শবে বরাত
🖋️ আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
حامدا و مصليا و مسلما اما بعد
শব (شب) শব্দটি ফার্সী, অর্থ হলঃ রাত ; রজনী। বরাত (برات) শব্দটিও ফার্সী, অর্থঃ অংশ ; বন্টন; ফরমান ; হুকুম নামা ; ওই প্রজ্ঞাপন, যদ্ধারা বেতন মাসোহারা মিলে। সুতরাং شب برات (শবে বরাত) এর অর্থ বন্টন রজনী। পরিভাষায় শা’বান মাসের চতুর্দশ ও পঞ্চদশ দিবসের মধ্যবর্তী রাত; মুসলিমদের বিশ্বাস মতে ওই রাতে জীবনের হিসাব নির্ধারণ এবং জীবিকা বন্টিত হয়। ফীরূযুল লুগাত দ্রষ্টব্য।
চান্দ্র বর্ষের অষ্টম মাস شعبان (শা’বান)। প্রথমে এ মাসের গুরুত্ব মাহাত্ম্যের ওপর কিঞ্চিত আলোচনা সঙ্গত মনে করি। ইরশাদ হচ্ছে,
عن اسامة بن زيد رضي الله عنهما قال قلت يا رسول الله صلى الله عليه وأله وسلم لم أرك تصوم من شهر من الشهور ما تصوم من شعبان؟ قال ذاك شهر يغفل الناس عنه بين رجب و رمضان و هو شهر ترفع فيه الأعمال الى رب العالمين فأحب أن يرفع عملي و أنا صائم-
অর্থাৎ যায়্দ তনয় উসামাহ (রাদ্বি.) বর্ণনা করেন,আমি আবেদন জানালাম যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামা! যে পরিমাণ রোযা আপনি শা’বানে রাখেন,অন্য কোন মাসে আপনাকে তত রোযা রাখতে আমি দেখিনি? প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ওটি রজব ও রমদ্বানের মধ্যখানে এমন মাস,যার সম্পর্কে মানুষ উদাসীন। অথচ ওই মাসেই আমলসমূহ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে উত্তোলিত হয়। আর আমি পছন্দ করি যে, আমার আমল আমি রোযাদার হওয়ার অবস্থায় উত্তোলিত হোক।
ইমাম নাসাঈ এর সুনান, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মাসনদসহ অসংখ্য মুহাদ্দিসীনে কিরামের গ্রন্থে উক্ত হাদীস সংকলিত হয়েছে। হাদীসটিতে শা’বান মাসের গুরুত্বের সাথে সাথে এ মাসের ব্যপারে মানুষের উদাসীনতার উল্লেখও রয়েছে।
পরবর্তীতে সাহাবাহ-ই কিরাম এ মাসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যত্নবান হওয়ার কথাও তাঁদের বর্ণনায় দেখা যায়।
عن أنس بن مالك رضى الله تعالىٰ عنه قال كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا نظروا الى هلال شعبان اكبٓوا على المصاحف يقراؤنها، أخرج المسلمون زكاة اموالهم ليتقوٓى بها الضعيف والمسكين على صيام شهر رمضان، وداعا الولاة اهل السجن، فمن كان عليه حدا أقاموه عليه وإلا خلٓوا سبيله، وانطلق التجار فقضوا ما عليهم وقبضوا ما لهم ، حتى إذا نظروا إلى هلال رمضان اغتسلوا و اعتكفوا-
হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র সাহাবীগণ শা’বানের নূতন চাঁদ যখন দেখতেন, তখন কুরআন তিলাওয়াত করতে পাণ্ডুলিপির ওপর ঝুঁকে পড়তেন। দুর্বল ও নিঃস্ব মানুষদের রমদ্বানের রোযার জন্য সমর্থ করার মানসে মুসলিমরা নিজেদের সম্পদের যাকাত আদায় করে দিতেন। হাকিমরা কয়েদিদের ডেকে দোষীদের সাজা এবং নির্দোষদের মুক্তি দিয়ে দিতেন। ব্যবসায়ীরা দেনা পরিশোধ এবং পাওনা আদায় করে নিতেন। যখন রমদ্বানের চাঁদ দেখতেন, গোসল করে ই’তিকাফে নিমগ্ন হতেন। [আলগুনিয়াহ , প্রথম খণ্ড,891 পৃষ্ঠা।]
এবার শবে বরাত প্রাসঙ্গিক আলোচনায় মনোনিবেশ করা যাক। শবে বরাত যারা কুরআন-হাদীসে খুঁজে পায়না, তাঁদের খিদমতে নিবেদন, জনাব! নামায রোযা খুঁজে পান কিনা একটু দেখুনতো! যদি নামায রোযা খুঁজে পান, তবে শবে বরাতও খুঁজে পাবেন।ফার্সী ভাষার অনুপ্রবেশে বাংলা ভাষায়ও “সালাত”কে নামায, ”সাওম” বা “সিয়াম”কে রোযা আখ্যায়িত করা হয়। এ দু’টি ইসলামের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম দুই স্তম্ভ। নামায ও রোযা শব্দদ্বয়ের উল্লেখ কুরআন-হাদীসে না থাকলেও মর্মার্থ বুঝেন বলেই কেউ এ দু’টি কুরআন হাদীসে নেই বলে মন্তব্য করেন না। অনুরূপ শবে বরাত শব্দের উল্লেখ কুরআন হাদীসে দেখতে না পেয়ে এর অস্তিত্ব নেই মন্তব্যের পূর্বে যদি মর্মার্থ বুঝতে যত্নবান হতেন,তবে অবশ্যই পেয়ে যেতেন।
