বোরহান উদ্দীন মুহাম্মদ শফিউল বশর
দু’রাকা‘আত বিশিষ্ট নামাযে একবার এবং তিন ও চার রাকা‘আত বিশিষ্ট নামাযে দু’বার তাশাহহুদ পড়তে হয়।
তাশাহহুদের হুকুম সম্পর্কে চার মাযহাবের ইমামগণ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম’র অভিমত: ইমাম আ’যম আবূ হানীফাহ (রা.)’র মতে প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় বৈঠকে তাশাহহুদ পাঠ ওয়াজিব। ইমাম মালিক (রা.)’র মতে উভয় বৈঠকে তাশাহহুদ পাঠ সুন্নাত। ইমাম শাফি‘ঈ (রা.)’র মতে প্রথম বৈঠকে সুন্নাত, দ্বিতীয় বৈঠকে ওয়াজিব। ইমাম আহমদ (রা.)’র মতে প্রথম বৈঠকে ওয়াজিব, দ্বিতীয় বৈঠকে ফরয। উল্লেখ্য যে, দু’রাকা‘আত বিশিষ্ট নামায এক বৈঠকে সমাপ্ত হয় বিধায় তাতে দ্বিতীয় তথা শেষ বৈঠকের বিধান প্রযোজ্য।
তাশাহহুদে নবী করীম (দ.)কে সম্বোধন করে “আসসালামু ‘আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু” (আপনার ওপর সালাম, ওহে নবী) বলতে হয়। এ পদ্ধতি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (দ.) শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবা-ই কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহুম আজমা‘ঈন থেকে শুরু করে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে মু’মিন-মুসলিমরা নবী করীম (দ.)কে হাদ্বির-নাযির বা উপস্থিত-প্রত্যক্ষকারী জ্ঞানে অন্তরে (ধ্যান যোগে) উপস্থিত করে সম্বোধন সূচক সর্বনামযোগে সালাম নিবেদন করে আসছেন, যুগ-যুগান্তরে।
বিশ্ব বরেণ্য দার্শনিক হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রা.) লিখেছেন, ‘ওয়াহদ্বূর ফী ক্বালবিকান্নবীয়্যা সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামা ওয়া শাখসাহুল করীমা, ওয়া ক্বুল সালামুন ‘আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু ওয়া রাহমতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহূ’ অর্থাৎ ‘আপন অন্তরে নবী (দ.) ও তাঁর সত্তার ধ্যান নিয়ে বল, হে নবী আপনার ওপর সালাম, রহমত ও বরকত’ (ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১ম খ- ১৭৫ পৃষ্ঠা, দারুল মা’রফত, বৈয়রূত)।
যুগ-যুগান্তে বিশ্ব মুসলিমদের লালিত আক্বিদাহ-বিশ্বাসের বিপরীত ওহাবীদের বিদ্‘আত ফীল আক্বায়িদ’র নমুনা দেখুন। বিদ্‘আতও আবার এমন জঘন্য যে, তৌহীদের আড়ালে শানে রিসালতে মারাত্মক আক্রমণ।
‘আয্ ওয়াসওয়াসাহ-ই যিনা খিয়ালে মুজামি‘আতে জাওযাহ-ই খোদ বিহতর আস্ত; ওয়া সরফে হিম্মত বসূয়ে শায়খ ওয়া আমসালে আঁ আয্ মু‘আযযমীন গো জনাবে রিসালতে মায়াব বাশন্দ বচন্দীঁ মরতবাহ বদতর আয ইস্তিগরাক্ব দর খিয়ালে গাও ও খরে খোদ আস্ত’। অর্থাৎ ‘নামাযে যেনার ধ্যান অপেক্ষা আপন স্ত্রীর সাথে সহবাসের ধ্যান উত্তম; আর শায়খ ও তদ্রুপ সম্মানী এমনকি রসূলুল্লাহ (দ.)’র প্রতিও মনযোগ নিবন্ধন আপন গরু ও গাধার ধ্যানে ডুবে থাকার চেয়েও বহুগুণ মন্দতর’ (সিরাতে মুস্তাক্বীম ৮৬ পৃষ্ঠা, মকতবাহ সালাফিয়্যাহ লাহূর)।
উল্লেখ্য যে, সিরাতে মুস্তাক্বীম হল সৈয়্যদ আহমদ বেরলভীর মলফূযাত বা বচনাবলী। সংকলন ও গ্রন্থণা করেছেন, ইসমাঈল দেহলভী।
প্রিয় পাঠক! আপন আর পরের যে মানদণ্ড তথাকথিত আমীরুল মু’মিনীন শহীদ বেরলভী ও তার শিষ্য তথাকথিত শহীদ দেহলভী নির্ধারণ করেছেন, তাতে গরু গাধাও আপনার, পর কেবল নবী করীম (দ.)ই। যারা রসূলুল্লাহ (দ.)কে এতই পর ভাবে, তাদেরকে নবী করীম (দ.) ও তাঁর সাহাবীদের মতাদর্শ আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের অনুসারী তথা আপন প্রমাণে তার ভক্ত-শিষ্যদের বিপুল কাগজ-খালির শ্রাদ্ধ যতনা আশ্চর্যের; তার চেয়েও অবাক করা তামাশা হল, সুন্নীদের ভাই-খেলা।
কেউ কেউ যখন বলে, চট্টগ্রামের বাইরে বেরলভী ট্রেড লাইসেন্সধারী ছাড়া নাকি সুন্নীই পাওয়া যায়না, তখন আমার হাসি পায়। যাক সে কথা অন্যদিনের জন্য তোলাই থাক।
এবার সিরাতে মুস্তাক্বীমের উদ্ধৃত বচনে নবী করীম (দ.) কত কষ্ট পেতে পারেন, তা ভাবা যাক। এ বিষয়টি অনুধাবনে সহীহ মুসলিম শরীফের ‘কিতাবুস সালাতি’র ‘বাবু সুতরাতিল মুসাল্লী ……. ওয়া বয়ানিস সুতরাতি ওয়া মা ইয়াতা‘আল্লাকু বিযালিকা’র ১০৪৪, ১০৪৫ ও ১০৪৬ নম্বর হাদীস দেখুন। উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ সিদ্দীকাহ (রা.)’র সামনে হাদীস বর্ণনা করা হল, ‘নামাযীর সম্মুখে কুকুর, গাধা ও মহিলার গমনে নামায ভেঙ্গে যায়।’ এতে তিনি (রা.) বললেন, ‘নারী কি ইতর প্রাণী?’ বর্ণনান্তরে ‘তোমরা আমাদের কুকুর ও গাধার সদৃশ করে দিয়েছ।’ বর্ণনান্তরে ‘তোমরা আমাদেরকে কুত্তা ও গাধার সমান করে ফেলেছ’। অথচ হাদীসের বর্ণনায় নির্দিষ্ট করে হযরত ‘আয়িশাহ সিদ্দীকাহ (রা.)কে কুকুর ও গাধার সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি, তবুও তিনি (রা.) এতে কষ্ট পেয়েছেন, এটাকে মর্যাদাহানি মনে করেছেন। উদ্ধৃত উদ্ধৃতিতে-তো বেরলভী-দেহলভী নামাযে রসূলুল্লাহ (দ.)’র খেয়াল আপন গরু ও গাধার খেয়াল অপেক্ষা বহুগুণ মন্দতর বলেছে ও লিখেছে। এতে রসূলুল্লাহ (দ.) কত কষ্ট পেয়েছেন, এটা নবী করীম (দ.)’র কত জঘন্য মর্যাদাহানি!
নবী করীম (দ.)কে কষ্ট দেওয়া মানে আল্লাহকেই কষ্ট দেওয়া। প্রেমাস্পদকে কেউ কষ্ট দিবে কিংবা মানহানি করবে, আর প্রেমিক কোন ব্যবস্থা নেবেননা, তা কি হয়? দেখুন তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কি ব্যবস্থা রেখেছেন, ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের ওপর দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর অভিসম্পাত এবং তিনি (আল্লাহ) তাদের জন্য লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন’ (সূরা আহযাব ৫৭ নম্বর আয়াত ৩৩:৫৭)।
নামাযে নবী করীম (দ.)’র খেয়ালের বিষয়ে ঐহেন ফতওয়া যার, মজার ব্যাপার যে, ওই বেরলভীই পূর্ণপ্রচেষ্টায় অন্যকে নিজের খেয়ালে নিমগ্ন করেছে। ‘হিকায়তে আউলিয়া’ নামক পুস্তিকা সমগ্রের ১৫৫-১৫৮ পৃষ্ঠায় ওই বেরলভী সাহেব কর্তৃক আধা অথবা পৌনে এক ঘণ্টার পূর্ণপ্রচেষ্টায় এক মুরীদের যেদিকে দেখে বেরলভীই দৃশ্যত হওয়ার পর্যায়ে উপনয়নের গল্পও দেখতে পাবেন। যদিওবা তার শিষ্যরা তাসাওউর বা ধ্যানকে স্বয়ংক্রিয় ধ্যানে উদ্ভাসন আর ইচ্ছাকৃত ধ্যানে আনয়ন দু’ভাগে বিভক্ত করে এটাকে প্রথম প্রকারের অভিহিত করে বেরলভী সাহেবকে দ্বিতীয় প্রকারের ধ্যানে বাধাদানকারী মর্মীয় ব্যর্থ ব্যাখ্যার প্রয়াস চালিয়েছে। এ ব্যাখ্যা কথিত মুরীদের বেলায় খাটলেও পীর বেরলভীর ক্ষেত্রে-তো খাটেইনা; সে-তো ইচ্ছাকৃতভাবে আধা অথবা পৌণে একঘণ্টার প্রচেষ্টায় নিজ তাসাররুফ বা বেলায়তী ক্ষমতায় যেদিকে দেখে তাকে দেখার অবস্থায় উপনীত করেছে মুরীদকে। এটাকে মু’মিনদের অন্তর হতে নবী করীম (দ.)কে সরিয়ে নিজের অধিষ্ঠান ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
এবার আপনারাই বলুন, বেরলভী ও দেহলভীর ‘সিরাতে মুস্তাক্বীম’ কি মুন‘ইমীন বা অনুগ্রহ প্রাপ্তদের পথ, নাকি মাগদ্বূব আলায়হিম বা অভিশপ্তদের ও দ্বাল্লীন বা পথভ্রষ্টদের পথ?
প্রত্যেকের হৃদয় উৎসরিত উত্তরটিই প্রত্যাশিত, মোল্লা-মুন্সীদের বাগাড়ম্বরতা নয়।
নামাযে তাশাহহুদে রাসূলে আকরম (দ.)কে সালাম নিবেদনের শিক্ষা স্বয়ং তিনি (দ.)ই দিয়েছেন। কুরআনের সূরার মতো করেই শিখিয়েছেন তাশাহহুদ। এতে ‘আসসালামু আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বরকাতুহু’ অর্থাৎ ‘ওহে নবী আপনার ওপর সালাম এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত’ বলে সালাম নিবেদনের নির্দেশ বিদ্যমান। কুরআনে পাকেও সালাম নিবেদনের নিমিত্তে সালাম আরযের নির্দেশ বিঘোষিত। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তার ওপর দুরূদ পড়ো এবং উত্তম রূপে সালাম নিবেদন করো’ (সূরা আহযাব ৫৬ নং আয়াত)।
