ইরানের জিলান অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত সৈয়্যদ পরিবারে এক অলৌকিক শিশুর জন্ম হয়। শিশুটি ধরাধামে এসে দুধ পান করা অবস্থায় রােযা পালন করতে শুরু করেন। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে লােকেরা তার দুধ পান করা না-করার ওপর ভিত্তি করে রােযা ও ঈদের চাঁদ ওঠা না-ওঠার বিষয়ে নিশ্চিত হত। এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয় তার নাম অনুমান করতে সক্ষম হয়েছেন, তবুও বলছি, তার নাম আব্দুল কাদের, উপনাম আবু মুহাম্মদ, উপাধি মুহীউদ্দীন,গাউসুল আ’যম ও বাযে আশহাব ইত্যাদি। তিনি পিতৃবংশে চতুর্দশ এবং মাতৃবংশে সপ্তদশতম আওলাদে রাসূল (দ.)। তিনি ৪৭০ হিজরী সনে ধরাধামে আগমন এবং ৫৬১ হিজরী সনে মহাপ্রস্থান করেন। মাত্র একানব্বই বছর পার্থিব জীবনে তিনি নবী আদর্শের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিশ্ব মানবতার সমীপে তুলে ধরে অগণিত পথহারাকে দিয়েছেন পথের দিশা, আজও তাঁর ত্বরীকা দর্শনে দিকভ্রান্ত মানুষ পাচ্ছে সঠিক পথনির্দেশনা।
কোন অলির অলৌকিক শক্তি অনুসরণীয় অনুকরণীয় হতে পারেনা এবং তা সম্ভবের বিষয়ও নয় । অনন্তর এখানে কিশাের গাউসুল আযম (রাদ্বি.)’র শৈশবের একটি ঘটনার উল্লেখ করছি; যা আমাদেরকে ন্যায় পরায়ণ, সত্যবাদী ও মাতৃভক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়।
স্বয়ং গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ছােট্ট বেলায় একদা আমি আরাফাত দিবসে জিলান নগরের গাঁয়ের পথে বের হই এবং হালের বলদের পিছু নিই। ষাঁড়টি আমার দিকে ফিরে দেখল এবং স্পষ্ট ভাষায় বলল, ‘হে আব্দুল ক্বাদের! আপনি না এ কাজের জন্য সৃষ্ট, না এর জন্য আদিষ্ট’। এতে আমি ভীত হয়ে গৃহে ফিরে এলাম এবং ঘরের ছাদে ওঠে পড়লাম। এমতাবস্থায় দেখতে পেলাম যে, হাজীরা আরাফাত ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে। (আল্লাহ! আল্লাহ! গাউসুল আ’যম (রাদ্বি.)’র দৃষ্টি শক্তি এ রূপ হলে গাউসুল আযমিয়্যাত থেকে শুরু করে আল্লাহর প্রতিটি নিয়ামত বন্টনকারী নবী (দ.)’র দৃষ্টির বিশালতা কেমন হবে? আফসােস! ওইসব অন্ধ কপাল মন্দ দুর্ভাগাদের জন্য যারা নিজের সংকীর্ণ জ্ঞানের সংকীর্ণতার ওপর নবী করীম (দ.)’র দৃষ্টি শক্তির অনুমান করে দেয়ালের ওপারের আলােচনা পাড়ে!) অতএব আমি আমার আম্মাজানের নিকট এসে বললাম, আপনি আমাকে আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্বফ করে দিন এবং বাগদাদ যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান অর্জন করব। মুহতরমা আম্মাজান এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে আমি পূর্বের ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিলাম। তিনি ছলছল নয়নে তাঁর নিকট আমার পিতার রেখে যাওয়া মিরাস আশি দিনার নিয়ে এলেন। আমি তা থেকে চল্লিশ দিনার নিলাম এবং বাকী চল্লিশ দিনার আমার ভাইয়ের জন্য রেখে দিলাম। (শিশু গাউসে পাকের ইনসাফ দেখুন, পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাইয়ের অংশ ভাইয়ের জন্য রেখে দিলেন, তা থেকে একটি কানা কড়িও স্পর্শ করলেননা।) মহীয়সী আম্মাজান আমার চল্লিশ দিনার আমার তালিযুক্ত জামায় সেলাই করে দিয়ে বাগদাদ যাওয়ার অনুমতি দিলেন। বিদায়ের বেলায় তাগিদ দিয়ে বললেন, ‘পরিস্থিতি যেমনই হােক, সত্যই বলবে’। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বৎস! আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তােমাকে নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন করছি, অতঃপর কিয়ামত দিবসেই আমি তােমার মুখ দেখতে পাবাে’। (মাতৃজাতি! আমরা কেন ছেলে-সন্তানকে শিক্ষা করি আর উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রাদ্বি.) কেন শিক্ষা করিয়েছেন? সুগভীর মনােযােগে ভাবুন এবং নিজেদের চিন্তা চেতনার পুনর্গঠনে ব্ৰতী হােন।)