কুরআনে কারীমের সূরাহ দুখানের তৃতীয় আয়াতে উল্লেখিত ليلةمٓباركة (লায়লাতুম্ মুবারাকাতুন) বা বরকতময় রাত – প্রাচূর্য মন্ডিত রজনী এবং হাদীসে পাকে উল্লেখিত ليلةالنصف من شعبان (লায়লাতুন্ নিসফি মিন শা’বান) বা অর্ধ শা’বানের রজনী, ফার্সী ভাষার অনুকরণে আমাদের দেশেও শবে বরাত নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে।
এ ছাড়াও এ রাতকে ليلة الرحمة (লায়লাতুর রাহমাতি) বা দয়ার রাত, الليلة المباركة (আল্লায়লাতুল মুবারাকাহ) বা বরকতময় রাত ও ليلة البراءة (লায়লাতুল বরায়াত) বা নিষ্কৃতি রাতও বলা হয়।[তাফসীরে রূহুল মাআনী দ্বাদশ খণ্ড 700 পৃষ্ঠা]
এ রাতের করণীয় জানতে বুঝতে জ্ঞানের নগরের দরজা খ্যাত মাওলা-ই কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শরণ নিলাম।
عن علي بن ابى طالب رضى الله تعالىٰ عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها – فان الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدٓنيا ، فيقول ألا من مستغفر لى فاغفر له،ألا من مسترزق فارزقه، ألا مبتلي فأعافيه ،ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر-
হযরত আলী ইবনে আবী ত্বালিব (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,যখন অর্ধ শা’বানের রজনী হবে, তোমরা ওই রাতে নামাযে দণ্ডায়মান হবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা আল্লাহ তাআলা সূর্য অস্তের সময় দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে (আপন শান অনুযায়ী) বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী কি আছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো।কোন রিয্ক প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে রিযিক দেবো।কেউ কি অসুস্থ, আমি তাকে শিফা দেবো। সকাল উদিত হওয়ার পর্যন্ত এমন কেউ কি আছে, ঐরূপ কেউ কি আছে, বলতে থাকেন। [ইবনু মাজাহ, বাবু মা জায়া ফী সাওমি লায়লাতিন্ নিসফি মিন শা’বান]
শায়খ আব্দুল ক্বাদির জীলানী হাসানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর গুনয়াতুত্ ত্বালিবীন গ্রন্থে সংকলিত উম্মুল মু’মিনীন আয়িশাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনায় ওই রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম নফল নামায আদায়, দু’আ-মুনাজাত, জান্নাতুল বক্বী’ যিয়ারত করতেন বলে উল্লেখ আছে।
উক্ত কিতাবে আরো রয়েছে, শবে বরাত বা অর্ধ শা’বানের রাত সালফে সালিহীন জমা‘আতে শত রাকা‘আত নামায, হাজার বার সূরাহ ইখলাস যোগে, প্রতি রাকা‘আতে দশ বার পাঠের মাধ্যমে আদায় করতেন; যা صلاةالخير (সালাতুল খায়রি) নামে অভিহিত।
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, شعبان شهرى “শা’বান আমার মাস”। আসুন নবী (ﷺ)’র মাসে নবী(ﷺ)’র প্রতি সালাতুস্ সালাম নিবেদনে সমধিক মনোযোগী হয়ে আল্লাহ তাআলার দয়া ও ক্ষমার উপযোগিতা অর্জন করি। ইরশাদ হচ্ছে,
عن أنس بن مالك رضى الله تعالىٰ عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وأله وسلم من صلٓى عليٓ واحدة ،صلى الله عليه عشر صلاة،وحطٓت عنه عشر خطيئات،و رفعت له عشر درجات- رواه النسائي و أحمد وقال الحاكم هذا حديث صحيح الاسناد-
আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করেন,যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দুরূদ পড়ে, আল্লাহ তার প্রতি দশটি রহমত করেন, তার দশটি ত্রুটি মার্জনা এবং তার মর্যাদা দশগুণ বৃদ্ধি করে দেন।
মায়াস্সালাম।