দেওবন্দি মাযহাব মতে তাশাহহুদে সালামের বাক্য উচ্চারণের সময় ইচ্ছাকৃত সালাম নিবেদনের নিয়্যাত করা যাবেনা, বরং মি’রাজ রাতে আল্লাহ তা‘আলা নবী করীম (দ.)কে যে সালাম দিয়েছেন, তার নকল ও হিকায়তের নিয়্যাত করবে।
যেমন কুরআনের আয়াত ‘ইয়া বনী ইস্রাঈল’ অর্থাৎ ‘হে ইস্রাইলের সন্তানরা!’ তিলাওয়াতকালে তাদের আহবানের নিয়্যাত করিনা, বরং আল্লাহ তাদের যে সম্বোধন করেছেন, তার বর্ণনা করি।
দেওবন্দিগণের উক্ত উক্তির ভিত্তি হল,“নবী করীম (দ.) না নিকট ও দূর থেকে সালাম শুনেন, না তাঁকে দূর থেকে ডাকা বৈধ; এ জন্যই নামাযে ‘আসসালামু আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু’ বলার সময় ইচ্ছাকৃত সালাম নিবেদনের নিয়্যাত করবেনা,বরং মি‘রাজে আল্লাহ প্রদত্ত সালামের নকল ও বর্ণনার নিয়্যাত করবে”।
রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব লিখেছেন, ‘যদি কারো আক্বীদাহ-বিশ্বাস এটা হয় যে, হুযূর আলায়হিসসালাম নিজে সালামের সম্বোধন শুনেন, তা কুফর; চায় আসসালামু আলায়কা বলুক বা সালামুন আলান্নবীয়্যি বলুক। আর যার আক্বিদাহ এটা হবে যে, সালাম ও সালাত তাঁর (দ.) নিকট পৌঁছানো হয়, একদল ফিরিশতা এ কাজের জন্য নিয়োজিত, যেমন হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে, তবে উভয়ভাবে পড়া মুবাহ বা বৈধ। অতঃপর শুন যে, যদি ইবনে মাসউদ ওফাত শরীফের পর দ্বিতীয় পুরুষবাচক শব্দকে নামপুরুষে পরিবর্তন করেনও কোন অসুবিধা নেই, হয়তো কোন উপযোগীতার কারণে করেছেন আর মূল শিক্ষা মতো পড়া হলেও কোন অসুবিধা নেই; যেহেতু উদ্দেশ্য (সালাম নিবেদন নয়) বর্ণনা’ (ফতওয়া-ই রশীদীয়্যাহ, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, ১০২-১০৩ পৃষ্ঠা, মকতবাহ-ই থানভী দেওবন্দ)।
যে গাঙ্গুহীর মতে নবী করীম (দ.) সালাম শুনতে পান আক্বিদাহ কুফর, সে গাঙ্গুহী সেবক ছাত্রের মনের অনুচ্চারিত কথাও বুঝে-শুনে মিঠাই নিয়ে দিয়ে আসার কারামত দেখতে পাবেন, তাযকিরাতুর রশীদ, ২য় খ-, ২৬৩ পৃষ্ঠা, দারুল কিতাব দেওবন্দে।
এখন দেওবন্দিদের কাছে জিজ্ঞাসা, এ কারামত সত্য কিনা? সেবক ছাত্রের মনের অনুচ্চারিত শব্দও গাঙ্গুহী শুনে ব্যবস্থার আক্বিদাহ কেন কুফর হবেনা?
