অতঃপর আহমদ ইবনে হাম্বল (রা.)’র ঘটনার বর্ণনা উপস্থাপন করলেন এবং তাঁর বীরত্বের প্রশংসা করলেন। সত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাণ বিসর্জনের তথা আত্মোৎসর্গের প্রয়োজনীয়তার প্রতি ইঙ্গিত দিলেন।
পিয়ারে মুসলমানো! আমার আলোচনা ওই দিকে নয়, আমি এ কথা বলতে চেয়েছিলাম, আল্লাহ আমাদের বানিয়েছে, তাঁকে চেনার জন্য-পাওয়ার জন্য। আল্লাহকে কীরূপে চেনা যাবে? হাদীসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, ‘মান আরাফা নফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রব্বাহু’ যে নিজেকে চিনেছে, সে তাঁর রবকে চিনেছে। আত্মপরিচয় লাভ হলে খোদার পরিচয় লাভ হবে। খোদাকে পাওয়ার আলোচনা পরে আসছে।
আল্লাহ আমাদেরকে ইসমে মুহাম্মদরে আকৃতিতে গঠন করে জন্নাত হতে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘লাক্বাদ খালাকনাল ইনসানা ফী-আহসানি তাক্বভীম, ছুম্মা রাদাদনাহু আসফালা সাফিলীন অর্থাৎ আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতিতে সৃজন করেছি। অতঃপর সর্বনিম্নস্তরে অবনমিত করে দিয়েছি’।(সূরা ত্বীন ৪-৫ নং আয়াত) এ জগতে প্রেরণের পূর্বে এখানে-ওখানে ও বেহেশতে রেখেছেন। এগুলো আল্লাহর হিকমত-কুদরত-বাহানা; আমরা বুঝবনা। রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, হযরত আদম ও মূসা আলায়হিমাস্সালাম বিতর্কে লিপ্ত হলেন। অতএব মূসা (আ.) আদম (্আ.) কে বললেন, আপনি ওই আদম, যাকে আপনার ভুল জান্নাত হতে বের করে দিয়েছে! আদম (আ.) তাঁকে বল্লেন, আপনি ওই মূসা, যাকে আল্লাহ আপন রিসালত ও কালাম দ্বারা মনোনীত করেছেন; অতঃপর আপনি আমাকে এমন বিষয়ে ভর্ৎসনা করছেন, যা আমার সৃষ্টির পূর্বে নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। এ ঘটনার বর্ণনাত্তোর রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেন, আদম (আ.) বিতর্কে মূসার ওপর দু’বার বিজয়ী হন। (বুখারী শরীফ, ১ম খ- ৪৮৪ পৃষ্ঠা)
মুর্দা দিল জিন্দা করার উপায়
পিয়ারে মুসলমানো! ‘আদ্দুনিয়াউ মায্রা‘আতুল আখিরাতি’ দুনিয়া আখিরাতের কৃষিক্ষেত-খামার। এ জমিনে এসেছি বা আমাদের পাঠিয়েছে চাষাবাদ-ব্যবসা-বাণিজ্য-তিজ
‘আর্শের পাক পাখি ছিলি ভবে আসি পেঁচা হলি
নিজ মান হারাইলি করি ধূলে গড়াগড়ি।
পাকা ছাড় ধূলা ঝাড় পরিষ্কার হও একবার
আর্শের কাঙ্গুরা পরে চল এবে মাটি ছাড়ি’।
আমাদের দেশের মানুষ টাকা-পয়সা রোজগারের মাধ্যমে নিজের অভাব মোচনের জন্য দুবাই, আবুধাবী, মস্কট, সৌদিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে যায় এবং আয়-রোজগার করে মানিঅর্ডার, ড্রাফট, হু-ি, ছালানি নানাভাবে স্বদেশে পাঠায়। ওই টাকায় গাড়ি-বাড়ি করে, জায়গা-জমি কিনে; অতঃপর স্বদেশে ফিরে আরাম-আয়েশে জীবন কাটায়। যারা টাকা পৌঁছাতে পারেনা, ইনকাম করতে পারেনা, তারা প্রবাসেও সুখ-শান্তিতে থাকতে পারেনা, স্বদেশে এসেও সুখ পায়না।
আমাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য-ক্ষেতকৃষি করার জন্য পাঠিয়েছে, যে দেশ হতে বিচ্ছেদ হয়ে এ দেশে এসেছি, সেখানে মানিঅর্ডার পাঠানোর জন্য, স্বদেশে সুখ-শান্তির আয়োজন করার জন্য, ফুল শয্যায় মারহাবা ধ্বনিতে বরিত হওয়ার জন্য।
পরকালে ক্ষেতকৃষি-ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য ওই কৃষিক্ষেত্র-ব্যবসা-বাণিজ্য
উক্ত কলিমা পড়েছেন কি? না, মোটেও না। আমরা সে তালে নেই। আমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ পড়লে হয়তো পড়েছে। আমরা ওই কলিমায় নেই, আমরা গোশত খাওয়া, টুপী দিয়ে কতক্ষণ মুসলমান হওয়ার মধ্যে আছি। বাপ-দাদার দেখাদেখি মুসলমান। এটাকে ঈমানে তাক্বলীদি বা প্রথাগত-গতানুগতিক বিশ্বাস বলা হয়। আমাদের বাপ যেদিকে গিয়েছে আমরাও যাচ্ছি। মুসলমানী আর ঈমান কি বুঝতে চেষ্টা করছিনা।
পিয়ারে মুসলমানো! যদি অনাবৃষ্টিতে দেশ বিরান ভূমিতে রূপান্তরিত হয়, গাছপালা-বৃক্ষলতা মরে শুকিয়ে যায়, গরু-ছাগল খাদ্য না পায়, ফসল বিনষ্ঠ হয়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, প্রখর রোদে যদি দেশ পুড়ে যায়, তখন আল্লাহর বান্দাগণ আল্লাহর দরবারে সকাতরে ফরিয়াদ জানায়, কান্নাকাটি করে, রোদন করে; এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা সদয় হন, রহম-করমের দৃষ্টি করেন এবং বৃষ্টি দিয়ে জমিনকে জীবন্ত ও উর্বর করে দেয়। ইরশাদ হচ্ছে, “ই’লামূ-আন্নাল্লাহ ইউহ্য়িল আরদ্বা বা’দা মওতিহা” অর্থাৎ জেনে রাখ, আল্লাহ জমিনকে সেটার মৃত্যুর পর জীবন্ত করেন। (সূরা হাদীদ ১৭ নং আয়াত)
পিয়ারে মুসলমানো! আমাদের সাড়ে তিন হাতের জমিন, যাতে আল্লাহ আহকামুল হাকিমীন পাক পরওয়ার দিগার, আঠার হাজার আলমের স্রষ্টা, নূরে যাতে আহদিয়াত মুস্তফা (দ.)’র তজল্লিয়াত হতে তৌহীদের বীজ বপন করে এ জগতে ক্ষেতকৃষি-ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পাঠিয়েছেন, আমাদের ওই জমিতো প্রখর রোদে শুকিয়ে গিয়েছে, ওই বীজতো নষ্ঠ হয়ে গিয়েছে, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফা আসবে কোত্থেকে।
‘যমীনে শোর সুম্বুল বরনাহ আওয়ারদ, দর ইঁ সুকম মগীরদাহ আমলরা’ অর্থাৎ লোনাভূমি সুগন্ধি ঘাস উৎপাদন করেনা, ওই লোকসানে নিজের কর্ম বিনষ্ঠ করোনা। আমাদের জমিতো লবণে বরবাদ হয়ে গিয়েছে, ওই জমি আবু জাহেলী, আবু লাহাবী, মরদুদী, মুরতাদী, কবিরাহ, সগীরাহ, র্শিক, যুলুমাত-এ গ্রাস করে নিয়েছে। জমি অনাবাদী, পরিত্যক্ত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। তৌহীদের বীজ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ তথা নূরে পাকে মুস্তফা (দ.)’র তজল্লীয়তের যে নূর আল্লাহ আমার-আপনার ক্বলবে আমানত রেখেছেন, আমরা সে আমানত-তো ধ্বংস করে দিয়েছি। ওই পরিত্যক্ত জমিতে আমল তথা নামায, রোযার সেচ দিয়ে কি লাভ-মুনাফা-তিজারত হবে? আমানতের এ মস্তবড় খিয়ানত করে কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহ পাকের দরবারে কি উত্তর দিব? চেহরা মুস্তফা (দ.) কে কিভাবে দেখাব?
আয় পিয়ারে মুসলমানো! আমাদের জমিন আজ বরবাদ হয়ে গিয়েছে, ফসল দিচ্ছেনা; অথচ আমাদের উহ, আহা আর কান্না নেই। সাধারণ জমির ফসল পোকা-মাকড় নষ্ট করলে, পেটের খানা না জুটলে, পেট আল্জুউ-আল্জুউ ক্ষুধা-ক্ষুধা রব করে আর তাতে আমরা হাজার হাজার মানুষ কাঁদতে শুরু করি। কিন্তু আল্লাহর যে আমানত আমদের ক্বলবে গচ্ছিত ছিল, সে আমানত বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে, রূহ রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা ক্ষুধা-ক্ষুধা শোর করছে; আমাদের কর্ণে কিন্তু সে শব্দ যাচ্ছেনা, আমরা বধির হয়ে গিয়েছি।
পিয়ারে মু’মিনো-মুসলমানো! আল্লাহর দরবারে আমাদের কাঁদতে হবে। আমাদের মুর্দা দিল জিন্দা করে দেওয়ার জন্য সক্রন্দন-সকাতর ফরিয়াদ-প্রার্থনা করতে হবে।
এখন কথা হল, মুর্দা দিলকে, মুর্দা জমিনকে কোন পানি দিয়ে সতেজ-সজীব করবো? বৃষ্টির পানি, ঝরণার পানি, সাগরের পানি, কূপের পানি দিলে হবে? আটলান্টিক মহাসাগরের পানি, সাত সমুদ্রের পানি দিলে কি হবে? ওয়াহদানিয়তের-তৌহীদের-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ পবিত্র কলিমার পানি দিতে হবে। ওটা কোন পানি তা কি বলতে পারেন? ওটা কনতু কনযান মখফিয়ান ফাআহব্বতু তথা আল্লাহর মুহব্বতের জলওয়া যে ইশক আর মুহব্বত; ইশকে মুহাম্মদ-ইশকে মুস্তফা-ইশকে হাবীবে খোদার সেচ দ্বারা মুর্দা দিলকে জিন্দা ও তদস্থ বীজ অঙ্কুরিত-প্রস্ফুটিত করতে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ দমে-দমে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর লাঙল, কোদাল দিয়ে ক্বলবে জমিন আবাদ করে প্রেম-ভালবাসার সেচ দিলে মুর্দা জমিন-মুর্দা দিল জিন্দা হয়ে যাবে। তখন তুমি আল্লাহর সত্তা, সকল সৃষ্টি, সপ্ত আসমান, সপ্ত জমিন নজরের সামনে দেখবে।
আমি সংক্ষিপ্ত ভাবে ব্যবসার কেন্দ্র, মূলধন, নিয়মাবলী বলে গেলাম, এ ভাবে তিজারত-ব্যবসা করলে লাভ-মুনাফা অর্জিত হবে।
আল্লাহ নূরে মুস্তফা (দ.)’র যে জ্যোতি দ্বারা ক্বলবে তৌহীদের আমানত রোপণ করেছেন, ওই নূরের জ্যোতিতে চোখের আলোও দিয়েছেন, যা দ্বারা আমরা দেখছি অনুরূপ দু’টি চোখ ক্বলবেরও আছে দেখেছেন কোন দিন? হারাম না, এগুলো দেখার মধ্যে আমরা নেই। হালাল-হারামের তারতম্যতে নেই, এমনি নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত যে যতটুকু পারছি, করছি। কিন্তু হৃদয়ের চক্ষু ফুটাইনি।
পিয়ারে মুসলমানো! আজ যদি আমাদের ওই আমানতের ক্বলব জিন্দা করতে পারি, অন্তরের সে চোখ ফুটাইতে পারি, তবে মুস্তফা (দ.) নয়, নবী-রাসূল নয়, ওলীয়ে কামিল পর্যন্ত যে মরেনা তা হৃদয়ের নযরে দেখতে পাবো। আল্লাহর কুরআন স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, ওয়া লা-তাকূলূ লিমায়ঁয়ুক্বতালু ফী সবীলিল্লাহি আমওয়াতুন; বল আহয়া-উওঁ ওয়ালাকিঁল লা তাশ‘উরূন’। অর্থাৎ ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদ করে) খুন-ক্বতল (শহীদ) হয়েছে, তাঁদের মৃত বলোনা। বরং তাঁরা জীবিত; অধিকন্তু তেমাদের খবর-অনুভূতি-উপলব্ধি-বোধ নেই’। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৪ নং আয়াত) আরো ইরশাদ হচ্ছে, ‘ওয়া লাতাহ্সাবান্নাল্লাযীনা কুতিলূ ফী সবীলিল্লাহি আমওয়াতান বাল আহয়া-উন ‘ইন্দা রাব্বিহিম য়ুরযাকূন; ফারিহীনা বিমা-আতাহুমুল্লাহু মিন ফদ্বলিহী, ওয়া য়াস্তাব্শিরূনা বিল্লাযীনা লাম য়ালহাক্বূ বিহিম মিন্ খালফিহিম, আল্লা খাওফুন আলায়হিম ওয়া লাহুম য়াহযানূন’। অর্থাৎ ‘যারা আল্লাহর পথে (ধর্মযুদ্ধে) নিহত (শহীদ) হয়েছেন, কখনো তাদের মৃত ধারণা করোনা; বরং তারা আপন প্রতিপালকের কাছে জীবিত, জীবিকা পান। আল্লাহ আপন অনুগ্রহে তাঁদের যা দান করেছেন, তাতে তাঁরা উৎফুল্ল-আনন্দিত; এবং আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করছেন, তাঁদের পরবর্তীদের জন্য যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। এ কারণে যে, তাঁদের না কোন আশঙ্কা আছে এবং না কোন দুঃখ-বিষণœতা। (সূরা আল্-ই-ইমরান ১৬৯-১৭০ নং আয়াত)
ধর্ম যুদ্ধে ইসলামের শত্রুর সাথে লড়ে যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা জিন্দা। অনুরূপ যারা আল্লাহর পথে গমনে মানুষের বড় শত্রু নফসে আম্মারাহ ও তার খাহেশাতের বিরুদ্ধে জিহাদ করে আল্লাহর মহানত্বের তরবারীতে আল্লাহর মাঝে ফানা বা বিলীন হয়েছেন, তাঁরাও শহীদ ফী সবিলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ-নিহত। তাঁরাও জীবিত-জিন্দা। কেননা হাদীসে রাসূল মর্মে সাব্যস্ত, ইরশাদ হচ্ছে, “রাজি’না মিনাল জিহাদিল আসগরি ইলাল জিহাদি আকবরি, ক্বালূ ইয়া রাসূলাল্লাহ মাল জিহাদুল আকবরি, ক্বালা জিহাদুল হাওয়ায়ি” আমরা ছোট্ট যুদ্ধ হতে বড় যুদ্ধের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি। সাহবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বড় যুদ্ধ কি? রাসূলুল্লাহ (দ.) বললেন, নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। এ যুদ্ধের মর্দে মুজাহিদ গাযীরাও মুর্দা নন, তাঁরা অমর, জিন্দা।