হযরত গাউসুল আযম জিলানী (রাদ্বি.) মা-জননী থেকে বিদায় গ্রহণ করে বাগদাদ অভিমুখী ছােট্ট এক কাফেলার সাথে রাওনা দিলেন। তিনি বলেন, আমরা হামদান পেরিয়ে এমন এক স্থানে পৌঁছি, যা ছিল পিচ্ছিল এবং কর্দমাক্ত। ওই স্থানে ষাটজনের বিরাট এক ডাকাত বাহিনী কাফেলার ওপর হামলা করে সবকিছু লুটে নেয় কিন্তু আমাকে কেউ কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ করলনা। অল্পক্ষণ পর এক ব্যক্তি আমার দিকে এল এবং জিজ্ঞাসা করল, তােমার নিকটও কি কিছু আছে? আমি বললাম, চল্লিশ দিনার আছে। সে জানতে চাইলে কোথায়? আমি বললাম, আমার জামার বগলের নীচে সেলাই করা। আমি মজা করছি ভেবে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল। (ফাটা-ছিড়া জামা পরিহিত ছােট্ট এক বালকের নিকট এত্তোগুলাে দিনার থাকার দাবী, ঠাট্টা হওয়ারইতাে কথা!) অতঃপর অন্য একজন এসে একই প্রশ্ন করল আর আমি একই উত্তর দেই। উভয়ে গিয়ে সর্দারকে বিষয়টি জানালে সে আমাকে তার নিকট ডেকে নিল। ডাকাত-সর্দার আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তােমার নিকট বাস্তবেই কি চল্লিশ দিনার আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমার জামায় সেলাই করা আছে। সে আমার জামা খুলে চল্লিশ দিনার বের করল। ঘটনার সত্যতায় সে যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত। (আশ্চর্যতাে তার হওয়ারই কথা। কারণ সবাই ডাকাত থেকে আপন সম্পদ রক্ষায় মিথ্যাই বলে আর এ বালক সম্পদ হারাবার নিশ্চয়তা উপেক্ষা করে সত্যই বলছে!) সুতরাং সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, এ গােপনীয়তা প্রকাশে তােমাকে বাধ্য করেছে কিসে? আমি বললাম, আমার সম্মানিত মা-জননী আমাকে সত্য বলার কঠোর তাগিদ দিয়েছেন। এ চল্লিশ দিনার কি ছার? আরাে চরম মূল্য দিতে হলেও আমি তাঁর নির্দেশ লংঘন করতে পারিনা। আমার কথােপকথন শুনে দস্যু-প্রধান কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আপনি আপনার মায়ের ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারছেন না! আর আমি পুরাে জীবন প্রভুর অঙ্গীকার বরাবর ভেঙ্গে চলছি। অতঃপর সে আমার হাতে তওবা করল। তার সাথীরা বল্ল, দস্যুবৃত্তিতে তুমি আমাদের নেতা ছিলে, সুতরাং তাওবার ক্ষেত্রেও নেতা। অতঃপর তারা সকলই তাওবা করে কাফেলার সমুদয় মালামাল ফেরৎ দিল।
সম্মানিত পাঠক! চল্লিশ দিনারের মােহ বিসর্জন দিয়ে চরম মুহূর্তে সত্যের একটি উচ্চারণ নিজের চল্লিশ দিনার শুধু নয় বরং পুরাে কাফেলার সমস্ত সম্পদ রক্ষা এবং ষাট সদস্যের ডাকাত বাহিনীর জীবনধারা পাল্টে দেওয়ার শক্তিশালী হাতিয়ার হওয়ার প্রমাণ উক্ত ঘটনার বিবরণে উদ্ভাসিত। আজ আমরা যারা বদলে যাওয়া ও দেওয়ার স্লোগান দিই, তারা সর্বক্ষেত্রে সত্য প্রতিষ্ঠার বেলায় কতটুকু মনােযােগী? আমাদের ওই শ্লোগানের যথার্থ বাস্তবায়নে সত্যের বিকল্প নেই। আসুন তাই সত্য বলা ও প্রতিষ্ঠার অভ্যাস ও আন্দোলন এবং মিথ্যা বর্জন ও প্রতিহত করার বিপ্লব গড়ে তুলি। অন্যথায় নিজেরাও ধ্বংস হবাে, সমাজও যাবে রসাতলে, আর গাউসুল আযম শাহানশাহে বাগদাদসহ পীর আউলিয়ার অনুসরণের দাবীও সর্বোত মিথ্যা প্রমাণিত হবে।