মাওলা-ই কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

মাইজভাণ্ডারী দর্শন

মাওলা-ই কায়িনাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

🖋আল্লামা বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
(পঞ্চম পর্ব)
[আয়াতে তাত্বহীর বিষয়ক বিভ্রান্তির জবাব]
চতুর্থ পর্বে কুরআনে কারীমের আয়াত মর্মে মদ হারাম হওয়ার পূর্বেও রিজস বা অপবিত্র হওয়া এবং আয়াতে তাত্বহীর আলোকে তা থেকে মাওলা আলী মুশকিল কোশা (রা.)’র পবিত্র হওয়ার প্রমাণ উপস্থাপন করেছি। ৫ম পর্বে অন্যান্য প্রমাণাদি উপস্থাপনের প্রতিশ্রুতি ছিল। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এম এ মতিন সাহেবের আহ্বানের প্রেক্ষিতে অপেক্ষা করার কথাও ভাবছিলাম। দুর্ভাগ্য! না প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা গেল, না ভাবনা! মাওলা-ই কায়িনাত (রা.)কে মদ্যপ প্রমাণের নেশায় মাতালরা ইতোমধ্যে আরেক বক্র যুক্তির অবতারণা করে বসলেন। সে আলোচনার পূর্বে এখানে একটু স্মৃতিচারণ করে নিই; আজ মনটা কেন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠল।
আমি যখন কামিল ফিকহর ছাত্র, তখন আমার দু’জন শিক্ষাগুরু দু’ধরণের কৌশল শিক্ষা দেন। একজন বলেন, ‘ফতওয়া দেওয়ার সময় দুর্বোধ্য-দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদির উদ্ধৃতি দিবে, যাতে আওয়াম ফতওয়ার কিতাব মুখী না হয়ে অভিজ্ঞ মুফতীদের শরণাপন্ন হবে; এতে সাধারণ মানুষের গোমরাহ হওয়ার সম্ভাবনাও কমবে, ওলামাদের ইজ্জত-ক্বদরও অক্ষুণ্ণ থাকবে, আর …..।’
অন্যজন বলেন, ‘সুলভ-সহজবোধ্য কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে ফতওয়া লিখবে, যাতে সাধারণের বুঝতে সহজ হয়; এতে ছোট-খাটো বিষয়গুলোর সমাধানে সমাজের মিয়াজীরাও সাহস পাবেন, সমাজে তাঁদের ইজ্জত-ক্বদর বজায় থাকবে।’ দু’জনের কথাই আপন যায়গায় ঠিক, আল্লাহ সকল সক্বামত হতে তাঁদের সালামত রাখুন।
আপনারা মনে করবেন না যে, আমি ফতওয়া দিতে যাচ্ছি, তবে আমি ফতওয়া সংকলন করবো এবং তা সহজলভ্য ও বোধ্য পুস্তক থেকেই।
সম্প্রতি কিছু রথী-মহারথী, বড়সড় জ্ঞানী-গুণী যারা মাওলা আলী মুশকিল কোশা (রা.) মদ পান করে নামাযের ইমামতিতে সূরা কাফিরূন ভুল পড়েছেন প্রমাণে কোমর বেঁধে নেমেছেন, তাঁরা সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর মানসে আয়াতে তাত্বহীরের অবতরণ কাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলে বেড়াচ্ছেন, ‘যারা আয়াতে তাত্বহীর আলোকে আলী (রা.)কে মদ থেকে পবিত্র বলছেন, তাঁরা আলোচিত আয়াত ও মদ হারাম হওয়ার আয়াতের অবতরণকাল নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছেন।’ অর্থাৎ তাঁরা বুঝাতে চাচ্ছেন, আয়াতে তাত্বহীর অবতরণের পূর্বে আল্লাহর ইরাদাহ বা ইচ্ছাও ছিলনা, মাওলা আলীও পবিত্র ছিলেন না। তাঁদের খেদমতে আমার জিজ্ঞাসা, আল্লাহর ইরাদাহ বা ইচ্ছা আল্লাহর সিফাত বা গুণ কিনা? আসুন এ বিষয়টা জানতে দশজন বিখ্যাত আলিম লিখিত ‘গাউসিয়া তারবিয়াতী নিসাব’ গ্রন্থে একটু দৃষ্টি দিই। এ গ্রন্থের সপ্তম সংস্করণের সপ্ত পৃষ্ঠায় ‘আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী’ অধ্যায়ে আল্লাহর সত্তাগত গুণ আটটি উল্লেখে তিন নম্বরে লিখা হয়েছে, ‘৩. ইরাদা বা ইচ্ছা’।
