বিন জাহশ ও উসমান বিন হুওয়াইরসসহ কুরাইশদের একটি দল ওই রাতে এক মূর্তি-আলয়ে প্রবেশ করলে দেখতে পেল, মূর্তি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তারা আশ্চর্য হয়ে তাকে সোজা  করল কিন্তু অনতিবিলম্বে তা আবার লুটে পড়ল। তারা আবার যথাস্থানে বসালে তা তৃতীয়বার মুখ থুবড়ে পড়ল। এতে পূজারীরা বলল, এ সব অকারণ ঘটছেনা, এর পেছনে অবশ্য চিরস্থায়ী সদাকত ও অদৃশ্য শক্তি কার্যকর রয়েছে। অতি অবশ্যই কোন বিপ্লব আসন্ন। এতে মূর্তি হতে শব্দ বেরোল,
‘পূর্ব-পশ্চিম সর্বদিক যার নূরে করেছে উজালা
সে নবজাতকের আগমনে মোদের এ ধ্বংস লীলা’।
(ইবনে আসাকির প্রণীত তারীখে দামেশ্ক আল কবীরের উদ্ধৃতিতে আল্ খাসায়িসুল কুবরা ১ম খণ্ড ৯১-৯২ পৃষ্ঠা)।
খ. কা’ব আহবার (রা.) আপন চাক্ষুষ দর্শনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ওই রাত্রি-ভোরে দুনিয়ার তাবৎ মূর্তি মাথা নুয়ে পড়েছিল। (আস্সিরাতুল হালবিয়্যাহ ১ম খণ্ড ৭৬ পৃষ্ঠা)
অত্যাচারী শাসকদের সিংহাসন উল্টে পড়া: ওই পবিত্র রাতে শক্তিমান বাদশাহদের ওপর বয়ে যাওয়া প্রলয়ও পরিবর্তন ধারার একটি অংশ। সাসান বংশ ৩১৬৪ বছর ধরে পারস্য শাসন করেছিল। তাদের রাজত্ব ও শাসন ব্যবস্থা এতই সুদৃঢ় ও দমন-পীড়ন মূলক ছিল যে, তাদের পরাজয় কল্পনাও করা যেতনা। ওই বংশের রাজা-বাদশাহরা শক্তির নেশায় বুঁদ ও অতি দাম্ভিক এবং অহংকারী ছিল। কোন গোষ্ঠী, সমাজ ও সভ্যতাকে আমলে নিতনা। পরন্তু ওই বিপ্লবের শিকার হয়ে গেল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ওই রাতে দুনিয়াদার বাদশাহদের কারো সিংহাসন উল্টে পড়া ব্যতিত ছিলনা’। (ইবনে কসীর প্রণীত আল বিদায়াহ ওয়ান্নিহায়াহ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা)
পারস্য সম্রাটের প্রসাদে কম্পন: পারস্য সম্রাটের সুরম্য-সুপ্রশস্ত-দুর্গবৎ রাজমহল মজবুত কাঠামোর ওরপ সুদৃঢ় হওয়া সত্ত্বেও এক ভয়ানক শব্দ করে কাঁপতে লাগল। মহলের চৌদ্দটি পাথর খসে পড়ল এবং তাতে বড় বড় ফাটল দেখা দিল। কম্পনের প্রবলতায় মহলবাসীদের অন্তরও কেঁপে ওঠল। একই সাথে বিগত হাজার বছর ধরে জ্বলন্ত পারস্যের অগ্নিকুণ্ডও নিমিষে নিভে গেল। (সুয়ূতীর আল খাসায়িসুল কুবরা)
শয়তানদের জন্য আকাশ পথ রুদ্ধ: ইকরামাহ (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র ধরাধামে আগমনের রাত শয়তানদের জন্য আকাশ পথ রূদ্ধ হয়ে গেল। তাদের ওপর বিদগ্ধকারী তারকার জ্বলন্ত উল্কা বর্ষণ শুরু হল। তারা যখন উর্ধ্বারোহণের চেষ্টা করতো, তখনই জ্বলসিয়ে দেওয়া হতো। এ আশ্চর্য পরিবর্তনে তারা হতবুদ্ধি হলে ইবলিস বল্ল, এমন এক নবজাতক ধরাধামে এসেছে, যে আমাদের শয়তানী কাজ-কারবারের দফা রফা করে দেবে। শয়তানরা পরামর্শ দিল যে, এখনই গিয়ে আসন্ন বিপদ রুখে দিন, যাতে আমাদের পথে বাঁধা সৃষ্টিকারী কেউ না থাকে। অতএব ইবলিস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র দিকে অগ্রসর হলে আল্লাহ জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে পাঠালেন। সুতরাং জিব্রাঈল স্বীয় পায়ে ইবলিসকে এমন এক লাথি মারল যে, সে আদনে (এডেন নগরীতে) গিয়ে পড়ল। (হালবীর আস্সিরাতুল হালবীয়্যাহ, ১ম খণ্ড ১১০ পৃষ্ঠা।)
বায়তুল্লাহর সাক্ষ্যদান: মীলাদের রজনীতে সমস্ত জগত দয়ার প্লাবনে নিমজ্জিত ছিল। আর্শ হতে ফর্শ পর্যন্ত আনন্দ- গান গীত হচ্ছিল। পুরো জগত মত্ততায় বিভোর ছিল। বায়তুল্লাহর দেওয়ালও নেচে নেচে গুনগুনিয়ে গাইতে লাগল, 
‘এলেন ভবে মুস্তফা-মুখতার;
নিজ হাতে ধ্বংসিবে যিনি কুফ্ফার।
মূর্তি পূজা নাশি পাক করিবে আল্লাহর ঘর।
ইবাদতের ফরমান দেবেন, যিনি সর্বজ্ঞাতা অধিশ্বর’। 
(প্রাগুক্ত ১১৫ পৃষ্ঠা)
শবে বিলাদত-এ প্রকাশিত ঘটনাবলী ও সহস্রাব্দের প্রতিষ্ঠিত বাতিল ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া পরিবর্তন এ ঘোষণাই দিচ্ছিল যে, জোর-জুলুম, অত্যাচার-অবিচারের দিন ফুরিয়ে গিয়েছে। ক্ষমতার দাপটে মাতাল রাজা-বাদশাহ ও তাদের দুশ্চরিত্র চেলা-চামুণ্ডারা স্বীয় অন্যায়-অবিচারের রাজ্য সচল রাখতে পারবেনা। যে বিপ্লবের পূর্বাভাষ তারা শুনতে- দেখতে পাচ্ছে, তারা ঝড়ো হাওয়ায় তাদের রাজসিংহাসন খড়ের ন্যায় ওড়িয়ে নেবে। আল্লাহর সৃষ্টির ওপর জোর-জুলুমের শোচনীয় পরিণতি জগত অচিরেই প্রত্যক্ষ করবে।
মুস্তফ্বী ইনকিলাবের জ্বলজ্বলে সকাল দেখতে না দেখতেই পূর্ণাঙ্গ দিবসে পরিণত হল। আল্লাহর দ্বীন ও নেয়ামত পরিপূর্ণতার খোদায়ী ঘোষণা বিঘোষিত হল।
মীলাদে মুস্তফার ওই শুভ সকাল সন বছর ঘুরে আমাদের দ্বারপ্রান্তে এসে প্রেমানন্দে হৃদয় আকুল করে যায়। নির্মল আনন্দে বিভোর চিত্ত প্লবিত হয় ঐশী প্রেমের ফাল্গুধারায়।