গাঙ্গুহী সাহেব ও তার শিষ্য দেওবন্দীদের আবেদনমূলক সালামের পরিবর্তে বিবৃতিমূলক সালাম পাঠের নিয়্যত করার আক্বীদাহগত ভিত্তিই শতভাগ গলদ; যেহেতু রসূলে পাক (দ.) সালাতুস্ সালামের শব্দ শুনতে না পাওয়ার কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থি বিশ্বাসের ওপরই তা প্রতিষ্ঠিত। বাস্তবতা হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হাবীব (দ.) কে এমন শ্রবণ-ক্ষমতা দিয়েছেন, তিনি (দ.) পার্থিব ও বিসালোত্তর জীবনে দূর ও কাছের কথা এক বরাবর শুনেন। ইবনি কাইয়ুম জূযীয়াহ (ইন্তিকাল ৭৫১ হিজরী) ত্ববরানীর সনদে হযরত আবূ দারদা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, ‘লায়সা মিন আব্দিন ইয়ুসাল্লি আলাইয়া ইন বালাগানী সাওতুহু হায়সু কানা, ক্বুলনা ওয়া বা’দা ওফাতিকা ক্বালা ওয়া বা’দা ওফাতী ইন্নাল্লাহা আযযা ও জাল্লা হাররামা ‘আলাল আরদ্বি আন তা’কুলা আজসাদাল আম্বিয়া-ই’ অর্থাৎ ‘যে-ই আমার ওপর দুরূদ পড়ে সে যেখানেই হোক, তার আওয়াজ আমার কাছে পৌঁছেই অর্থাৎ আমি শুনতে পাই। সাহাবা-ই কিরাম আবেদন করলেন, আপনার বিসাল শরীফের পরও? তিনি (দ.) উত্তর দিলেন, আমার ওফাতের পরও। নিশ্চয় আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা নবীগণ আলাইহিমুস সালামের দেহ মোবারক ভক্ষণ মাটির ওপর হারাম করে দিয়েছেন।’ (জিলাউল আফহাম, ৬৩ পৃষ্ঠা, মকতবাহ-ই রদ্বভীয়্যাহ-নূরীয়্যাহ ফয়সালাবাদ)।
ইমাম রাযী (রা.) লিখেছেন: ‘যখন বান্দাহ ধারাবাহিক ইবাদত করে, তবে সে ওই স্তরে উপনীত হয় যে, যার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি ওই বান্দাহর কান ও চোখ হয়ে যাই। আল্লাহর মাহত্ম্যের নূর যখন বান্দাহর চোখ-কান হয়ে যায় তখন সে নিকট ও দূর এক বরাবর দেখেন-শুনেন। ওই নূর যখন তার হাত হয়ে যায়, তখন সে সহজ কঠিন ও দূর-নিকটে সমান ক্ষমতা ফলাতে সক্ষম হয়ে যান।’ [ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (ইন্তিকাল ৬০৬ হিজরী), তাফসীরে কবীর পঞ্চম খ-, ৪৬৭ পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর বৈয়রূত-১৩৯৮ হিজরী।]
ইমাম বুখারী (রা.)’র বর্ণনা: ইমাম রাযী যেই হাদীসের সূত্রে উক্ত মন্তব্য করেছেন, স্বয়ং ইমাম বুখারী (রা.) আপন সনদে ওই হাদীসখানা হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,‘যে ব্যাক্তি আমার অলীদের সাথে শত্রুতা করে, অবশ্য আমি তাকে যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। আমার বান্দা যা দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করে, তদ্মধ্যে আমি যা তার ওপর ফরয করেছি তদ্ধারা নৈকট্য অর্জনই আমার নিকট অধিক প্রিয়তর। এবং বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, এমনকি আমি তাকে ভালবাসি। আমি যখন তাকে ভালবাসি, তখন তার কান হয়ে যায় যা দ্বারা সে শুনে, তার চোখ হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যায়, যা দ্বারা সে ধরে এবং তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে হাঁটে।” (বুখারী শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড, কিতাবুর রিক্বাক্বি, বাবুত তাওয়াদ্বূ, ৯৬৩ পৃষ্ঠা)।
নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে থাকা বান্দা যখন আল্লাহর মাহবূবিয়্যাত বা প্রেমাস্পদত্বে বরিত হয়, তখন তার কান, চোখ, হাত ও পা সবই আল্লাহময় হয়ে যায় আর সে সব শুনতে, দেখতে, করতে এবং সর্বত্র চলতে সক্ষম হয়ে যান। একজন সাধারণ প্রিয় বান্দার শুনা, দেখা, করা ও চলার ক্ষমতার জগত যদি এমনিই হয়, তবে সৈয়্যদুল মুরসালীন মাহবূব-ই রব্বিল আলামীন; সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা যার বদান্যতায় সবাই প্রেমাস্পদত্বে বরিত হওয়ার সৌভাগ্যধন্য হয়, তার শুনা, দেখা, করা ও চলার ক্ষমতার অনুমান কে করতে পারে? তিনি (দ.) তার প্রতি সালাতুসসালাম নিবেদকের সালাম শুনতে না পাওয়ার কথা বিশ্বাস-তো দূরে থাক, কল্পনাও কি করা যায়? আলোচিত হাদীসে কুদসীর আলোকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমাদের রাসূল (দ.) শুধু সালাম নিবেদনকারীর সালাম শুনেন, তা নয়; বরং সম্মুখে বা অন্তরে উপস্থিত থেকে গ্রহণ ও উত্তরও দেন।
এবার আসুন, আমাদের প্রিয় নবী (দ.) যে আমাদের সালামের উত্তর দেন, সে বিষয়ক হাদীসে মনোনিবেশ করি। ইরশাদ হচ্ছে, ‘মা মিম্ মুসাল্লিমিন সাল্লামা আলায়্যা ফি শারকিন ও লা গারবিন ইল্লা-আনা ওয়া মালা-য়িকাতু রব্বী নারুদ্দু আলায়হিস্ সাল্লামা’ অর্থাৎ ‘যে কোন সালাম আরযকারী আমার ওপর সালাম দেয়, উদয়াচলে কিংবা অস্তাচলে পরন্তু আমি ও আমার প্রভুর ফিরিশতারা তার সালামের উত্তর দিই’ (আবূ নু‘আইম সংকলিত হিলইয়াতুল আওলীয়া ও ত্ববাক্বাতুল আসফীয়া ৬ষ্ঠ খণ্ড ৩২৯ পৃষ্ঠা, জিলাউল আফহাম ১৮ পৃষ্ঠা)।
উক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান যে, আমাদের প্রিয় নবী (দ.) আমাদের সালাম শুনেন এবং উত্তরও দেন। ফিরিশতা কর্তৃক আমাদের সালাতুসসালাম নবী করীম (দ.)’র দরবারে হাদিয়াহ রূপ পেশ হওয়ার বর্ণনা সম্বলিত হাদীস ও বিশ্বাস সম্পর্কে কোন আহলে ইসলামের দ্বিমত নেই বিধায় এ বিষয়ক বর্ণনা উপস্থাপনে নিবৃত্ত রইলাম।
প্রিয় পাঠক! আমরা আল্লাহ কর্তৃক সালাম আরযের উদ্দেশ্যে সালাম নিবেদনে আদিষ্ট, নবী করীম (দ.) কর্তৃক নিবেদনমূলক সালামের শব্দাবলী শিক্ষাপ্রাপ্ত, কুরআন-সুন্নাহর দলীল মতে আমাদের সালাম নবী (দ.)’র শুনতে পাওয়া ও উত্তর দেওয়া প্রমাণিত; সুতরাং তাশাহহুদে সালাম নিবেদনের নিয়্যতেই সালাম আরয করবো, গাঙ্গুহী সাহেবের কথা মতে মি’রাজে আল্লাহ প্রদত্ত সালামের আবৃত্তির নিয়্যত কখনো করবোনা। আরো উল্লেখ্য যে, হাদীসে বিবৃত তাশাহহুদস্থ “আসসালামু আলায়না ওয়া ‘আলা ‘ইবাদিল্লাহিস সালিহীন’ মর্মীয় সালাম আসমান-যমিনস্থ আল্লাহর সকল পুণ্যবান বান্দাদের নিকট পৌঁছবে”। (সহীহ মুসলিম প্রথম খ- ১৭৩ পৃষ্ঠা)। সর্বজন পরিজ্ঞাত যে, সালামতো তখনই পৌঁছবে, যখন উদ্দেশ্য হিকায়ত নয় বরং সালাম দেওয়াই হয়।
ফতওয়া-ই রশীদীয়্যাহ’র উদ্ধৃতি মর্মে আপনারা জ্ঞাত যে, গাঙ্গুহী সাহেবের ফতওয়া মতে ‘নবী (দ.) নিজে সালামের সম্বোধন শুনেন, আক্বিদাহ কুফর’ আর আমাদের উপস্থাপিত আল্লাহ ও রাসূলের বাণী মর্মে নবী-ই আকরম (দ.)’র শুনতে পাওয়া সাব্যস্ত; এখন আপনারাই বলুন, শুনতে পাওয়ার আক্বিদাহ কুফর, নাকি ঈমান-ইসলাম?