এবার আসুন, আল্লাহর গুণাবলীর বিষয়ে কি আক্বীদাহ বা বিশ্বাস রাখতে হবে, সেটি একটু দেখি।
عقيده جسطرح اسكی ذات قديم ازلی ابدی ہے صفات بهی قديم ازلی ابدی ہيں
আক্বীদাহ জিসত্বরহে ইসকী যা-ত ক্বদীম আযলী আবদী হ্যায়, সিফত ভী ক্বদীম আযলী আবদী হ্যাঁয়।
‘আক্বীদাহ যে রূপ তাঁর (আল্লাহর) সত্তা অনাদি-অনন্ত-চিরন্তন, সিফা-ত বা গুণাবলীও অনাদি-অনন্ত-চিরন্তন।’ সূত্র: বাহারে শরীয়ত, জনাব মাওলানা মাওলভী হাকীম আবুল উলা আমজাদ আলী ছাহেব আ’জমী রদ্বভী সুন্নী হানাফী ক্বাদেরী বরকাতী (কু.), ১ম খণ্ড, ৩ পৃষ্ঠা, ফারূকীয়্যাহ বুক ডিপো, দিল্লী।
আয়াতে তাত্বহীর অবতরণ থেকেই আল্লাহর ইরাদাহ বা ইচ্ছার সূচনা মানা এবং মাওলা আলী (রা.)’র পবিত্র হওয়ার কাল গনা আল্লাহর সিফত বা গুণকে অনাদি-অনন্ত-চিরন্তনের পরিবর্তে ক্ষণস্থায়ী-সৃষ্টি মানারই নামান্তর। নাঊযুবিল্লাহ! এ কেমন জঘন্য ভ্রষ্টতা! এ-তো বিতর্ক নয়, মারাত্মক বিতণ্ডা! অন্যকে জব্দ করতে গিয়ে ভ্রষ্টতার অন্ধকূপে আত্মনিমজ্জন!
এ ধরণের আক্বীদাহ বিষয়ে ইসলামের ফয়সালা জানতে আবারও বাহারে শরীয়ত গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেখুন।
عقيده صفات الہی كوجو مخلوق كہے يا حادث بتا‍ۓ گمراه بددين ہے
আক্বীদাহ সিফা-তে এলাহী কো জূ মাখলূক্ব কহে ইয়া হা-দিছ বাতা-য়ে গুমরা-হ বদদীন হ্যায়।
অর্থাৎ ‘আল্লাহর গুণাবলীকে যে সৃষ্টি বলবে অথবা নশ্বর বলবে সে পথভ্রষ্ট নগ্নধর্ম’ প্রাগুক্ত ৪ পৃষ্ঠা।
আসলে নেশায় পেলে বিবেক বিলুপ্ত হয়ে যায় আর বিবেক বিলুপ্ত হলে কি হয়? গাউসিয়া তরবিয়াতী নিসাবের ভাষায় দেখুন, ‘বিবেক বিলুপ্ত হয়ে গেলেই প্রতিটি মন্দ কাজের পথ সুগম হয়ে যায়’ (৪৯৩ পৃষ্ঠা)। দেখুন না, তাঁরা কত সহজে গুমরাহ বদদীন হওয়ার পথ পাড়ি দিলেন।
মুখে আল্লাহর ইরাদাহকে মাখলূক্ব- হাদিছ না বললেও আয়াতে তাত্বহীর অবতরণ থেকেই মাওলা-ই কায়িনাত (রা.)’র পবিত্র হওয়ার ক্ষণ গণনার মাধ্যমে তা-ই প্রকাশ করে বসলেন পরোক্ষভাবে। তাঁদের এ জঘন্য ধারণায় আরো বহু মন্দ কাজের পথ তাঁদের জন্য সুগম হবে বৈকি! উম্মুল মু’মিনীন খাদিজাতুল কুবরা (রা.)’র পবিত্রতা বিষয়েও তাঁরা একই পথে চলবেন; যেহেতু এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার আগেই তিনি ইন্তিকাল করেছেন। 
সুতরাং মাওলা-ই কায়িনাত (রা.)’র পবিত্রতা প্রসঙ্গে আয়াতে তাত্বহীর ও আয়াতে তাহরীমে খামর এর অবতরণ কালের আলোচনা আদৌ প্রাসঙ্গিক নয়, তা-ই সে আলোচনার অবতারণায় পাঠকদের বিরক্ত করা থেকে নিবৃত্ত রইলাম।
উল্লেখ্য যে, মদ থেকে মাওলা-ই মু’মিনীন (রা.)’র পবিত্র হওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত ঐক্যমত্যকে আকারে-ইঙ্গিতে স্বল্পজ্ঞানী- মূর্খদের ঐক্যমত্য প্রমাণে নন ইসলামিক হিস্ট্রির তথ্য ধার নিতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে! আফসোস! তাঁদের দৃষ্টি যদি لا تجتمع امّتي علي الضلاله – ‘লা-তাজতামি‘উ উম্মাতী আলাদ দ্বালা-লাহ’ বা ‘আমার উম্মত ভ্রষ্টতার ওপর ঐক্যমত্য হবেনা’র প্রতিও একটু আকৃষ্ট হতো! 
আল্লাহ তা‘আলা বুঝার তৌফীক্ব দিন। আজকের মতো এখানে বিদায়।
 মা‘আসসালাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *