সুন্নী ঐক্যের অন্তরায় ও অপসারণের উপায়

সুন্নী ঐক্যের অন্তরায় ও অপসারণের উপায়

✍️মুহাম্মদ মামুন সিকদার


আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা স্তুতি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবার- পরিজন, প্রিয় ও প্রেমিকজনদের প্রতি সালাতুচ্ছালাম নিবেদান্তে বিষয়ালোক আলোচনায় মনোনিবেশ করছি।
প্রথমেই আপন অক্ষমতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বা সুন্নীয়্যাতের সংজ্ঞা অতি প্রাসঙ্গিক; না তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে, না তাতে জড়াবার দুঃসাহস! স্বল্প জ্ঞানে সহজভাবে পরিচিহ্নিত করার পথ ধরে এগুবার চেষ্টা করছি। চেষ্টা আমার, পরিপূর্ণতা দানের মালিক আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা। ‘হে আল্লাহ! তোমার হাবীব মুস্তফার মর্যাদার দোহাইতে তোমার প্রতি মনোনিবেশ করছি, তুমি বিষয়টি আমার জন্য সহজ করে দাও’।
পবিত্র কালামে পাকের সূরাতুল ফাতিহার ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতালোকে স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা‘আলার দয়া-অনুগ্রহধন্য বান্দাদের পথই সিরাত্বে মুস্তাক্বীম বা সহজ-সরল-সত্য-সঠিক পথ। সূরাতুন্ নিসার ৬৯ নম্বর আয়াতালোকে নবী, সিদ্দীক্ব, শহীদ ও সালিহ বা অলিয়ুল্লাহগণই নি’মতপ্রাপ্ত। সুতরাং তাঁদের পথ ও মতের ওপর যারা আছেন, তাঁরাই মুক্তি লাভকারী দল বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তথা সুন্নী; বিপরীত সবাই অভিশপ্ত-পথভ্রষ্ট।
“শরঈ আহকামের যা কর্মপদ্ধতি সংশ্লিষ্ট, তা শাখা ও কর্মগত আর যা বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট, তা মৌলিক ও বিশ্বাসভিত্তিক” শরহে আক্বায়িদে নাসাফী।
মৌলিক বিশ্বাসে গণ্ডগোল থাকলে আমলের প্রাচুর্য বিফল-সুন্নীয়্যাত থেকে বহির্ভূত, আর আমলে ত্রুটি থাকলেও মৌলিক বিশ্বাস ঠিক থাকলে সুন্নী, যদিও গুনাহগার; এখানেই অনেককে হোঁচট খেতে দেখা যায়। শাখাকে মূলের স্থান দিয়ে শাখা বিষয়ক মতানৈক্যে মিত্র বিসর্জন এবং আমলগত সাদৃশ্য হেতু শত্রুর সাথে আলিঙ্গন; সুন্নীয়্যাত অঙ্গনে আত্মঘাতি এক পদক্ষেপ। এতে মযলূম মিত্র অভিমানে দূরে সরতে বা নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে আর মিত্রবেশি শত্রুরা কূটকৌশলে নিজেদের কব্জা জমিয়ে নেয়। আকাবিরদের অনুসরণে শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে আরো সচেতন হলে এবং শাখা বিষয়ক মতানৈক্যে মাযহাব ভিত্তিক আমলের বৈচিত্র্য মাথায় রেখে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল হলে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করি।
কুরআন, সুন্নাহ ও ফতোয়ার অপপ্রয়োগ এবং জোশে হুশ খোয়ানো বক্তব্য ঐক্যের পথে বিরাট এক অন্তরায়। দুনিয়াবী হীনস্বার্থে ব্যক্তিতুষ্টি বা বাজার দখল কিংবা ভাইরাল হওয়ার মানসে ক্ষেত্রবিশেষ ফতোয়ার অপপ্রয়োগ হতে এবং অযৌক্তিক বক্তব্য বিবৃতি আসতে দেখা যায়। ওয়ায-নসীহত ও ফতোয়া যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনে হয়, তবে এসব বাধা-বিপত্তি অনায়াসে দূরীভূত হবে।