নমস্য পাঠক! নবী করীম (দ.) নিজে সালামের সম্বোধন শুনার আক্বিদাহকে কুফর বলে বর্ণনার উদ্দেশ্যেই মাত্র আবৃত্তির ফতওয়া কেন? একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে বুঝতে পারবেন, এটি উম্মতকে নবী হতে বিচ্ছিন্ন করার এক সুগভীর ষড়যন্ত্র বৈ কিছুই নয়। অন্যথায় তিনি তাশাহহুদস্থ ‘আসসালামু আলায়না ওয়া ‘আলা ‘ইবাদিল্লাহিস সালিহীন’র বেলায়ও হিকায়ত বা বর্ণনার উদ্দেশ্যে আবৃত্তির শর্ত যুক্ত করতেন। আসমান-যমিনের সকল পুণ্যবান বান্দাকে সালাম দেওয়ার নিয়্যতে আসসালামু আলায়না ….. বলতে পারবেন, অসুবিধা নেই, কিন্তু নবীর সালামের বেলায় ‘আসসালামু ‘আলায়কা আয়্যুহান্নবীয়্যু বলুন কিংবা ‘আসসালামু আলান্নবীয়্যি’ বলুন তবে আপনাকে হিকায়তের উদ্দেশ্যেই বলতে হবে! হায়রে ফতওয়াবাজি! নামাযে সবকিছুর খেয়াল তুলনামূলক ভাল, সর্বনিকৃষ্টতর কেবল নবীর খেয়াল!!! নামাযে সকলকে সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে সালাম দেওয়া যাবে, কেবল নবীর সালাম এলেই নিয়্যত করতে হবে হিকায়তের !!! গাঙ্গুহী সাহেবের খাদেম ছাত্রের মনের অব্যক্ত কথা শুনে মিঠাই দেওয়ার কারামত বিশ্বাস করা যাবে কিন্তু নবী করীম (দ.) নিজে সালামের সম্বোধন শুনেন বিশ্বাস করলে কুফর!!!
প্রিয় পাঠক! গাঙ্গুহী গংরা নবী করীম (দ.)’র শুনার আক্বিদাহ কে কুফর বলে আমাদের কাফির বানানোর যে প্রয়াস পেয়েছে, তা তাদের ওপরই আপতিত হবে। যেহেতু হাদীসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, ‘লা ইয়ারমী রাজুলুন রাজুলান বিল ফুসূক্বি ওয়া লা ইয়ারমীহি বিল কুফরি ইল্লা ইরতাদ্দাত আলায়হি ইন লাম ইয়াকুন সাহিবুহু কাযালিকা’ অর্থাৎ ‘কোন ব্যক্তি যেন অপর কোন ব্যক্তিকে দূরাচারী-কাফির মর্মীয় অভিযোগ না দেয়; কেননা সে ব্যক্তি ঐরূপ না হলে তা অভিযোগকারীর ওপরই প্রর্ত্যাবর্তিত হয়’ (বুখারী শরীফ ২য় খণ্ড ৮৯৩ পৃ.)।
আল্লাহ যেন সকলকে বুঝার তৌফিক দিন। আমীন।