দীন-ধর্ম-ত্বরীক্বত-রাজনীতি-অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে আপন প্রভাব প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা, মানুষকে আল্লাহমুখী না করে নিজের প্রতি টেনে আনার কূটকৌশল এবং ইসলামপূর্ব গোত্রীয় দ্বন্ধের মতো নানাবিধ ইস্যু সৃষ্টি করে তা যুগ যুগ জিইয়ে রাখা ঐক্য শুধু নয়, সুন্নীয়্যাতের জন্যেও মরণব্যাধি ক্যান্সার। তাযকিয়্যার তিক্ত প্রতিষেধকের মাধ্যমে নফ্সে আম্মারার এ স্বভাব বিতাড়ন সন্দেহাতীতভাবে সম্ভব
রাফিদ্বীদের খণ্ডন করতে গিয়ে আলে রাসূলের প্রতি বিদ্বেষভাবের বহিঃপ্রকাশ এবং খারিজীদের মোকাবেলায় আসহাবে রাসূলের শানে অশোভন উক্তি উচ্চারণও ঐক্যের সাথে সাথে ঈমান বিধ্বংসীও বটে। এ ক্ষেত্রে স্কলারদের আরো সচেতনতা আরো অধ্যবসায় জরুরি মনে করি।
সর্বোপরি প্রবৃত্তিপূজা ও ব্যক্তিপূজায় সমস্ত সীমা অতিক্রম, নিজেকে বা নিজেদের পূজ্য-ভজ্য-মান্য ব্যক্তিকে সুন্নীয়্যাতের মাপকাঠি বানিয়ে ফেলা, ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে জ্ঞান করা, ব্যক্তির মতকে চূড়ান্ত ফায়সালা মনে করা, কুরআন, সুন্নাহর বিপরীত চরম অযৌক্তিক হলেও তা আঁকড়ে ধরে রাখার একগুঁয়েমি সুন্নী ঐক্যের সবচেয়ে বড় ও জঘন্য অন্তরায়। সূরাতুন্ নিসার ৬৫ নম্বর আয়াতালোকে নিঃসংশয়ে বিনাবাক্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর ফায়সালা মান্যকারী মু’মিন হওয়ার সাধনায় নিবিষ্ট হলে এ অন্তরায়ও অপসারিত হবে।
উস্তাদ সাগরিদের সংক্ষিপ্ত এক কথোপকথন দিয়ে শেষ করতে চাই।
শায়খ আবূল হাসান আশ্‘আরী তাঁর উস্তাদ আবূ আলী জুবায়ীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ওই তিন ভাই সম্পর্কে কি বলেন, যাদের একজন অনুগত, একজন অবাধ্য এবং একজন শিশু অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে? উস্তাদ বললেন, প্রথম জন জান্নাতে পুরস্কার পাবে, দ্বিতীয়জন জাহান্নামে সাজা পাবে আর তৃতীয়জন না পুরস্কার পাবে, না সাজা। আশ্‘আরীঃ তৃতীয়জন যদি বলে, “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে শৈশবে কেন মৃত্যু দিলে, কেন বড় হওয়া পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখলেনা যে, আমি তোমার উপর ঈমান আনতাম, তোমার আনুগত্য করতাম, ফলে জান্নাতে প্রবেশ করতাম” ফের আল্লাহ কি বলবেন?
জুবায়ীঃ আল্লাহ বলবেন, আমি জানি যে, তুমি বড় হলে গুনাহ করতে এবং জাহান্নামে যেতে; সুতরাং শৈশবের মৃত্যুই তোমার জন্য অধিকতর সঙ্গত। দ্বিতীয়জন যদি বলে,“হে আল্লাহ! আমাকে শৈশবে কেন মৃত্যু দিলেনা, তবে না আমি অবাধ্য হতাম, না নরকে যেতাম” তখন প্রভু কি বলবেন? এতে জুবায়ী নির্বাক নিরুত্তর হয়ে গেল। অতএব আশ্‘আরী তার মাযহাব ছেড়ে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা মু’তাযিলাদের মতের খণ্ডন আর সুন্নাতে বিবৃত বিষয় সাব্যস্ত করণে মশগুল হয়ে যান। শরহে আক্বায়িদে নাসাফী দ্রষ্টব্য।
পরিশেষে শত্রুতা-মিত্রতা সব আল্লাহর সন্তুষ্টি লক্ষ্যেই আবর্তিত বিবর্তিত হোক; এ প্রত্যাশায় ইতি টানছি।

মা‘আসসালাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *